অরণ্য ধ্বংসের বা বিনাশের কারণ: অরন্যের প্রতিস্থাপনের চেষ্টা না করে বৃক্ষচ্ছেদনের মাধ্যমে অরন্যের অপসারণকে অরন্যচ্ছেদন বলে। যথেষ্ট ভাবে অরণ্য সম্পদ আরোহনের ফলে অরণ্য বিনষ্ট হয় এবং সেইসঙ্গে জলবায়ু তথা সমগ্র পরিবেশ প্রভাবিত হয়ে থাকে। অবেবিচনা প্রসূত অরণ্যনিধনের ফলে সারা বিশ্বব্যাপী অরন্যের পরিমান দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
FAO এর মতে প্রতি হেক্টর জমিতে কমপক্ষে ০.০৫ হেক্টরে বিভিন্ন ধরণের গাছপালার সমাবেশকে বনভূমি বলে। বনভূমি জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রন করে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে মানুষ তাঁর নিজস্ব প্রয়োজন মেটাতে নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন বা বনভূমি ধবংশ করে চলেছে। এই নির্বিচারে বনভূমি ধবংশের প্রক্রিয়াকে Deforestation বলে।
এই অরণ্য ধ্বংস বা বিনাশের কারণ গুলিকে তিনটি শ্রেনীতে ভাগ করে নিচে আলোচনা করা হল –
প্রাকৃতিক কারণ
১. দাবানল – প্রাকৃতিক কারনেই হোক বা মানুষের দাঁড়ায় হোক বনভূমিতে আগুন লাগলে বনভূমি ধ্বংস হয়। সাধারণত বজ্রপাত এবং গাছে গাছে ঘর্ষনের ফলে দাবানলের সৃষ্টি হয়। ফলে বিস্তৃর্ন অঞ্চলের বনভূমি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
যেমন – অস্ত্রেলিয়ায় দাবানলে প্রচুর বনভূমি প্রতি বছর দাবানলের কারণে নষ্ট হয়।
২. ভূমিকম্প – প্রবল তীব্রতার ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় বিশাল আকারের ভূমিভাগের অবনমন ঘটলে তার উপরের সব গাছপালা মাটির নিচে চাপা পড়ে অরণ্য ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
৩. অগ্ন্যুৎপাত – কোনো আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত ঘটলে যে উত্তপ্ত লাভা স্রোত নির্গত হয়, তা যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেখানকার উদ্ভিদকে দগ্ধ করে দেয়।
৪. অ্যাসিড বৃষ্টি – কয়লা ও খনিজ তেলের দহনের ফলে এবং তাপবিদ্যুৎ ও ধাতু নিষ্কাশন কেন্দ্র থেকে নির্গত নাইট্রিক ও সালফিউরিক অ্যাসিড বৃষ্টির জলের সাথে মিশে অ্যাসিড বৃষ্টি রূপে পৃথিবীপৃষ্টে পতিত হ্য,যার ফলে অরন্যের বহু উদ্ভিদ বিনষ্ট হয়।
৫. ধস – পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়শয় ভূমি ধস দেখা যায়, যার ফলে অরণ্য বিনষ্ট হয়।
৬. কীট পতঙ্গের আক্রমন – বনভূমির মধ্যে বিশেষ কিছু প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে কীটপতঙ্গের আক্রমন যথেষ্ট মাত্রায় দেখা যায়। ফলে কোথাও কোথাও বিস্তৃর্ন অঞ্চলে বনভূমি ধ্বংস হয়।
অর্থনৈতিক কারণ
১. বহুমুখী নদী পরিকল্পনা – বহুমুখী নদী পরিকল্পনা বনভূমি ধ্বংসের আরেকটি অন্যতম কারণ। প্রধানত কৃষিক্ষেত্রে জলসেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদী তে বাঁধ দিয়ে বাঁধের পশ্চাতে জল ধরে রাখা হয়, এর ফলে বাঁধের পশ্চাতে বিস্তৃত অঞ্চল জলমগ্ন হয়। ফলে ওই অঞ্চলের বনভূমি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
২. বনভূমি পশুচারন ভূমিতে রূপান্তর –জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যেমন খাদ্যশস্যের চাহিদা বেড়েছে, তেমনি দুদ্ধজাত দ্রব্য, মাংস ও চামড়ার প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে বহুগুন। ফলে পশুচারন ক্ষেত্রের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বনভূমি সংকুচিত হয়।
৩. বনভূমি কৃষিভূমিতে রূপান্তর – ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে বনভূমি দ্রুত পরিষ্কার করে চাষের জমিতে পরিনত করা হচ্ছে। এর ফলে বনভূমি ধ্বংস পাপ্ত হচ্ছে। এই কারণ গুলির জন্য উন্নয়নশীল দেশ গুলিতে খুব দ্রুত অরন্যের বিনাশ ঘটছে।
৪. স্থানান্তর কৃষি বা ঝুম চাষ – দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রাম্যমান উপজাতিদের জঙ্গল পুড়িয়ে আদিম প্রথায় চাষ আবাদ করার ফলে বনভূমির দ্রুত বিলাপ ঘটছে। এদিক থেকে ওড়িশা অগ্রনি ভূমিকা গ্রহন করে।
৬. শিল্পস্থাপন – উন্নত দেশগুলিতে শিল্প ব্যবস্থা দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন শিল্পকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা, যার ফলে বৃক্ষচ্ছেদন করার প্রবনতা দেখা যায়।
৭. যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারন – যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারনের জন্য নতুন রাস্তা ও রেলপথ নির্মানের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। এই রাস্তা ও রেলপথ নির্মানের জন্য যে জায়গার দরকার হয়, তার জন্য গাছপালা ও বনভূমি কাটা হয়, ফলে অরন্যের বিনাশ ঘটে। বর্তমানেও আমাদের দেশে সড়ক পথ নির্মানের জন্য প্রচুর গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে।
৮. খনি উত্তোলন ক্ষেত্রে – বনভূমি অঞ্চলে কোন নতুন খনি আবিষ্কার হলে, সেখানে খনি উত্তোলন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য নির্বিচারে প্রচুর পরিমানে বৃক্ষ কেটে ফেলা দেওয়া হয়, যার ফলে প্রচুর বনভূমি হ্রাস হয়।
সামাজিক কারণ
১. বসতি স্থাপন – প্রতিবছর সারা বিশ্বব্যাপী প্রচুর পরিমানে জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এই বিপুল পরিমান জনসংখ্যার বসত বাড়ি নির্মান ও তাদের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বনভূমি কেটে বসত বাড়ি নির্মান ও কৃষিজমি তৈরি করা হচ্ছে। যা বর্তমানে বনভূমি ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ।
২. বেআইনি ভাবে বৃক্ষচ্ছেদন – বিশ্বের অনেক দেশে কাঠের চোরাচালানের ব্যবসা আছে। এই ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা সরকারী বিধিনিষেদ না মেনে বেআইনি ভাবে গাছ কেটে চলেছে। এই ভাবে গাছ কাঁটার ফলে ব্রাজিলের আলাজন অরন্যের পরিমান অনেকটাই কমে গেছে।
প্রভৃতি প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক কারণে প্রচুর পরিমান বনভূমি প্রতিবছর বিলুপ্ত হচ্ছে।