পরিবেশের উপর ওজোন স্তর বিনাশের প্রভাব: বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত ওজোন স্তর সমগ্র জীবজগৎ কে সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করে। সেই ওজোন স্তর আজ মনুষ্য সৃষ্ট গ্যাস ক্লোরোফ্লোরোকার্বনের কারণে ক্রমশ বিনাশ প্রাপ্ত হচ্ছে, যার প্রভাব সরাসরি পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের উপর গিয়ে পড়ছে। পরিবেশের উপর ওজোন স্তরের বিনাশ কীরূপ প্রভাব ফেলে তা নিচে উল্লেখ করা হল।
ওজোন স্তরের বিনাশের ফলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি অতি সহজেই পৃথিবীর বুকে প্রবেশ করছে। এই অতিবেগুনি রশ্মি গুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক UV – B, যা মানুষের স্বাস্থ্য, উদ্ভিদ, প্রানী, অনুজীব, বস্তু ও বায়ুর গুনমানের উপর ঋনাত্মক প্রভাব ফেলে।
মানুষ ও অন্যান্য প্রানীদের উপর প্রভাব – ওজোন স্তরের বিনাশ ও তার ফলে অতিবেগুনি রশ্মির পৃথিবীর মধ্যে প্রবেশ এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রানীদের উপর এই অতিবেগুনির সম্ভাব্য প্রভাব হল চোখের রোগ, ত্বকের ক্যানসার ও সংক্রামিত রোগ গুলির সংক্রমণের প্রভাব বৃদ্ধি অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিমান হ্রাস। অতিবেগুনি রশ্মি – B চোখের কর্নিয়া ও লেন্সের ক্ষতি করে এবং অল্প বয়সে চোখে ছানি পরে যায়। ত্বকের ক্যানসার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি সাদা চামড়ার মানুষদের কারণ এদের শরীরে মেলানিনের পরিমান সবচেয়ে কম থাকে।
উপর প্রভাব – প্রতি দিনের সৌর বিকিরনে কী পরিমান UV – B রয়েছে তার দ্বারা উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় ও গঠন মূলক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ উদ্ভিদের বৃদ্ধি সরাসরি ভাবে UV – B দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতি UV – B দ্বারা বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত হয়।
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব – ফাইটোপ্ল্যাংটন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এছাড়া বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব নিয়ন্ত্রনেও ফাইটোপ্ল্যাংটন গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। মানুষের প্রয়োজনীয় প্রানীজ প্রোটিনের ৩০% জোগান পাওয়া যায় সমুদ্র থেকে, পরোক্ষ ভাবে যার মূলে রয়েছে সেই ফাইটোপ্ল্যাংটন।
এই ফাইটোপ্ল্যাংটন সমূদ্রের সর্বত্র সমান ভাবে পাওয়া যায় না, প্রধানত উচ্চ অক্ষাংশীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পরিমানে পাওয়া যায় এছাড়া মহীসোপান অঞ্চলেও পাওয়া যায়।
গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে আন্টার্কটিকার পার্শ্ববর্তী সমুদ্র অঞ্চলে ফাইটোপ্ল্যাংটনের উৎপাদন অনেক হ্রাস পেয়েছে, যার একমাত্র কারণ আন্টার্কটিকায় ওজোন গহ্বরের সৃষ্টি, যার মাধ্যমে অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ।
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, উভচর ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রানীর প্রারম্ভিক পর্যায়ে ক্ষতি সাধন করে থাকে।
বায়ুর গুনমানের উপর প্রভাব – ওজোন স্তরের বিনাশ ও তার ফলে UV – B এর নিম্ন বায়ুমন্ডলে প্রবেশ। UV – B রশ্মি বায়ুর নিম্ন স্তরে অবস্থিত প্রধান গ্যাস গুলিকে বিশ্লেষিত করে এই গ্যাস গুলির রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার কে নিয়ন্ত্রন করে।
যেমন – অতিবেগুনি রশ্মি ওজোন স্তরকে বিশ্লেষণ করে অক্সিজেন অনু ও পরমানুর সৃষ্টি হয় এবং অক্সিজেন অনু বায়ুর হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন পারক্সাইড উৎপন্ন করে, এই হাইড্রোজেন পারক্সাইড মানুষ, উদ্ভিদ ও বিভিন্ন পদার্থের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
পদার্থের উপর প্রভাব – অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ন সিন্থেটিক পলিমার, প্রাকৃতিক বায়োপলিমার গুলি অতিবেগুনি রশ্মির দ্বারা ক্ষতি গ্রস্ত হয়। এই পদার্থ গুলি থেকে তৈরি প্লাস্টিক সূর্যের প্রখর তীব্রতা থেকে রক্ষার পেতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে কিন্তু সৌর বিকিরনে UV – B রশ্মির পরিমান বৃদ্ধি পাওয়ায় এই প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য গুলি ক্রমশ ক্ষয় প্রাপ্ত হচ্ছে।
ভূরাসায়নিক চক্রের উপর প্রভাব – অতিবেগুনি রশ্মি স্থলজ ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত জীব ভূরাসায়নিক চক্র কে প্রভাবিত করে। UV – B পরিমান বৃদ্ধি পেলে উদ্ভিদ জাত জৈব পদার্থ উৎপাদনের পরিমান বৃদ্ধি পায়। জৈব পদার্থ উৎপাদনের সময় বায়ুমণ্ডলের কিছু গুরুত্বপূর্ন গ্যাস যেমন – মিথেন, কাররবন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড প্রভৃতি গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধি পায়।
মেরু অঞ্চলে ওজোন গহ্বরের সৃষ্টির ফলে সমুদ্রের উপরি অংশে ফাইটোপ্ল্যাংটন ও সামুদ্রিক ব্যাকটেরিয়ার উৎপাদন অনেক টা কমে গেছে, যা সামুদ্রিক জীব – ভূরাসায়নিক চক্রকে প্রভাবিত করে।
UV – B সমুদ্রের জলে ভাসমান জৈব পদার্থের অবক্ষয় ঘটায়, যার ফলে এই সব জৈব পদার্থ গুলি থেকে উৎপন্ন সমুদ্রের জলে দ্রবীভূত গুরুত্বপূর্ন কিছু অজৈব পদার্থ যেমন – কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড ও অন্যান্য জৈব পদার্থ যা খনিজীকরনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে তার অভাব পরিলক্ষিত হয়, যা সামুদ্রিক অনুজীবরা খাদ্য হিসাবে গ্রহন করতো। এছাড়া সামুদ্রিক নাইট্রোজেন ও সালফার চক্র অতিবেগুনি রশ্মির পরিমান বৃদ্ধির দ্বারা প্রভাবিত।