রণজিৎ সিং জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Ranjitsinhji Biography in Bengali. আপনারা যারা রণজিত সিংহ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী রণজিৎ সিং এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
রণজিৎ সিং কে ছিলেন? Who is Ranjitsinhji?
রণজিত সিংহ (১০ সেপ্টেম্বর, ১৮৭২ – ২ এপ্রিল, ১৯৩৩) ব্রিটিশ ভারতের কাঠিয়াওয়ার এলাকার সাদোদারে জন্মগ্রহণকারী নওয়ানগরের শাসক ও বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের পক্ষে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন এছাড়াও, প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও কাউন্টি ক্রিকেটে সাসেক্সের প্রতিনিধিত্ব করেন রঞ্জি ডাকনামে পরিচিত রঞ্জিত সিংজী। দলে তিনি মূলতঃ ডানহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। পাশাপাশি ডানহাতে স্লো বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন তিনি।
রণজিৎ সিং জীবনী – Ranjitsinhji Biography in Bengali
নাম | রণজিত সিংহ – রণজিৎ সিং |
জন্ম | 10 সেপ্টেম্বর 1872 |
পিতা | জীবন সিংহজি |
মাতা | – |
জন্মস্থান | সদোদর, কাঠিয়াওয়ার, বোম্বে প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | নওয়ানগরের শাসক ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার |
মৃত্যু | 2 এপ্রিল 1933 (বয়স 60) |
রণজিৎ সিং এর জন্ম: Ranjitsinhji’s Birthday
রণজিৎ সিং 10 সেপ্টেম্বর 1872 জন্মগ্রহণ করেন।
যাঁর প্রতিভাকে আশ্রয় করে বিশ্বের খেলাধুলার আসরে ভারত প্রথম স্বীকৃতি লাভ করে, যিনি ছিলেন বিশ্বের ধুরন্ধর এবং ভারতের অদ্বিতীয় ক্রিকেট খেলোয়াড়, ইংলন্ডের শহরে গ্রামে এককালে যাঁর নাম রূপকথার নায়কের মত প্রচারিত হয়েছে, তিনিই হলেন রণজিৎ সিংজী। তাঁর অপূর্ব ক্রীড়া সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েই প্রথম ইউরোপের জনসাধারণ ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের বিষয়ে সচেতন ও সজাগ হন। সেইকালে ইংলন্ডের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ক্রিকেট খেলা।
স্বভাবতঃই ইংলন্ডের ক্রিকেট – কর্তারা ভারতীয়দের সম্বন্ধে ঘৃণা ও অবজ্ঞার ভাব পোষণ করতেন। তারাই সেদিন সমস্ত অনাদর অশ্রদ্ধা বিস্মিত হয়ে অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন রণজিৎ সিংজিকে। কেবল তাই নয়, জাতীয় সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তাঁরা সাগ্রহে তার সাহায্য বরণ করে নিয়েছিলেন। রণজিৎ সিংজীর বৈশিষ্ট্য ছিল, ক্রিকেট খেলার ছকে বাঁধা নিয়মের পরোয়া না করে সকল প্রকার আক্রমণকে তুচ্ছ করে দিয়ে স্বকীয় ভঙ্গীতে দ্রুত রান তুলবার পারদর্শিতা ছিল তার করায়ত্ত।
এই অনন্য বৈশিষ্টার জন্যই ইংলন্ডের জনসাধারণ তার নাম দিয়েছিলেন ‘রানগেন সিংজী’। স্বকীয় ভঙ্গিমায় বল মারবার কৌশল, উইকেট থেকে উইকেটে ছুটবার ক্ষিপ্রতা – ইত্যাদি দুর্লভ গুণের বলেই তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট খেলোয়াড়দের মধ্যে নিজের স্থানটি নির্দিষ্ট করে নিতে পেরেছিলেন। রণজিৎ সিংজীর প্রতিভার অন্যতম সাক্ষ্য হল, প্রথম শ্রেণীর খেলায় ৭২ বার শতরান করবার গৌরব।
রণজিৎ সিংজীর ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের সময় ক্রিকেট জগতের অন্যতম বিস্ময় – প্রতিভা ডব্লিউ. জি. গ্রেস বলেছিলেন: “I assure you that you will never see a batsman to beat I am Saheb if you live for a hundred years.”
ইংলন্ডের বিখ্যাত পত্রিকা ডেলি নিউজ লিখেছিল, “The king of cricket will come no more…….. the well – graced actor leaves the stage becomes only a memory ….. Prince of a little state but king of a great game….. he is not a miser hoarding up runs, but a milionaire spending with a liberal yet judicioues prodigality this batting can be compared with Asquith’s oratory.”
**** লর্ড সেলসবেরী রণজিৎ সিংজী সম্বন্ধে বলেছিলেন, “He was a black man playing cricket for all the world to see as if he were a white man.”
রণজিৎ সিং এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Ranjitsinhji’s Parents And Birth Place
ভারতের নবনগরের জামসাহেব জাম বিভাজীর দত্তক পুত্র ছিলেন রণজিৎ সিংজী। তার জন্ম ১৮৭৭ খ্রিঃ ১০ ই সেপ্টেম্বর। রাজপরিবারে লালিত পালিত হওয়া সত্ত্বেও বাল্য বয়সেই পারিবারিক ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছিল সিংজীকে।
রণজিৎ সিং এর শিক্ষাজীবন: Ranjitsinhji’s Educational Life
সিংহাসনের অধিকার থেকে বিচ্যুত করবার জন্য পড়াশুনার নাম করে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইংলন্ডে। তার আগে রাজকোটের রাজকুমার কলেজে তিনি নয় বছর পড়াশুনা করেছিলেন। এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন চেস্টার ম্যাকনাটেল। ক্রিকেট খেলায় তার ছিল প্রবল উৎসাহ। নিজেও ছিলেন দক্ষ খেলোয়াড় কেমব্রিজ ব্লু। তার কাছেই সিংজীর ক্রিকেট খেলার প্রথম হাতেখড়ি। ক্রিকেট খেলায় সহজাত প্রতিভা ছিল সিংজীর।
ম্যাকনাটেলই তার প্রতিভার পরিচয় জানতে পেরেছিলেন প্রথম। বুঝতে পেরেছিলেন রাজপরিবারে পালক রাজকুমার হলেও ভবিষ্যতে ইনিই ক্রিকেটের সত্যিকার রাজার আসন লাভ করবেন। রাজকোট থেকে ইংলন্ডে পড়তে এলেন সিংজী। অদ্ভুত যোগাযোগ এই যে, সেই সময়েই ম্যাকনাটেলও ইংলন্ডে ফিরে এসেছেন। এখানে তার সাহচর্য ও সহযোগিতা সিংজীর প্রতিভার বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
ম্যাকনাটেল নিজে সঙ্গে করে সিংজীকে ইংলন্ডের বড় বড় খেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন। খেলার মাঠেই শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। সিংজী কেমব্রিজে আসেন ১৮৮৯ খ্রিঃ। ভর্তি হন ট্রিনিটি কলেজে। তাঁর থাকবার ব্যবস্থা হয় কলেজের রেভারেন্ড বরিশ – এর সংসারে। পড়াশুনা চলতে থাকে তাঁরই তত্ত্বাবধানে। রাজ্যের অধিকার থেকে সিংজী বঞ্চিত হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু রাজকুমার হিসেবে বিদেশে সবরকম সুযোগ সুবিধাই তিনি পেতেন।
সেই সুবাদেই তিনি সেন্ট ফেথ স্কুলে খেলাধুলার চর্চা করবার সুযোগ পেয়ে যান। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আর. এস. গুডচাইল্ড। ক্রিকেট খেলায় তাঁরও ছিল প্রবল উৎসাহ। সিংজীর খেলার সহজাত নৈপুণ্য দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তাঁর ক্রিকেট খেলার প্রতিভা যাতে মূর্ত হয়ে উঠতে পারে সেই উদ্দেশ্যে তিনি নিয়মকানুনের বাধা অপসারিত করে ডান হাওয়ার্ড রিচার্ডসন, লকউড ও ওয়াট প্রমুখ বিখ্যাত পেশাদারী বোলারদের সঙ্গে সিংজীর অনুশীলনের সুযোগ করে দেন।
কেমব্রিজের পার্কার পিচের সঙ্গে ক্রমশঃ নিবিড় হয়ে উঠতে থাকে সিংজীর সম্পর্ক। এখানেই তাঁর প্রতিভা প্রথম বিকশিত হবার সুযোগ পায়। সিংজী ক্রিকেটের ছক বাঁধা নিয়মকানুনের খুব একটা ধার ধারতেন না। রান তুলবার জন্য তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে বেপরোয়াভাবে ব্যাট চালনা করতেন। তাঁর খেলার এই বৈশিষ্ট্য এমনই ছিল যে তিনি যখন মাঠে ব্যাট হাতে নামতেন, তার মার দেখার জন্য চারপাশে রীতিমত ভিড় জমে যেত।
ব্যাট চালনার এই স্বকীয় রীতির জন্য সিংজী অল্পদিনের মধ্যেই ইংলন্ডের ক্রিকেট সমাজের আলোচনা ও সমালোচনার পাত্র হয়ে ওঠেন। সেই সময় কেমব্রিজের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন স্যার স্ট্যানলী জ্যাকসন ৷ একদিন তিনি ভিড় দেখে পার্কার পিচের কাছে এসে সকৌতুকে লক্ষ করতে লাগলেন। সেই সময় তীব্র বেগে ছুটে আসা একটা বলকে সিংজী হাঁটু গেড়ে বসে ব্যাট হাঁকিয়ে বাউন্ডারীর দিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
জ্যাকসন সবিস্ময়ে দেখলেন, বল মারার পরই সাবলীল ভঙ্গিতে সিংজী অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে রান তুলে চলেছেন। এবারে রীতিমত আগ্রহী হয়ে উঠলেন জ্যাকসন। তিনি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে লাগলেন। প্রতিবারেই লক্ষ করলেন সিংজীর খেলা একেবারেই চিরাচরিত নিয়মরীতির বাইরে। কিন্তু খেলার এই ভঙ্গি তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হলেও ব্যাপারটা জ্যাকসন খুশি মনে মেনে নিতে পারলেন না। জ্যাকসন ছিলেন ক্রিকেট খেলার সনাতন রীতির মারের পক্ষপাতী।
বিজ্ঞানসম্মত খেলনরীতিই তার পছন্দ। ধীরে ধীরে তিনি বিরক্তি নিয়েই পিচের ধার থেকে সরে এলেন। কিন্তু অন্য দর্শকরা তখন মুগ্ধদৃষ্টিতে উপভোগ করছে সিংজীর খেলা। আর তাদের হর্ষোৎফুল্ল কোলাহল ও করতালি ধ্বনিতে মুহুর্মুহু প্রকম্পিত হচ্ছে মাঠের বাতাস ৷ সিংজী কিন্তু তার খেলার নিজস্ব ভঙ্গি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। মারের কায়দাকানুন সবই ছিল তার নিজস্ব উদ্ভাবন। এই সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “I found a great difference between the English style and my own.”
সিংজীর খেলার মান ক্রমশঃই উন্নত হয়ে চলেছিল। তিনি এমন ক্ষিপ্র গতিতে রান তুলতেন যে শোনা যায় একই দিনে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলে তিনটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। সিংজীর নিজস্ব ঢঙে ‘লেগ গ্লান্স’ মার ছিল অনবদ্য। মারের এই বিশেষ ধারার সাহায্যে যে কোন ধারার আক্রমণকে প্রতিহত করে তিনি অনায়াসে অসংখ্য রান তুলতে পারতেন। ‘লেগ গ্লান্স’ মারবার সময় সিংজীর ডান পা থাকতো অনড়, অপূর্ব দক্ষতায় দেহ সম্পূর্ণ বাঁকিয়ে কব্জির সাবলীল চালনার দ্বারা তিনি ব্যাট হাঁকাতেন।
ব্যাটে লাগামাত্রই বল এমন তীব্রগতিতে উৎক্ষিপ্ত হত যে প্রায় সময়ই বিপক্ষদলের খেলোয়াড়রা চোখে বল দেখতে পেতেন না। যদি বা কখনো দেখতে পেতেন বুলেট গতির সেই বলের গতিরোধ করতে তাঁরা সাহস পেতেন না। সিংজীর লেগ গ্লান্স মারের তীব্রতা বিষয়ে ডেলি টেলিগ্রাফও মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিল। তারা লিখেছিল— “…. it goes to leg and boundary like a shell from a7 pounder, immense, audacious, unstappable.”
রণজিৎ সিংজীর জীবনী লিখেছিলেন রোলান্ড ওয়াইল্ড। তিনি তাঁর এই বিশেষ মার সম্বন্ধে লিখেছেন, “Thus was born the greatest scoring stroke ever known. For Ranjit Singhji, with his right foot perforce immov able, still refused to play on the defensive. To the amazement of the bowlers he twisted his body, flicked his wrists, and smashed the ball round the leg. They sent him good length balls and he treated them in the same manner. They declared that it was risky, unconventional and in fact ‘ not cricket ‘. His reply was to score fours off them.”
রণজিৎ সিংজীর মারের এই তীব্র গতি খেলার জীবনের শুরু থেকে অবসর নেবার সময় পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। তিনি তার খেলায় বরাবর একটা রীতি মেনে চলতেন, তা হল, আক্রমণই শ্রেষ্ঠ রক্ষণ। তিনি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় সর্বদাই প্রস্তুত হয়ে থাকতেন — বল এলেই মারতে হবে — সোজা হোক বাঁকা হোক, ধীরে কিংবা জোরে যে ভাবেই বল আসুক না কেন। তার এই মনোবল এসেছিল খেলার দক্ষতা ও নৈপূণ্য থেকে, তা বলাই বাহুল্য।
কেমব্রিজের রেভারেন্ড বরিশ বরাবরই সিংজী সম্বন্ধে ছিলেন আশাবাদী। ফলে তার দিক থেকে প্রেরণা ও উৎসাহের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন হয়ে দাঁড়াল যে সিংজী সবকিছু ভুলে খেলা নিয়েই মেতে উঠলেন। খেলাই হয়ে উঠল তার ধ্যান – জ্ঞান। রেভারেন্ড বরিশ কেবল নয়, শুভানুধ্যায়ীরা প্রায় সকলেই বুঝে গেলেন, এই ছেলের লেখাপড়া আর হবে না। ক্রিকেটই সব গ্রাস করেছে ! সিংজী কিন্তু সকলের ধারণাই পালটে দিলেন।
১৮৯২ খ্রিঃ পরীক্ষায় যথারীতি উত্তীর্ণ হলেন এবং যথাসময়ে ট্রিনিটি কলেজে ভর্তিও হলেন। সেই সঙ্গে রেভারেন্ড বরিশের সংসার থেকেও নিজেকে আলাদা করে নিলেন। পৃথক ঘর ভাড়া করলেন সিডনি স্ট্রীটে। দেখে শুনেই বাড়িটি নিয়েছিলেন সিংজী। তাই নিজের মনের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতেও কার্পণ্য করলেন না। অর্থও তার জন্য ব্যয় হল জলের মত। সিংজীর এই নতুন বাসাটি রীতিমত স্মরণীয় হয়ে আছে।
পরবর্তীকালে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট প্লেয়ারদের অনেক আনন্দমুখর দিন কেটেছে এখানে, হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা। ইতিমধ্যে যথেষ্টই পরিচিতি এবং খ্যাতি লাভ করেছেন সিংজী। কিন্তু হলে হবে কি, কেমব্রিজ দলে তখনো পর্যন্ত ঠাঁই হয়নি তার। রক্ষণশীল ইংরেজরা একজন অশ্বেতাঙ্গকে দলে নেবার ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ। ইংরেজ বা খ্রিষ্টান ছাড়া কেমব্রিজ দলে সেই কালে কোন খেলোয়াড়ের ঠাই পাওয়া ছিল একরকম অসম্ভব ব্যাপার। সিংজী এই দুয়ের কোনওটিই নন, কাজেই ইচ্ছা থাকলেও তা পূরণের আশা ছিল না।
এইসময়ে, ১৮৯২ খ্রিঃ ইংলন্ডের একটি ক্রিকেট দল ভারত সফরে আসে। দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্বে ছিলেন লর্ড হক। আবার দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে এসেছিলেন কেমব্রিজ দলের অধিনায়ক স্ট্যানলি জ্যাকসন। ইংরেজদের এই দলের ভারত সফর ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ভারতীয়দের সম্বন্ধে তাঁরা নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরলেন। তারা ভালভাবেই বুঝে গেলেন যে অশ্বেতাঙ্গ হলেও ক্রিকেট খেলাতে তারাও কিছু কম যান না।
এই মনোভাব পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল হল এইযে জ্যাকসনকে সিংজী সম্বন্ধে নাক উঁচু ভাব সংবরণ করতে হল এবং তিনি অবিলম্বে কেমব্রিজ দলে স্থানলাভ করলেন। এই সুযোগের প্রতীক্ষাতেই ছিলেন সিংজী। তাই তা কাজে লাগাতেও খুব একটা সময় নিলেন না। অবিলম্বেই তিনি কেমব্রিজ দলে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ১৮৯৩ খ্রিঃ তিনি ইউনিভার্সিটি ব্লু লাভ করলেন।
রণজিৎ সিং এর কর্ম জীবন: Ranjitsinhji’s Work Life
এরপর তিনটি বছর দেখতে দেখতে অতিবাহিত হয়ে গেল। ১৮৯৬ খ্রিঃ সিংজী ইংলন্ডের টেস্ট দলে স্থানলাভ করলেন। এর আগে আর কোন ভারতীয় ইংলন্ড দলে স্থান লাভের যোগ্য বিবেচিত হননি। অবশ্য এই সুযোগলাভের আগে সিংজীকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। এম.সি. সি. দলে সভাপতি লর্ড হ্যারিস খোদ ছিলেন সিংজীর নির্বাচনের ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু সিংজীর খেলার প্রতিভায় অন্যান্য সদস্যেরা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাদের ঐকান্তিক আগ্রহকে উপেক্ষা করতে পারলেন না হ্যারিস।
দেশের সম্মানরক্ষার একটা তাগিদও অবশ্য দলের সভাপতির ছিল। তাই সিংজীকে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট দলের অন্তর্ভুক্ত করতে হল। সিংজীর দাবি ছিল অনুচ্চারিত এবং তা হল তার খেলা। তা তিনি প্রতিপন্ন করতে সমর্থ হলেন প্রথম টেস্টেই ৬২ ও ১৫৪ (নট আউট) রান করে। অবাক হবার কিছুই ছিল না যে তাঁর দ্বিতীয় ইংনিংসে অপরাজিত ১৫৪ রানই দেখা গেল সমূহ পরাজয়েব হাত থেকে ইংলন্ডকে রক্ষা কবল।
এই বছরেই শেষ দিকে আর এক চমক সৃষ্টি করলেন রণজিৎ সিংজী ২,৭৮০ রান করে ব্যাটিং এভারেজে প্রথম স্থান অধিকার করে। তাঁর রান সংখ্যার রেকর্ড যে ডব্লিউ. জি. গ্রেসের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়ে নতুন রেকর্ড হিসেবে গণ্য হলো তা বলাই বাহুল্য। সিংজীর এই সাফল্যকে অভিনন্দিত করার জন্য কেমব্রিজে এক বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সভায় ইংলন্ডের সর্বশ্রেণীর জনসাধারণ উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিংজীকে অভিনন্দিত করলেন।
ওই বছর ১৮৯৬ খ্রিঃ ছাড়াও ১৯০০ খ্রিঃ এবং ১৯০৪ খ্রিঃ এই দুইবার সিংজী ইংলন্ডের ব্যাটিং এভারেজে শীর্ষস্থান লাভ করেন। ১৮৯৫ খ্রিঃ তিনি দল বদল করে যোগ দিলেন সাসেক্স দলে। তাল্পদিনের মধ্যেই তিনি শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করেন। ইংলন্ড দল ১৮৯৭-৯৮ খ্রিঃ অস্ট্রেলিয়া সফরে গেল। সিংজী এই দলে সাদরে অন্তর্ভুক্ত হলেন। প্রথম টেস্টটি অনুষ্ঠিত হল সিডনিতে।
এই খেলায় সিংজী ১৭০ রান করেন। কেবল তাই নয়, অসুস্থ অবস্থায় ১৮৮৯ খ্রিঃ ১৮৯ রান করে সকলকে বিস্মিত ও চমৎকৃত করলেন। অস্ট্রেলিয়া সফরে সিংজী সর্বমোট ১০৭২ রান করেন। তাঁর এই রানসংখ্যার রেকর্ড ইংলন্ডের ব্যাটসম্যানদের প্রতিষ্ঠিত রেকর্ডকে ভঙ্গ করে নবতম রেকর্ড হিসাবে গৃহীত হল। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যে খেলাগুলি হয়েছিল তাতে সিংজীর সংগৃহীত রান সংখ্যা ছিল ৯৮৫ এবং ব্যাটিং – এর গড় ছিল ৪৪.৭৭। ইংলন্ডের হয়ে সিংজী মোট ১৪ টি টেস্ট খেলেছিলেন।
তাতে ইংলন্ডের ব্যাটিং এভারেজে তিনবার প্রথম স্থান, তিনবার দ্বিতীয় স্থান এবং একবার তৃতীয়স্থান লাভ করে অভূতপূর্ব কীর্তি স্থাপন করেন ৷ ১৮৯৯ খ্রিঃ ইংলন্ড দলের সঙ্গে টেন্টব্রিজ মাঠে অস্ট্রেলিয়ার যে খেলা হয় তাই ছিল সিংজীর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সর্বশেষ অধিনায়কতা। এই খেলায় দলের নিশ্চিত পরাজয় ঠেকিয়েছিলেন সিংজী। ওই বছরে তার রান সংখ্যা ছিল ৩,০০০।
এই বছরেই তাঁর অধিনায়কতায় এমেচার টু দি নিউ ওয়ার্ল্ড নামে একটি শক্তিশালী ক্রিকেট দল ফিলাডেলফিয়া অ্যাসোসিয়েটেড ক্লাবের আমন্ত্রণে ফিলাডেলফিয়া সফর করে। রনজিৎ সিংজীর গৌরবোজ্জ্বল খেলোয়াড় জীবনের চরম উৎকর্ষতা দেখা যায় ১৯০৮ খ্রিঃ। ওভাল মাঠে সারের বিরুদ্ধে সাসেক্স দলের হয়ে। এই খেলায় তিনি ডবল সেঞ্চুরী করার গৌরব অর্জন করেন। এই দলের হয়ে তিনি খেলেছিলেন বারো বছর।
এর মধ্যে কাউন্টি ক্রিকেটের ব্যাটিং অ্যাভারেজে তিনি নয়বার প্রথম স্থান এবং দুইবার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯০১ খ্রিঃ সিংজী সাসেক্স দলের হয়ে টনটন মাঠে সমারসেট দলের বিরুদ্ধে খেলে অপরাজিত থেকে যান ২৮৫ রান করে। এটিই তার জীবনের সর্বোচ্চরান সংখ্যা। ১৯২০ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি নিয়মিত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলায় অংশ গ্রহণ করেন। সাসেক্স দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্বও তার ওপরেই ছিল। ১৮৯৭ খ্রিঃ রণজিৎ সিংজির বিখ্যাত ক্রিকেট বই জুবিলী বুক অব ক্রিকেট প্রকাশিত হয়েছিল।
তিনি তাঁর জীবনে প্রায় ২৫,০০০ রান সংগ্রহ করেন। এই রান সংখ্যার গড় ছিল প্রতি ইনিংসে ৫৬ রান। তিনি একমাসের মধ্যে তিনবার ১০০০ রান সংগ্রহ করেন। রণজীর বিশেষ মার ছিল লেগ গ্লান্স। এ ছাড়াও একটি বিখ্যাত মার ছিল তার যা আজ পর্যন্ত কোন খেলোয়াড়ের মধ্যে দেখা যায় নি।
এই বিশেষ মার প্রসঙ্গে তার জীবনীকার জ্যাকসন এক জায়গায় বলেছেন, “বোলার বল করছেন — বল হয়তো সোজাসুজি কিংবা একটু অফে তীব্রভাবে উইকেটের দিকে ছুটে আসছে — এই ধরনের বলে রণজী উইকেটে অবিচল থাকতেন এবং শুধুমাত্র হাতের কব্জীর অপূর্ব দক্ষতায় নিমেষ মধ্যে ব্যাটটিকে এমনভাবে চালনা করতেন যে মাঠভর্তি দর্শক শুধু দেখতে পেতেন বলটি অন সাইডের বাউন্ডারীর দিকে তীব্রভাবে ছুটে আসছে। বিস্ময়ে হতবাক বোলারের মুখ থেকে বেরিয়ে আসত – একমাত্র রণজীর পক্ষেই এমন মার সম্ভব। খেলোয়াড়েরা শ্রদ্ধায় মাথা নত করতেন।”
রণজীর প্রতিভার অনন্যতা কেবল তার রান সংখ্যার মধ্যেই নিহীত নয়। তার খেলার মধ্যে দর্শকরা পেতেন অনাবিল আনন্দ আর খেলোয়াড়ী উত্তেজনা। তার ব্যাট চালনার ভঙ্গিমা দেখার জন্য সারা মাঠ রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করে থাকত। বিখ্যাত ক্রিকেট সমালোচক সি.বি.ফ্রাই ক্রিকেট জগতের বিগ ফোর নামে যে চারজন খেলোয়াড়ের নাম করেছেন তারা হলেন, ডবলিউ জি গ্রেস, ভি.টি.ট্রম্পার, রণজিৎ সিংজী ও ডন ব্রাডম্যান।
রণজিৎ সিং এর মৃত্যু: Ranjitsinhji’s Death
স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করে ক্রিকেটের ইতিহাসের অমর প্রতিভা সিংজী ১৯৩৩ খ্রিঃ ২ রা জুন ইহলোক ত্যাগ করেন।