সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের কারণগুলি কী ছিল?

Rate this post

সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের কারণগুলি কী ছিল?: সাম্রাজ্যবাদ বলতে কোন বৃহৎ রাষ্ট্রের দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের উপর উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করাকে বোঝায়। ল্যাটিন শব্দ ইম্পেরিয়া থেকে হিম্পেরিয়ালিজম বা সাম্রাজ্যবাদ এবং ল্যাটিন শব্দ কলোনিয়া থেকে কলোনি বা উপনিবেশ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ষোড়শ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্র বাণিজ্যিক অগ্রগতির প্রয়োজনে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদীর বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল নিম্নরূপ-

A)সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের রাজনৈতিক কারণ

1)উগ্র জাতীয়তাবাদ-1870 খ্রীঃ সেডানের যুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সব রাষ্ট্র ও জাতি নিজে নিজে রাষ্ট্র ও জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়। এর ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করে।

2)রাজনৈতিক ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা-এক দেশ অন্য দেশের উপর নিজের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটে। প্রধানত জাতীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্মান, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়। যেমন ইতালি ও রাশিয়ার কোন উদ্বৃত্ত উৎপাদন না থাকায় তাদের বিদেশি বাজার দখলের কোন প্রয়োজন ছিল না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তারা উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহী হয়। এছাড়া শিল্পের ক্ষেত্রে জার্মানীর থেকে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের আগ্রহেই তারা উপনিবেশ স্থাপনে এগিয়ে আসে।

B)সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক কারণ

1)পণ্য বিক্রির বাজার-অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিল্প বিপ্লব ঘটে। শিল্পোন্নত দেশগুলির কলকারখানায় বিপুল পরিমাণে পণ্য সামগ্রী উৎপাদিত হতে থাকলে নিজে দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত পণ্যাদি বিক্রির জন্য ওই সমস্ত দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অনুন্নত দেশের বাজার দখলের চেষ্টা চালায়। ফলে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের প্রসার ঘটে।

2)কাঁচামাল সংগ্রহ-শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপের শিল্প উন্নত দেশগুলির কারখানায় প্রচুর কাঁচামালের প্রয়োজন হয়, যার যোগান নিজের দেশ থেকে দেওয়া সম্ভব হতো না। তাই স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি কাঁচামাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে সেখানে উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

3)পুঁজি বিনিয়োগ-বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হবসন এবং কমিউনিস্ট নেতা লেলিন সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের কারণ হিসেবে পুঁজি বিনিয়োগের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মতে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলির উপনিবেশ বিস্তারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলেন।হবসনের মতে পুঁজিপতিরা তাদের হাতে সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ মূলধন উপনিবেশগুলিতে বিনিয়োগ করে আরো মুনাফা অর্জনের চেষ্টা চালান। লেলিন বলেন পুঁজিপতিরা বাজার দখলের থেকে উপনিবেশগুলিতে পুঁজি বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী ছিলেন।

4)শ্রমিক সংগ্রহ-শিল্প বিপ্লবের ফলে শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ ও শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রির বাজার দখলের পাশাপাশি কলকারখানাগুলিতে কায়িক শ্রম দানের জন্য সস্তায় প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। তাই ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি ইউরোপের বাইরে বিভিন্ন অনগ্রসর দেশে সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে কল-কারখানাগুলিতে প্রচুর সস্তায় শ্রমিকের যোগান অব্যাহত রাখার তো গ্রহণ করে।

C)সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের সামরিক কারণ

1)নিরাপত্তা বৃদ্ধির চেষ্টা-সাম্রাজ্যবাদের যুগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পারস্পরিক সন্দেহ ও বিদ্বেষ বৃদ্ধির দ্বারা ইউরোপে যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে নিজ নিজ দেশের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক ও নৌঘাঁটি স্থাপন করতে থাকে। ফলে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের প্রসার ঘটে। যেমন সাইপ্রাস ও কেপের মতো নৌঘাঁটি ইংল্যান্ড কেবলমাত্র দখল করেছিল নিজের নিরাপত্তা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে।

2)সামরিক মর্যাদা বৃদ্ধি-ইউরোপের বিভিন্ন দেশ নিজেদের সামরিক শক্তি ও সামরিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য উপনিবেশ স্থাপনের পন্থাকে বেছে নিয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে ফরাসীরা আফ্রিকায় ও ইতালি লিবিয়ায় সামরিক অভিযান চালায়। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন না থাকলেও শুধুমাত্র শত্রুর হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ দখল করে।

D)সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের সামাজিক কারণ

1)জনসংখ্যা বৃদ্ধি-ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপের দেশগুলিতে জনসংখ্যা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পেলে ওই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হয়। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে তাদের বাড়তি লোকজনের বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

2)সভ্যতার প্রসার-ইউরোপের কোন কোন সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাবিদ সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের কারণ হিসাবে এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত মানুষদের প্রতি ইউরোপের সাদা চামড়ার মানুষদের দায়বদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। ফরাসি লেখক জুলে ফেরি ও ইংরেজ কবি রুডওয়ার্ড কিপলিং সাদা চামড়ার মানুষদের এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত মানুষদের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।। এই দায়বদ্ধতার কারণে মিশর, নাইজেরিয়া, উত্তমাশা অন্তরীপ, মরক্কো প্রভৃতি স্থানে ইউরোপীয়রা তাদের উপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

E)সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের ধর্মীয় কারণ

1)খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার-ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করে অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতিগুলিকে আলোর জগতে আনার উদ্যোগ নিলে ওইসব ধর্ম প্রচারকদের অনুসরণ করে ইউরোপের স্বার্থান্বেষী বণিক ও রাজনীতিকরা এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করে উপনিবেশ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে ফরাসি মিশনারিগণ আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে এবং বেলজিয়ামের মিশনারিগণ কঙ্গো অঞ্চলে খুবই সক্রিয় ছিল।

2)মানব কল্যাণ-ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকগণ মানব কল্যাণ ও নিপীড়িত জনগণের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যাত্রা করেন। লন্ডন মিশনারি সোসাইটির মিশনারি ডক্টর ডেভিড লিভিংস্টোন আফ্রিকায় প্রবেশ করে চিকিৎসালয় স্থাপনের দ্বারা মানবকল্যাণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ফরাসি মিশনারীগণ ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যালয়ে ও চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে মানব কল্যাণে ব্রতী হন।

F)সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের প্রযুক্তিগত কারণ

আধুনিক ঐতিহাসিকরা সাম্রাজ্যবাদের উপাদান হিসেবে প্রযুক্তিবিদ্যার ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন। লিওনার্ড থমসনের মতে, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, যন্ত্রচালিত যানবাহন ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের অভিযান স্পৃহা বাড়িয়ে তুলেছিল। এছাড়া উন্নত প্রযুক্তিতে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ নেভি লীগ, জার্মান নেভি লীগ প্রভৃতি নৌ সংগঠনগুলি উপনিবেশ বিস্তারের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। ফলে উক্তদেশ গুলি উপনিবেশ বিস্তারে আগ্রহী হয়েছিল।

Leave a Comment