বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতি বা ইতস্তত জনবসতি কাকে বলে?

Rate this post

বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতি বা ইতস্তত জনবসতি কাকে বলে? বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতির বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখসহ গড়ে ওঠার কারণগুলি আলোচনা করো।

বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতি-ভূপৃষ্ঠের কোন স্থানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক কারণে কয়েকটি পরিবার একে অন্যের থেকে পৃথক হয়ে বা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করলে যে গ্রামীণ বসতির উদ্ভব হয়, তাকে বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতি বা ইতস্তত জনবসতি বলে। বন্ধুর ভূ প্রাকৃতিক অঞ্চলে, অরণ্য ও তৃণভূমি অঞ্চলে, অনুর্বর কৃষি ক্ষেত্রে, প্রতিকূল জলবায়ু অঞ্চলে এবং যেখানে কৃষককে কৃষিজমির মধ্যে বসবাস করতে হয়, সেখানে বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতি গড়ে ওঠে।

বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতির বৈশিষ্ট্য

বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতির বৈশিষ্ট্যগুলি হলো নিম্নরূপ:

১)বিক্ষিপ্ত জনবসতিতে একটি পরিবার অন্যান্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে বহু দূরে অবস্থান করে। যদি কখনো দুটি বা তিনটি পরিবার একসাথে বসবাস করে সেক্ষেত্রে একটি ক্ষুদ্র বসতি ওপর ক্ষুদ্র বসতি থেকে দূরে অবস্থান করে। জলপাইগুড়ি জেলার যৌথ গ্রাম বা ট্যাঁড় গ্রাম কিংবা ঝাড়খণ্ডের পালামৌ ও রাঁচি মালভূমির দুর্গম অরণ্য অঞ্চলে এই ধরনের জনবসতি চোখে পড়ে।

২)বিক্ষিপ্ত জনবসতিতে বসতবাড়িগুলির মধ্যবর্তী ব্যবধান যথেষ্ট বেশি এবং ওই বসতবাড়িগুলিতে বসবাসকারী অধিবাসীদের সদস্য সংখ্যা কম থাকে।

৩)বিক্ষিপ্ত জনবসতিতে বসতবাড়িগুলির মধ্যবর্তী ব্যবধান যথেষ্ট বেশি থাকার কারণে অধিবাসীদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের সুযোগ কম থাকে।

৪)এই ধরনের জনবসতিতে একটি বাড়ি থেকে অপর বাড়ির দূরত্ব বেশি থাকায় অধিবাসীদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়।

৫)দুর্গম অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই ধরনের জনবসতিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ব্যবস্থা প্রভৃতির ক্ষেত্রে সমস্যা লক্ষ্য করা যায়।

বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতি গড়ে ওঠার কারণ

বিক্ষিপ্ত জনবসতি বা বিচ্ছিন্ন জনবসতি গড়ে ওঠার কারণগুলি হলো-

A)প্রাকৃতিক কারণ

১)বন্ধুর ভূ প্রকৃতি-পৃথিবীর অধিকাংশ বিক্ষিপ্ত জনবসতি বন্ধুর ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলে গড়ে উঠেছে। বন্ধুর ভূ প্রকৃতিতে যেমন কৃষিকাজের জন্য সমতল জায়গা পাওয়া যায় না, তেমনি এখানে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলাও কষ্টসাধ্য। ফলে এই বন্ধুর ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর। বন্ধুর ভূ প্রকৃতির প্রভাব হেতু এই অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ।ভিল উপজাতিদের বসতি এই ধরনের জনবসতি।

২)প্রতিকূল জলবায়ু-জলবায়ুগত প্রতিকূলতা বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রতিকূল জলবায়ু কৃষি ও শিল্পের অনুপোযোগী এবং মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে প্রতিকূল জলবায়ু অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠে। হিমালয়ের উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে রুক্ষ ও শুষ্ক জলবায়ুর কারনে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠেছে।

৩)মৃত্তিকা-উর্বর ও অনুর্বর-এই দুই প্রকার মৃত্তিকাতেই বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে উঠতে পারে। অনুর্বর মৃত্তিকায় ফসল উৎপাদনের পরিমাণ খুব কম বলে কৃষকেরা খন্ড খন্ড জমিতে কৃষিকাজ করেন এবং প্রতিখন্ডে এক একটি করে বসতবাড়ি গড়ে তোলেন। এইভাবে বিক্ষিপ্ত জনবসতির সৃষ্টি হয়। আবার বিস্তীর্ণ উর্বর নিম্নভূমিতে একসাথে প্রচুর পরিমাণে কৃষি জমি পাওয়া যায় বলে কৃষকেরা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করেন।

৪)জলের প্রাচুর্য্য-যে অঞ্চলে প্রায় সর্বত্রই জল পাওয়া যায় সেখানে সাধারণত বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠে। কারণ অসংখ্য জলের উৎস কোন অঞ্চলে মানুষের একত্রে বসবাস করার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে উঠতে সাহায্য করে।

৫)বন্যা-বন্যার সময় গ্রামের অপেক্ষাকৃত উঁচু অংশ জলের উপর জেগে থাকে। যেহেতু একটিমাত্র উঁচু জমিতে সব গ্রামবাসী বসবাস করতে পারেন না, তাই তারা যতদূর সম্ভব যেখানে সেখানে অবস্থিত উঁচু জমিতে বসবাস করার চেষ্টা করেন। এভাবে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠে। গঙ্গা ও ঘর্ঘরা নদীর তীরবর্তী প্লাবনভূমিতে এই কারণে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে উঠেছে।

B) আর্থসামাজিক কারণ

১)জমির ভোগ দখল ব্যবস্থা-ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে জমিদারদের প্রজারা তাদের কৃষি জমির নিকটে বসবাস করতে বাধ্য ছিলেন এবং জমিদারদের দাতব্য জমিতে ঘরবাড়ি তৈরিতে আগ্রহী ছিলেন। তখন সমাজে গোষ্ঠীবদ্ধ বসতির প্রাধান্য দেখা যেত। কিন্তু জমিদারি প্রথা অবলুপ্তির পর সামাজিক ক্রম পরিবর্তনের কারণে গোষ্ঠীবদ্ধ গ্রামে বসবাসের পরিবর্তে মানুষ কৃষি জমির ধারে নিজেদের ইচ্ছা মতো বসতি করে তুলতে থাকেন। ফলে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠে।

২)কৃষির প্রকার-যেখানে কৃষিযোগ্য জমি ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত হওয়ার কারণে জমিতে বৃহৎ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যায় না, কৃষি কাজের জন্য প্রচুর কায়িক শ্রমের প্রয়োজন হয়, যেখানে কৃষকরা গরীব, অশিক্ষিত ও অদক্ষ; সেখানে কৃষি জমির পাশেই কৃষি খামার গড়ে ওঠে; যা বিক্ষিপ্ত বসতি গড়ে ওঠার একটি অন্যতম কারণ। ইথিওপিয়ার উচ্চভূমিতে উক্ত কারণে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে উঠেছে।

৩)ব্যক্তিগত উদ্যোগ-ব্যক্তিগত উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে উঠতে সাহায্য করে। কেউ কেউ ধর্মীয় ও জাতিগত অনুশাসন থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য অথবা জীবন যাপনের মান উন্নয়নের জন্য, নতুন খনিতে কাজের জন্য, বনজ সম্পদ আহরণের জন্য কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দীর্ঘদিনের বাসভূমি ছেড়ে দূরে গিয়ে বসবাস করেন।ফলে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠে।

৪)শান্তি ও নিরাপত্তা-পূর্বে মানুষ শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে একসঙ্গে গোষ্টিবদ্ধ ভাবে বসবাস করতেন। কিন্তু যখন নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার আর কোন প্রয়োজন থাকলো না, তখন তারা সাধারণ ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন। এভাবে কিছু কিছু বিক্ষিপ্ত বসতির সৃষ্টি হল।

৫)বংশগত টান-বংশগত ভালবাসার টানে এক জ্ঞাতি অন্য জ্ঞাতির থেকে পৃথক হয়ে বসবাস করেন। এইভাবে বিক্ষিপ্ত বসতি করে ওঠে। চিনাদের মধ্যে এই ধরনের বংশ অনুযায়ী এক একটি পাড়া গড়ে উঠতে দেখা যায়।

৬)জাতিভেদ প্রথা-জাতিভেদ প্রথা ও বিভিন্ন কুসংস্কার বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠার একটি অন্যতম কারণ।নিম্ন শ্রেণীর কৃষিজীবিরা মূল্যবান শস্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেওয়ার জন্য কিছু জমিতে বাড়ি তৈরি করেন। এছাড়া সমাজে কিছু অস্পৃশ্য শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা গ্রামের কুয়ো থেকে জল নিতে পারেনা, সমাজে যাদের স্থান সকলের নীচে অথবা যারা সমাজচ্যুত ব্যক্তি তারা মূল গ্রামীন এলাকা থেকে দূরে সরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। এভাবেও বিক্ষিপ্ত বসতি গড়ে ওঠে।

Leave a Comment