হো চি মিন জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Ho Chi Minh Biography in Bengali. আপনারা যারা হো চি মিন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হো চি মিন এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
হো চি মিন কে ছিলেন? Who is Ho Chi Minh?
হো চি মিন (১৯ মে ১৮৯০ – ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯) জন্মনাম-Nguyễn Sinh Cung, এছাড়াও Nguyễn Tất Thành, Nguyễn Ái Quốc, Bác Hồ, বা কেবল Bác নামে পরিচিত, ছিলেন ভিয়েতনামের একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা। তিনি ভিয়েতনামের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী (১৯৪৬–১৯৫৫) এবং রাষ্ট্রপতির (১৯৪৫–১৯৬৯) পদে আসীন ছিলেন। তিনি একজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তিনি আমৃত্যু ভিয়েত কং-এর নেতৃত্ব দান করেন। তিনি ভিয়েতনামের ওয়ার্কার্স পার্টির চেয়ারম্যান এবং ফার্স্ট সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
হো চি মিন জীবনী – Ho Chi Minh Biography in Bengali
নাম | হো চি মিন |
জন্ম | 19 মে 1890 |
পিতা | নগুয়েন সিনহ সাক |
মাতা | Hoàng Trù |
জন্মস্থান | কিম লিয়েন, ন্যাম ডান, এনঘে আন, আনাম, ফরাসি ইন্দোচীন |
জাতীয়তা | ভিয়েতনামী |
পেশা | রাজনীতিবিদ, বিপ্লবী, প্যাস্ট্রি শেফ |
মৃত্যু | 2 সেপ্টেম্বর 1969 (বয়স 79) |
হো চি মিন এর জন্ম: Ho Chi Minh’s Birthday
হো চি মিন 19 মে 1890 জন্মগ্রহণ করেন।
অকুতোভয় সৈনিকের মত যিনি সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছেন স্বদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ভিয়েৎনামের প্রাণপুরুষ সেই চিরসংগ্রামী মানুষটিকে বিশ্বের মানুষ গ্রহণ করেছে বিপ্লবের প্রতীক রূপে, আলোকের দিশারী রূপে। অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর শৌর্যের অধিকারী এই অবিস্মরণীয় মানুষটির নাম হো – চি মিন। অবশ্য দেশের মানুষের কাছে আঙ্কেল নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম শুরু করেছিলেন ১৮ বছর বয়সে।
এই সংগ্রাম ছিল মাতৃভূমির স্বাধীনতার সংগ্রাম। নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্যেই ৭৯ বছর বয়সে জীবনপাত হয়, স্বদেশের স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করা তার ভাগ্যে হয়ে ওঠে নি। কিন্তু এই সংগ্রামী সৈনিক পৃথিবীর মানুষের মনে লাভ করেছেন চিরস্থায়ী আসন – অমরত্ব।
হো চি মিন এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Ho Chi Minh’s Parents And Birth Place
নখেআন হল ভিয়েতনামের একটি প্রদেশ। এই প্রদেশের অখ্যাত এক গ্রামে ১৮৯০ খ্রিঃ ১৯ শে মে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে হো চি মিনের জন্ম। তার বাবার নাম ছিল নগুয়েন মিন হয়ে। হোয়ের প্রকৃত নাম নগুয়েন য়ান থাট। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ। ছেলেবেলা থেকেই কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হতে থাকেন হো। আশ্চর্যভাবে ওই বয়স থেকেই তিনি এ বিষয়ে সজাগ হয়ে উঠেছিলেন। তাই যথাসাধ্য বাবাকে খেতের কাজে সাহায্য করতে চেষ্টা করতেন।
হো চি মিন এর ছোটবেলা: Ho Chi Minh’s Childhood
খেলাধুলায় মেতে থেকে সময় নষ্ট করা তিনি একদম পছন্দ করতেন না। বাল্য বয়সে মায়ের কাছে গল্প শুনতে ভালবাসতেন হো। বীর মানুষদের গল্পই তাকে বেশি আকৃষ্ট করত। এ সংসারে মায়ের সান্নিধ্যই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। এগারো বছর বয়সে মাকে হারিয়ে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন তিনি। মায়ের অকাল মৃত্যু হোয়ের জীবনে এক বিরাট আঘাত হয়ে বাজল। চিকিৎসার অভাবে রুগ্ন মায়ের মৃত্যুকে তিনি যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। পরিণত বয়সেও এই স্মৃতি তাঁকে বিহ্বল করে তুলত।
হো চি মিন এর শিক্ষাজীবন: Ho Chi Minh’s Educational Life
১৯০১ খ্রিঃ হোকে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। পড়াশুনায় গভীর আগ্রহ ছিল তার। কৃতিত্বের সঙ্গেই পাঠশালার পাঠ শেষ করলেন। গ্রামে বড় স্কুল ছিল না। হোকে ভর্তি করে দেওয়া হল হুয়ে শহরের স্কুলে। শহরের পরিবেশে এসে হো প্রথম বুঝতে পারলেন, তাঁদের দেশ শাসন করছে ফরাসীরা। তারা স্বাধীন নয়, পরাধীন। নিজেদের দেশে তাদের কোন অধিকার নেই। হো যেই স্কুলে পড়তেন, তার প্রধান শিক্ষক ছিলেন ফরাসী। অন্য শিক্ষকরা ভিয়েৎনামী।
তাঁদের সকলকে প্রধান শিক্ষকের মর্জি – মেজাজ মেনে চলতে হয়। আর ছাত্রদের মধ্যে যারা ফরাসী সমস্ত সুযোগ – সুবিধা তারাই ভোগ করতে পায়। সামান্য পান থেকে চুন খসার অপরাধে কঠোর সাজা ভোগ করতে হয় ভিয়েৎনামী ছাত্রদের। এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবার কোন পথ নেই। এইভাবেই চলছিল দীর্ঘদিন। শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রক্ষা সম্ভব হল না ভিয়েৎনামী ছাত্রদের। উঁচু ক্লাশের ছাত্ররা একদিন ঠিক করল তাঁরা সমবেত ভাবে প্রতিবাদ জানাবে। একদিন ক্লাশে ঢুকলেন প্রধান শিক্ষক। স্কুলের নিয়ম মত ছাত্ররা উঠে দাঁড়িয়ে শিক্ষককে সম্মান জানাল।
দেখা গেল কেবল ফরাসী ছাত্ররাই উঠে দাঁড়িয়েছে, ভিয়েৎনামী ছাত্ররা সকলেই যার যার সিটে বসে রয়েছে। এতো রীতিমত অপমান। রাগে ফেটে পড়লেন প্রধান শিক্ষক। ভিয়েৎনামী ছাত্রদের এমন সাহস কি করে হয় তা ভেবে তিনি অত্যন্ত কঠোর হয়ে উঠলেন। ক্লাশের সেরা ছাত্র হো। শান্ত স্বভাবের এই ছেলেটিকেই প্রধান শিক্ষক নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন কাদের প্ররোচনায় ছাত্ররা তাঁকে অপমান করল।
হো কিন্তু কোন কথারই জবাব দিলেন না। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এবারে রাগে গর্জন করে উঠলেন প্রধান শিক্ষক। চিৎকার করে তিনি জানতে চাইলেন, কেন ভিয়েৎনামী ছাত্ররা তাঁকে অপমান করেছে ? এবারে মুখ খুললেন হো। দৃঢ় অকম্পিত কণ্ঠে হো জানিয়ে দিলেন, ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ করে তিনি যে বৈষম্যমূলক ব্যবহার করছেন তারই প্রতিবাদ জানিয়েছে তাঁরা। সবকথা জানালে পরিণতি কি হবে বিলক্ষণ জানা ছিল হোয়ের। তবু নিৰ্ভীক দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি প্রধান শিক্ষকের অন্যায় ব্যবহারের প্রতিবাদ জানাতে কুণ্ঠিত হলেন না।
সেদিন প্রবল ক্রোধে উন্মত্তের মত বেত চালিয়ে প্রধান শিক্ষক হোয়ের শরীর রক্তাক্ত করে দিয়েছিলেন। নীরবে সবই সহ্য করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেদিনই গাঁয়ের শান্ত লাজুক ছেলেটির মধ্যে নতুন এক মানুষের জন্ম হল। পরাধীনতার যন্ত্রণা কিশোর হো অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলেন। সঙ্কল্প নিলেন, পরাধীনতার এই গ্লানি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। তার জন্য জীবন মরণ সংগ্রাম তিনি করবেন। এরপরই নতুন খাতে প্রবাহিত হল হোয়ের জীবন।
তিনি নিজের দেশের ইতিহাস, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করতে শুরু করলেন। এভাবে জানতে পারলেন মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কিভাবে সংগ্রাম করেছে, লাঞ্ছিত হয়েছে। হো লক্ষ্য করলেন সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র সবদেশেই এক। একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে সমস্ত পরাধীন দেশে। আজকে যে দেশ উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েৎনাম নামে পরিচিত, পূর্বে তা ছিল ইন্দোচীনের অংশ — টংসিন, আনাম, কোচিন চায়না প্রভৃতি অঞ্চলে বিভক্ত। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে ফবাসী ধর্মযাজকরা এখানে আসে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে। শ্বেতাঙ্গরা এই একই কৌশলে পৃথিবীর দেশে দেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে।
সেই সময়ে ভিয়েৎনামের সম্রাট ছিলেন মিংমাং। তিনি যাজকদের দেশের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করবার অনুমতি দিয়েছিলেন। ফরাসী যাজকরা বছর কয়েক নিজেদের ধর্মচর্চার আড়াল নিয়ে থাকলেও অচিরেই তাদের স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ল। দ্রারিদ্যক্লিষ্ট, শোষিত ভিয়েৎনামীদের মধ্যে তারা ধর্ম প্রচারের কাজ শুরু করেন। কিছু পাওয়ার লোভে পড়ে তারা দলে দলে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে লাগল। এই সুযোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল উপাসনালয় ৷ সম্রাট বিদেশীদের এই আচরণ সহ্য করলেন না।
স্থানীয় মানুষরাও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তাদের আক্রমণে অনেক ধর্মযাজককে প্রাণ হারাতে হল, অনেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল ফ্রান্সে। এই ঘটনার প্রতিশোধ নেবার জন্য বিরাট সৈন্যবাহিনী ভিয়েৎনামে পাঠালেন ফরাসী সম্রাট। ১৮৬০ খ্রিঃ তারা সায়গনে অবতরণ করল। ভিয়েৎনাম সরকার বাধা দেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফরাসী সৈন্যদের কাছে তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হল। সেই প্রথম সায়গনে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ আস্তানা গাড়ল। ১৮৮৩ খ্রিঃ মধ্যেই সমগ্র ভিয়েৎনামে ফরাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। স্বাধীনতা হারাল ভিয়েৎনাম। প্রতিবাদের কোন পথ আর রইল না। নির্মম অত্যাচার আর পীড়ন বরাদ্দ হল প্রতিবাদীদের জন্য।
হো চি মিন এর কর্ম জীবন: Ho Chi Minh’s Work Life
বিশ শতকের প্রথম দিকেই ভিয়েৎনামে সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় চেতনার সঞ্চার হতে থাকে। স্বাধীনতার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন সংগঠিত হতে লাগল। হুয়ে শহরে এই সময়ে গোপনে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ১৮ বছর বয়সে হো চি মিন এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। দলের হয়ে গোপনে জনসাধারণের মধ্যে স্বাধীনতার কথা প্রচার ও প্রচারপত্র বিলি করলেন তিনি গোড়ার দিকে।
অত্যাচারী ফরাসীদের বিতাড়িত করতে না পারলে যে এ দেশের মুক্তি নেই এই কথা তিনি পৌঁছে দিতে লাগলেন সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে। একদিন পুলিসের হাতে ধরা পড়ে প্রচন্ড মার খেলেন হো। ক্ষতবিক্ষত শরীরে শয্যাশায়ী থাকতে হল কয়েকদিন। ফরাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ তার মনে আরও তীব্র হয়ে উঠল এই ঘটনার মধ্য দিয়ে। এরপরেই তিনি সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করলেন বিপ্লবী আন্দোলনের কাজে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা।
ফরাসী সরকার গোয়েন্দাবাহিনীর মাধ্যমে বিপ্লবীদের খবরাখবর সংগ্রহে তৎপর হয়ে উঠল। ষড়যন্ত্রের একটা পরিকল্পনাও তারা বানচাল করে দিতে সক্ষম হল। এরপরেই শুরু হল ধরপাকড়। অধিকাংশ বিপ্লবী নেতাই ধরা পড়লেন। আত্মগোপন করলেন হো। কিন্তু গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে একের পর এক আস্তানা বদল করে কতদিন আর চলা যায়। এই সময় সহযোদ্ধাদের সহযোগিতায় তিনি বিদেশগামী একটি জাহাজে নাবিকের কাজ নিয়ে পশ্চিম দেশে পাড়ি জমালেন। হোয়ের দেশ ছাড়ার উদ্দেশ্য ছিল ফরাসী কর্তৃপক্ষের চোখে ধূলো দেওয়া।
দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন দেশের শিক্ষা সংস্কৃতি ও শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা। পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের সঙ্কল্প যাঁর মনপ্রাণ জুড়ে সদা আলোড়িত নাবিকের কষ্টসাধ্য কাজে অভ্যস্ত হতে তাঁকে বেগ পেতে হবে কেন। হো দিব্যি মানিয়ে নিলেন। জাহাজে দেশ থেকে দেশে ঘুরতে ঘুরতে একসময় হো এসে পৌঁছলেন ফ্রান্সে। এখানেই আশ্রয় নিলেন শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এখানে ফরাসীদের দেখে তাব বিস্ময়ের পরিসীমা রইল না। ভিয়েৎনামেও ফরাসী তিনি দেখেছেন। তারা যেন নরদেহে এক একটি পশু বিশেষ। তাদের নৃশংসতা ও বর্বরতার তুলনা হয় না।
কিন্তু প্যারিসে দেখলেন ফরাসীরা ভদ্র মার্জিত, সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ, রীতিমত সুসভ্য জাতি। যারা ভিয়েৎনামে উপনিবেশ গড়ে তুলেছে তাদের সঙ্গে এদের কোন তুলনাই হয় না। তিনি স্থির করলেন, এই ফ্রান্স থেকেই তিনি সংগ্রহ করবেন তার বিপ্লবের ইন্ধন। একটা মাথা গোঁজার ঠাই তো চাই। ঘোরাঘুরি করে একটা ছোট দোকানে কাজ জুটিয়ে নিলেন। কিন্তু বেশি দিন এক জায়গায় থাকতে ভরসা পান না, পাছে ফরাসী পুলিশের নজরে পড়ে যেতে হয়। বারকয়েক কর্মস্থলের পরিবর্তন করলেন। এই সময়েই তার পরিচয় হল কয়েকজন ফরাসী সমাজতান্ত্রিক নেতার সঙ্গে। ইতিপূর্বে মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ৷
সমাজবাদ প্রতিটি দেশ থেকে উপনিবেশবাদ শোষণ বঞ্চনা দূর করার সঙ্কল্প ঘোষণা করেছে। মানুষে মানুষে সমতা ও মৈত্রী গড়ে তোলাই মহান সমাজবাদের লক্ষ। সেই সময় দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়া থেকে আরো কয়েকজন বিপ্লবীনেতা প্যারিসে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপিত হল হোয়ের। প্যারিসে ফরাসী সোসালিস্ট পার্টির অধিবেশন হল ১৯২৬ খ্রিঃ। সেই সময় হো ত্রিশ বছরের যুবক। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অনেক প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দেন। ভিয়েৎনামের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদিলেন হো।
এই অধিবেশনেই হো তার বিখ্যাত বক্তৃতায় বিশ্বের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরলেন নির্যাতীত ভিয়েৎনামের প্রকৃত চিত্র। ফরাসী শাসকদের শোষণ – নির্যাতনের তথ্য। তিনি জানালেন, যারাই সামান্য প্রতিবাদ করছে কঠোর হস্তে তাদের কন্ঠরোধ করা হচ্ছে। ভিয়েৎনামী নারীদের হতে হচ্ছে ফরাসী সৈনিক ও রাজ- পুরুষদের লালসার বলি। হাজার হাজার তরুণের জীবন তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে চলেছে কারাগারের অন্ধ কুঠুরিতে। দেশের মানুষ অমানুষিক পরিশ্রমে যা উৎপাদন করছে তা পাচার হচ্ছে বিদেশে, আর অনাহারে, অশিক্ষায় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পশুর মত জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে তারা।
হো কেবল তার দেশের সমস্যার কথাই বললেন না, ভিয়েৎনামের মুক্তির জন্য আন্তরিকভাবে সকলের কাছে সাহায্য প্রার্থনাও করলেন। রাশিয়া সেই সময় কিছু দিন হল সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠনের শক্তি সামর্থ্যও সীমাবদ্ধ। হো তার প্রত্যাশা মত সাহায্য না পেলেও নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ পেলেন। হো এবারে স্থির করলেন, বাইরের কোন শক্তির সাহায্য ছাড়াই তিনি ভিয়েৎনামের মুক্তির সংগ্রাম পরিচালনা করবেন। তার শক্তি হবে দেশের মানুষের ঐক্য আর সাংগঠনিক প্রয়াস। এরপর হো প্রতিষ্ঠা করলেন ভিয়েৎনাম কমিউনিস্ট পার্টি।
যে সকল ভিয়েৎনামী রাজনৈতিক কর্মী প্যারিসে আত্মগোপন করেছিল তাঁদের নিয়েই তিনি গঠন করলেন এই রাজনৈতিক দল। সময়টা ১৯২০ খ্রিঃ। বিদেশে সামান্য কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর উদ্যোগে গঠিত এই দলই পরবর্তীকালে সমগ্র ভিয়েৎনামে শাখা – প্রশাখা বিস্তার করে বিশাল এক মহীরুহে পরিণত হয়েছিল ৷ সংগঠনের কাজের পাশাপশি পড়াশুনাও করে চলেছিলেন হো। ক্রমে লেনিনের রচনাবলীর সঙ্গে পরিচিত হলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, লেনিনের মতাদর্শ ও কর্মধারাই অনুসরণ করতে হবে তাঁকে।
লেনিনের পথই প্রকৃত বিপ্লবের পথ। প্যারিসে থাকার সময়েই হো বিভিন্ন পত্র – পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করতে থাকেন। প্যারিসে পাঁচ বছর ছিলেন হো। তারপর সেখান থেকে গেলেন মস্কোতে। সেখানে একবছর থেকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের কাছ থেকে রুশ বিপ্লবের বিস্তাবিত ইতিহাস জেনে নিলেন। এই সময়ে তাঁর ভিয়েৎনাম সম্পর্কে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশিত হল। মস্কোতেই হোর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে। চীন থেকে কয়েকজন বিপ্লবী নেতা এসেছিলেন, তাদের সঙ্গেও পরিচিত হলেন হো।
দেশের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে বিদেশে থেকে যে তা সম্ভব নয় হো অবিলম্বে তা উপলব্ধি করলেন। কিন্তু ভিয়েৎনামে প্রত্যাবর্তন সম্ভব ছিল না। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে হো ১৯২৫ খ্রিঃ এলেন চীনের ক্যান্টন শহরে ৷ সেই সময়ে একাধিক বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠেছিল ভিয়েৎনামে। সরকার প্রতিটি সংগঠনকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল ; সদস্য ও নেতাদের অধিকাংশকে বন্দি করে ছিল। যারা গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই পালিয়ে এসে আত্মগোপন করেছিল ক্যান্টনে। ফাই বই চাও ভিয়েৎনামে সবচেয়ে বড় বিপ্লবী দল গঠন করেছিলেন।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবার জন্য দেশের হাজার হাজার তরুণ তার দলে যোগ দিয়েছিলেন। এতবড়দল পরিচালনা করবার মত সাংগঠনিক দক্ষতা ও ব্যক্তিত্ব ফাই বই চাও এর ছিল না। এছাড়া তার সুনির্দিষ্ট কোন কর্মসূচীও ছিল না। ফলে অধিকাংশ সদস্যই দলের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। ক্যান্টনে এসে হো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের নিয়ে গড়ে তুললেন ভিয়েৎনাম বিপ্লবী তরুণ সংঘ। পরে এই দলই হয় ভিয়েৎনামের প্রধান রাজনৈতিক দল — থান নিয়েন।। সেই সময় চীনের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন কমিউনিস্ট বিদ্বেষী চিয়াংকাইশেক।
তাঁর নির্দেশে চীনে ১৯২৭ খ্রিঃ হাজার হাজার কমিউনিস্টকে বন্দি করা হয়। হো আত্মগোপন করে রইলেন। পরে এক বৌদ্ধসন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে শ্যামদেশে যান এবং সেখান থেকেই দলের কর্মীদের নির্দেশ পাঠিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তুললেন ছোট ছোট সংগঠন। ইতিমধ্যে ১৯২৮ খ্রিঃ ফরাসী শাসকরা বহু ভিয়েৎনামী বিপ্লবী নেতাকে হত্যা করে কমিউনিস্ট আন্দোলন স্তব্ধ করবার চেষ্টা করল। সেই সময় হো ছিলেন হংকং এ। তার অবর্তমানেই বিচারে তাঁকে প্রাণদন্ড দেওয়া হল। হো – চি – মিন গোপনে দেশত্যাগের আগেই পুলিসের হাতে ধরা পড়ে গেলেন।
কিছুদিন পরেই অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সেখান থেকে গোপনে পালিয়ে তিনি মস্কো চলে যান ৷ ১৯৩৪ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৮ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি মস্কোতেই থাকেন। ইতিমধ্যে ভিয়েৎনামে গঠিত হয়েছে ভিয়েৎনাম কমিউনিস্ট পার্টি। চীনেও কমিউনিস্ট পার্টি বিরাট শক্তিতে পরিণত হয়েছে। জাপান চীন আক্রমণ করলে তাদের প্রতিহত করবার জন্য চিয়াংকাইশেক কমিউনিস্টদের সঙ্গে হাত মেলালেন। গঠিত হল নতুন গেরিলা বাহিনী। সুযোগ বুঝে হো মস্কো থেকে ফিরে এসে গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিলেন। এখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় ফান ভন ডঙ এবং নুয়েন গিয়াপের সঙ্গে। পরবর্তীকালে হো – র অবর্তমানে তারাই দলকে পরিচালনা করেছিলেন।
১৯৪১ খ্রিঃ ছদ্মনামে ছদ্মবেশে দেশে ফিরে এসে হো এক চাষীর বাড়িতে আশ্রয় নিলেন ৷ সেই বছরই গোপনে ইন্দোচীন কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম প্লেনাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের কথা ঘোষণা করা হল। রাষ্ট্রের নাম হল ভিয়েৎনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ডাক দেওয়া হল সর্বাত্মক বিপ্লবের। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই সময় হো চিয়াংকাইশেকের হাতে বন্দি হয়ে জেলে নিক্ষিপ্ত হলেন। বন্দি অবস্থায় তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। সব অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করেও হো প্রাণে বেঁচে ছিলেন। শেষপর্যন্ত তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে গিয়াপের নেতৃত্বে সুসংগঠিত গেরিলা বাহিনী বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ফরাসী বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাল।
জাপান সেনাবাহিনী ও ভিয়েৎনাম আক্রমণ করে বহু ফরাসী সৈন্য নিহত করল। গিয়াপ এই সুযোগে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর সাহায্যে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল অধিকার করে নিলেন। নিজেদের দিন শেষ বুঝতে পেরে ফরাসীরা অপদার্থ সম্রাট বা ওদাই – এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করল। প্রতিবাদে হো ১৯৪৫ খ্রিঃ ২০ শে আগস্ট দেশজুড়ে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিলেন ! ফরাসীদের সঙ্গে যোগ দিল ব্রিটিশ বাহিনী। এই সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হল ভিয়েৎনামী মুক্তিবাহিনী। বিপ্লবীদের কাছে হো ছিলেন প্রেরণার আদর্শ। গেরিলা যোদ্ধাদের দিনে রাতে সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন তিনি।
পাহাড়ে জঙ্গলে থেকে একই খাবার তিনি ভাগাভাগি করে খেয়েছেন। জয়ে পরাজয়ে তিনি তাদের উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়েছেন, অভিনন্দন জানিয়েছেন। শান্তি আলোচনার মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতা অর্জন কাম্য ছিল শান্তিবাদী হোর। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আপোসহীন মনোভাব তাঁকে দীর্ঘ চারবছর ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বাধ্য করে। অবশেষে ভিনোমী জনগণের সাহায্যে এগিয়ে এল চীন ও রাশিয়া। অপরদিকে ফরাসীদের শক্তি বৃদ্ধি করল আমেরিকা।
কিন্তু যুদ্ধের শেষ মীমাংসা হল দিয়েন বিয়েন ফুতে। ভিয়েৎনামে ৮০ বছরের ফরাসী শাসনের অবসান ঘটাল ভিয়েৎনামীদের বিজয়। ১৯৫৬ খ্রিঃ জেনেভায় আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের শর্ত অনুসারে বিভক্ত করা হল ভিয়েৎনামে। বাধ্য হয়েই দেশ বিভাগ মেনে নিতে হলো হোকে। উত্তর ভিয়েৎনামের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন হো চি মিন। নো দিন জিয়েস হলেন দক্ষিণের রাষ্ট্রনায়ক। ইনি ছিলেন ধনতান্ত্রিক আমেরিকার হাতের পুতুল। তার বকলমে আমেরিকাই রইল দক্ষিণ ভিয়েৎনামের প্রশাসক। কিন্তু অত্যাচারী শাসক নো দিনের বিরুদ্ধে অল্পদিনের মধ্যেই ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠল দেশ।
দাবি উঠল অখন্ড ভিয়েৎনামের। দক্ষিণের গণ আন্দোলনকে সমর্থন জানালেন হো। নো দিনকে সাহায্য করবার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল আমেরিকা প্রস্ফুটিত হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন নৃশংস চেহারা। বৃষ্টির মত নাপাম বোমা বর্ষণ করে আমেরিকা ভিয়েৎনামীদের ধ্বংস করবার চেষ্টার ত্রুটি করল না। কিন্তু হোচিমিনের নেতৃত্বে ভিয়েৎনামের সংগ্রামী মানুষ দুরন্ত মনোবলের সঙ্গে লড়াই করে সাম্রাজ্যবাদীদের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে লাগল।
হো চি মিন এর মৃত্যু: Ho Chi Minh’s Death
যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ১৯৬৯ খ্রিঃ ১০ ই মে অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন হো। তার জ্বলন্ত দেশপ্রেম বিনষ্ট হল না। প্রতিটি ভিয়েৎনামীকে আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান করে তুলল। ভিয়েৎনামের মাটি থেকে বিতাড়িত হল আমেরিকা। ভিয়েৎনামে উড্ডীন হল স্বাধীনতাব পতাকা।