চার্লি চ্যাপলিন জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Charlie Chaplin Biography in Bengali. আপনারা যারা চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী চার্লি চ্যাপলিন এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
চার্লি চ্যাপলিন কে ছিলেন? Who is Charlie Chaplin?
চার্লি চ্যাপলিন (ইংরেজি: Charlie Chaplin) নামেই বেশি পরিচিত স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র (১৬ এপ্রিল ১৮৮৯ – ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭) ছিলেন একজন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার। হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের শুরুর সময় থেকে মধ্যকাল পর্যন্ত তিনি তার অভিনয় ও পরিচালনা দিয়ে সাফল্যের শিখরে আরোহণ করেন।
চ্যাপলিনকে বড় পর্দার শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলেও বিবেচনা করা হয়। চলচ্চিত্র শিল্প জগতে চ্যাপলিনের প্রভাব অনস্বীকার্য। ভিক্টোরীয় যুগে তার শৈশব থেকে ১৯৭৭ সালে তার মৃত্যুর এক বছর পূর্ব পর্যন্ত তার কর্মজীবনের ব্যাপ্তি প্রায় ৭৫ বছর এবং এই সময়ে তার বর্ণাঢ্য ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে খ্যাতি ও বিতর্ক, দুইই নিম্ন থেকে শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে গেছে।
চার্লি চ্যাপলিন জীবনী – Charlie Chaplin Biography in Bengali
নাম | চার্লি চ্যাপলিন |
জন্ম | 16 এপ্রিল 1889 |
পিতা | চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র |
মাতা | হ্যানা চ্যাপলিন |
জন্মস্থান | লন্ডন, ইংল্যান্ড, যুক্তরাজ্য |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ |
পেশা | অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার |
মৃত্যু | 25 ডিসেম্বর 1977 (বয়স 88) |
চার্লি চ্যাপলিন এর জন্ম: Charlie Chaplin’s Birthday
চার্লি চ্যাপলিন 16 এপ্রিল 1889 জন্মগ্রহণ করেন।
কঠোর জীবন – সংগ্রাম আর ক্লান্তিহীন অধ্যবসায়ের বলে দীনহীন ধূলার জীবন থেকে নিজেকে পরিণত করেছিলেন পৃথিবীর অন্যতম মহত্তম ব্যক্তিতে একজন মাত্র মানুষ যাঁর হৃদয় ছিল মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা, সহমর্মিতা আর বিশ্বাসে ভরপুর, সুদীর্ঘ জীবনে যিনি বিশ্বমানবতাবোধের আদর্শকে প্রচারের মাধ্যম করেছিলেন চলচ্চিত্রকে, যিনি অন্যায়কে কোন দিন প্রশ্রয় দেননি, ভালবাসা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করেননি তাঁর নাম চার্লস চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিন নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।
চার্লি চ্যাপলিন এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Charlie Chaplin’s Parents And Birth Place
লন্ডনের ইস্ট লেনের এক দরিদ্র শিল্পী পরিবারে ১৮৮৯ খ্রিঃ ১৬ ই এপ্রিল জন্ম হয়েছিল চার্লির। তার বাবা অভিনয় করতেন থিয়েটারে, মা ছিলেন গায়িকা। বাবা যা রোজগার করতেন মদের পেছনেই তা ফুঁকে দিতেন। ফলে অভাবের সংসারে বাসা বেঁধেছিল নিত্য অশান্তি। চার্লির যখন এক বছর বয়স, আর তাঁর দাদা সিডনির চারবছর সেই সময় মা বাবা দুজনের বিচ্ছেদ হয়ে গেল।
চার্লি চ্যাপলিন এর প্রথম জীবন: Charlie Chaplin’s Early Life
দুঃখিনী মা দুই ছেলেকে নিয়ে উঠে এলেন আলো বাতাসহীন এক বস্তির অন্ধকার ঘরে। থিয়েটারে গান করে মা যা রোজগার করতেন তিনটি মানুষের কায়ক্লেশে চলে যেত। একটু বড় হয়ে মাকে সাহায্য করবার জন্য সিডনি বাচ্চাদের মধ্যে মজার মজার খেলা দেখিয়ে রোজগারের চেষ্টা করতেন। চার্লির ভারি ভাল লাগত দাদার খেলাগুলো। তিনি ভাবতেন বড় হয়ে দাদার মত খেলা দেখাবেন।
চার্লির যখন পাঁচ বছর বয়স, সেই সময় সংসারের দুঃখের অন্ধকার আরও ঘনীভূত হল। একদিন গান গাইতে গাইতে মায়েরকন্ঠস্বর কেমন বিকৃত হয়ে গেল। সে গলা আর কোন দিন স্বাভাবিক হল না — চিরদিনের জন্য তার গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। চরম দুঃখের গ্রাসে পড়লেন তিনটি অসহায় প্রাণী। এই সময়ের দিনগুলো যেন কাটতেই চাইত না। মনে হতো এই অর্ধাহার অনাহারের গ্লানিময় জীবন বুঝি এমনিই শেষ হয়ে যাবে। দাদা সিডনি ইতিপূর্বে জাহাজে চাকরি নিয়ে দূরে কোন দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন।
অসুস্থ মাকে নিয়ে একা কোন রকমে দিন গুজরান করতে লাগলেন চার্লি। এই সময় যখন যে কাজ পেয়েছেন ক্ষুধার রুটি জোগাড় করবার জন্য তাই করতে হয়েছে তাঁকে। কখনো খবরের কাগজ ফিরি করেছেন, জুতো পালিশ করেছেন, মোট বইতেও দ্বিধা করেন নি।সুঁড়িখানার সামনে মাতালদের গান শুনিয়ে, নাচ দেখিয়ে টুপি পেতে ভিক্ষেও করেছেন। এমনি করে চরম দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে বারো বছরে পা দিলেন চার্লি।
ততদিনে মা আরও নির্জীব হয়েছেন। তার বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখ, কোটরে বসা চোখ আর অনাহারে ক্লিষ্ট শরীর সহ্য করতে পারতেন না তিনি। বুকের ভেতরটা অসহ্য ব্যথায় মুচড়ে উঠত। আকুল হয়ে ভাবতেন, কবে তিনি দু’হাত ভরে মায়ের জন্য খাবার নিয়ে আসতে পারবেন — মায়ের মলিন শীর্ণ মুখে আবার হাসি দেখতে পাবেন। একদিন জাহাজ থেকে ফিরে এলেন সিডনি। কিন্তু সংসারে সাহায্য করবার মত সম্বল কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি।
এদিকে দুঃখের জ্বালা সইতে না পেরে মায়ের মাথায় দেখা দিয়েছে গোলমাল। দুভাই মিলে অগত্যা মাকে পাঠালেন পাগলা গারদে। আর নিরুপায় অবস্থায় তাঁদের উঠতে হল গিয়ে বাবার আশ্রয়ে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকা সম্ভব হল না। সৎমায়ের যাতনা ছিল অসহনীয়। কিছুদিনের মধ্যে মা ভালো হয়ে উঠলেন। আবার তিনজনে ফিরে এলেন আগের বস্তির ঘরে। ভাগ্য এবারে বুঝি কিছুটা প্রসন্ন হল।
চার্লি চ্যাপলিন এর কর্ম জীবন: Charlie Chaplin’s Work Life
সিডনির একটা চাকরি জুটল। যৎসামান্য মাইনে। কিন্তু সেই সামান্যই দরিদ্রের সংসারে অসামান্য। দাদার রোজগারে যদি কিছু যোগ করা যায় এই আশায় চার্লিও কাজের সন্ধানে পথে নামলেন। নাটক দলের আখড়া বেডফোর্ড স্ট্রিটের কাছেই ছিল বস্তিটা। প্রতিদিন সেই পথে যাতায়াতের সময় নাটক দলের অফিসগুলো চোখে পড়তো চার্লির। অভিনয় তাঁর রক্তে। ছোটবেলায় বাবার অভিনয়ও দেখেছেন দু – একবার। তখন থেকেই স্বপ্ন বাবার মত অভিনেতা হবার।
তাই কাজের সন্ধানে নেমে নাটকের দলের কথাই আগে মনে পড়ল তার। যদি কোন নাটক দলে সামান্য একটা কাজ পাওয়া যায়। কিন্তু একের পর এক অফিস ঘরগুলোর দরজা পার হয়ে যান। ভেতরে ঢোকার সাহস করে উঠতে পারেন না। একদিন মনে বল সঞ্চয় করলেন। তারপর কপাল ঠুকে ঢুকে পড়লেন এক নাটক দলের অফিস ঘরে। কিন্তু কাজের কথা পাড়তেই কেরানী ভদ্রলোক দরজা দেখিয়ে দিলেন।
সেদিনের মত নিরাশ হয়ে ফিরলেও হাল ছাড়লেন না চার্লি। দু চারদিন পর পরই গিয়ে হাজির হন সেই অফিসে। ততদিনে ভয় সঙ্কোচ কেটে গেছে। কাজ একটা তাঁর চাই যে করে হোক, কে বিরক্ত হল তা দেখলে তো চলবে না। ভাগ্যক্রমে একদিন পড়ে গেলেন মালিকের চোখে। সপ্রতিভ চার্লিকে দেখে তার ভাল লেগে গেল ৷ কাজও জুটে গেল। সেই সময় শার্লক হোমস নামে একটা নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে সেই দলের।
তাতে বিলি বলে একটা ছোট ছেলের ভূমিকায় যে ছেলেটি অভিনয় করতো, সে চলে যাবে বলে তার জায়গায় নেওয়া হল চার্লিকে। মাইনে ঠিক হল সপ্তাহে ২ পাউন্ড ১০ শিলিং। টাকাটা প্রত্যাশার চাইতেও অনেক বেশি। খুশি হয়ে চার্লি ভাবলেন, এবার বুঝি সংসারের অভাব ঘুচল। ভবিষ্যতে যাঁর অনবদ্য অভিনয় গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে তুলবে, অভিভূত করবে, সেই অবিস্মরণীয় শিল্পীর অভিনয় জীবন এভাবেই শুরু হল। এই সময় দলের সঙ্গে নাটক দেখাবার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে হয়েছে চার্লিকে।
সেই ভ্রাম্যমাণ জীবন ভাল লাগতো তাঁর। যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যে দাদাকেও নাটুকে দলে ভিড়িয়ে নিলেন চার্লি। নিজে জায়গা করে নিলেন আরো বড় দলে। তিনি তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন — ইংলন্ডের সব সেরা অভিনেতা হবেন। চার্লির অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফ্রেডকারনো নামে এক থিয়েটার মালিক। তাঁর দলের নাম কারোনার। সেখানে ফুটবল ম্যাচ নাটকে হাসির অভিনয় করবার জন্য চার্লিকে তাঁর দলে নিয়ে এলেন। সেই সময় চার্লির সতেরো বছর বয়স।
প্রথম রাতে অভিনয় করেই হল মাতিয়ে দিলেন চার্লি ! দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়লেন ৷ কৌতুক অভিনেতা হিসেবে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন চার্লি। সুনামের সঙ্গে টানা দুই বছর এই দলে অভিনয় করলেন তিনি। এখানেই তাঁর পরিচয় হল অভিনেত্রী হেটি কেটীর সঙ্গে। প্রথম আলাপেই দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। সেই প্রথম প্রেম চার্লির জীবনে। কিছুদিন মেলামেশার পর চার্লি বিয়ে করতে চাইলেন কেটীকে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন কেটীর মা। দুজনের মিলন আর সম্ভব হল না। জীবনের প্রথম প্রেমই এভাবে ব্যর্থ হল।
অনেক দিন এই ব্যর্থতার বেদনা চার্লিকে পীড়া দিয়েছিল। জীবনে কেটীর সঙ্গে আর কোনদিন দেখা হয়নি তার। কিন্তু তাঁর স্মৃতি বয়ে বেড়িয়েছেন সারা জীবন। চার্লির জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রা ১৯০৯ খ্রিঃ। নাটকের দলের সঙ্গে প্যারিসে গেলেন। এখানকার মানুষের খোলামেলা উজ্জ্বল জীবন মুগ্ধ করল তাঁকে। পাশাপাশি নিজের জীবন, জীবনযাত্রাকে খুবই অকিঞ্চিতকর মনে হল তার।
যেন তিনি অদৃশ্য কোন গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রয়েছেন। কিছুতেই বাইরে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছেন না। অথচ ক্রমাগত হাতছানি তাকে টানছে যেন অনুভব করছেন। ইংলন্ডে ফিরে এসে আবার সেই ভ্রাম্যমাণ জীবনের একঘেয়েমির সঙ্গে যুক্ত হলেন। কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেন ক্রমশই ভেতরে ভেতরে। ভাঁড়ামো, রঙ্গ তামাশা এসব যেন হঠাৎ কেমন কাটার মত বিঁধতে লাগল। অথচ এটাই তার নাটকের জীবনে বাঁধাধরা গন্ডি।
এই সময় অপ্রত্যাশিত ভাবেই চার্লির জীবনে পরিবর্তনের সুযোগ এসে গেল। আমেরিকায় দলের একটা নতুন শাখা খোলার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে একজন কৌতুকাভিনেতার প্রয়োজন পড়েছিল। কারোনার দলের মালিক ফ্রেডকারনো আমেরিকা যাবার প্রস্তাব দিতেই একরকম লুফে নিলেন চার্লি। নতুন কিছু করার জন্য ভেতরে ভেতরে তিনি প্রবল অস্থিরতা বোধ করছিলেন। ইংলন্ডে তা করবার সুযোগ ছিল না। কেননা এখানকার দর্শকরা তার রঙ্গ – কৌতুকেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। নতুন কিছু ওরা সহজে মেনে নিতে চাইবে না।
চার্লি ইংলন্ড ছেড়ে আমেরিকায় চলে এলেন ১৯১০ খ্রিঃ। প্রথম অভিনয় করলেন ৩ রা অক্টোবর নিউইয়র্কের কলোনিয়াল থিয়েটারে। নাটকের নাম আউ – হাউস। নিউইয়র্কের দর্শকদের মন জয় করে নিলেন প্রথম অভিনয়ের রাতেই। পত্র পত্রিকাতেও তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা প্রকাশিত হল। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন চার্লি। এরপর যেখানেই দলের সঙ্গে গেছেন সেখানেই তাঁর কৌতুকাভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ, আপ্লুত করেছে।
চার্লির জীবনে এভাবেই ধীরে ধীরে সৌভাগ্যের সূত্রপাত হতে লাগল। একদিন নাটক দেখতে এসেছিলেন এক সিনেমা কোম্পানির কর্মকর্তা অ্যাডাম কেসেল। চার্লির অভিনয় দেখে তিনি এমনই মুগ্ধ হলেন যে নাটক শেষ হলে নিজে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করলেন। সাগ্রহে প্রস্তাব দিলেন সিনেমায় অভিনয় করবার। ততদিনে শিল্পী চার্লির স্বকীয় চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছে। তিনি কি করতে চান, কিভাবে তা করবেন — এসব বিষয়ে পরিষ্কার একটা ছক নিজের মনে তৈরি করে নিয়েছেন। সেই সময় সিনেমা সবে হাঁটতে শিখেছে। নির্বাক যুগ। অভিনেতাদের মুখে সংলাপ থাকে না।
পরিবেশ পরিস্থিতি বোঝাবার জন্য অভিনয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে বাজনা বাজানো হয়। আমেরিকায় আসার পর এরকম দু – একটা সিনেমা দেখেছিলেন চার্লি। কিন্তু তার মোটেই ভাল লাগেনি। অভিনয়কে মনে হয়েছে নিতান্তই কৃত্রিম। আর বাজনা তো একেবারেই সামঞ্জস্যহীন। এই ধারার সঙ্গে নিজেকে জড়াবার মত মানসিক সাড়া পেলেন না চার্লি। যদিও সপ্তাহে ষোল ডলার মাইনেটা ছিল রীতিমত লোভনীয়। তবুও তিনি সিনেমার অভিনয়ের প্রথম সুযোগ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন।
কেসেল ছিলেন পাকা জহুরী। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা তাঁর। চার্লির সহজাত প্রতিভা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও চার্লিকে রাজি করতে ব্যর্থ হলেন। আমেরিকায় থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে সেবারের মত চার্লিকে ইংলন্ডে ফিরে আসতে হল। ফের এলেন দুবছর পরে। এবারে মনস্থির করেই এসেছিলেন। প্রথমেই দেখা করলেন কেসেলের সঙ্গে। জানালেন থিয়েটারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই তার কোম্পানিতে যোগ দেবেন।
কিছুদিন পরেই নাটকের সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করলেন চার্লি, যোগ দিলেন সিনেমায়। মাইনে স্থির হল সপ্তাহে পঁচিশ ডলার। নাটক দিয়ে যে অভিনয় জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল এভাবেই তার ছায়াছবির পর্দায় পদার্পণ ঘটল। তখনো হলিউড সাধারণ পর্যায়ে। সাদামাটা কিছু যন্ত্রপাতি ও ছবির সেট ছাড়া সেখানে আর কিছু ছিল না। কেসেলের সঙ্গে হলিউডে এসে চার্লির মন দমে গেল। এখানকার কাজের পরিবেশ, মানুষজন দেখে কাজের উৎসাহ ঝিমিয়ে গেল তাঁর।
তবু প্রথম একটা ছবিতে অভিনয় করলেন। নিতান্তই যেন দায়সারা ভাবে। থিয়েটারের সেই প্রণোচ্ছল টগবগে চার্লি যেন কেমন নিস্তেজ, প্রাণহীনভাবে হাতমুখ নেড়ে গেলেন কেবল। অভিনয়ের স্বতঃস্ফুর্ততার স্পর্শ তার মধ্যে ছিল না। কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে গেলেন চার্লির অবস্থা দেখে। কোম্পানির মালিক ম্যাক সেনেট তো রীতিমত নিরাশ হলেন এবং তা প্রকাশ করতেও ইতস্ততঃ করলেন না। চার্লি সরাসরি তার অভিযোগগুলি প্রকাশ করলেন। অভিনয়ে তার কোন স্বাধীনতা ছিল না।
এছাড়া সাজপোশাকও করতে হয়েছিল নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এরপর চার্লি প্রস্তাব করলেন, তাঁর মতকরে অভিনয় করতে দিতে হবে। আর সাজ পোশাক ও নিজেই ঠিক করবেন। শিল্পীর স্বাধীনতা মেনে নিলেন ম্যাক সেনেট। জানালেন, দ্বিতীয় ছবিতে তাকে অভিনয় করতে হবে এক সাংবাদিকের ভূমিকায়। সম্পূর্ণ হাসির রোল। এবারে চার্লি নিজেই পড়লেন মুশকিলে। পোশাকের ব্যাপারটা নিয়ে আগে বিশেষ কিছু ভেবে রাখেননি তিনি। অথচ তার ইচ্ছা এমন কিছু একটা করা, যা আগে কেউ কখনো করেনি। আবার তা হবে এমন, যা দেখেই দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়তে বাধ্য হবে।
চিন্তায় ডুবে গেলেন চার্লি – পোশাকটা কেমন হওয়া দরকার কেবল তাই নিয়ে। পোশাকটাই হবে অভিনীত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। চার্লি যে ঘরে থাকতেন, তার পাশের ঘরেই থাকতেন দশাসই চেহারার এক অভিনেতা ৷ তাকে লক্ষ করে হঠাৎই একদিন তার মাথায় একটা পরিকল্পনা খেলে গেল। চার্লির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দৈহিক মাপের সেই অভিনেতার ঢোলাঢালা ট্রাউজারটা পরে নিলেন। কিন্তু গায়ে চাপালেন নিজেরই ছোট হয়ে যাওয়া একটা জ্যাকেট। মাথায় পরলেন বাউলার টুপি। লম্বা টাই ঝোলালেন গলায়।
প্রতিবেশী অভিনেতার বিরাট আকারের জুতো দিয়ে পা ঢাকলেন, তবে উল্টোভাবে। এরপর হাতে নিলেন ছোট্ট ছড়ি, ঠোটের ওপরে সাঁটলেন খাটো গোফ। সাজটা উদ্ভট – বিদকুটে রকমের হলেও চার্লির বেশ মনের মতই হল। তবে সেদিন তিনি নিশ্চয় কল্পনাও করতে পারেননি যে এই বিচিত্র উদ্ভট সাজেই একদিন জগৎজোড়া খ্যাতির অধিকারী হবেন। পোশাক অনুমোদন করার পর চার্লি পাকাপাকিভাবে ঠিক করে নিলেন, এই বিচিত্র পোশাকের সঙ্গে তাঁর অভিনয়টাও হবে অদ্ভুত রকমের।
শিল্পী হিসেবে তার যা বক্তব্য তা তিনি প্রকাশ করবেন এই পোশাক ও অভিনয়ের মোড়কেই। এরপর পোশাক ও অভিনয় ভঙ্গিতে এক নতুন চার্লির আবির্ভাব ঘটল পর্দায়। যাত্রা শুরু হল চার্লি চ্যাপলিনের। এর পরে কেবল অর্থ, খ্যাতি, যশ, সম্মান — এরই ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল শিল্পী চার্লির জীবন। স্বাধীনভাবে ছবি তৈরি করার উদ্দেশ্যে চার্লি কিছুদিন পরে দুই ধনী ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় গঠন করলেন ইউনাইটেড আর্টিস্টস ফিল্মস।
১৯১৭ খ্রিঃ চার্লির সোলডার আর্মস ছবি চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা লাভ করল। ছবির সুবাদে অর্থাগম হতে থাকে স্রোতের মত। ১৯১৮ খ্রিঃ তিনি বিয়ে করলেন সুন্দরী তরুণী মিলড্রেড হ্যারিসকে। কিন্তু এই বিয়ে শান্তির হল না। অল্পদিন পরেই বিবাহ – বিচ্ছেদ হয়ে গেল। এরই মধ্যে একে একে মুক্তি পেতে লাগল চার্লির দুনিয়া কাপানো সব ছবি। দি কিড, দি পিলগ্রিম, এ উওম্যান অব প্যারিস, দিগোল্ডরাশ, দি সার্কাস, দি সিটি লাইট ইত্যাদি। শেষোক্ত ছবিতে চার্লির প্রতিভার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল।
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ছবি তার এক অনন্যসাধারণ অবদান। চার্লি আগাগোড়া সেই ঢলঢলে ট্রাউজার, পায়ে বেঢপ মাপের জুতো, গায়ে আঁটোসাটো জামা, মাথায় বাউলার টুপি ইত্যাদি নিয়ে সব ছবিতে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেছেন। হলিউডে নিজস্ব বাড়ি তৈরি হলে চার্লি সেখানে তার চিরদুঃখিনী মাকে নিয়ে এসেছিলেন। জীবনের অবশিষ্ট কাল তিনি এখানেই মাতৃভক্ত পুত্রের সেবাযত্নে সুখে অতিবাহিত করেছেন।
১৯৩১ খ্রিঃ হলিউডে নির্বাক ছবির যুগ শেষ হলে নরদানব হিটলারকে নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে নির্মিত হল চার্লির দি গ্রেট ডিকটেটর ছবি। এই ছবিতে তিনি ব্যঙ্গ – বিদ্রূপ আর কৌতুকের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুললেন হিটলারের চরিত্র। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চার্লির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, তিনি কমিউনিজম প্রচার করছেন। চার্লির ছবির বিশেষত্ব হল, মানুষের জীবনের ছোট ছোট দুঃখ, সুখ, ব্যথা বেদনা, অনুভূতির বাঙ্ময় প্রকাশ।
মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, প্রগাঢ় ভালবাসা, অন্যায়ের প্রতি ব্যঙ্গ – বিদ্রূপ ও মানবিক চেতনা তাঁর প্রতিটি ছবির মূল প্রতিপাদ্য। মঁসিয়ে ভার্দু, লাইম লাইট, এ কিং অব নিউইয়র্ক চার্লির অসামান্য ছবিগুলোর অন্যতম। ১৯১৪ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৯ খ্রিঃ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সব ছবি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন চলচ্চিত্র জগতের একচ্ছত্র অধিপতি। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ তাঁকে আপনজন বলে মেনে নিয়েছে। দেশে দেশে তিনি লাভ করেছেন রাজকীয় সম্বৰ্ধনা ৷
চার্লির চতুর্থ স্ত্রীর নাম উনা। ইনি ছিলেন আমেরিকান নাট্যকার ইউজিন ও নীলের কন্যা। চুযান্ন বছর বয়সে আঠারো বছরের উনাকে বিয়ে করেছিলেন চার্লি এবং তাঁদের বিবাহিত জীবন ছিল সুখ শান্তিতে পরিপূর্ণ। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির সপক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন চার্লি। তার জীবন ছিল অনন্য নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও মানব প্রেমের প্রতিভূস্বরূপ। আত্মজীবনীতে তাঁর জীবনবোধ ও আদর্শ অকপটভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি।
চার্লি চ্যাপলিন এর মৃত্যু: Charlie Chaplin’s Death
১৯৭১ খ্রিঃ ২৫ শে ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডের বাসভবনে বিশ্বমানবতার পূজারী ও রুপোলী পর্দার অনন্য নায়ক চার্লি চ্যাপলিনের জীবনাবসান হয়।