দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Chittaranjan Das Biography in Bengali. আপনারা যারা চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
চিত্তরঞ্জন দাশ কে ছিলেন? Who is Chittaranjan Das?
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (৫ নভেম্বর ১৮৭০ – ১৬ জুন ১৯২৫) হলেন একজন বাঙালি আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, কবি ও লেখক। তিনি স্বরাজ্য পার্টি-র প্রতিষ্ঠাতা। তার সময়ের অন্যতম বৃহৎ অঙ্কের আয় অর্জনকারী উকিল হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার সম্পদ অকাতরে সাহায্যপ্রার্থীদের কাছে বিলিয়ে দিয়ে বাংলার ইতিহাসে দানবীর হিসাবে সুপরিচিত হয়ে আছেন। তিনি “দেশবন্ধু” নামেতে জগৎ বিখ্যাত হয়ে আছেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ জীবনী – Chittaranjan Das Biography in Bengali
নাম | চিত্তরঞ্জন দাশ |
জন্ম | 5 নভেম্বর 1870 |
পিতা | ভুবনমোহন দাশ |
মাতা | নিস্তারিণী দেবী |
জন্মস্থান | কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | আইনজীবী, রাজনীতিবিদ |
মৃত্যু | 16 জুন 1925 (বয়স 55) |
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর জন্ম: Chittaranjan Das’s Birthday
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ 5 নভেম্বর 1870 জন্মগ্রহণ করেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন আসল নাম চিত্তরঞ্জন দাশ। কিন্তু দেশবাসীর শ্রদ্ধা ভালবাসা তাঁকে দেশবন্ধু আখ্যায় ভূষিত করেছিল। তিনি ছিলেন দেশবাসীর প্রাণের মানুষ। দেশবাসীর দুঃখ দুর্দশাকে তিনি অন্তর দিয়ে নিজের বলেই উপলব্ধি করতেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন প্রতিকারের, অকাতরে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। শ্রদ্ধায় – কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত দেশবাসী তাঁকে তাই দেশবন্ধু নামে আপনার করে নিয়েছে।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Chittaranjan Das’s Parents And Birth Place
অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী চিত্তরঞ্জন যে সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সেটা ছিল ভারতের নবজাগরণের যুগ। বিদেশী শাসকইংরাজের পদানত জাতির অন্তরে জেগে উঠতে শুরু করেছে জাতীয় চেতনা, স্বাধীনতার মূল্যবোধ। পরিবেশগত সমস্ত প্রভাব নিয়েই যেন তিনি জন্মেছিলেন। ১৮৭০ খ্রিঃ ৫ ই নভেম্বর চিত্তরঞ্জনের জন্ম। পিতার নাম ভুবনমোহন দাশ, মাতা নিস্তারিণী দেবী।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর শিক্ষাজীবন: Chittaranjan Das’s Educational Life
ধনীর পরিবারে জন্মেও ধনের অহঙ্কার বা বিলাসী মনোভাব তার মধ্যে কখনোই ফুটে ওঠেনি। অল্প বয়স থেকেই দয়া ও দান এই দুটি গুণ তাঁকে সকলের প্রিয় করে তুলেছিল। সহপাঠী সমবয়সীদের অভাব – অভিযোগ তাঁকে কাতর করে তুলত। চেষ্টা করতেন দুঃখী বন্ধুর দুঃখ দূর করবার। পড়াশুনায় ছিল গভীর মনোযোগ। তেমনি খেলাধুলাতেও ছিলেন চৌকস। নেতৃত্বের সহজাত প্রতিভা সেই সময়েই তাঁর মধ্যে স্ফূরিত হয়েছে।
পিতামাতার সুশিক্ষার গুণে চিত্তরঞ্জনের অস্তার্নিহিত গুণাবলী সাবলীল ভাবেই বিকশিত হয়ে উঠেছিল। তার মন ছিল, কোমল, সহানুভূতিশীল। স্বভাব ছিল নেতৃত্ব সুলভ। কিন্তু অন্যায় অথবা মিথ্যাকে কখনোই সহ্য করতে পারতেন না। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ করতেন। ১৮৮৬ খ্রিঃ চিত্তরঞ্জন এন্ট্রান্স পাশ করেন। এই সময়েই তিনি অসাধারণ বক্তৃতা করতে পারতেন। শিক্ষায়তনের বিতর্ক সভায় তার সমকক্ষ হবার যোগ্যতা কারোর হত না। সহপাঠীরা তার শ্রেষ্ঠত্ব সহজভাবেই মেনে নিতেন।
১৮৯০ খ্রিঃ বি.এ. পাস করবার পর আই.সি.এস পড়বার জন্য চিত্তরঞ্জনকে বিলেত পাঠানো হলো। তৎকালীন সময়ে আই.সি.এস পাস করে প্রভূত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও অর্থ উপার্জনের লোভনীয় আকর্ষণ শিক্ষিত তরুণদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করত। চিত্তরঞ্জনের অন্তরে ছিল দেশপ্রেম। তিনি এই চাকরিকে দেশের কাজ করার সহায়ক রূপেই বিবেচনা করেছিলেন। চাকরি সূত্রে দেশের সামাজিক এবং আর্থিক অবস্থার প্রকৃত অবস্থাটা প্রত্যক্ষ করা যায়। কেবল তাই নয়, ইংরেজদের আইনকানুন সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার এবং উপযুক্ত জবাব দেবার যোগ্যতা অর্জনের জন্যও আই.সি.এস হওয়াটাকে তিনি জরুরী মনে করেছিলেন।
বিলেতে এসে যথারীতি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন চিত্তরঞ্জন। কিন্তু তার স্বভাবজাত তেজস্বীতাই হলো তাঁর কাল। ধুরন্ধর ইংরাজরা বুঝে গেল এই স্বাধীনচেতা যুবক কখনোই ইংরাজ শাসনের সহায়ক হবে না। তাঁর ক্ষমতা লাভ হবে বিপজ্জনক। ইংরাজরা চিত্তরঞ্জনকে আই.সি. এস পরীক্ষার অনুমতি দিলেন না। চিত্তরঞ্জন এতে হতাশ হলেন না। তিনি স্থির করলেন, ব্যারিস্টারী পাশ করেই দেশে ফিরবেন।
এই সময়ে একদিন লর্ড সেলিসবেরি এবং জন ম্যাকলীন ভারতবাসীদের সম্পর্কে কিছু অপমানজনক মন্তব্য করেন। দেশবাসীর অপমানে চিত্তরঞ্জন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি লন্ডনে প্রবাসী ভারতীয়দের সংগঠিত করে একটি প্রতিবাদ সভা আহ্বান করলেন। সেই সভায় আমন্ত্রণ জানালেন ব্রিটেনের প্রধান মন্ত্রী গ্লাডস্টোনকে। সেদিনের সেই সভায় চিত্তরঞ্জনের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বিষয়টির গুরুত্ব বিশ্লেষণ এমন বুদ্ধিদীপ্ত ও তীক্ষ্ণ হল যে পরদিনই বিলেতের সমস্ত কাগজে সেই বিবরণ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হল।
ভারতীয় অভারতীয় সকল মহলেই চিত্তরঞ্জন তাঁর ব্যক্তিত্ব ও স্বদেশী চেতনার জন্য প্রশংসিত হলেন। ইংরাজরা ইতিপূর্বেই চিত্তরঞ্জনকে বিপজ্জনক ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত করেছিল। এবারে তাঁরা তাঁর সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হল। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে চিত্তরঞ্জন স্বদেশের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনের বিশিষ্টতা নতুনভাবে উপলব্ধি করলেন। তিনি তার ভবিষ্যৎ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এই সময় থেকে ছকে নিলেন। যথাসময়ে ব্যারিস্টারি পাশ করে ১৮৯৩ খ্রিঃ চিত্তরঞ্জন দেশে ফিরে এলেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর কর্ম জীবন: Chittaranjan Das’s Work Life
শুরু হলো তার কর্মজীবন- আইন ব্যবসায়। পিতা ভুবনমোহন একসময়ে অর্থবান রূপেই খ্যাত ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বভাবদাতা ৷ বিপদে পড়ে কেউ তাঁর কাছে হাত পাতলে তিনি কখনো প্রত্যাখ্যান করতেন না। ফলে নানা দিকে দানধ্যান ও অন্যান্য খাতে অর্থব্যয় করে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। শেষে নিঃস্ব হয়ে আদালত কর্তৃক দেউলিয়া প্রতিপন্ন হয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন যখন আইন ব্যবসা আরম্ভ করেন সেই সময় তার কাঁধে পিতার চল্লিশ হাজার টাকা ঋণের বোঝা।
পিতৃভক্ত চিত্তরঞ্জন অকাতরে পিতার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই আইন ব্যবসায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেন তিনি। ফলে প্রভূত অর্থাগমের সুযোগ হল। অবিলম্বেই তিনি পিতাকে ঋণমুক্ত করলেন এবং পিতার দেউলিয়া অপবাদ ঘোচালেন। সেই সময় থেকেই চিত্তরঞ্জন তার আয়ের একটা অংশ জনসেবার কাজে ব্যয় করার সঙ্কল্প করলেন। পরাধীন স্বদেশের প্রতি কর্তব্যবোধ সম্পর্কে চিত্তরঞ্জনের অন্তরে সচেতনতা পুর্ণভাবেই জাগরুক ছিল। আইন ব্যবসায় আরম্ভ করার কয়েক বছরের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
১৯০৮ খ্রিঃ আলিপুর বোমার মামলায় অরবিন্দ সহ জাতীয়তার পূজারী তরুণ বিপ্লবীরা বন্দী হন। চিত্তরঞ্জন বিনা পারিশ্রমিকে বিপ্লবীদের পক্ষ অবলম্বন করে মামলা নিজের হাতে নিলেন। আসামী পক্ষের প্রধান কৌসুলী হিসেবে অরবিন্দ প্রমুখকে সমর্থন করতে গিয়ে আদালতে তিনি যে সওয়াল করেছিলেন, তা জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। অগ্নিযুগের ইতিহাসেও তা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। মামলার শেষ শুনানীর দিনে বিচারক এবং জুরীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, “My appeal to you, therefore, is that a man like this who is being charged, charged with the offence with which he has been charged, stands not only before the bar in this court, but stands before the bar of the High Court of history and my appeal to you is this the song after the controversy will be hushed in silence, long after this turmoil, the agitation will have ceased, long after he is dead and gone, he will be looked upon as the poet of patriotism, as the prophet of nationalism and love of huminity ….. ” চিত্তরঞ্জন সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন যে, এই মামলার শুনানী আদালতে শেষ হলেও মানব ইতিহাসের বিরাট বিচারালয়ে এই মামলার শুনানী চলতে থাকবে অনন্তকাল।
আজ যিনি আসামী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, যেদিন সব বিচার বিতর্কের অবসান হয়ে যাবে, আজকের আসামীও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, সেই অনাগত যুগের মানুষের কাছে, এই অরবিন্দই দেশপ্রেমের উদগাতা বলে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সমগ্র পৃথিবী তাঁকে সেদিন মানবতার পূজারী হিসাবে শ্রদ্ধার পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করবে। তাই দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ আইনের চোখে অপরাধ হতে পারে না। দেশপ্রেমের যেই বাণী প্রচারের জন্য আজ তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন, সেদিন সেই বাণীর তরঙ্গ দেশ দেশান্তরের মানুষের অন্তরে মহাভাবের উচ্ছ্বাস জাগিয়ে তুলবে। দেশবন্ধুর অসামান্য সওয়ালের পরে অরবিন্দ মুক্তি পেলেন।
আইনের চোখে তিনি আর অপরাধী নন। বিপ্লবী মহানায়ক এক নতুন সত্তা নিয়ে কারাগারের বাইরে বেরিয়ে এলেন। দেশবন্ধুর সেদিনের ভবিষদ্বাণী ব্যর্থ হয়নি। ইংরাজের চোখে অভিযুক্ত বিপ্লবী নায়ক অরবিন্দ আজ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধা ও ভক্তির আসনে প্রতিষ্ঠিত — তিনি ঋষি অরবিন্দ। আলিপুর বোমার মামলার রায় বেরবার সঙ্গে সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের নাম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। দেশপ্রেমী ভারতবাসী অকুন্ঠ চিত্তে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তখন ঝড়ের তান্ডব।
বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলন ব্যাপকভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। একদিকে জাতীয় কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলন অপরদিকে সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত দেশপ্রেমী তরুণ সম্প্রদায়ের সহিংস আন্দোলনে দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে ! স্বাভাবিক ভাবেই এই সময়ে চিত্তরঞ্জন কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। তাঁর লক্ষ ইংরাজ রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা আদায় করে দেশের দুরপনেয় দুঃখ ঘোচানো। ভারতে ইংরাজ রাজত্বের চরম কলঙ্কময় ঘটনাটি ঘটল ১৯১৯ খ্রিঃ।
পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের জনসভায় ইংরাজসৈন্য নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শতশত নরনারীকে হত্যা করল। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে দেশময় তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ ঘৃণার সঙ্গে পরিত্যাগ করলেন ইংরাজের দেওয়া নাইট উপাধি। দেশের এই পরিস্থিতিতে ক্ষোভে দুঃখে ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠল চিত্তরঞ্জনের চিত্ত। আইন ব্যবসায় আঁকড়ে থাকা আর সম্ভব হল না তার পক্ষে। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল কংগ্রেস। গঠিত হলো তদন্ত কমিটি। চিত্তরঞ্জন হলেন এই কমিটির অন্যতম সদস্য।
বিচলিত মর্মাহত গান্ধীজি ইংরাজদের দমনমূলক নীতির প্রতিবাদে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। অমৃতসরে কংগ্রেসের অধিবেশনে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব দিলেন। সারা দেশ জেগে উঠল গান্ধীজির ডাকে। আইনব্যবসা ত্যাগ করে চিত্তরঞ্জন সামিল হলেন স্বদেশী আন্দোলনে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হল নারায়ণ পত্রিকা। এই পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি প্রচার করতে লাগলেন স্বদেশের মর্মবাণী।
১৯২০ খ্রিঃ নাগপুর কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবে গান্ধীজি ইংরাজ শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। তবে তিনি এও জানিয়েছিলেন, এই অসহযোগ হবে অহিংস। স্বাধীনতার আন্দোলন, কিন্তু গান্ধীজি তার প্রকৃতি নির্দিষ্ট করলেন, অসহযোগ এবং অহিংস শব্দ দুটি দিয়ে। ১৯২০ খ্রিঃ আগস্ট মাস থেকে দেশব্যাপী আরম্ভ হল আন্দোলন। সর্বস্তরের মানুষ দলে দলে সামিল হল এই আন্দোলনে। ইংরাজ সরকার কিন্তু বসে থাকল না। তাদের দমননীতি কঠোর থেকে কঠোরতর হল।
কিন্তু পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের প্রেরণায় জাগ্রত জনতা ইংরাজের সমস্ত অত্যাচার নির্যাতনকে উপেক্ষা করে দেশের প্রত্যন্তরে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে লাগল। ইংরাজের রক্তচক্ষু তাদের নিরস্ত করতে ব্যর্থ হল। চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে বিপ্লবের পীঠভূমি কলকাতায় আরম্ভ হলো ব্যাপক আইন অমান্য আন্দোলন। ইতিপূর্বে বিলেতে আই.সি.এস পরীক্ষায় যোগ না দিয়ে দেশসেবার ব্রতকে জীবনের লক্ষ স্থির করে দেশে ফিরে এসেছেন সুভাষচন্দ্র। চিত্তরঞ্জনের স্বদেশ ভাবনায় উদ্বুদ্ধ তিনি। গ্রহণ করলেন চিত্তরঞ্জনের শিষ্যত্ব।
কলকাতার আইন অমান্য আন্দোলনে স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠনের দায়িত্ব পেলেন সুভাষচন্দ্ৰ। তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে স্বদেশী খদ্দর কাপড় বিক্রি এবং কংগ্রেসের বাণী প্রচারে পথে নেমে এলেন। এই আন্দোলনকে জোরদার করবার উদ্দেশ্যে এবং দেশবাসীর মনে উৎসাহ উদ্দীপনা সঞ্চারের জন্য চিত্তরঞ্জন তার স্ত্রী বাসন্তীদেবী এবং পুত্র চিররঞ্জনকে পাঠিয়ে দিলেন। ফলে এক অভূতপূর্ব জনজাগরণ ঘটল কলকাতায়। ১৯২১ খ্রিঃ ডিসেম্বরে চিত্তরঞ্জন গ্রেপ্তার বরণ করলেন।
পরদিনই গ্রেপ্তার হলেন তার সহধর্মিণী বাসন্তীদেবী। আগুনে যেন ঘৃতাহুতি হল। বাসন্তীদেবীর গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সমগ্র বাংলায় দেখা দিল তীব্র উত্তেজনা। টনক নড়ল ইংরাজ প্রশাসনের। পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য সেদিনই মধ্যরাত্রে ইংরাজ শাসক বাসন্তীদেবীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল। আন্দোলন কিন্তু চলতেই লাগল। দেশপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবকের দল দলে দলে গ্রেপ্তার বরণ করল সম্পূর্ণ অহিংসভাবে। স্কুল কলেজ, অফিস আদালত, হাট বাজার সর্বত্রই আন্দোলনের স্রোত পৌঁছে গেল।
দেশব্যাপী গণজাগরণের এমন নজির মানব ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা। চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র, বীরেন্দ্র শাসমল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। খিলাফৎ আন্দোলনের নেতারাও বাদ গেলেন না। মতিলাল নেহরু, লালা লাজপত রায় প্রভৃতি কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দকেও গ্রেপ্তার করা হল। প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহ্যামের বিচারে চিত্তরঞ্জনের বিনাশ্রমে ছয় মাস কারাবাসের দন্ড হল।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইংরাজের দমন পীড়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল আন্দোলনের তীব্রতা ৷ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত অহিংস থাকল না। চোরিচৌরায় ঘটল চরম হিংসার প্রকাশ। আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আগেই গান্ধীজি বাধ্য হয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন। অশান্ত ভারতবাসীকে শান্ত রাখার জন্য ইংরাজ সরকার ইতিপূর্বে ১৯১৯ খ্রিঃ শাসন সংস্কার আইন প্রবর্তন করেছিল। তাতে ভারতবাসীকে আইনসভায় প্রবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছিল।
এই সংস্কার আইন ভারতবাসীদের সামনে একটি মহাসুযোগ বলেই গণ্য হল। কিন্তু গান্ধীজি স্বয়ং, চিত্তরঞ্জন, মতিলাল নেহরু প্রমুখ দেশের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ রয়েছেন কারাবন্দি। ফলে ভারতবাসীদের মধ্যে সৃষ্টি হল হতাশা। তাদের উৎসাহ উদ্দীপনাও স্তিমিত হতে লাগল। এদিকে খিলাফৎ আন্দোলনও বন্ধ হয়ে গেল। ফলে জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার যে মৈত্রীবন্ধন হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ছেদ পড়ল, দেশের মানসিক সঙ্কট হল তীব্রতর।
এই সময় চিত্তরঞ্জন আইনসভায় প্রবেশের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে বললেন যে সরকারের শাসনকার্য এবং দমনমূলক নীতির বিরোধিতা করতে হবে আইনসভায় নির্বাচিত হয়ে, ভেতরে থেকে। গান্ধীজি এই সময় কারাগারে থাকায় তার অনুগামীদের বিরোধিতায় এ নীতি কংগ্রেস কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। ১৯২২ খ্রিঃ কংগ্রেসের অধিবেশন বসল গয়ায়। সভাপতিত্ব করলেন চিত্তরঞ্জন। এই অধিবেশনে আইনসভায় প্রবেশের প্রশ্নে নেতাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল।
শেষ পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন তাঁর অনুসারী মতিলাল, সত্যমূর্তি, হাকিম আফজল খাঁ, বিটলভাই প্যাটেল, মদনমোহন মালব্য প্রমুখ নেতাদের নিয়ে স্বরাজ্যপার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করলেন। পরে অবশ্য এই পার্টি কংগ্রেসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। স্বারাজ্য পার্টির সভাপতি হলেন চিত্তরঞ্জন, সম্পাদক হলেন মতিলাল নেহরু। চিত্তরঞ্জনের তৎপরতায় এই দল ক্রমে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ইংরাজ সরকারের ঘোষণাক্রমে ১৯২৩ খ্রিঃ নভেম্বর মাসে আইনসভার নির্বাচন হল।
চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ্য দল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করল। বাজধানী দিল্লীর কেন্দ্রীয় আইনসভায় স্বরাজ্য দল ১০৫ টি আসনের মধ্যে ৪০ টি আসন লাভ করল। জিন্নার নেতৃত্বে ২৪ জন মুসলিম প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। দুই দলের নেতাদের সমঝোতার ফলে মতিলালের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ দল গড়ে ওঠে। স্বরাজ্য দল ও মুসলমান নেতাদের মধ্যে এই সময় যে চুক্তি হয় তা বেঙ্গল অ্যাক্ট নামে খ্যাত। ঐক্যবদ্ধ শক্তির বলে আইন সভায় ইংরাজের বহু প্রস্তাব, এমন কি বাজেট প্রস্তাবও এই দল বাতিল করে দিতে সমর্থ হয়।
স্বারাজ্য পার্টির আদর্শ ও কর্মপন্থা প্রচারের উদ্দেশ্যে পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই চিত্তরঞ্জন ফরোয়ার্ড নামে একটি ইংরাজি পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। এই পত্রিকার লেখার মাধ্যমে তিনি জনসাধারণের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চারে সমর্থ হয়েছিলেন। স্বরাজ্য দলের প্রতিষ্ঠায় চিত্তরঞ্জনের এই ফরোয়ার্ড পত্রিকার প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। চিত্তরঞ্জনই কলকাতা করপোরেশনের প্রথম মেয়র হন এবং সুভাষচন্দ্র হন প্রথম প্রধান অফিসার।
ইংরাজ সরকার স্বরাজ্য দলকে দমনের জন্য ১৯২৪ খ্রিঃ বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারি করে। গ্রেপ্তার হন সুভাষচন্দ্র প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। চিত্তরঞ্জন এই সময় নিজের বাড়িতেই নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকের আহ্বান জানান ৷ গান্ধীজি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সরকারের নতুন অর্ডিন্যান্স জারির উদ্দেশ্য। তাই তিনি এরপর থেকে দেশবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে থাকেন৷
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর মৃত্যু: Chittaranjan Das’s Death
অত্যধিক পরিশ্রমে চিত্তরঞ্জনের শরীর দ্রুত ভেঙ্গে পড়ছিল। চিকিৎসকরা তাকে সুচিকিৎসা ও বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের শরীর স্বাস্থ্য জীবনের চাইতে দেশের মানুষের সেবাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি। তাই পরিশ্রম ও চিন্তা ভাবনার বিরাম ছিল না। অসুস্থ শরীর নিয়েই আরাম কেদারায় শুয়ে তিনি আইনসভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অসুস্থতা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল।
ফলে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য তাকে দার্জিলিঙে যেতে হল। দেশবিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় চিত্তরঞ্জনের চিকিৎসা করতেন। কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে চিত্তরঞ্জন মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে ১৯২৫ খ্রিঃ ১৬ ই জুন দার্জিলিঙে পরলোক গমন করেন। দেশবন্ধুর মৃত্যু ছিল ইন্দ্রপতনের মত এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ।
দাবানলের মত তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। শোকে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গেল ভারতবাসী। মহাত্মা গান্ধী সহ দেশের বিশিষ্ট নেতারা ছুটে এলেন দেশের মহান নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। রবীন্দ্রনাথ তার শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখলেন, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান ! ’
বাংলার বিদ্রোহী কবি নজরুল প্রশস্তি রচনা করলেন, দীনের বন্ধু, দেশের বন্ধু, মানব বন্ধু তুমি, চেয়ে দেখ আজ লুটায় বিশ্ব তোমার চরণ চুমি। চিত্তরঞ্জনের শেষ যাত্রায় কলকাতায় যে লোক সমাগম হয়েছিল তা আজও ইতিহাস হয়ে আছে ! দেশের সেবার জন্য দেশবন্ধু তাঁর সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত আইন ব্যবসায় পরিত্যাগ করেছিলেন।
তার এই অসামান্য ত্যাগের ফলে সমগ্র ভারতের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়, বাংলার মানুষ তাঁকে দেশবন্ধু অভিধায় ভূষিত করে। পেশা পরিত্যাগ করে তিনি ও তাঁর পরিবারবর্গ তাঁদের অভ্যস্ত বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে সর্বহারা সন্ন্যাসীদের মত জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়েছেন। মৃত্যুর পূর্বে দেশবন্ধু তার পৈতৃক বসতবাটি জনসাধারণকে দান করেন। এখন সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশবন্ধু নামাঙ্কিত চিত্তরঞ্জন সেবাসদন।
রাজনীতির কর্মব্যস্ততার মধ্যে থেকেও চিত্তরঞ্জন নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করতেন। সাহিত্যপ্রতিভা ছিল তার সহজাত। তার প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ পত্রিকা তৎকালীন সময়ে খ্যাতি লাভ করেছিল। মালঞ্চ সাগরসঙ্গীত ও অন্তর্যামী প্রভৃতি গ্রন্থ কবি ও লেখক হিসাবে তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব দান করেছে। তার রচিত ডালিম গল্পের নাট্যরূপ ১৯২৪ খ্রিঃ মিনার্ভা মঞ্চে পরিবেশিত হয়।