জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ আলোচনা করো: নদী, ঝর্ণা, জলপ্রপাত ইত্যাদি প্রবাহমান জলধারার বেগে টারবাইন চাকা ঘুরিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, তাকে জলবিদ্যুৎ বলে। এই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কতকগুলি অনুকূল প্রাকৃতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার তথা অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশের প্রয়োজন হয়। সেগুলি হল-
A)প্রাকৃতিক পরিবেশ
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ হলো নিম্নরুপ-
১)বন্ধুর ভূ-প্রকৃতি: উঁচু-নিচু বা বন্ধুর পার্বত্য ভূ-প্রকৃতি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সহায়ক। এই ধরনের ভূ-প্রকৃতিতে জলস্রোতের বেগ প্রবল হয় বলে টারবাইন চাকার ঘূর্ণন বেশি হয় এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সহজ হয়।এই কারণে বন্ধুর পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলগুলিতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়।
২)নিয়মিত ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত: জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান ও প্রাথমিক শর্ত হলো নিয়মিত জল সরবরাহ। তাই ভূপৃষ্ঠের যেসব অঞ্চলে নিয়মিতভাবে ও পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়, সেইসব অঞ্চলে জল সরবরাহ অব্যাহত থাকে বলে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সহজ হয়।
৩)হিমাঙ্কের উপর উষ্ণতা: জলের উষ্ণতা হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেলে জল জমে বরফে পরিণত হয় বলে জলের গতিশীলতা থাকেনা। তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এই কারণে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হিমাঙ্কের ওপর উষ্ণতা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
৪)প্রাচীন শিলা গঠিত ভূভাগ: প্রাচীন ও কঠিন শিলা গঠিত ভূ-ভাগের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীর ওপর সহজেই জলাধার ও বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কিন্তু ভূমিকম্পপ্রবণ ও ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে দুর্বল অঞ্চলে কখনোই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত নয়।কারণ এক্ষেত্রে প্রবল ভূূ- আলোড়নের ফলে নদীর গতিপথের পরিবর্তন ঘটে যে কোন মুহূর্তে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
৫)বনভূমির অবস্থান: জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বনভূমি পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। গভীর অরণ্য যে কেবলমাত্র বৃষ্টিপাতের পরিমাণই বৃদ্ধি করে তা নয়, জলস্রোতের গতিবেগকে প্রতিহত করে মৃত্তিকার ক্ষয়রোধও করে থাকে। এইভাবে মৃত্তিকা ক্ষয় রোধের দ্বারা বনভূমি নতুন পলি সৃষ্টিতে বাধা দেয়। ফলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতিগুলির আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায়।
B)অর্থনৈতিক পরিবেশ
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ হলো নিম্নরুপ-
১)মূলধনের জোগান: জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের প্রাথমিক ব্যয় খুব বেশি হলেও একবার বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়ে গেলে আর কোন পৌনঃপুনিক ব্যয় নেই। তথাপি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য নদীতে বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ, ভারী যন্ত্রপাতি স্থাপন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কক্ষ ও বিদ্যুৎ পরিবহনের পরিকাঠামো নির্মাণ এবং জলস্রোতের বেগে টারবাইন চাকা ঘুরিয়ে ডায়নামোর সাহায্যে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রচুর প্রাথমিক মূলধন প্রয়োজন হয়।
২)উন্নত কারিগরি বিদ্যা: পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলের খরস্রোতা নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন অত্যন্ত কঠিন ও জটিল কাজ। তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উন্নত কারিগরি বিদ্যার প্রয়োগ ও দক্ষ কারিগরদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
৩)বহুমুখী নদী পরিকল্পনা: বহুমুখী নদী পরিকল্পনার মাধ্যমে কোন একটি অঞ্চলে নদীর উপর বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও স্থায়ী সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনেরও ব্যবস্থা করা হয়। তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অনেক সময় বহুমুখী নদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
৪)উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা: জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য অত্যন্ত দামী ও ভারী যন্ত্রপাতি নির্মাণ স্থলে নিয়ে যেতে হয়। তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উন্নত ও সর্বাধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক।
৫)বিকল্প শক্তির অভাব: জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলে কয়লা, খনিজ তেল ও অন্যান্য শক্তি সম্পদের অভাব থাকা একান্ত প্রয়োজন। কারণ এই সমস্ত শক্তি সম্পদ থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের অভাব থাকলে তবেই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
৬)চাহিদা: অন্যান্য বিদ্যুতের থেকে জলবিদ্যুৎ তুলনামূলকভাবে সস্তা হলেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রারম্ভিক ব্যয় যথেষ্ট বেশি। তাই এই প্রকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করতে হয় তার জন্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিক্রি করে উপযুক্ত পরিমাণ লাভ হওয়া দরকার।এই কারণে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
৭)সরকারি ব্যবস্থাপনা: জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের প্রারম্ভিক ব্যয় বেশি বলে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে বেসরকারি উদ্যোগে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। তাই এইসব দেশগুলিতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হলে সরকারি সহযোগিতা ও ব্যবস্থাপনা একান্ত প্রয়োজন।