আডলফ হিটলার জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Adolf Hitler Biography in Bengali. আপনারা যারা আডলফ হিটলার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী আডলফ হিটলার এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
আডলফ হিটলার কে ছিলেন? Who is Adolf Hitler?
আডলফ হিটলার (২০শে এপ্রিল, ১৮৮৯ – ৩০শে এপ্রিল, ১৯৪৫) অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত জার্মান রাজনীতিবিদ যিনি ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। হিটলার ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর এবং ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সে দেশের ফিউরার ছিলেন।
আডলফ হিটলার জীবনী – Adolf Hitler Biography in Bengali
নাম | আডলফ হিটলার |
জন্ম | 20 এপ্রিল 1889 |
পিতা | অ্যালোইস হিটলার |
মাতা | ক্লারা হিটলার |
জন্মস্থান | অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি |
জাতীয়তা | অস্ট্রীয় (১৮৮৯-১৯৩২) জার্মান (১৯৩২-১৯৪৫) |
পেশা | লেখক, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রপ্রধান, চিত্রশিল্পী |
মৃত্যু | 30 এপ্রিল 1945 (বয়স 56) |
আডলফ হিটলার এর জন্ম: Adolf Hitler’s Birthday
আডলফ হিটলার 20 এপ্রিল 1889 জন্মগ্রহণ করেন।
ধ্বংসের মূর্তপ্রতীক রূপে যদি রক্ত – মাংসের কোন মানুষের নাম নির্দেশ করতে হয়, তবে মানবসভ্যতার ইতিহাসের সেই ঘৃণালিপ্ত নামটি নিঃসন্দেহে অ্যাডলফ হিটলার। তাঁর কীর্তি যা ইতিহাসে পৃথিবীর সবচাইতে ঘৃণ্য ও নিষ্ঠুরতম কুকীর্তি রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে তা স্মরণ করতে গেলেও শরীর রোমাঞ্চিত হয়। অর্থ সম্পদ, পারিবারিক আভিজাত্য এবং শিক্ষাদীক্ষাহীন এই মানুষটিই একটি বিধ্বংসী বিশ্বযুদ্ধের স্রষ্টা, হতে চেয়েছিলেন সমগ্র জার্মানীর তথা পৃথিবীর ভাগ্যবিধাতা, পৃথিবীজোড়া মানব জাতিকে পদানত করার অভিসন্ধি নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ সংহার করেছিলেন নির্বিকারে। বস্তুতঃ হয়েও উঠেছিলেন বিশ্বের ত্রাস।
কিসের জোরে এই মানুষটি পৃথিবীজুড়ে জ্বালিয়েছিলেন ধ্বংসের দাবানল ? কে তাঁকে শক্তি জুগিয়েছিল পৃথিবীর অধীশ্বর হওয়ার অভিযানে সে হল তার অদম্য মনোবল, ব্যক্তিত্ব আর আকাশছোঁয়া উচ্চাশা। অথচ এই দুর্লভ সহজাত গুণ নিয়ে জন্মে কোন মানুষ ইতিহাসে স্মরণীয় কীর্তি স্থাপন করে সহজেই হয়ে উঠতে পারতেন মানবজাতির প্রাতঃস্মরণীয় গৌরবের অধিকারী ব্যক্তিত্ব।
আডলফ হিটলার এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Adolf Hitler’s Parents And Birth Place
অস্ট্রিয়া ও ব্যাভেবিয়ার মাঝামাঝি ব্রনাউ নামের এক অখ্যাত শহরতলীতে ১৮৮৯ খ্রিঃ ২০ শে এপ্রিল জন্মেছিলেন হিটলার। তার পিতা ছিলেন একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের কনিষ্ঠতম কর্মী। তিন পত্নী আর তাদের সন্তানদের নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারের মধ্যেই বলতে গেলে তার দিন কাটত। হিটলার ছিলেন তাঁর পিতার তৃতীয় পত্নীর তৃতীয় সন্তান। ছেলেবেলাতেই হিটলারের পরিণত জীবনের স্বরূপ ফুটে উঠেছিল।
আডলফ হিটলার এর ছোটবেলা: Adolf Hitler’s Childhood
তিনি ছিলেন অসম্ভব একগুঁয়ে, জেদী আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির। এর সঙ্গে অস্বাভাবিক ভাবেই যেন সহাবস্থান করত একটি কল্পনাপ্রবণ শৈল্পীক মন। শুনলে অবিশ্বাস্য বলেই মনে হবে যে তিনি শৈশব থেকেই ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। ছয় বছর বয়সেই হিটলারকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় অবৈতনিক স্কুলে।
আডলফ হিটলার এর শিক্ষাজীবন: Adolf Hitler’s Educational Life
পড়াশুনায় মেধা থাকলেও ছবি আঁকার ব্যাপারেই ছিল তার ঝোক। কোনরকমে স্কুলের পাঠ সাঙ্গ করেই ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে বসতেন। তার বাবার ইচ্ছে ছিল স্কুলের পড়া শেষ করে হিটলার কোন কাজকর্মে ঢুকে পড়বেন –সংসারের ভার কিছুটা লাঘব হবে তার। বাবার ইচ্ছার কথা জানা সত্ত্বেও কিন্তু হিটলার এগারো বছর বয়সেই স্কুলের পাট চুকিয়ে দিলেন ৷ ঠিক করলেন পাকাপাকিভাবে ছবি আঁকায় মনোযোগ দেবেন। হবেন নামকরা চিত্রশিল্পী।
এই উদ্দেশ্যে স্থানীয় আর্টস্কুলে ভর্তির পরীক্ষা দিলেন। কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। ফলে আর্টস্কুলে শিক্ষা লাভের ইচ্ছার ওখানেই ইতি টানতে হল। সংসারের অনটনের আঁচ এড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। তাই বাধ্য হয়েই চাকরির সন্ধান করতে লাগলেন। চাকরির সন্ধানে যখন হন্যে হয়ে ঘুরছেন, সেই সময় মা মারা গেলেন। একমাত্র মায়ের বন্ধনই সংসারের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছিল তাঁকে। এবারে সেই বন্ধন ছিন্ন হতে স্বাধীন জীবনের দ্বার খুলে গেল তার সামনে। ভাগ্যান্বেষণে চলে এলেন ভিয়েনায়।
আডলফ হিটলার এর প্রথম জীবন: Adolf Hitler’s Early Life
অজানা অচেনা জায়গায় শুরু হলো তার কঠোর জীবন – সংগ্রাম। হিটলারের ভিয়েনার জীবন শুরু হলো জন মজুরের কাজ দিয়ে। কিছুদিন পরে আরম্ভ করলেন মাল বওয়ার কাজ। এরপর ধরলেন রং বিক্রির ব্যবসা। এতসব করেও যখন দুবেলা অন্নসংস্থান হচ্ছে না সেই সময় রোজগারের সহজ একটা পথ বের করলেন মাথা খাটিয়ে। হিটলারের আসল চরিত্র এবার থেকেই আত্মপ্রকাশ করবার সুযোগ পেল। হিটলার অশ্লীল ছবি এঁকে গোপনে বিক্রি আরম্ভ করলেন।
এই সময় হিটলারের মন আর একটি বিষয়ের সন্ধান লাভ করল। নানা কারণে ইহুদীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ জেগে উঠতে লাগল তার মনে। সেই সময়ে জার্মানীর ব্যবসাক্ষেত্রে ইহুদীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অধিকাংশ কলকারখানা, সংবাদপত্র ইত্যাদির মালিকানা ছিল ইহুদীদেরই। তারাই বলতে গেলে দেশের অর্থনীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করত। খাটাখাটুনির কাজে নেমে এই ব্যাপারটা যখন ধরা পড়ল, হিটলার ভালভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না।
জার্মানদের দেশে বসে তাদের ওপরই ইহুদীরা প্রভুত্ব করবে একজন খাঁটি জার্মান হয়ে কি করে তিনি মেনে নেবেন। দুঃখকষ্টের বোঝা যদি কিছুটা লাঘব হয় এই আশা নিয়ে হিটলার ভিয়েনা ছেড়ে মিউনিখে এলেন ১৯১২ খ্রিঃ। কঠোর সংগ্রামের মধ্যে এখানে কাটলো দুটো বছর। এলো ১৯১৪ খ্রিঃ।
আডলফ হিটলার এর কর্ম জীবন: Adolf Hitler’s Work Life
ইউরোপে বাঁধল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এতদিনে যেন বাঁচার মত একটা পছন্দমত পথ পেয়ে গেলেন হিটলার। সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যথেষ্ট সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কোন পদোন্নতি হয় নি। যুদ্ধ শেষ হল দেশজোড়া তীব্র হাহাকার অভাব আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে। এই সুযোগে জন্ম নিল নানা রাজনৈতিক দল আর বিপ্লবী সংগঠন। বিরুদ্ধ শক্তির এই ঘাঁটিগুলির ওপর গোয়েন্দাগিরি করার কাজে কর্তৃপক্ষ হিটালারকে নিয়োগ করলেন।
দেশে সেই সময় লেবার পার্টি ছিল সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী। তীক্ষ্ণবুদ্ধি হিটলার প্রথমে সাধারণ সদস্য হিসেবে এই দলে নাম লেখালেন। আশ্চর্য কর্মকুশলতা গুণে বছর না ঘুরতেই তিনি হয়ে উঠলেন পার্টির প্রধান। তার উদ্যোগে দলের নতুন নাম হল ন্যাশানাল ওয়ার্কাস পার্টি। পরবর্তীকালে হিটলারের এই দলেরই নাম হয়েছিল নাৎসী পার্টি। পার্টির প্রধান হিসাবে হিটলার প্রথমেই জনসাধারণের কাছে পঁচিশ দফার এক কর্মসূচী পেশ করলেন।
এতে তিনি প্রধানত যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন তা হল, জার্মান জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ না করলেও তার উদ্দেশ্য যে সমস্ত অধিকার জার্মানদের হাতে কেন্দ্রীভূত করা, তা অপ্রকাশ্য থাকল না। ১৯২০ খ্রিঃ ২৪ শে ফ্রেব্রুয়ারী নাৎসী দলের এক কেন্দ্রীয় সভায় হিটলার তার পঁচিশ দফা দাবি উত্থাপন করলেন। এরপরেই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন হিটলার। স্বস্তিকা চিহ্নযুক্ত দলের পতাকা প্রকাশ করলেন। জার্মান জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে নাৎসী দল খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সমর্থ হল।
তিন বছরের মধ্যেই সদস্য সংখ্যা প্রায় ষাট হাজারে পৌছল। স্বাভাবিক ভাবেই জার্মান রাজনীতিতে নাৎসী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করে বসল। মিউনিখে প্রতিদ্বন্দ্বী কোন রাজনৈতিক দল যাতে না থাকে সেই উদ্দেশ্যে হিটলার ইতিমধ্যেই গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তার এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হল। তিনি গ্রেপ্তার হলেন। বিচারের পর তাঁকে এক বছরের জন্য ল্যান্ডসবার্গে এক পুরনো দুর্গে বন্দি করে রাখা হল। কারবাস থেকে মুক্তিলাভের পর পূর্ণ শক্তিতে রাজনৈতিক কাজে ঝাপিয়ে পড়লেন হিটলার।
তাঁর দলের মতবাদ আগের চাইতে আরও বলিষ্ঠ ও দৃপ্ত ভঙ্গীতে প্রচার করতে শুরু করলেন। দেখতে দেখতে তিনি জার্মানদের মনে স্থান করে নিলেন। জনপ্রিয় নেতা হিসেবে খ্যাতিলাভ করলেন। জার্মান যুবকরা দলে দলে নাৎসী দলে নাম লেখাতে লাগল। ১৯৩৩ খ্রিঃ জার্মানীতে যে সাধারণ নির্বাচন হল অনুষ্ঠিত তাতে বিপুল সংখ্যার ভোটে হিটলারের ওয়ার্কাস দল বিজয়ী হল। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারল না। পার্লামেন্টে মোট আসন সংখ্যা ছিল ৬৪৭ টি। তার মধ্যে তার দল পেল ২৮৮ টি।
এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে হিটলার যে শিক্ষা লাভ করলেন তা হল ক্ষমতা দখল করতে হলে কেবল নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে। সেবার কোন দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় হিটলার পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিলেন। তারপর স্বমূর্তি ধারণ করলেন তিনি। শুরু করলেন ঘৃণ্য রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। কিছুদিনের মধ্যেই বিরোধী দলগুলির প্রথম সারির অনেক নেতা খুন হলেন। মিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করিয়ে অনেককে জেলবন্দি করা হল।
ওখানেই থেমে থাকলেন না তিনি। বিরোধী দলের মধ্যে কৌশলে নিজের দলের লোক ঢুকিয়ে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে দিলেন। হিটলারের এই চক্রান্তে অল্পসময়ের মধ্যেই বিরোধী পক্ষ একরকম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল ৷ অনিবার্যভাবে তিনি হয়ে উঠলেন নাৎসী দলের সর্বেসর্বা এবং সেই সঙ্গে সমগ্র জার্মানীর ভাগ্যনিয়স্তা। হিটলারের এই আকস্মিক উত্থান সম্ভব করে তুলেছিল তার ২৫ দফা কর্মসূচীর প্রধান বিষয়, তা হল ইহুদী বিরোধিতা।
সুকৌশলে জার্মানদের মধ্যে ইহুদী বিদ্বেষের বীজ রোপন করে রাতারাতি এভাবেই তিনি তার ফল চয়ন করলেন। তার নাৎসী বাহিনীকেও তিনি দেশ থেকে ইহুদীদের বিতাড়নের উপযুক্ত করে গড়ে তুলে ছিলেন। পরের ধাপেই, ১৯৩৪ খ্রিঃ হিটলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক শক্তিকেও কুক্ষিগত করলেন। তিনি হলেন সৈন্য বাহিনীর প্রধান। তাঁর অন্য নাম হল ফুয়েরার অব জার্মান অর্থাৎ জার্মানীর নেতাজী। পূর্ণক্ষমতা করায়ত্ত কবে হিটলার এবার দেশজুড়ে ব্যাপক ইহুদী বিদ্বেষের চাষ শুরু করলেন।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে বোঝাতে শুরু করলেন, দেশের প্রধান প্রধান শিল্প – বাণিজ্য ইহুদীদের দখলে। তাদের জন্যই জার্মানরা নিজেদের দেশে কোনঠাসা হয়ে আছে আর সমস্ত সুযোগ সুবিধা একচেটিয়া ভোগদখল করে চলেছে ইহুদী বা জার্মান জাতির সমস্ত দুঃখ – কষ্টের জন্য দায়ী ইহুদী গোষ্ঠীই। এই প্রচারের ফল ফলতেও বিলম্ব হল না। দেশের নানা প্রান্তে ইহুদী নির্যাতনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটল প্রথমে। তারপর শুরু হল পরিকল্পিত ভাবে সংগঠিত আক্রমণ, লুঠতরাজ, হত্যা। এইভাবে দেশব্যাপী নির্যাতন শুরু করে ইহুদীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন এই ছিল হিটলারের উদ্দেশ্য।
১৯৩৫ খ্রিঃ দেশে নতুন একটি আইন চালু করে নাগরিকদের দুটি ভাগে ভাগ করে ফেললেন। জার্মানদের নাম হল জেন্টিল আর ইহুদীদেব নাম হল জু। হিটলার ঘোষণা করলেন জার্মানরাই হল পৃথিবীর আদি সভ্যজাতি আর্যবংশসদ্ভুত। ইহুদীরা অনার্য — জার্মান দেশে বসবাসকারীমাত্র ! আর্যদের প্রয়োজনে অনার্যদের এই দেশ ছেড়ে যেতে হবে। হিটলারের বিভিন্নমুখী প্ররোচনায় দেশজুড়ে মাথাচাড়া দিল তীব্র ইহুদীবিদ্বেষ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের রাজনীতি ক্ষেত্রে জার্মানী কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল। পরাজয়ের পর ইউরোপের মিত্রপক্ষ ও জার্মানদের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তা হল ভার্সাই চুক্তি। এই চুক্তির ফলে জার্মানীর সমস্ত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই অস্বস্তিকর অবস্থার অবসান ঘটিয়ে হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন হিটলার। তিনি ধীরে ধীরে নিজের শক্তি ও ক্ষমতা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ভার্সাই চুক্তির সর্তগুলিও অস্বীকার করতে শুরু করেছিলেন।
এই ভাবেই অগ্রসর হয়ে একসময় তিনি নিজেকে জার্মানির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে নিজেকেই তিনি জার্মানীর ফুয়েরার বা প্রধান রূপে ঘোষণা করলেন। দেশের জনসাধারণের মনেও তিনি সুকৌশলে পাকাপোক্ত করে নিলেন নিজের জার্মানজাতির পরিত্রাতার ভাবমূর্তিটি। দেশের নানাবিধ অভাব অভিযোগ, দারিদ্য, ক্রমবর্ধমান বেকারিত্ব মোটকথা জার্মানদের সর্বপ্রকার দুরবস্থারই সুযোগ করে দিয়েছে দেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থা।
এই শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে ইহুদীরা। সুতরাং জার্মানদের ভাগ্য ফেরাতে হলে তাদের বিতাড়নের মাধ্যমে বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন এনেই তা সম্ভব এই কথা নানাভাবে প্রচার করে হিটলার নিজের আসনটি নির্দিষ্ট করে নিলেন। সুপরিকল্পিতভাবেই হিটলার তার দেশের সামরিক শক্তির বৃদ্ধির দিকে সমস্ত ক্ষমতা নিয়োগ করলেন। কয়েকজন সুদক্ষ সমর নায়ক ও প্রচারবিদকে সহযোগী হিসেবে পেতেও বিলম্ব হল না। তারপর তাদের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন সীমান্তে বিপুল সংখ্যায় সৈন্য সমাবেশ করলেন।
ভার্সাই চুক্তির যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটুকুকে পদদলিত করে হিটলার এক তরফাভাবে রাইনল্যান্ড অধিকার করে নিলেন। তারপর অস্ট্রিয়া আর ইতালিকেও ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করলেন। সেই সময় মুসোলিনী ছিলেন ইতালির সর্বাধিনায়ক। তাঁর নেতৃত্বে ফ্যাসীবাদী শক্তি ও নাৎসী জার্মানী বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা ছকে ফেলল। সেই সূত্র ধরেই ইতালি প্রথমে আলবানিয়া ও পরে ইথিওপিয়ার কতকাংশ দখল করে নিল। অপর পাশে হিটলার ডানজিগ ও পোলিশ করিডর দাবি করে বসলেন পোল্যান্ডের কাছে।
তাঁর উদ্দেশ্য সৈন্য সমাবেশ করে এই অঞ্চলটিকে সুরক্ষিত করা। হিটলারের এই অযৌক্তিক দাবি সঙ্গত ভাবেই পোল্যান্ড সরকার প্রত্যাখ্যান করলেন। জার্মানীর সামরিক শক্তি সম্পর্কে পোল্যান্ডের কোন ধারণাই ছিল না। তাই তারা আশা করেছিল, হিটলারের আক্রমণ ঘটলে ইউরোপের শক্তিবর্গের সাহায্যে জার্মানবাহিনীকে অনায়াসেই পরাস্ত করতে পারবে। ভার্সাই চুক্তির শর্ত হিটলার যখন একের পর এক লঙ্ঘন করে চলেছেন, সেই সময় ইংলন্ড ও ফ্রান্স নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হিটলারের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়নি।
হিটলারের চাইতে কমিউনিস্ট রাশিয়াই সেই সময় হয়ে উঠেছিল ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে মহা শত্রু স্বরূপ। তাই তারা হিটলারকে বাধা দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। ইউরোপের দেশগুলির সুবিধাবাদী নীতির সুযোগটাই নিয়েছিলেন হিটলার। ১৯৩৯ খ্রিঃ ১ লা সেপ্টেম্বর হিটলারের জার্মানবাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করল। আর সেই দিন থেকেই শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পোল্যান্ডকে পরাস্ত করার পরই জার্মানবাহিনীর অগ্রগমন শুরু হল।
এরপর হিটলারের দখলে এলো নরওয়ে ও ডেনমার্ক। পরে আক্রান্ত হল ফ্রান্স। দুপক্ষের তুমুল যুদ্ধের পর ফরাসী বাহিনী পরাজিত হল। ইউরোপের অপরাপর দেশও যুদ্ধ থেকে সরে থাকতে পারল না। দেখতে দেখতে সমগ্র ইউরোপ আফ্রিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন। ফ্রান্স জয়ের পর যুগোস্লাভিয়া আর গ্রীস জার্মানদের দখলে এল। ফরাসীদের পরাজয়ের পরেই ইতালী জার্মানদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। এবারে যোগ দিল রুমানিয়া ও বুলগেরিয়া। ফলে সমগ্র দক্ষিণ ইউরোপ জুড়ে জার্মানদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত হয়ে পড়ল।
জার্মানবাহিনী যখন একের পর এক যুদ্ধজয় করে চলেছে সেইসময় হিটলার দেশজুড়ে শুরু করলেন নারকীয় ইহুদী নিধন। হিটলারের এই নৃশংসতা মানব সভ্যতার এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছে। হাজার হাজার ইহুদীকে নির্বিচারে বন্দি করা হয়। তাদের জনবসতিহীন সীমান্ত অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে বন্দিনিবাসে রাখা হল। সেখানে তাদের মারা হল নির্মম যন্ত্রণা দিয়ে। গুলি খরচ কমাবার জন্য হিটলার গ্যাসচেম্বার তৈরি করলেন। চারদিক বন্ধ বিশাল এক ঘরে; দুশোজন করে ইহুদীকে ঢুকিয়ে দিয়ে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ছেড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের মেরে ফেলা হত। মৃতদেহগুলিকে বার করে এনে বাইরে পুঁতে ফেলা হত।
এইভাবে তিনবছরে হিটলার প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করে নৃশংসতার চূড়ান্ত ঘটিয়েছেন। ফ্রান্সের পতনের পর হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলেন ১৯৪১ খ্রিঃ ২২ শে জুন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী হিটলারের জীবনের সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল রাশিয়া আক্রমণ। প্রথমে জার্মান বাহিনী জয়ী হতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত রুশ লাল ফৌজের মরণপণ লড়াইয়ের মুখে পরাজিত হয়। রাশিয়ায় যখন যুদ্ধ চলছে, ঠিক সেই সময়েই হিটলারের নির্দেশে রোমেল আফ্রিকায় যুদ্ধ শুরু করেন।
এইভাবে ইউরোপ ও আফ্রিকা জুড়ে যুদ্ধের লেলিহান শিখা প্রজ্জ্বলিত করলেন হিটলার। এশিয়ায় জাপান জার্মানীর পক্ষে যোগ দেয় এবং আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দর বিধ্বস্ত করে। ফলে আমেরিকাও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। ইরাজ সেনাপতি মন্টগোমারি রোমেলকে পরাজিত করলেন। ইতালিতে ফ্যাসিবিরোধী জনগণ মুসোলিনীকে হত্যা করল। ছয়মাস যুদ্ধের পর রাশিয়ার স্ট্যালিনগ্রাদে জার্মানবাহিনী লাল ফৌঝের কাছে আত্মসমর্পণ করল।
স্বভাবতই অনেক সেনাপতি হিটলারের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠলেন। অনেকেই তাকে হত্যার চেষ্টা করলেন। বাধ্য হয়ে, সঙ্গীদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে হিটলার সর্বক্ষণের জন্য ট্রেঞ্চে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। এই সময় তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিলেন প্রণয়িনী ইভা ব্রাউন। অসাধারণ সংগঠন শক্তি, বুদ্ধি ও প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েও হিটলার ছিলেন বিকৃত মানসিকতার শিকার। ফলে সুদক্ষ সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলেও ক্ষমতালাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষার তাড়নায় তিনি নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছিলেন।
আডলফ হিটলার এর মৃত্যু: Adolf Hitler’s Death
চারদিক থেকে যখন জার্মান বাহিনীর পরাজয়ের সংবাদ আসতে লাগল, সেই সময়, ১৯৪৫ খ্রিঃ ৩০ শে এপ্রিল রাশিয়ার লাল ফৌজ বার্লিন অবরোধ করে ফেলল। নিরুপায় আশাহত হিটলার কাল বিলম্ব না করে ট্রেঞ্চের মধ্যে আত্মহত্যা করলেন। একই সঙ্গে ইভাও বিষ খেয়ে হিটলারকে অনুসরণ করেন।