বায়ু দূষণ কাকে বলে? বায়ু দূষণের ক্ষতিকারক প্রভাব সমূহ: ক্ষতিকারক পদার্থ বাতাসে মেশার ফলে বায়ু দূষণ হয়। বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, পরিবেশ এবং সম্পদও নষ্ট হয়। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে জলবায়ুর উপর এবং তা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনেরও কারণ হয়।
শিল্প, যানবাহন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং নগরায়ন বায়ু দূষণের কয়েকটি প্রধান কারণ। নানা কারণে বায়ু দূষণ ঘটে যার অনেকগুলিই আবার মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। মরুভূমি অঞ্চলে ধুলোঝড় এবং অরণ্যে বা ঘাসে আগুন লাগার ফলে নির্গত ধোঁয়া বাতাসে রাসায়নিক ও ধুলিকণাজনিত দূষণ ঘটিয়ে থাকে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অবাঞ্ছিত পদার্থ সমূহের মিশ্রনের ফলে বায়ু যখন মানুষ তথা অন্যান্য জীবজগতের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে তখন তাকে বায়ু দূষন বলে। বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত প্রতিটি গ্যাস একটি নির্দিষ্ট পরিমানে থাকে, এই গ্যাস গুলি ব্যতিত মানবিক কারণে সৃষ্ট অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস ও অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পদার্থ বায়ুতে মিশে গিয়ে বায়ুকে দূষিত করে তুলে। এই বায়ুদূষণ জীব প্রজাতির উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। বায়ু দূষণের ক্ষতিকারক প্রভাব গুলি হল –
মানব স্বাস্থ্যের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব
মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বিষাক্ত বায়ুদূষককারী গ্যাসের ক্ষতিকারক প্রভাব
বায়ুতে বিষাক্ত গ্যাসীয় ও সূক্ষ্ম ধূলিকনা জাতীয় দূষক মানুষের শ্বাস ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসটি আমাদের ফুসফুস দ্বারা যখন শোষিত হয় তখন এটি আমাদের রক্তের হিমোগ্লোবিন সাথে বিক্রিয়া করে কার্বক্সিল হিমোগ্লোবিন গঠন করে, ফলস্বরূপ মানুষের রক্তে অক্সিজেন বহন করার জন্য প্রয়োজনীয় হিমোগ্লোবিনের পরিমান হ্রাস পায়। তাই যে সব মানুষ অক্সিজেন বহন ক্ষমতা জনিত সমস্যার ভোগে তারা এর দ্বারা অতি সহজেই প্রভাবিত হয়।
সালফার ডাই অক্সাইড বায়ুদূষক গুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও ব্যাপক বায়ুদূষক। এই সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমান হ্রাস পেলে মানুষের ব্রঙ্কাওলসের মসৃন পেশি গুলি শিথিল হয়ে পরে এবং পরিমান বা ঘনত্ব বাড়লে শ্লেষ্মা উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। শ্বাসযন্ত্রের সুরক্ষা প্রদানকারী সিলিয়া গুলিও এই গ্যাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
বায়ুমন্ডলে সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমান বাড়লে এই গ্যাস থেকে বায়ুমন্ডলে আরো কিছু অকাঙ্খিত উপাদানের সৃষ্টি হয়, যেমন – সালফিউরিক অ্যাসিড, এই সালফিউরিক অ্যাসিডের সূক্ষ্ম কনা বায়ুর মানুষের নাকের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসের ক্ষতিসাধন করে।
অপর এক বায়ু দূষক ওজোন হল এক প্রকার উত্তেজক গ্যাস, যা সালফার ডাই অক্সাইডের তুলনায় আরো দ্রুত ফুসফুসে প্রবেশ করে। খুব সামান্য পরিমান ওজোনের উপস্থিতি শ্বাসজনিত সমস্যা এমনকি হৃৎপিন্ডের সমস্যা সৃষ্টি করে ও রক্ত ক্ষরনও হতে পারে।
নাইট্রিক অ্যাসিড একটি অউত্তেজক বায়ুদূষক হলেও বায়ুতে এই গ্যাসের উপস্থিতির ফলে ফুসফুসে জ্বালা এবং পরিমানে বেশি হলে রক্তক্ষরন পর্যন্ত হতে পারে।
বায়ুতে থাকা অন্যতম বায়ু দূষক হাইড্রোকার্বন জনিত কারণে ফুসফুসে ক্যানসার হয়ে থাকে। গাড়ির ধোঁয়া থেকে নির্গত সিসা একপ্রকার বিপজ্জনক বিষ বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে কারণ এটি শিশুদের মস্তিস্কের ক্ষতিসাধন করে।
এছাড়া বায়ু দূষণের ফলে ফুসফুসে কান্সার, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি ও শ্বাস কষ্ঠ জনিত দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে।
মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বায়ুদূষণ কারী সূক্ষ্ম কনার ক্ষতিকারক প্রভাব
আমাদের নাকের ছিদ্রগুলি ৫ মাইক্রনের চেয়ে বড়ো কনা গুলিকে শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশে বাঁধা দেয় কিন্তু ৫ মাইক্রনের চেয়ে ছোট কনা গুলি অতি সহজেই আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
এক মাইক্রন বা তার চেয়ে ক্ষুদ্র কনা গুলি ফুসফুসে গিয়ে সঞ্চিত হতে থাকে। ফুসফুসে কি পরিমান পদার্থ সঞ্চিত হবে তা কেবলমাত্র অ্যারোসল কনার আকৃতির উপর নির্ভর করে না, একজন মানুষ মিনিটে কতবার শ্বাস নিচ্ছে তার উপরও নির্ভর করে।
দ্রবীভূত অ্যারোসল গুলি ফুসফুস থেকে রক্তের সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়। সিসা জাতীয় কনা গুলি শিশুদের মস্তিস্কের ক্ষতিসাধন করে এবং বেরিলিয়াম থেকে বেরিলিওসিস রোগের সৃষ্টি হয়।
তেজস্ক্রিয় দূষক – রাসায়নিক শিল্পকারখানা গুলি যখন কোন দূর্ঘটনার সম্মুখিন হয় তখন সেই কারখানা গুলি থেকে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, যা আমাদের প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটায়। এভাবে অনেক মানুষের প্রানহানী ঘটে। যেমন উদাহরন হিসাবে ভারতের ভূপাল গ্যাস দূর্ঘটনার কথা বলা যায়। এই দূর্ঘটনার ফলে বিষাক্ত মিথাইল আইসো সায়ানেট বা মিক গ্যাস নির্গত হয় যার ফলে প্রচুর মানুষ মারা যায় এবং বর্তমান সময়ে বিশাখাপত্তনম অঞ্চলে একটি কেমিক্যাল কারখানা থেকে বিষাক্ত স্টেরিন গ্যাস নির্গত হয় যার ফলে বেশ কয়েক জন মারা যান এবং অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পরেন।
প্রানীদের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব
বাতাসে ভাসমান ধূলিকনা গুলি এক সময় গাছপালা ও তৃণভূমির ওপর এসে পরে এবং সেগুলির ওপর সঞ্চিত হতে থাকে । তাই তৃণভোজী প্রানীরা সেগুলি কে যখন খাবার হিসাবে গ্রহন করে সেই বায়ু দূষক গুলি তৃনভোজী সেই সব প্রানীর দেহে সঞ্চিত হতে থাকে এবং বিষ ক্রিয়া ঘটায় এবং তা ক্রমে মাংসাশী প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে।
বায়ুতে ওজোনের পরিমান বৃদ্ধি পেলে তা মানুষ কে যেমন প্রভাবিত করে তেমনি প্রাণীদের শরীরে প্রবেশ করে এবং এই ওজোন গ্যাসের একটি জ্বালাময় গুন রয়েছে তাই এই গ্যাস প্রাণীদের শরীরে প্রবেশ করলে অস্বস্তিময় অবস্থার সৃষ্টি হয়, এমনকি কুকুর ও খরগোশের রক্তক্ষরন পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বায়ুতে উপস্থিত ফ্লোরাইড গুলির দ্বারা প্রানীরা সরাসরি প্রভাবিত না হলেও উদ্ভিদের মাধ্যমে এই ফ্লোরাইড গুলি প্রানীদের দেশে প্রবেশ করে এবং প্রানীরা ফ্লোরোসিসের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফ্লোরিন যেহেতু একটি প্রোটোপ্লাজমেটিক বিষ তাই ফ্লোরিনের দ্বারা প্রানীদের দাঁতে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং বেশি পরিমান ফ্লোরিন প্রানীদের শরীরে প্রবেশ করলে হারের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। এছাড়া ডাইরিয়া, ওজন কমে যাওয়া, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস ও দুগ্ধ উৎপাদন কমে যাওয়া প্রভৃতি সমস্যা ফ্লোরাইড দূষণের ফলে হয়ে থাকে।
উদ্ভিদের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব
প্রধান তিনটি বায়ুদূষক রয়েছে যারা উদ্ভিদ ও কৃষিজ ফলসের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে উদ্বেগের কারণে পরিনত হয়েছে। এই বায়ুদূষক গুলি হল সালফার ডাই অক্সাইড, ফ্লোরিনের উপাদান সমূহ ও ধোঁয়াশা ।
সালফার ডাই অক্সাইড স্টোমাটার মাধ্যমে পাতায় প্রবেশ করে পাতার মধ্যে ক্রমশ সঞ্চিত হতে থাকে এবং এক সময় এই সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধি পেতে পেতে একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে পাতার কোশ গুলি নিস্ক্রিয় হয়ে মারা যায়, ফলে পাতা গুলি শুকিয়ে ঝরে পড়ে। সালফার পরিমানে কম হলে সবুজ পাতা বাদামী রঙের হয়ে পরে বা সবুজ রঙ ফ্যাঁকাসে হয়ে পরে। এই ঘটনা কে ক্লোরোসিস বলা হয়। তুলো, গম, বার্লি ও আপেল সালফার ডাই অক্সাইডের প্রতি সংবেদনশীল।
সালফার ডাই অক্সাইড ক্লোরোসিস জনিত প্রভাব ছাড়াও উদ্ভিদের শোষণ ও সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া কেও প্রভাবিত করে থাকে।
বাতাসে ফ্লোরাইডের পরিমান বৃদ্ধি পেলে উদ্ভিদ গুলিতে ফ্লোরাইড জনিত ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পাতায় ফ্লোরাইডের পরিমান ৫০ থেকে ২০০ PPM মতো হলে পাতায় এই জাতীয় ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
আপেল, ডুমুর, পিচ ও লেবু জাতীয় গাছের পাতা বায়ুবাহিত ফ্লোরাইডের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে।
অন্য এক বায়ু দূষক ওজোন গ্যাস গাছের পাতার উপরের স্তরে ক্ষতের সৃষ্টি করে। এই ক্ষত গুলি সাদা ও বাদামী রঙের অভিন্ন ফলক দ্বারা সহজেই চিহ্নিত করা যায়। ওজোন জনিত এই ক্ষত গুলি আঙুর, সিস্ট্রাস ও তামাক গাছে দেখা যায়।
আলোক রাসায়নিক ধোঁয়াশাও উদ্ভিদের পক্ষে ক্ষতিকারক কারণ এই ধোঁয়াশা মধ্যস্থিত রাসায়নিক গাছের সময়ের আগেই পরিপক্কতা ঘটিয়ে দেয়, যা গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক।
ক্লোরিন সালফার ডাই অক্সাইডের চেয়ে তিনগুন বেশি বিষাক্ত। অ্যামোনিয়ার বিষাক্ততা কম হলেও পরিমানে ৪০ ppm এর বেশি হলে তা টম্যাটোর ক্ষতি করে।
বস্তুর উপর বায়ু দূষণের প্রভাব
বায়ুদূষণ মানুষের সম্পদ ও বস্তুর উপরও প্রভাব ফেলে। গ্যাসীয় দূষক গুলির মধ্যে সালফার ডাই অক্সাইড সবচেয়ে বেশি ধাতব বস্তুর ক্ষতিসাধন করে। সালফার ডাই অক্সাইড ধাতব মধ্যস্থিত বায়ু ও জলীয় অংশের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সালফিউরাস ও সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরি করে, যা অতি সহজেই ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে যায়।
অ্যালুমিনিয়াম, কপার ও লৌহ ইস্পাত বায়ুতে উন্মুক্ত হলে ক্ষয় হতে শুরু করে। হাইড্রোজেন সালফাইড সিসার সাথে বিক্রিয়া করে বাদামী ও কালো রঙের পদার্থের সৃষ্টি করে।
আবার সালফারের অক্সাইড সমূহ চুনাপাথরের সাথে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম সালফেট গঠন করে, যা বৃষ্টির জলের সাথে অতি সহজেই দ্রবীভূত হয়ে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়।
বায়ুমণ্ডলের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব
বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে তাপের বিকিরনের মাধ্যমে শীতলীকরনের হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কার্বন ডাই অক্সাইড সেই তাপ শোষণ করে পৃথিবীর তাপমাত্রাকে ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে।