অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব আলোচনা করো: জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয় দুটি পরস্পর অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদগণের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিিশেষ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কোন কোন অর্থনীতিবিদগণের মতে দেশে দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে শ্রমের যোগান বৃদ্ধি পায় এবং ওই বর্ধিত শ্রম দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে কোন কোন অর্থনীতিবিদগণের মতে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে মূলধনের অভাব ও উন্নত প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহারের জন্য বর্ধিত জনসংখ্যা সম্পদ বৃদ্ধির সহায়ক না হয়ে অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক কথায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুকূল ও প্রতিকূল উভয় প্রভাবই লক্ষ্য করা যায়।
A)প্রতিকূল প্রভাব
১)খাদ্য সংকট সৃষ্টি:-জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পায় দেশে খাদ্যের উৎপাদন সেই হারে বৃদ্ধি না পেলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এর ফলে অনাহার ,অপুষ্টি প্রভৃতি সমস্যা সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবার ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দেয়। ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
২)মূলধন গঠনের কাজে বাধা:-জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ভোগ্যপণ্যের অভাব দেখা দেয় বলে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য বেশি পরিমাণ অর্থনৈতিক সম্পদ বিনিয়োগ করতে হয়। এর ফলে মূলধন গঠনের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না।
৩)কৃষি উৎপাদন হ্রাস:-জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হলে কৃষির ওপর চাপ বাড়ে এবং কৃষিতে ছদ্ম বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। ফল স্বরূপ মাথাপিছু কৃষি উৎপাদন হ্রাস পায়।
৪)সঞ্চয় হ্রাস:-জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উপার্জনশীল প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির তুলনায় অনুপার্জনশীল অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে উপার্জনশীল ব্যক্তির ওপর অনুপার্জনশীল ব্যক্তির নির্ভরশীলতা বাড়ে। ফলে উপার্জনশীল ব্যক্তির সঞ্চয় ক্ষমতা হ্রাস পায়।
৫)বিদেশ নির্ভরতা:-কোন দেশের জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেলে বাড়তি জনসাধারণের খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য সেই দেশকে বিদেশি সাহায্য ও ঋণের উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে দেশটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দূর্বল হয়ে পড়ে।
৬)বেকারত্ব ও অন্যান্য সামাজিক সমস্যা:-উচ্চ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায় এবং তার সহগামী হিসাবে অন্যান্য সামাজিক সমস্যা তথা চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, পকেটমারি ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়া বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইত্যাদি সবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।৭)পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট:-অত্যধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বনভূমি ধ্বংস হয়, শিল্প কলকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, কৃষি ক্ষেত্রে অধিক উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাসায়নিক সার, আগাছানাশক ও কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ানো হয়। এর ফলে জল, বায়ু ও মাটি দূষণের মাধ্যমে পরিবেশ তন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
B)অনুকূল প্রভাব
১)শ্রমের যোগান:-উৎপাদন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো শ্রম। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে শ্রমিকের শ্রমের যোগান বৃদ্ধি পায় বলে সম্পদ আহরণ ও উৎপাদন বাড়ে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে।
২)জীবিকা কাঠামোর পুনর্বণ্টন:-স্বল্প উন্নত দেশগুলিতে অধিকাংশ জনসাধারণের প্রধান উপজীবিকা কৃষিকাজ। জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় জীবন ধারনের প্রয়োজনে মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে অন্যান্য জীবিকার সন্ধানে ঘুরতে থাকে এবং এইভাবে সারা বিশ্বে জীবিকা কাঠামো পুনর্বন্টন ঘটে।
৩)উৎপাদন ব্যয় হ্রাস:-জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে শ্রমের যোগান বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমিকের মজুরি হ্রাস পায়। এর ফলে পণ্য সামগ্রী উৎপাদনের ব্যয় হ্রাস পায়।
৪)দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার বৃদ্ধি:-জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রসার ঘটে বলে দেশীয় শিল্প বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। একই সাথে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা পূরণের জন্য জাতীয় উৎপাদন ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়।
৫)দ্রুত নগরায়ন:-জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিল্প-বাণিজ্যের যে প্রসার ঘটে তাতে গ্রাম থেকে মানুষ শহরের দিকে যেতে বেশি আগ্রহী হয়। ফলে দ্রুত অনেক নতুন নতুন শহর ও নগর সৃষ্টি হয়।
৬)জমির ব্যবহার বৃদ্ধি:-জনস্বল্পতা যুক্ত দেশগুলিতে শ্রমিকের অভাবে ব্যাপক পরিমাণ জমি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। কিন্তু ওই সব দেশের জনসংখ্যার পরিমাণ বাড়লে কৃষি ও শিল্পের প্রসার ঘটে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে জমির কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
উপরিলিখিত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি যেমন কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে, তেমনি আবার কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করতেও পারে। যেমন-অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি জনস্বল্পতা যুক্ত দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশ প্রভৃতি জনবহুল দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়।