চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন জীবনী: gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Chandrasekhara Venkata Raman Biography in Bengali. আপনারা যারা চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন (C. V. Raman) সম্পর্কে জানতে আগ্রহী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন (C. V. Raman) কে ছিলেন? Who is Chandrasekhara Venkata Raman (C. V. Raman)?
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন (C. V. Raman) (তামিল: சந்திரசேகர வெங்கடராமன்) ভারতীয় বিজ্ঞানী যিনি রামন ক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ১৯৩০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল পুরস্কারের বিষয় ছিল আলোর বিচ্ছুরণের ক্ষেত্রে তাঁর মৌলিক আবিষ্কার। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরও ১৯৮৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন কেবল ভারতবর্ষেই নয় গোটা পৃথিবীতেই এমন পরিবারের জুড়ি দুর্লভ, যেখানে মাত্র ৫৩ বছরের ব্যবধানে একই বিষয়ে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দুজন বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। এই দুজন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীর একজন হলেন চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন, নোবেল পান ১৯৩০ খ্রিঃ। দ্বিতীয়জন সুব্রহ্মনিয়ম চন্দ্রশেখর, নোবেল পান ১৯৩০ খ্রিঃ। চন্দ্রশেখর সম্পর্কে রামনের ভাইপো, বড়ভাইয়ের বড় ছেলে।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন জীবনী – Chandrasekhara Venkata Raman Biography in Bengali
নাম | চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন (C. V. Raman) |
জন্ম | 7th নভেম্বর 1888 |
পিতা | আর. চন্দ্রশেখর আইয়ার (R. Chandrasekhar Iyer) |
মাতা | পার্বতী আম্মাল (Parvathi Ammal) |
জন্মস্থান | তিরুচ্চিরাপল্লী, ভারত |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | পদার্থবিদ, বৈজ্ঞানিক |
মৃত্যু | 21st নভেম্বর 1970 (বয়স 82) |
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর জন্ম: Chandrasekhara Venkata Raman’s Birthday
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন (C. V. Raman) ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Chandrasekhara Venkata Raman’s Parents And Birth Place
রামনের জন্ম হয়েছিল ১৮৮৮ খ্রিঃ ৭ ই নভেম্বর তামিলনাড়ুর তিরুচিরপল্লী শহরের তিরুবনইক্কবল গ্রামে। তার পিতা চন্দ্রশেখর আইয়ার ছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। আট ভাইবোনের মধ্যে রামন ছিলেন মেজ।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর শিক্ষাজীবন: Chandrasekhara Venkata Raman’s Educational Life
সবার আগ্রহ ও যত্নে ছেলেবেলাতেই বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন রামন। অসাধারণ মেধা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। স্কুলের প্রতিটি পরীক্ষাতেই বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে শিক্ষকদেরও বিস্মিত করেছিলেন তিনি।
মাত্র এগারো বছর বয়সেই প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেছিলেন রামন৷ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ইংরাজি ও পদার্থ বিদ্যায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য পেয়েছিলেন দুটি সোনার মেডেল।
উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিলেত যাবারই কথা হয়েছিল। কিন্তু দুর্বল শরীরে বিদেশ বাসের ধকল সইবে না বলে ডাক্তারের পরামর্শে ১৯০৪ খ্রিঃ ভর্তি হলেন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যার এম.এ ক্লাসে।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর প্রথম জীবন: Chandrasekhara Venkata Raman’s Early Life
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হবার আগেই নিজের মত করে গবেষণার কাজ আরম্ভ করলেন রামন। প্রস্তুত করলেন দুটি গবেষণাপত্র ৷ প্রথম গবেষণার বিষয় আলোর প্রতিসম বিবর্তন। দ্বিতীয় প্রবন্ধটির বিষয় তরলের পৃষ্ঠটান। গবেষণা দ্বারা তিনি তরলের পৃষ্ঠটান পরিমাপের পদ্ধতিও বার করলেন।
প্রবন্ধ দুটি যথাসময়ে প্রকাশিত হল লন্ডনের বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে। জীবনের প্রথম থেকে আলো নিয়েই বিজ্ঞানী জীবনের যাত্রা শুরু করলেন রামন।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর বিবাহ জীবন ও পরিবার: Chandrasekhara Venkata Raman’s Marriage Life And Family
১৯০৭ খ্রিঃ এম.এ – তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করলেন। সেই সময়ে, পরাধীন ভারতে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতেই মেধাবী ছাত্ররা বেশি আগ্রহ বোধ করত। আনুষঙ্গিক সুখ সুবিধার সঙ্গে মাইনেও ছিল খুবই লোভনীয়। রামনের বড়ভাই ছিলেন সিভিলিয়ান। তিনিও অগ্রজের পথই অনুসরণ করলেন। আই.এফ.সি.এস অর্থাৎ ভারতীয় ফিনান্সিয়াল সিভিল সার্ভিসে সহকারী অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের পদে যোগ দিলেন রামন। তার কর্মস্থল হল কলকাতায় ৷ ইতিমধ্যে বিয়েও করলেন। স্ত্রীর নাম লোকসুন্দরী। ১৯০৭ খ্রিঃ জুন মাসের সাত তারিখে কলকাতার বাসাবাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে চলে এলেন রামন।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর কর্ম জীবন: Chandrasekhara Venkata Raman’s Work Life
অর্থ ও প্রতিষ্ঠার নিশ্চিন্ত ভোগ সুখের জীবন তার। কিন্তু মানসিক তৃপ্তির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল গবেষণার নেশা। উনবিংশ শতাব্দীর ভারতের শিক্ষা – সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতা। এখানে কি গবেষণার উপযুক্ত একটি স্থানের অভাব হবে?
কোথায় যাবেন কার সঙ্গে দেখা করবেন এমনি ভাবনা চিন্তা নিয়ে চলাফেরার পথেই একদিন উপস্থিত হলেন ভারত বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স – এর দপ্তরে।
ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণার সূতিকাগার বলে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল বিজ্ঞানমনস্ক চিকিৎসক ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের অর্থ সাহায্যে ও উদ্যোগে। বিজ্ঞান – বিমুখ ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞান চর্চার প্রচার ও প্রসারের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই মানুষটি একরকম একক চেষ্টাতেই গড়ে তুলেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে অবশ্য বিজ্ঞান গবেষণার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরি। সেখানে স্বমহিমায় বিরাজিত বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীযুগল পি.সি এবং জি.সি। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অব সায়েন্স – সংস্থা হয়ে পড়েছিল যথেষ্টই নিষ্প্রভ। সেই অবস্থাতেই, সব জেনে শুনেই রামন স্থির করলেন এই অবহেলিত সাধন ক্ষেত্রই হবে তার গবেষণার পীঠভূমি।
কিন্তু উচ্চপদের চাকরি বজায় রেখে বিজ্ঞানের গবেষণা চালানো কি সহজ কাজ ? করতে হবে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। পিছপা হলেন না রামন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সময় ছকে বেঁধে নিলেন নির্মম ভাবে। নির্মম ভাবে বলছি এই কারণে যে তখন তার ঘরে সদ্য পরিণীতা পত্নী লোকসুন্দরী। জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রের আহ্বানে সামান্য আত্মসুখকে নিতান্ত তুচ্ছ বলেই গণ্য করলেন তিনি।
ভোরে ঘুম ভাঙ্গতেই ছুটে আসতেন গবেষণাপীঠে। বাড়ি ফিরে যেতেন দশটা নাগাদ, সামান্য কিছু মুখে গুজেই ছুটতেন চাকুরিস্থলে। বিকেল পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়ে সরাসরি এসে বসতেন গবেষণার টেবিলে। মুখবুজে কাজ করে যেতেন টানা। রাত দশটার আগে কোনদিনই বাসায় ফিরতে পারতেন না।
রোববার বা অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতে গোটা দিনই কাটাতেন গবেষেণা নিয়ে। লোকসুন্দরী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তার কর্মব্যস্ত স্বামীর মধ্যে ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ভবিষ্যৎ এক মহাবিজ্ঞানীর সম্ভাবনা। তাই বৃহত্তর স্বার্থের মুখ চেয়ে আত্মস্বার্থ ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হন নি। কায়মনোবাক্যে প্রতিনিয়ত স্বামীকে উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়ে গেছেন।
টানা দশ বছর ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান এ একক গবেষণায় কাটিয়ে দিলেন রামন। ততদিনে তার উৎসাহ আরও অনেক তরুণ বিজ্ঞানীকে টেনে নিয়ে এসেছে অ্যাসোসিয়েশনে। গবেষণার কাজে জমজমাট হয়ে উঠেছে ডাঃ মহেন্দ্রলালের স্বপ্নের বিজ্ঞান কেন্দ্র।
এই দশ বছরে রামনের কাজের সূত্রে এখানে তৈরি হয় ২৭ টি গবেষণা নিবন্ধ। বিদেশের বিজ্ঞান পত্রিকায় সেগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারেই ছাপা হয়েছে। এই সূত্রেই আসে ১৯১২ খ্রিঃ কার্জন পুরস্কার এবং ১৯১৫ খ্রিঃ উডবার্ণ মেডেল। ভারতবর্ষ ছাপিয়ে বিদেশেও পরীক্ষা আশ্রয়ী গবেষণার অন্যতম কেন্দ্র রূপে অ্যাসোসিয়েশনের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
ইতিপূর্বে ১৯০৬ খ্রিঃ স্যার আশুতোষের উদ্যোগে কলকাতার রাজাবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সায়েন্স কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষের স্বপ্ন ছিল কলকাতাতেই গড়ে তুলবেন উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষার একটি কেন্দ্র। সায়েন্স কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার দীর্ঘলালিত স্বপ্নই বাস্তবে রূপ পেল।
অবশ্য এই মহৎ উদ্যোগ সার্থক করার জন্য সর্বতোভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের দুই প্রবাদপ্রতিম আইনজীবী রাসবিহারী ঘোষ ও তারকনাথ পালিত। তাঁদেরই অর্থ সাহায্য ও প্রদত্ত জমিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সায়েন্স কলেজ।
স্যার আশুতোষ এই নব প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তনে নিয়ে এলেন দিকপাল অধ্যাপকদের। প্রথমে তিনটি বিষয় নিয়ে এম.এসসি ক্লাসের পড়াশুনা শুরু হল। রসায়নের পালিত অধ্যাপকের পদে এলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ফলিত গণিতের প্রধান হলেন গণেশপ্রসাদ। পদার্থবিদ্যার ঘোষ অধ্যাপক চেয়ারে এলেন দেবেন বোস।
পদার্থবিদ্যার লেকচারার পদে পরবর্তী সময়ে যোগ দিয়েছেন তিন স্নাতকোত্তর তরুণ। এরা হলেন মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস ও শিশির মিত্র। পরবর্তীকালে এই তিন জনই নিজেদের প্রতিভার অবদানে বিশ্ববিজ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে বিশ্বসভায় ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তখনো পর্যন্ত পদার্থবিদ্যার পালিত অধ্যাপকের পদটি শূন্য রয়েছে। প্রতিভা নির্বাচনের পাকা জহুরী স্যার আশুতোষ এই পদের জন্য রামনকেই নির্বাচন করলেন।
রামন তখন সিভিলিয়ানের চাকরিতে তৎকালীন সময়ের হিসাবে বিশাল অঙ্কের অর্থ এগারোশো টাকা মাইনে পাচ্ছেন। এছাড়া রয়েছে আনুষঙ্গিক নানা সুযোগ – সুবিধা। কিন্তু তাঁর কাছে যখন স্যার আশুতোষের অধ্যাপনা ও গবেষণার আহ্বান এলো, মুহূর্ত মাত্র দ্বিধা করলেন না উচ্চমাইনের লোভনীয় সরকারী চাকুরি ছুঁড়ে ফেলতে। মাত্র ছশো টাকা মাস মাইনেতে হাসিউজ্জ্বল মুখে সায়েন্স কলেজে এসে ঢুকলেন।
এভাবেই কত স্বজাতিপ্রেমী মনীষীর বিন্দু বিন্দু আত্মত্যাগে গড়ে উঠেছে আধুনিক ভারতের শিক্ষা – সংস্কৃতির বেদীভূমি। রামনের চাকরি পরিবর্তনের প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী বলেছিলেন, “আশুতোষ মুখার্জি যদি রামনকে ওভাবে বিজ্ঞান কলেজে টেনে না নিতেন তাহলে একজন সৎ সিভিলিয়ান হিসেবে বড়জোর অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল হতেন।”
কেবল রামনই নন, বাংলার বাঘ আশুতোষ এমনি অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভারই বিকাশলাভের পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে দেশের অগ্রগতিতে বেগ সঞ্চার করেছিলেন। স্যার আশুতোষের আহ্বানে বিজ্ঞান কলেজ কাকে পায় নি ? বাংলার মাটি থেকে এসেছিলেন মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস, শিশির মিত্র, রাজচন্দ্র বসু, নীলরতন ধর, প্রশান্ত মহলানবীশ, বীরেন গুহ, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞান মুখোপাধ্যায়, দেবেন বোস প্রভৃতি।
বাংলার বাইরে থেকে এসেছিলেন কে.এস.কৃষ্ণান, সিভি রামন প্রমুখ। নবপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তন হলেও রামন সায়েন্স কলেজে এসে পেলেন গবেষণার প্রশস্ত সুযোগ ও সঙ্গ। গবেষণার প্রতি অনুরাগ লক্ষ করেই স্যার আশুতোষ রামনকে অধ্যাপনার তুলনামূলক কম দায়িত্বের পালিত অধ্যাপকের পদে নিয়োগ করেছিলেন। সেই সুযোগের পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছিলেন রামন। নিশ্ছিদ্র গবেষণার কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে ৷
প্রথম তিন বছর এভাবেই চলল। তারপর থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ক্লাশে তড়িৎ ও চুম্বকতত্ত্ব নিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। একবছরের মাথায়ই বিষয় পরিবর্তন করে নিলেন ভৌত আলোকবিদ্যা। অধ্যাপক হিসেবে তিনি অল্পদিনের মধ্যেই ছাত্রদের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠলেন। ইতিমধ্যে রামন তাঁর বাসা তুলে নিয়ে এসেছেন অ্যাসোসিয়েসনের কাছে। অধ্যাপনার ফাঁকে প্রায় সময়েই চলে আসেন এখানকার গবেষণার টেবিলে। কলেজের চাইতে এখানেই যেন তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
এদিকে বিশ্বজুড়ে প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ সদ্য থিতিয়েছে। ভারতে তার বিধ্বংসী প্রভাব এতটা পড়েনি এই রক্ষা। কিন্তু ১৯১৯ খ্রিঃ সারা ভারত জুড়ে তীব্রতর হল স্বাধীনতা আন্দোলন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহাত্মা গান্ধী। স্বদেশীয়ানার ঢেউ কলকাতাকে করে তুলেছে উত্তাল। এই সময়ে অ্যাসোসিয়েশনের অবৈতনিক সম্পাদক মনোনীত হলেন রামন। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন ও গবেষণা দুয়েরই দায়িত্ব চাপল তার কাঁধে। অ্যাসোসিয়েশনের ল্যাবরেটারিগুলিতে জোরকদমে চলছে নানান গবেষণা।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর বিজ্ঞানচর্চা:
১৯২১ খ্রিঃ রামন ইংলন্ড যান। ফিরে এসেই অ্যাসোসিয়েশনে আরম্ভ করেন আলোর বিক্ষেপণ নিয়ে গবেষণা। এই আলোক – গবেষণার দৌলতেই তিনি বিশ্বখ্যাতি লাভ করেন ১৯২৪ খ্রিঃ। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই রয়াল সোসাইটির ফেলো হলেন।
এক্স – রশ্মিকে পদার্থের ভেতর পাঠিয়ে তার প্রকৃতির পরিবর্তন সম্ভব করে ১৯২৪ খ্রিঃ প্রফেসর কম্পটন নোবেল পুরস্কার পেলেন। রামনের গবেষণা চলতে লাগল আলো নিয়ে। তাঁব ধারণা আলোককেও পদার্থের ভেতর পাঠিয়ে তার প্রকৃতির পরিবর্তন আনা সম্ভব।
১৯২৮ খ্রিঃ বাঙ্গালোরে বিজ্ঞানীদের এক সমাবেশে রামন তার আলোর বিকীরণ বিষয়ের আবিষ্কার পেশ করলেন। তাঁর এই আবিষ্কারই অনতিবিলম্বে সারা বিশ্বে রামন এফেক্ট নামে স্বীকৃতি লাভ করল।
পশ্চিমী জগতে কম্পটন তার গবেষণার জন্য পেয়েছিলেন অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরির সুবিধা। রামনের সেই সুযোগ ছিল না। কিন্তু ছিল অদম্য মনোবল। তারই জোরে অতি সামান্য যন্ত্রপাতি নিয়েই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি সম্পূর্ণ করলেন রামন। তবে তাঁকে এই কাজে অসামান্য সহযোগিতা করেছিলেন তারই সুযোগ্য ছাত্র তরুণ গবেষক কে.এস.কৃষ্ণান।
রামনের গবেষণা প্রবন্ধটি নেচার পত্রিকায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিজ্ঞানীমহলে হৈ চৈ বেঁধে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা একবাক্যে স্বীকার করেছিলেন, রামনের এই আবিষ্কারের ফলে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোর সুদূর বিস্তৃত সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল। এই আলোক বিক্ষেপণ জনিত আবিষ্কার দ্বারা কোয়ান্টাম তত্ত্বের সত্য পুনঃস্বীকৃত হল।
শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরমাণুবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড নতুন আবিষ্কারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ১৯২৯ খ্রিঃ রয়াল সোসাইটির সভাপতির ভাষণে বললেন, এই অসাধারণ আবিষ্কার পরীক্ষামূলক গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর পুরস্কার ও সম্মান: Chandrasekhara Venkata Raman’s Awards And Honors
নিঃসন্দেহে এর ফলে রাসায়নিক অণুর গড়ন ও কম্পনের ধরনের প্রকৃতিতে নতুন করে আলোকপাত ঘটবার সম্ভাবনা প্রবল। আশ্চর্য দূরদৃষ্টি ছিল বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডের। সেই বছরেই রামনের নতুন বিকিরণ তত্ত্বের ওপর শতাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে ভিড় করে আসতে লাগল স্বীকৃতি। ইতালির বিজ্ঞান আকাদেমি থেকে বছরের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ হিসেবে রামন পেলেন মাত্তেউচি স্বর্ণপদক। ব্রিটেন থেকে এল সরকারী খেতাব নাইট হুড। জার্মানির ফ্রাইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডি.এস.সি উপাধি দিয়ে সম্মানিত করল। এছাড়াও বহু বিজ্ঞানসভা ও বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক সদস্যপদ দিয়ে রামনকে সম্মানিত করল।
ফ্যারাডে সোসাইটি শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের এক সভায় নেতৃত্বের আহ্বান জানালেন রামনকে। পরের বছরেই এলো জগদ্বিখ্যাত নোবেল পুরস্কার। যৌবনের সাধনভূমি কলকাতা ত্যাগ করে ১৯৩২ খ্রিঃ রামন ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনসটিটিউট অব সায়েন্সের অধিকর্তার পদে যোগ দিলেন। ১৯০২ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার সর্বময় কর্তৃত্বে এই প্রথম একজন ভারতীয় অধিকার পেল ৷
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর রচনা: Written by Chandrasekhara Venkata Raman
শব্দবিদ্যার ক্ষেত্রেও রামনের যথেষ্ট কাজ স্মরণীয় হয়ে আছে। যদিও তিনি সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছিলেন আলোকবিদ্যার কাজের ওপর। ব্যাঙ্গালোরে তিনি ইনসটিটিউটে আলাদাভাবে পদার্থবিদ্যার বিভাগ গড়ে নিলেন। এখানে তার একাধিক কাজ, সবই অবশ্য আলো নিয়ে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এখান থেকে প্রকাশিত তার প্রথম গবেষণা প্রবন্ধটির নাম ছিলপাখির পালকে রঙের উৎপত্তি। এরপর প্রকাশিত হয় তার একটি বই, নাম কেলাসের পদার্থবিদ্যা। এতে স্থান পেয়েছে, পটাসিয়াম ক্লোরেট কেলাসের প্রতিফলিত আলোর বর্ণলিপি, সামুদ্রিক কড়ির বিবর্তিত আলোর বর্ণলিপি ও হীরের কেলাসের গঠন ইত্যাদি নিয়ে বিশ্লেষণ।
রামনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করা প্রবন্ধগুলির প্রথম তিনটি হল আলোকের আণবিক বিক্ষেপণ, তোবড়ান তার ও এক্স – রশ্মির বিক্ষেপণের যান্ত্রিক তত্ত্ব ও বাদ্যযন্ত্রের তত্ত্ব। ১৯৪৬ খ্রিঃ ব্যাঙ্গালোরে রামন ইনসটিটিউট তৈরি হলে তার সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হল। ইনসটিটিউটের কাজ থেকে অবসর নেন ১৯৪৮ খ্রিঃ। সেই সময় তার বয়স ষাট। চাকরি থেকে অবসর নিলেও গবেষণার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অবিচ্ছিন্নই রইল ৷ পাকাপাকিভাবে যুক্ত হলেন নিজের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর পুরস্কার ও সম্মান: Chandrasekhara Venkata Raman’s Awards And Honors
সম্মান ও পুরস্কারের স্রোতও অব্যাহতই ছিল। ১৯৫১ খ্রিঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যিাত ফিলাডেলফিয়া ইনসটিটিউট থেকে পেলেন ফ্রাঙ্কলিন পদক। তিন বছর পরেই ভারত সরকার ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত করল। ভারতের জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান লাভ করলেন ১৯৪৮ খ্রিঃ। সোভিয়েত লেনিন শান্তি পুরস্কার পেলেন ১৯৫৭ খ্রিঃ। ভারতকে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ক্ষেত্রে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রামন ৷ এ জন্য জীবনভোের তাকে অনেক বাধাবিপত্তি, অসম্মান অবহেলা ডিঙিয়ে নিজের পথ করে নিতে হয়েছে। সে এক কঠোর সংগ্রামের ইতিহাস। তরুণ বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে রামন তার জীবনসাধনার সত্য তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘ বিজ্ঞানের মূল কথা হল স্বাধীন চিন্তা ও কঠোর পরিশ্রম। যন্ত্রপাতির প্রশ্ন নিতান্তই গৌণ।
চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এর মৃত্যু: Chandrasekhara Venkata Raman’s Death
১৯৭০ খ্রিঃ ২১ শে নভেম্বর মহাবিজ্ঞানী রামন পরলোক গমন করেন।