হেলেন কেলার জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Helen Keller Biography in Bengali. আপনারা যারা হেলেন কেলার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হেলেন কেলার এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
হেলেন কেলার কে ছিলেন? Who is Helen Keller?
হেলেন কেলার বা হেলেন অ্যাডামস কেলার (Helen Adams Keller) (২৭শে জুন, ১৮৮০ – ১লা জুন, ১৯৬৮) বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকারের জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। একই সাথে তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী।
হেলেন কেলার জীবনী – Helen Keller Biography in Bengali
নাম | হেলেন কেলার |
জন্ম | 27 জুন 1880 |
পিতা | আর্থার কেলার |
মাতা | কেইট আডামস |
জন্মস্থান | আলাবামা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র |
জাতীয়তা | আমেরিকান |
পেশা | লেখক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবতাবাদী |
মৃত্যু | 1 জুন 1968 (বয়স 87) |
হেলেন কেলার এর জন্ম: Helen Keller’s Birthday
হেলেন কেলার 27 জুন 1880 জন্মগ্রহণ করেন।
হেলেন কেলার এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Helen Keller’s Parents And Birth Place
মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী, মানুষের চেষ্টা ও উদ্যমের পবিত্র প্রতিমূর্তি হেলেন কেলার। নিজের বিচিত্র জীবনের কাহিনী লিখতে গিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন “আমার জীবন নিরন্তর সংগ্রামের জীবন”। বস্তুতঃ হেলেন কেলারের জীবন এক অপরাজেয় সংগ্রামী মানুষের জীবন কাহিনী। সমস্ত প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে একজন মানুষ কেবলমাত্র নিজের চেষ্টায় ভাগ্যকে জয় করতে পারে, নিজের জীবন দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করেছেন।
১৮৮০ খ্রিঃ ২৭ শে জুন উত্তর আমেরিকার টুসকুমরিয়া নামক এক ছোট্ট শহরে জন্ম। তার পিতার নাম আর্থার কেলার, মায়ের নাম ক্যাথারিন। জন্মের সময় হেলেন ছিলেন অন্য পাঁচটি শিশুর মতই সবল সুস্থ স্বাভাবিক। তাঁর ফুটফুটে চেহারা দেখে আর মুখের আধো আধো বুলি শুনে বাবামায়ের মন ভরে উঠত।
হেলেন কেলার এর ছোটবেলা: Helen Keller’s Childhood
যখন বয়স মাত্র একবছর সাত মাস সেই সময় একদিন তিনি হঠাৎ করে মায়ের কোল থেকে মাটিতে পড়ে যান। এই আকস্মিক দুর্ঘটনাই ছোট্ট হেলেনের জীবনে নিয়ে আসে দুর্ভাগ্যের অভিশাপ। কিছুদিন জ্বর ভোগের পরেই তিনি চিরতরে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল তাঁর মুখের ভাষাও।
বাইরের পৃথিবীর কোন শব্দ তিনি শুনতে পেতেন না। কোন আলো তার চোখে ছায়া ফেলত না। দিন রাতের কোন পার্থক্য তার কাছে ছিল না। নিজের থেকে কোন কিছুই করতে পারতেন না তিনি। সারাক্ষণ তাই মাকে কাছে কাছে থাকতে হত ! একমাত্র সন্তানের এই অবস্থা বাবামায়ের বুক ভেঙ্গে দিল। তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টায় নিবিড় সান্নিধ্যে সস্তানের দুঃখ – বঞ্চনাকে ভাগ করে নিলেন।
একটা জড় পদার্থের মত সারাক্ষণ বসে থেকে থেকে কয়েকটা বছর কেটে গেল। বয়স একটু বাড়তে নিজের জীবনের যন্ত্রণা – বঞ্চনা উপলব্ধি করতে পারলেন হেলেন। অবরুদ্ধ আবেগে অসহায়ভাবে চিৎকার করতেন তিনি, জেদে আক্রোশে হাতের নাগালে যা পেতেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতেন। স্নেহ দিয়ে সান্নিধ্য দিয়ে মা তাঁকে শাস্ত করবার চেষ্টা করতেন।
হেলেন কেলার এর শিক্ষাজীবন: Helen Keller’s Educational Life
হেলেনের বাবা মা ধরেই নিয়েছিলেন, তাদের মেয়ের জীবনে আশার আলো চিরদিনের মত নিবে গেছে। চির অন্ধকারের মধ্যেই কাটবে হেলেনের বাকি জীবনটা৷ তবু এই বোবা অন্ধ মেয়েকে কি করে লেখাপড়া শেখানো যায় তা নিয়ে তারা ভাবতে শুরু করলেন। ভাগ্যেরই যোগাযোগ বলতে হবে, একদিন আকস্মিকভাবে ওয়াশিংটনের বিখ্যাত ডাক্তার আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের সঙ্গে আর্থার কেলারের পরিচয় হল ৷ বেল তাঁকে সন্ধান দিলেন বোস্টনের পার্কিনস ইনসটিটিউশনের।
অন্ধদের শিক্ষা দেবার পদ্ধতি এখানে শিক্ষা দেওয়া হত। প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ হো তখন মারা গিয়েছিলেন। নতুন ডিরেক্টর হয়ে যিনি এসেছিলেন তার নাম মাইকেল অ্যাগানেসে। কেলার দম্পতি তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাদের মেয়ের কথা খুলে জানালে মাইকেল অ্যাগানেস একজন শিক্ষয়িত্রীর ওপর হেলেনের শিক্ষার ভার দেবার পরামর্শ দিলেন। কেলার দম্পতি সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হলেন। তাঁদের আশা যদি হেলেন কোনভাবে জীবনে আলোর সন্ধান পেতে পারে তাহলে নতুন জীবন লাভ করবে।
১৮৮৭ খ্রিঃ ৩ রা মার্চ। এই দিন একুশ বছরের এক তরুণী মিস অ্যানি সুলিভ্যান ম্যানসফিল্ড কেলার পরিবারে এসে হেলেনের শিক্ষার দায়িত্ব নিলেন। বস্তুতঃ তিনিই হেলেনের অন্ধকার জীবনে নিয়ে এলেন প্রথম আলো। এই শিক্ষিকার জীবন হেলেনের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। তার অকৃত্রিম স্নেহ ভালবাসা ও যত্নের ফলেই হেলেনের পক্ষে জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করা সম্ভব হয়েছিল।
অ্যানি মানুষ হয়েছিলেন সরকারী অনাথ আশ্রমে। দরিদ্র আইরিশ পরিবারের সম্ভান, আট বছর বয়সেই মাতৃহারা হন। কিছুদিন পরে পিতাও নিরুদ্দেশ হয়ে যান। অসহায় দুটি ভাইবোন স্থান পেয়েছিলেন সরকারী অনাথ আশ্রমে। ছেলেবেলা থেকে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ ছিল বলে অ্যানিকে থাকতে হয়েছিল ম্যাসাচুসেট প্রতিবন্ধীদের হোমে। পরে সেখান থেকে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় পার্কিনস ইনসটিটিউটে সময়টা ১৮৮০ খ্রিঃ।
এখানে কয়েকজন ডাক্তারের আন্তরিক চেষ্টায় এবং দুবার অপারেশনের পরে অ্যানি স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। এরপর তিনি অন্ধদের শিক্ষা দেবার কাজেই নিজেকে উৎসর্গ করেন। অ্যানির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটার কথা বলতে গিয়ে হেলেন তাঁর আত্মজীবনী The story of my life গ্রন্থে লিখেছেন যে সেইদিনটা প্রকৃতপক্ষে ছিল তার আত্মার জন্ম দিন। তার শিক্ষার গুণেই তিনি নতুন জীবন পেয়েছেন। গোড়ার দিকে কয়েক সপ্তাহ হেলেন কিছুতেই অ্যানিকে সহ্য করতে পারতেন না।
অ্যানি কাছে এলেই, হাত পা ছুঁড়ে কান্না জুড়তেন। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে অ্যানি সব সহ্য করেছেন। মায়ের মত স্নেহ মমতা দিয়ে ধীরে ধীরে তিনি হেলেনকে নিজের বশে এনেছেন। তারপর শুরু করেছেন তার শিক্ষার কাজ। হেলেনকে শিক্ষা দেবার কাজটিও ছিল রীতিমত এক কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষা। হৃদয়ভরা মমতা ছিল বলেই অ্যানির ধৈর্য ও কঠোর পরিশ্রম সার্থকতামন্ডিত হয়েছিল।
জলের প্রকৃতি অনুভব করাবার জন্য হেলেনের হাতের ওপর একটু একটু করে জল ঢেলে দেওয়া হত। তারপর জল – ভেজা আঙুল দিয়ে তাকে বারবার করে মাটির ওপর লেখানো হত জল শব্দটি। এভাবে বারবার লিখিয়ে শব্দটির সঙ্গেও তার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো। এভাবে আশপাশের প্রতিটি বস্তুর সাথে হেলেনের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হত। বস্তুর আকার আয়তন স্পর্শ অনুভূতি দিয়ে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হত। তারপর অ্যানি নিজের আঙুল দিয়ে বস্তুর নাম হেলেনের হাতের পাতার ওপরে লিখতেন।
কখনো বা হেলেনকে দিয়ে সেই নাম বারবার করে লেখাতেন। অ্যানির চেষ্টায় ও যত্নে হেলেনের সুপ্ত প্রতিভা ধীরে ধীরে জেগে উঠতে লাগল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সব কিছু শিখে নিতে লাগলেন। এইভাবেই একদিন হেলেন ব্রেল পদ্ধতির মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে ইংরাজি, লাতিন, গ্রীক, ফরাসী, জার্মান প্রভৃতি ভাষা শিক্ষা করলেন। একই সঙ্গে তিনি আঙ্গুলের স্পর্শের মাধ্যমে নিজের মনের ভাবও প্রকাশ করতে শিখলেন।
ইতিপূর্বে নরওয়ের একটি মূক শিশুকে বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে কথা বলতে শেখানো হয়েছিল। অ্যানি সেই পদ্ধতির সাহায্যে দীর্ঘ এগারো মাস চেষ্টার পর হেলেনের মুখে প্রথম কথা ফোটাতে সক্ষম হলেন। পরবর্তীকালে হেলেন নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতেন, তবে কথাগুলো উচ্চারিত হত জড়ানো ভাবে। এই ত্রুটি অবশ্য পরে বিশেষ চিকিৎসায় অনেকটাই কমে গিয়েছিল।
নিজের চেষ্টাতেই হেলেন কুড়ি বছর বয়সের মধ্যেই ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য জ্ঞান অর্জন করলেন। তাকে তখন র্যাডক্লিফ কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। ক্লাশে অধ্যাপকদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন হেলেন। পরে হাতের তালুতে তা লিখে নিতেন। এমন ক্লান্তিকর কাজটি করতে কখনো ধৈর্যচ্যুত হননি তিনি। তার এই অমানুষিক পরিশ্রম ব্যর্থ হয়নি।
চার বছর পরে যখন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পেল, দেখা গেল, হেলেন কলেজে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বি.এ পাশ করেছেন। কলেজ জীবনে হেলেন সহপাঠীদের সঙ্গে প্রাণখুলে মেলামেশা করতেন। কাউকে স্পর্শ করেই তার মানসিক প্রকৃতি অনুভব করার দুর্লভ ক্ষমতা তিনি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে দেখা গেছে কেবলমাত্র স্পর্শদ্বারাই তিনি নির্ভুলভাবে কোন মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে পারতেন। কলেজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হেলেন যোগদান করতেন।
হেলেন কেলার এর কর্ম জীবন: Helen Keller’s Work Life
এই সময়েই তাঁর সাহিত্য চর্চার শুরু। Optimism নামে আত্মজীবনীমূলক একটি ছোটগল্প তিনি কলেজে পড়বার সময়েই লিখেছিলেন। বি . এ . পাশ করবার পর তিনি লেখেন তাঁর আত্মজীবনী The story of my life। জীবনের তেইশ বছরের যে কাহিনী তিনি বিবৃত করেছেন, তা যেমনি মর্মন্তুদ তেমনি রোমাঞ্চকর। কিভাবে অ্যানি দিনে দিনে তাঁর শ্রদ্ধা ভালবাসা নির্ভরতা অর্জন করেছেন, কিভাবে তিনি তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছেন, তাঁকে হাত ধরে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তার এক মর্মস্পর্শী জুলন্ত বিবরণ রয়েছে এই বইয়ের প্রতিটি পাতা জুড়ে।
একটি অন্ধ মূক বধির মেয়ে অমানুষিক ধৈর্য ও পরিশ্রমের বলে নিজেকে মানুষের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, এই সুকঠোর অবিশ্বাস্য জীবন সংগ্রামের কাহিনী যখন দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ল, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সকলে। হেলেনের নাম দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশের মানুষের কাছেও পরিচিত হয়ে গেল। নিজের জীবনের অপূর্ণতা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতেন হেলেন।
অপরের জীবনকে অপূর্ণতার যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি তীব্র ব্যাকুলতা বোধ করতেন। অন্তর দিয়ে নানা সমস্যা বুঝবার চেষ্টা করতেন। পরে এই সব সমস্যা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলেন। তার এই সব লেখায় থাকত, মানুষের জীবনের বিভিন্ন সমস্যার কথা, শিশুদের নিরাপদ জীবন লাভের কথা, খনিশ্রমিকদের বঞ্চিত দুঃখময় জীবনের কথা ও সমাজতন্ত্রের কথা। স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণা, আন্তরিক আকুতি থেকেই মুক্ত মনে এসব কথা লিখতেন হেলেন।
তিনি কোন রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না, কোন গোঁড়ামি বা অন্ধ বিশ্বাসও তার ছিল না। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী র্যাডিকাল পার্টির এক কর্মকর্তা মিঃ ম্যাকি। অ্যানি তাকে বিয়ে করলেন। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর লোকের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল অ্যানিকে। বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের সমর্থক বলে তার নামে অভিযোগ তোলা হয়েছিল।। হেলেন বা অ্যানি অবশ্য এতে বিচলিত হননি। অবজ্ঞার সঙ্গেই দুজনে এসব উপেক্ষা করেছিলেন।
সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন হেলেন। অ্যানি সংসার জীবনে চলে গেলে তিনি জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেবার কাজ বেছে নিলেন। অ্যানির সংসার জীবন সুখের হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল। অ্যানি আবার যুক্ত হলেন হেলেনের জীবনের সঙ্গে। তাঁদের এই বন্ধন আমৃত্যু অবিচ্ছিন্ন ছিল।
এবার থেকে হেলেন আর অ্যানির জীবন কাটতে লাগল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে। কখনো নিজেরাই নানা অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মঞ্চে বক্তৃতার আয়োজন করতেন। দলে দলে লোক তাঁদের সভায় ভিড় করত। হেলেন সম্পর্কে মানুষের মনে ছিল কৌতূহলের সঙ্গে শ্রদ্ধাবোধ। তাঁকে দেখার জন্য তাঁর জীবনের কথা, উপলব্ধি অনুভবের কথা শুনবার জন্য সকলেই যথেষ্ট আগ্রহ বোধ করত।
হেলেন নিজের জীবনের আলোকে সকলকে শোনাতেন আশার কথা, বিশ্বাসের কথা, কিভাবে মনোবল বাড়ানো যায় এসব কথা। হেলেনের কথা জড়ানো ছিল বলে অনেক কথাই সহজে বোঝা যেত না। অ্যানি তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলে দিতেন। এইভাবে বক্তৃতা করে যে অর্থ উপার্জন হত, তা দিয়ে দুজনকে যথেষ্ট অর্থকৃচ্ছ্বতার মধ্যেই দিন কাটাতে হত। তবু তারা কখনো মনোবল হারাননি, তাঁদের উদ্যম আহত হয় নি। অ্যানির দৃষ্টিশক্তি বরাবরই ছিল দুর্বল। ক্রমেই চোখের অবস্থা খারাপ হতে আরম্ভ করেছিল।
কিছুদিনের মধ্যে একরকম অন্ধই হয়ে গেলেন। হেলেন ও অ্যানির একাত্ম জীবন যে ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছিল তার সামনে উপস্থিত হল এক বাধার প্রাচীর। এই দুঃসময়ে তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন এক সহৃদয় তরুণী, তার নাম পলি টমসন। হেলেনের সংগ্রামী জীবন, তার ব্যক্তিত্ব, তার বক্তৃতা পলিকে মুগ্ধ করেছিল। পরবর্তীকালে হেলেনের নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সামান্য বক্তৃতার আয় থেকে যখন দুজনের ব্যয়ভার ক্রমশঃ দুর্বহ হয়ে উঠছিল সেই সময় ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতই কিছু সহৃদয় ব্যক্তি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাদের চেষ্টায় ও দানে হেলেন ও অ্যানির জীবনের অভাব দূর হল। তবে সমস্ত অবস্থার মধ্যেই হেলেন তার আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছেন। নিজের ব্যয়ভার নিজেই যথাসাধ্য বহন করবার চেষ্টা করেছেন।
হেলেন তার জীবনে দেশ বিদেশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তার সংস্পর্শে এসে সকলেই মুগ্ধ অভিভূত হয়েছেন। টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ছিলেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোকাল ফিজিওলজির অধ্যাপক। তিনি নিজের মেয়ের মত হেলেনকে ভালবাসতেন। নানাভাবে তাকে সাহায্যও করতেন।
একবার তিনি হেলেন আর অ্যানিকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেরোন। দেশের বাইরে সেই প্রথম পা রাখেন হেলেন। নতুন দেশে নতুন পরিবেশে দৃষ্টি দিয়ে তিনি কিছু প্রত্যক্ষ করতে না পারলেও অনুভব দিয়ে সেই অচেনা জগৎকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করতেন। একবার যে পথে যেতেন সে – পথ কখনো ভুলতেন না। পথে কোথায় হাসপাতাল, কোথায় গীর্জা কিংবা নদী, বাগান বা কারখানা — এসবের অস্তিত্ব তিনি নির্ভুলভাবে বুঝতে পারতেন।
অ্যানির আন্তরিক চেষ্টায় হেলেনের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল এক আশ্চর্য শক্তি। কোন মানুষের কন্ঠনালীর ওঠা পড়া অনুভব করেই তিনি তার প্রতিটি কথা বুঝতে পারতেন। একবার মাত্র যাকে স্পর্শ করতেন, দীর্ঘকাল পরেও তাকে চিনতে তাঁর ভুল হত না। হেলেন শিশুদের মধ্যেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেছেন হেলেন। এই অসামান্য প্রতিভাময়ী নারী সর্বত্রই শ্রদ্ধার সঙ্গে গৃহীত হয়েছেন।
রাষ্ট্রনায়ক থেকে সাধারণ মানুষ তাকে দেখে তার কথা শুনে সকলেই হয়েছেন বিস্ময়বিমুগ্ধ। তার গুণমুগ্ধ অনুরাগীদের মধ্যে ছিলেন বার্নার্ড শ, মার্ক টোয়েন, উড়ু উইলসন, জওহরলাল নেহরু, স্যার হেনরি আরভিং প্রমুখ এবং বিশ্বের আরও অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে হেলেনের অনুরাগীদের জড়িয়ে একদল কুৎসাবাদী লোক তার নামে অপবাদ রটনা করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। দীর্ঘাঙ্গী, স্বাস্থ্যবতী হেলেনের আকর্ষণী শক্তিই তঁার নিন্দা রচনাকারীদের ইন্ধন জুগিয়ে ছিল।
অনেকে এ – ও প্রচার করেছিল যে হেলেন যশ ও খ্যাতির লোভে অন্ধ সেজে থাকেন, নিজের কথা যা বলেন সবই বানানো মিথ্যা। যাইহোক, হেলেন ছিলেন সমস্ত কুৎসা ও অপপ্রচারের উর্ধ্বে। গভীর আত্মবিশ্বাস ও মানসিক দৃঢ়তা নিয়েই তিনি সর্বপ্রকার প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন। হলিউডের এক পরিচালকের অনুরোধে হেলেন একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ছবির নাম রাখা হয়েছিল Deliverence।
এই ছবিতে হেলেনের প্রকৃত জীবনকে বাদ দিয়ে তাকে অন্য ভূমিকায় তুলে ধরা হয়েছিল। তাকে স্থান দেওয়া হয়েছিল জোয়ান অব আর্কের সমপর্যায়ে শান্তির লক্ষে আত্মোৎসর্গকারী এক অসাধারণ নারীরূপে উপস্থাপিত হয়েছিলেন তিনি। এই চলচ্চিত্র অবশ্য দর্শকমনে আশানুরূপ সাড়া জাগাতে পারেনি। আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর ব্লাইন্ড প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক ছিলেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। ১৯২২ খ্রিঃ তিনি মারা যান।
তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুসারে হেলেন এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। অন্ধদের কল্যাণে কাজ করার এক বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র পেলেন তিনি। দেশের অন্ধ ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষার জন্য বহু সংখ্যক স্কুল প্রতিষ্ঠা হল তাঁর উদ্যোগে। অন্ধদের মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তিনি তার জন্যও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে সব মানুষ নিজেদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল তাদের কল্যাণের জন্যও তিনি নিরলসভাবে চেষ্টা করে গেছেন। কেবল আমেরিকাই নয়, পৃথিবীর বহু দেশের অন্ধ – কল্যাণ সংস্থার সঙ্গেই হেলেন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। নিজের জীবনই হয়ে উঠেছিল তার সমস্ত কর্মপ্রেরণার উৎস। দেশে দেশে ঘুরে সভাসমিতিতে বক্তৃতা করে হেলেন অন্ধদের কল্যাণকর্মের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। সেই অর্থে তিনি গড়ে তুলেছিলেন পঞ্চাশটিরও বেশি প্রতিষ্ঠান।
তাঁর চেষ্টাতেই হাজার হাজার অন্ধ আশাহত মানুষ, বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষালাভ করে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কেলারের শিক্ষয়িত্রী ও জীবনের সর্বক্ষণের ও সর্বকাজের সঙ্গী ও সহযোগী অ্যান মারা যান ১৯৩৬ খ্রিঃ। অ্যানের শিক্ষায় ও সহযোগিতাতেই হেলেন লাভ করেছিলেন জীবনের আলো। সেই আলো তিনি উৎসর্গ করেছিলেন পৃথিবীর সব মানুষের কল্যাণে। অ্যানের পরে হেলেন তার সুবিশাল কর্মযজ্ঞে সঙ্গী পেলেন পলি টমসনকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হলে তিনি দেশে দেশে ঘুরে প্রচার করেছেন শান্তির বাণী।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও পরিচয় হয় হেলেনের। কবিকে তিনি খুবই শ্রদ্ধা করতেন। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে হেলেন শান্তিনিকেতনে এসে গভীর আনন্দ লাভ করেছিলেন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক স্নাতক উপাধিতে ভূষিত করেন। দেশ বিদেশের বহু সম্মান লাভ করেছেন তিনি। খ্যাতি, সম্মান, অর্থ— এই সবকিছুর মধ্যেই নিজের আদর্শ অটুট রেখে কর্তব্য করে গেছেন হেলেন।
হেলেন কেলার এর মৃত্যু: Helen Keller’s Death
প্রায় দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর মানুষের কল্যাণে কাজ করে কর্মরত অবস্থাতেই ১৯৬৮ খ্রিঃ ১ লা জুলাই হেলেনের কর্মময় জীবনের অবসান হয়।