জল দূষণ কাকে বলে? জল দূষণের কারণ ও ফলাফল?: জলের অপর নাম জীবন। জীবনধারনের জন্য প্রতিটি জীবেরই জলের প্রয়োজন হয়। ভূপৃষ্ঠের মোট জলভাগের ৯৭.৩% সামুদ্রিক জল এবং মাত্র ২.৭% মিষ্টি জল। কৃষিকাজ, শিল্পোৎপাদন, গৃহস্থালীর কার্যাদি, যাতায়াত ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই জলের প্রয়োজন হয়।
কিন্তু মানুষের অদূরদর্শী ক্রিয়াকলাপের ফলে বিভিন্ন ধরণের জলদূষক পদার্থ স্থলভাগের মিষ্টি জলে ও সমুদ্রের জলে ক্রমাগত মিশছে। এর ফলেই ঘটছে জলদূষন। এই পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল জলে আবৃত হলেও জল দূষণ ও জলের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে জীবের প্রয়োজনীয় জলের সঙ্কোচন ক্রমাগত ঘটছে।
জলদূষন কাকে বলে? জলে কোনো অবাঞ্ছিত পদার্থ মিশলে জলের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয় এবং তার ফলে উদ্ভিদ, প্রানী ও মানুষের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে জলের সে খারাপ অবস্থাকে জলদূষন বলে। বিজ্ঞানী সাউথউইক এর মতে মানুষের কর্মকাণ্ড ও প্রাকৃতিক কারণে জলের প্রাকৃতিক, রসায়নিক এবং জৈব উপাদান গুলির গুনগত মান নষ্ট হওয়াকে জলদূষন বলে।
জলদূষক: বিভিন্ন উৎস থেকে নির্গত যে সব পদার্থ জলকে দূষিত করে সেগুলিকে কয়েকটি শ্রেনীতে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।
১] বিভিন্ন জৈব পরিপোষক – মানুষ ও প্রানীর বর্জ্য পদার্থ ও অন্যান্য জৈব আবর্জনা, পলি প্রভৃতি।
২] অজৈব পরিপোষক – নাইট্রোজেন, ফসফরাস, ডিটারজেন্ট প্রভৃতি।
৩] রোগ জীবাণু – বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্যারাসাইট প্রভৃতি।
৪] জৈব দূষক – কীটনাশক, পলিক্লোরিনেটেড, বাইফিনাইল প্রভৃতি।
৫] অজৈব পদার্থ – পারদ, সিসা, ক্যাডমিয়াম প্রভৃতি ধাতু, আর্সেনিক নাইট্রেট প্রভৃতি লবন।
৬] তেজস্ক্রিয় পদার্থ – ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি।
৭] তাপীয় দূষক – তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গরম জল।
নর্দমার দূষিত জল – জলদূষণের প্রধান কারণ গুলির মধ্যে অন্যতম হল নর্দমা বা নিকাশি ব্যবস্থার মাধ্যমে দূষিত জলকে সরাসরি নদী বা অন্যান্য জলাশয়ে ফলে দেওয়া। এই নিকাশি জলের মধ্যে থাকে মানুষ ও প্রানীর বর্জ্য পদার্থ, খাবারের অবশিষ্টাংশ, কাপড় পরিস্কারের দূষিত জল, ডিটারজেন্ট ও রঙ প্রভৃতি জলদূষক। এই নিকাশী দ্বারা দূষিত জল রোগ বহনকারী বিভিন্ন জীবানু যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীর উৎস। এই দূষিত জল থেকেই কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড প্রভৃতি জলবাহিত রোগ ছড়ায়। তাছাড়া ব্যাকটেরিয়া গুলি জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন শোষণের মাধ্যমে জলে অক্সিজেনের পরিমান কমিয়ে দেয়, দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান হ্রাস জলজ বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংসের মুখে ঢেলে দেয়।
অজৈব যৌগ ও খনিজ পদার্থ – খনি ও শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যের মধ্যে থাকা অ্যাসিড, খনিজ তন্তু ও ভারী ধাতু জলদূষণের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন উৎস। ভারী ধাতু যেমন – আর্সেনিক, কোবাল্ট, কপার, পারদ, সিসা, ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি জলের সাথে মিশে গিয়ে জল কে দূষিত করে।
সিনথেটিক জৈব যৌগ সমূহ – বিভিন্ন ধরণের সিন্থেটিক জৈব যৌগ গুলি জলদূষণের উৎস হিসাবে কাজ করে। এই ধরণের সিন্থেটিক জলদূষকের প্রধান উৎস হল – জ্বালানি, প্লাস্টিক তন্তু, দ্রাবক, ডিটারজেন্ট, পেইন্টের রঙ, খাদ্য সংযোজন, ওষুধ প্রভৃতি । কখনো কখনো ক্লোরিন জাতীয় পদার্থ সমূহ সদিচ্ছাকৃত ভাবে জলের সাথে মেশানো হয়, যা জলকে দূষিত করে দেয়। জলে এই সব পদার্থ থাকলে জলে বসবাসকারী মাছ ও জলজ উদ্ভিদের স্বাদ, গন্ধ ও বর্নের পরিবর্তন সাধিত হয়।
খনিজ তেলের মিশ্রন – জলের সাথে পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থের মিশ্রনের ফলে জলের গুনমানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন উৎস থেকে খনিজ তেল জলের সাথে এসে মিশ্রিত হয়, যেমন – তেলবাহী ট্যাঙ্কারের দূর্ঘটনা, তেলের উত্তোলনের সময়, ইচ্ছাকৃত ভাবে জাহাজ থেকে সমুদ্রে তেল ফেলা ও আবার কখনো কখনো স্বাভাবিক ভাবে ভূগর্ভস্থ খনিজ তেল ভূ-গর্ভের বাইরে বেরিয়ে এসে জলকে দূষিত করে দেয়।
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য – পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ গুলি মূলত ভূগর্ভে প্রোথিত করা হয়, যা ধীরে ধীরে ভূগর্ভস্থ জলের সাথে মিশ্রিত হয়ে ভৌমজলকে দূষিত করে দেয়। আবার বর্তমান সময়ে পারমানবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা গুলি সমুদ্র পৃষ্ঠে করা হয়, যার দরুন সমুদ্রের জল দূষিত হয়ে পড়ে।
শিল্প কারখানার দূষিত নোংরা জল – বিভিন্ন শিল্প কারখানার দূষিত নোংরা জলকে পরিশোধিত না করেই সরাসরি কোন নদী বা জলাশয়ে ফেলা দেওয়ার ফলে জলদূষন ঘটে। কাপড়, চিনি, সার শিল্প কারখানা, তৈল শোধনাগার, ওষুধ, রাবার, কৃত্রিম তন্তু ও কাগজ শিল্পকেন্দ্র প্রভৃতি প্রতি শিল্প কেন্দ্র থেকে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক পদার্থ জলে মিশে জলের রাসায়নিক দূষণ ঘটায়।
বিষাক্ত কীটনাশকের ব্যবহার – বিভিন্ন ধরণের বিষাক্ত কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, হার্বিসাইট, নেমাটিসাইট কৃষিক্ষেত্রে ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। এগুলির মধ্যে ক্লোরিনযুক্ত হাইড্রোকার্বন, জৈবফসফেট, ধাতব লবন, কার্বনেট, অ্যাসিটিক অ্যাসিড প্রভৃতি বিষাক্ত পদার্থ থাকে এবং এদের মধ্যে বেশ কিছু কখনো ক্ষয় হয় না, ফলস্বরূপ এগুলি খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে পুষ্টিস্তরের বিভিন্ন জীবের দেহে সঞ্চিত হয়ে স্বাস্থ্য জনিত সমস্যার সৃষ্টি করে।
তাপীয় দূষন – তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলি জলের তাপীয় দূষণের প্রধান উৎস। এই সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শীতলীকরনের কাজে ব্যবহৃত গরম জল গুলি সরাসরি নদী বা অন্যান্য জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়, যার ফলে জলের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রানী গুলি মারা যায় এবং জলজ উদ্ভিদের শ্বাস প্রশ্বাসের ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়।
ভৌমজল দূষণ – ভূপৃষ্ঠের দূষিত জল সেপ্টিক ট্যাঙ্ক, মলকুন্ড, তেলের কূপ, আবর্জনাসমৃদ্ধ পুকুর প্রভৃতির মাধ্যমে চুইয়ে ভূগর্ভে প্রবেশ করে এবং ভৌমজলকে দূষিত করে। এই দূষিত ভৌমজল পানীয় বা সেচের কাজে ব্যবহারের ফলে মানুষ, উদ্ভিদের দেহে তা সংক্রামিত হয়।
খনি থেকে নিষ্কাসিত অ্যাসিড – কয়লা খনি গুলি বিশেষত যেগুলি পরিত্যক্ত হয়েছে সেগুলি থেকে নিষ্কাসিত জলে প্রচুর পরিমানে সালফিউরিক অ্যাসিড ও ফেরিক হাইড্রোক্সাইড থাকে, যা নিকাশীর মাধ্যমে নদীতে মিশে জলজ বাস্তুতন্ত্রকে বিঘ্নিত করে।
পলি বা কর্দম জাতীয় পদার্থ – বিভিন্ন প্রাকৃতিক মাধ্যমের দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয় পেয়ে অতি সূক্ষ্ম কনায় পরিনত হয়, তারপর সেগুলি জল ও বায়ু দ্বারা বাহিত হয়ে নদী বা অন্য কোন জলাশয়ে পড়ে জলে দ্রবীভূত হয়ে জলের স্বচ্ছতা হ্রাস করে এবং জলজ জীব কুলের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে।