গ্রামীণ বসতির কার্যাবলী বা কর্মধারা আলোচনা করো: গ্রামীণ বসতির কর্মধারা বলতে গ্রামের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বোঝায়। আরো বিশদভাবে বলা যায় গ্রামবাসীগন তাদের জীবিকার জন্য বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থাকায় বিভিন্ন কাজের সমন্বয়ে বিভিন্ন গ্রামীন কার্যাবলীর এক এক ধরনের ধাঁচ তৈরি হয়। গ্রামীণ বসতির মধ্যে ঘটমান এই কর্মকাণ্ড গুলিকে গ্রামীণ বসতির কর্মধারা বলা হয়। অধিকাংশ গ্রামীণ বসতি প্রাথমিক জীবিকার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। কারণ বৃহদায়তন শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলার মতো উপযুক্ত পরিকাঠামো গ্রামীণ অঞ্চলে নেই। গ্রামীণ বসতির কর্মধারার বেশির ভাগই জমি কেন্দ্রিক ও শ্রম নিবিড় প্রকৃতির। ভারতের জনগণনা বিভাগ এদেশে গ্রামীণ মানুষের কর্মধারা বা কার্যাবলীকে ৯টি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলি হল-
১) কৃষিকাজ ও কৃষি শ্রমিক
২) পশুপালন ও বনজ সম্পদ সংগ্রহ
৩) মৎস্য শিকার ও অন্যান্য প্রাণী শিকার
৪)খনি শ্রমিক
৫) বাগিচা ও ফলের বাগানে বিভিন্ন ধরনের কাজ
৬)গৃহস্থালির বিভিন্ন প্রয়োজনীয় শিল্প অর্থাৎ উৎপাদন ভিত্তিক কুটির শিল্প, ক্ষুদ্রায়তন শিল্প ও নির্মাণ সংক্রান্ত শিল্প
৭) ব্যবসা-বাণিজ্য
৮) পরিবহন ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কাজ
৯) অন্যান্য পেশা ভিত্তিক কাজ।
১)কৃষিকাজ: পৃথিবীর অধিকাংশ গ্রামীণ বসতিই কৃষির ওপর নির্ভরশীল।কৃষিকাজের উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত কৃষিভিত্তিক গ্রামগুলি সাধারণত গোষ্ঠীবদ্ধ প্রকৃতির হয়ে থাকে। এই গ্রামগুলি বহু সংখ্যক বাসগৃহ, কিছু রাস্তাঘাট, ধর্মীয় স্থান, দোকান বাজার ইত্যাদি নিয়ে গঠিত হয় এবং এদের চারপাশে বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র অবস্থান করে। এছাড়া বাগিচা কৃষি কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গ্রামীণ বসতিগুলি বিক্ষিপ্ত গোষ্ঠীবদ্ধ রূপ ধারণ করে।
২)পশুপালন: গ্রামীণ মানুষের কার্যাবলীর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো পশুপালন। তৃণভূমি, বনভূমি ও পার্বত্য ভূমি অঞ্চলে পশুপালনের ওপর নির্ভর করে গ্রামীণ বসতি করে ওঠে। এদের মধ্যে কিছু গ্রাম ক্ষুদ্রাকার, বিচ্ছিন্ন ও ক্ষণস্থায়ী হয় এবং কিছু গ্রাম বৃহৎ, ঘন সঙ্গবদ্ধ বা গোষ্টিবদ্ধ ও স্থায়ী হয়। মধ্য এশিয়ার স্তেপ, উত্তর আমেরিকার প্রেইরি, দক্ষিণ আমেরিকার পম্পাস প্রভৃতি তৃণভূমি অঞ্চলের মানুষেরা পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে বলে ওই সমস্ত অঞ্চলে পশুপালনকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ বসতি করে ওঠে।
৩)মৎস্য শিকার: প্রধানত সমুদ্র উপকূল ও নদী সন্নিহিত অঞ্চলে এবং জলাভূমির নিকটে মৎস্য চাষ ও মৎস্য সংগ্রহ নির্ভর গ্রামীণ বসতি করে ওঠে। মৎসজীবীরা তাদের সুবিধার জন্য জলভাগের নিকট বসবাস করতে আগ্রহী হন এবং ছোট বড় গ্রাম করে তোলেন। স্থানীয় ভূ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে মৎস্য শিকার ভিত্তিক গ্রামগুলিতে ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন, রৈখিক ও গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি দেখা যায়। যেসব জলাভূমি অঞ্চল থেকে বাণিজ্যিক ভাবে মৎস্য সংগ্রহ করা হয় সেখানে ঘন সংঘবদ্ধ জনবসতি গড়ে ওঠে।
৪)বনজ সম্পদ সংগ্রহ: অরণ্যের নিকটবর্তী গ্রাম সমূহে বনজ সম্পদ সংগ্রহ মানুষের প্রধান উপজীবিকা। উন্নত দেশগুলিতে সরলবর্গীয় বৃক্ষের কাঠ চেরাই কলকে কেন্দ্র করে এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলে জ্বালানি ও শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঠ, মধু, মোম ইত্যাদি সংগ্রহকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিক্ষিপ্ত ও রৈখিক জনবসতি গড়ে। এছাড়া পশু পাখি শিকারও গ্রামীন মানুষের একটি প্রধান উপজীবিকা। এই উপজীবিকার সঙ্গেও যুক্ত অধিবাসীরা সাধারণত বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করেন।
৫)খনিজ দ্রব্য সংগ্রহ: খনি সমৃদ্ধ অঞ্চলে এমন এক ধরনের গ্রামীণ বসতি গড়ে ওঠে, যেখানে মানুষের প্রধান উপজীবিকা খনিজ সম্পদ সংগ্রহ। বিভিন্ন ধরনের খনিজ দ্রব্য সংগ্রহের জন্য খনির নিকট ক্ষুদ্র মাঝারি কিংবা বৃহৎ জনবসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। খনিগুলির কাছে অনেক সময় খনি শ্রমিকদের বসবাসের জন্য পরিকল্পিতভাবে গ্রামীণ বসতি নির্মাণ করা হয়।
৬)ক্ষুদ্র শিল্প, কুটির শিল্প ও হস্তশিল্প: গ্রামীণ মানুষের কর্মধারার মধ্যে ক্ষুদ্র শিল্প, কুটির শিল্প ও হস্তশিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় উপকরণের সাহায্যে শ্রমনিবিড় পদ্ধতিতে যেসব ক্ষুদ্র শিল্প, কুটির শিল্প ও হস্তশিল্প গড়ে ওঠে, সেইসব ক্ষেত্রে গ্রামীণ বসতি ক্ষুদ্র, মাঝারি বা বৃহদাকারে বিক্ষিপ্তভাবে কিংবা রৈখিক বা গোষ্টিবদ্ধ আকারে গড়ে উঠতে পারে।যেমন-পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুরে তাঁত বস্ত্র, মেদিনীপুরের মাদুর শিল্প ও কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের উপর ভিত্তি করে গ্রামীণ বসতি গড়ে উঠেছে।