মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো: ভারতের উপজাতি কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো মুন্ডা বিদ্রোহ। 1899-1900 খ্রিস্টাব্দে ছোটনাগপুর সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাসকারী মুন্ডারা বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে যে ব্যাপক আন্দোলনে সামিল হয়েছিল ইতিহাসে তা মুন্ডা বিদ্রোহ বা উলগুলান (ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা) নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের প্রধান নেতা বিরসা মুন্ডা ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজ উপজাতির মানুষকে একত্রিত করণের দ্বারা এই আন্দোলন সংঘঠিত করেছিলেন।
মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ
মুন্ডা বিদ্রোহের পেছনে ছিল একাধিক কারণের সমাবেশ। সেগুলি হল-
১) ভূমি ব্যবস্থা পরিবর্তন: মুন্ডারা জঙ্গল কেটে জমি তৈরি করে সেই জমিতে পরিবারগত ভাবে যৌথ মালিকানায় বা খুৎকাঠি প্রথায় চাষাবাদ করত। জমিদার বা রায়তদার সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ওই অঞ্চলে চড়া রাজস্বের শর্তে জমিদারদের ভূমি বন্দোবস্ত দিতে শুরু করলে জমিতে ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রত্যেকের জমিতে আলাদা আলাদা করে ভূমি রাজস্ব আরোপ করা হয়। এই ব্যবস্থা মুন্ডাদের অসন্তুষ্ট করে।এছাড়া সঠিক সময়ে খাজনা দিতে না পারায় বহু মুন্ডা কে তাদের জমি থেকে উৎখাত করা হয়। এর ফলেও মুন্ডাদের মনে প্রচন্ড বিদ্বেষ জন্মায়।
২)মহাজনদের অত্যাচার: ছোটনাগপুর অঞ্চলে বহিরাগত জমিদার, মহাজন ও ঠিকাদারদের আগমন ঘটলে বহু জমি মুন্ডাদের কাছ থেকে তাদের অধীনে চলে যায়। এই বহিরাগত জমিদাররা মুন্ডাদের উপর বিভিন্ন ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। এছাড়া বহিরাগত মহাজনরা গ্রামে গ্রামে মদের দোকান খুলে নেশায় প্রলুব্ধ করে মুন্ডাদের ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ করে। এই ঋণের দায়ে মহাজনরা মুন্ডাদের জমি জায়গা লিখিয়ে নিতো এবং বেট বেগারি প্রথায় বিনা মজুরিতে নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য করতো। এইসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুন্ডাদের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
৩) সামাজিক মর্যাদাহানি: ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক নীতি মুন্ডাদের সমাজ ব্যবস্থায় আঘাত হেনেছিল। মুন্ডা সমাজ ব্যবস্থায় সর্দার ছিলেন অতি সম্মানীয় ব্যক্তি। এই সর্দারের মধ্যস্থতায় যেকোনো সামাজিক বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটানো হত।কিন্তু ইংরেজ প্রবর্তিত নতুন ব্যবস্থায় আইন-আদালত প্রতিষ্ঠিত হলে সর্দারের সম্মানহানি ঘটে। শুধু তাই নয় দিকু বা বহিরাগত ভদ্রলোকদের কূটনীতির সংস্পর্শে আসার ফলে সৎ ও সহজ-সরল প্রকৃতির মুন্ডাদেরও নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয়। মুন্ডা সমাজের এই মর্যাদাহানি ও অধঃপতন বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন মুন্ডাদের অসন্তুষ্ট করে।
৪)খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচার: মুন্ডাদের মধ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের চেষ্টা মুন্ডাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। লুথারান ও অ্যাঙ্কলিকান মিশনারিরা মুন্ডাদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার উদ্দেশ্যে তাদের চিরাচরিত ধর্ম ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাতে থাকে। এমনকি তারা মুন্ডাদের নানারকম প্রলোভন দেখায় ও ভীতি প্রদর্শন করে। এর ফলে মুন্ডাদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং তারা বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে।
৫) বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বদান: 1875 খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলার উলিহাতু গ্রামের এক ভাগচাষী পরিবারে জন্মগ্রহণকারী সুগান মুন্ডার পুত্র বিরসা মুন্ডা অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত মুন্ডা সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।পিতৃ সূত্রে বিরসা মুন্ডা প্রথমে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও পরবর্তীকালে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করেন।1895 খ্রিস্টাব্দে মাত্র 21 বছর বয়সে তিনি দাবি করেন যে তিনি ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ পেয়েছেন এবং এক নতুন ধর্ম প্রবর্তন করে তিনি নিজেকে “ধরতি আবা” বা ধরণীর পিতা বলে ঘোষণা করেন। মুন্ডা সমাজ অচিরেই তাঁকে সিংবোঙা বা সূর্য দেবতার মর্যাদায় ভূষিত করে। বিরসা মুন্ডা বিদেশিদের খাজনা বন্ধ ও বহিষ্কারের আহ্বান জানান এবং স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। সরকার বিরোধী প্রচার কার্যের জন্য 1896 খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডা ও তার 15 জন অনুগামীকে গ্রেফতার করে ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
মুন্ডা বিদ্রোহের বিদ্রোহের সূচনা ও বিস্তার
দু’বছর পর কারামুক্ত বিরসা সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মেতে ওঠেন। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মুন্ডাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন এবং প্রায় 6000 মুন্ডা কে নিয়ে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। গয়া মুন্ডা এই সেনাবাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত হন। খুঁটি, রাঁচি, চক্রধরপুর, বুন্দু, তামার, তোরপা, কারাবাসিয়া প্রভৃতি স্থানে তাদের ঘাঁটি নির্মিত হয়। এদের মধ্যে খুঁটি ছিল বিরসা মুন্ডার প্রধান কার্যালয়।1899 খ্রিস্টাব্দের 24 শে জানুয়ারি রাঁচি ও সিংভূম জেলার গির্জা, থানা, সরকারি অফিস ইত্যাদি আক্রমণের দ্বারা মুন্ডা বিদ্রোহের সূচনা হয়। 1900 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। জমিদার, মহাজন, পুলিশ ও ইংরেজ কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত 9ই জানুয়ারি সইল রাকার পাহাড়ের যুদ্ধে ছোটনাগপুরের বিভাগীয় কমিশনার আর্থার ফরবেশের কাছে মুন্ডাবাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। গয়া মুন্ডা সহ বহু মুন্ডা এই যুদ্ধে নিহত হন।অনেককে বন্দি করে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।1900 খ্রিস্টাব্দের 3রা ফেব্রুয়ারি এক গোপন ঘাঁটি থেকে বিরসাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচার চলাকালীন 1900 খ্রিস্টাব্দের 9ই জুুুন কারাগারে কলেরাাা রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র 25 বছর বয়সে বিরসা মুন্ডার মৃত্যু হয়। এইভাবে অত্যন্ত নির্মমতার সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার মুন্ডা বিদ্রোহ দমন করে।
মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল
১) মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম ও প্রভাব ছিল সুদুরপ্রসারি। এই বিদ্রোহের পর সরকার মুন্ডাদের অভাব-অভিযোগ নিরসনে সচেষ্ট হন এবং তাদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যে 1908 খিষ্টাব্দে ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে মুন্ডাদের খুৎকাঠি প্রথা স্বীকার করে নেওয়া হয়। এছাড়া তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ ও বেট বেগারি প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়।
২)মুন্ডা বিদ্রোহ মূলত আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ হলেও এই বিদ্রোহের কর্মসূচি ও তাৎপর্য ছিল রাজনৈতিক। এই বিদ্রোহের মূল উদ্দেশ্য স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠা ব্যর্থ হলেও তা মুন্ডাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও মর্যাদাবোধ আনতে সক্ষম হয়েছিল।
৩) ছোট্ট একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদগাতা হিসাবে বিরসা মুন্ডা মুন্ডা উপজাতির অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, তার প্রভাব অন্যান্য উপজাতিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ছোটনাগপুরের ওঁরাও সম্প্রদায় তানা ভগৎ আন্দোলন শুরু করে।
৪)মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে বিরসা মুন্ডা তার অনুগামীদের প্রশ্নাতীত আনুগত্য অর্জন করে এবং বিদ্রোহের পর মুন্ডাদের মধ্যে বিরসা সম্প্রদায় নামের একটি স্বতন্ত্র উপজাতি শাখা আত্মপ্রকাশ করে।
৫) বিরসা মুন্ডা তাঁর অলৌকিকত্ব প্রমাণ করতে না পারলেও মুন্ডাদের মধ্যে তিনি সিংবোঙা বা সূর্য দেবতা রূপে পূজিত হতে থাকেন। বিরসা সম্প্রদায়ের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন বিরসা ভগবান।