সিন্ধু সভ্যতা ও হরপ্পা সভ্যতা | Indus Civilization and Harappan Civilization

5/5 - (2 votes)

সিন্ধু সভ্যতা ও হরপ্পা সভ্যতা | Indus Civilization and Harappan Civilization : সময় অনুসারে যদি ইতিহাসের ভাগ হয় তাহলে দু’টি প্রধান ভাগ আমাদের সামনে এসে পড়ে-(ক) প্রাগৈতিহাসিক যুগ (খ) ঐতিহাসিক যুগ। পূর্বকালে হরপ্পীয় সভ্যতাকে প্রাক্-ঐতিহাসিক যুগের সভ্যতার অন্তর্গত বলে মনে করা হত; কিন্তু আধুনিককালে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। তা সত্ত্বেও আমরা যখন ভারতীয় ইতিহাসকে কালানুসারে (ক) প্রাচীন যুগ (খ) মধ্য যুগ (গ) আধুনিক যুগ এইভাবে ভাগ করি, তখনও কিন্তু হরপ্পা সভ্যতাকে আমরা প্রাচীন যুগের অন্তর্গত করতে পারি না; কারণ হরপ্পা সভ্যতা প্রাচীন যুগেও প্রাচীনতম পর্যায়ে অবস্থিত; অর্থাৎ, হরপ্পা সভ্যতা ভারতীয় ইতিহাসের আদিমতম এবং প্রথমতম উল্লেখযোগ্য ধারা।

এই সভ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে কয়েকটি কথা মনে রাখা দরকার। প্রথমত, হরপ্পীয় সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের সমস্ত জ্ঞান প্রত্নতত্ত্বভিত্তিক এবং এই জ্ঞানের পরিধি অন্যান্য জ্ঞানের বিষয়ের মতোই ক্রমবর্ধমান। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, পূর্বে আলোচনাকে মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা এই দু’টি শহরের মধ্যেই সীমিত রাখা হত। কিন্তু বর্তমানে প্রাক্-হরপ্পা, হরপ্পা এবং হরপ্পা-উত্তর সভ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, হরপ্পা সভ্যতা ভারতীয় সভ্যতাকে প্রাচীন বিশ্বের সমকালীন নদীমাতৃক সভ্যতার সঙ্গে এক পংক্তিতে দাঁড় করিয়েছে এবং হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে সুমেরীয় এবং মেসোপটেমিয়ার যোগাযোগ এখন প্রত্নতাত্ত্বিকদের গভীর গবেষণার বিষয়। তৃতীয়ত, হরপ্পীয় সভ্যতা ভারতীয় সভ্যতার কালানুক্রমিক ধারাকে প্রসারিত করেছে। পূর্বে আর্য সভ্যতা থেকে ভারতীয় সভ্যতার শুরু ধরা হত; কিন্তু হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কারের পর বোঝা গেল যে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন সহস্রাধিক বছর বা তারও পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশে এক জনগোষ্ঠী ছিল যারা কৃষি, হস্তশিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে একটি সভ্যতা গড়ে তুলেছিল।এছাড়াও, হরপ্পা সভ্যতার নামকরণ সম্বন্ধে দু’টি একটি কথা বলা প্রয়োজন। পূর্বে এই সভ্যতাকে “সিন্ধু সভ্যতা” বলা হত; কারণ এই সভ্যতার দু’টি প্রধান কেন্দ্র হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থিত বলেই প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকেরা একে “সিন্ধু সভ্যতা” বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এই নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ইরাবতী (রাভি) নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত প্রাচীন হরপ্পা শহরটি প্রাচীনত্ব, কৃষি ও সংস্কৃতির বিচারে সিন্ধু উপত্যকায় অবস্থিত অন্যান্য শহর অপেক্ষা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভূগর্ভস্থিত খননকার্যের ফলে হরপ্পা অঞ্চলে যেসব প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে, যেমন তামার তৈরি অস্ত্র, তৈজসপত্রাদি, পোড়ামাটির জিনিস ইত্যাদি, সেগুলি দেখে মনে হয় নিকটবর্তী স্থানের অধিবাসীরা হরপ্পাবাসীদের অনুকরণ করত; এই অনুকরণকে সহজেই সংস্কৃতির চিহ্ন বলে মনে করা যায়। দ্বিতীয়ত, উৎখননের দ্বারা প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু থেকে প্রমাণ করা যায় যে, হরপ্পা সভ্যতা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার থেকে অনেক প্রাচীন। আধুনিক খননকার্যের ফলে অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী, রফিক মুঘল প্রমাণ করেছেন যে হরপ্পার সর্ব নিম্নতলে একটি প্রাক্-হরপ্পা সভ্যতার অবস্থিতি রয়েছে। প্রাক্-হরপ্পা সভ্যতার উপস্থিতি নিরবচ্ছিন্নতার কথা প্রমাণ করে যা অন্যান্য অঞ্চলে পাওয়া যায় না। তৃতীয়ত, প্রত্নতত্ত্বের নিয়ম অনুসারে কোন প্রত্নবস্তু প্রথম কোন স্থানে পাওয়া গেলে সেই এলাকার সভ্যতার নাম প্রথম স্থানটির নামানুসারে করা হয়ে থাকে। প্রথম আলেকজান্ডার কানিংহাম হরপ্পা থেকে কতকগুলি সিলমোহর পান; ১৮৮৩-৭৩ সালের মধ্যে তিনি কয়েকবার ঐ স্থানটি পরিভ্রমণ করেন এবং বেশ কয়েকটি প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করেন; এরও পূর্বে ১৮২৬ সালে চার্লস ম্যাসন হরপ্পা টিবির কথা প্রথম পণ্ডিতমহলের গোচরে আনেন। কানিংহাম, প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রা এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ঐসকল প্রত্নবস্তুর গুরুত্ব বোধহয় যথাযথ অনুধাবন করতে পারেননি; পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে মহেঞ্জোদারোতে আবিষ্কৃত সিলমোহরের সঙ্গে কানিংহাম প্রাপ্ত পূর্বের সিলমোহরের মিল দেখা গেলে হরপ্পায় অনুরূপ সভ্যতার অবস্থান থাকতে পারে এই অনুমানে হরপ্পায় খননকার্য চালানো হয়। সুতরাং সঙ্গত কারণেই সিন্ধু সভ্যতার নাম পরিবর্তন করে বর্তমানকালে এই নতুন নামকরণ করা হয়েছে।

হরপ্পীয় সভ্যতার সূত্রপাত

বর্তমান শতাব্দীর বিশের দশকে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে এক সুউন্নত, পরিশীলিত, পরিণত প্রাচীন সভ্যতার পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয়। এই সভ্যতার পরিণত রূপ প্রথম থেকেই প্রত্নতত্ত্ববিদদের ভাবিয়ে তুলেছে শুরুতে এই সভ্যতা কী রকম ছিল? কোথা থেকে এর সূত্রপাত হল তা নিয়ে তারা চিন্তা করতে শুরু করলেন। তখন কোন প্রমাণ সামনে না থাকা সত্ত্বেও মার্শাল সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে সিন্ধুসভ্যতার এক বিরাট পূর্ব বৃত্তান্ত আছে। মার্শালের অনুমান সঠিক প্রমাণ করে ননীগোপাল মজুমদার সিন্ধুপ্রদেশে প্রাক্-ঐতিহাসিক প্রত্নস্থল অনুসন্ধান করবার সময় এমন কতকগুলি প্রত্নবস্তু উদ্ধার করেন যে, তার ভিত্তিতে অনুমান করা সম্ভব হল যে, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর চেয়েও পুরাতন তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা ছিল। আশ্রিতে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর অনুরূপ বস্তু গাজী শাহতে পাওয়া গেলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমানের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হল। পরে স্যার মার্টিমুর হুইলার হরপ্পার বিশেষ একটি স্থানে, যাকে AB ঢিপি বলা হয়, তার তলায় কতকগুলি মৃৎপাত্র পেলেন যার ভিত্তিতে প্রাক্-হরপ্পা যুগের সভ্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া গেল।

স্বাধীনতাউত্তরকালে ভারত ও পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ববিদদের চেষ্টায় অনুসন্ধানের ব্যাপারে বেশ কিছু অগ্রসর হওয়া সম্ভব হল। ১৯৫৫-৫৭ সালে পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এফ. এ. খান সিন্ধু প্রদেশের খয়েরপুর জেলার কোটাডিজিতে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালান। এই প্রথম প্রাক্-সিন্ধুসভ্যতা যুগের প্রাকারবিশিষ্ট একটি জনবসতির আবিষ্কার করা সম্ভব হয়; দেখা গেল যে কিছু মৃৎপাত্রের আকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য পরবর্তী সিন্ধুসভ্যতার যুগেও অনুসৃত হয়েছিল; অর্থাৎ প্রাক্-সিন্ধুসভ্যতা যুগের সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতা যুগের একটি ধারাবাহিকতা ছিল। ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ জে. এল. ক্যাসালের নেতৃত্বে সিন্ধুপ্রদেশের আম্রিতে এবং ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ বি. বি. লাল এবং বি. কে. থাপার ১৯৬০-এর দশকে অধুনা শুষ্ক ঘাঘর নদীর খাতে কালিবঙ্গানে অনুসন্ধান চালিয়ে একই রকম ফল লাভ করলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাক্-সিন্ধুসভ্যতার অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হল।

কিলি-গুল-মহম্মদ অঞ্চলে যোয়ার সার্ভিস প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে প্রাক্-সিন্ধু সভ্যতার বেশ কয়েকটি স্তর আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কয়েকটি সাংস্কৃতিক বিভাজন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম স্তরের প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর কার্বন’ পদ্ধতি অনুসারে সময়ানুত্রাস নির্ণয় করা সম্ভভব হয়েছে। প্রথম স্তরটির সূচনাকাল আনুমানিক ৩৬৮৮ খ্রিঃপূঃ। পশুচারণের জীবনের ছাপ এই পর্যায়ে স্পষ্ট। ভেড়া, বলদ, ছাগল, গৃহপালিত পশু পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালে এবং প্রায় শেষ পর্যায়ে তারা কাদামাটির তৈরি ইট দিয়ে ঘর বানাতে পারত। পাথর এবং হাড়ের তৈরি জিনিস পাওয়া গেছে কিন্তু কোন ধাতব বা মাটির জিনিস নয়। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ে একটু উন্নত পর্যায়ের গৃহনির্মাণ কৌশল দেখা গেল; অপরিপক্ক স্থূল ধরনের মাটির বাসন এবং পূর্বের মতো প্রায় একই ধরনের বস্তুগত জীবনের
ছাপ দেখা যায়; চতুর্থ পর্যায়ে এসে প্রথম তামার জিনিস দেখা গেল এবং মৃৎপাত্র নির্মাণের কৌশলেরও অনেক উন্নতি ঘটেছিল; কুমোরের চাকার তৈরি মৃৎপাত্র এবং হাতে তৈরি মৃৎপাত্র উভয় ধরনের পাত্রতে লাল এবং কালো রঙে রং করা এবং নানা ধরনের জ্যামিতিক নকশা দেখা দিল যা পরবর্তীকালের সিন্ধুসভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচনা করা হয়। কিলি-গুল-মহম্মদ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়েরসঙ্গে সমগোত্রীয় আরও অনেক প্রত্নক্ষেত্র উত্তর এবং মধ্য বেলুচিস্তানে পাওয়া গেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উত্তর বেলুচিস্তানের লোরালাই উপত্যকার রানা ঘুন্ডাই প্রত্নক্ষেত্রের নাম করা যায়। উত্তর এবং মধ্য বেলুচিস্তানে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষে পরিবর্তনের হাওয়া আসতে শুরু করে। অলচিন দম্পতি “মুন্ডিগক” প্রত্নক্ষেত্রটিকে দৃষ্টান্তস্বরূপ বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। এখানে চতুর্থ পর্যায়ে গ্রাম থেকে শহরে পরিণত হবার চিহ্ন দেখা যায়- চতুর্দিকে প্রাকার বেষ্টিত শহর, বৃহৎ একটি বাড়ি যাকে প্রায় প্রাসাদ বলা যায়, প্রচুর লাল/কালো রঙের মৃৎপাত্রের সমন্বয়-সম্পূর্ণভাবে এই পর্যায়টি হরপ্পীয় যুগের সঙ্গে তুলনীয়। অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন ডাজ এফ ডেলস (১৯৬৫) এবং যোয়ায় গর্ভিসা (১৯৬৭) পৃথক পৃথকভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে। কোট ডিজি, মুন্ডিগক প্রতিটি ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে শহরে উত্তরণ ঘটে; প্রাকারযুক্ত দুর্গ, ঘন জনবসতি ইত্যাদি শহরের ইঙ্গিত বহন করে এবং চূড়ান্ত পর্যায় যাকে ডলফ্রেড্ এফ বলে উল্লেখ করেছেন তা সিন্ধু সভ্যতার সমগোত্রীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়। সুতরাং প্রায় প্রত্যেক প্রত্নতত্ত্ববিদ, বিশেষ করে অলচিন দম্পতি, অমলানন্দ ঘোষ পরিষ্কারভাবে “প্রাক্-হরপ্পা যুগে নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা” লক্ষ্য করলেন। হরপ্পীয় সভ্যতার মূল উপাদানগুলি প্রাক্-হরপ্পীয় সংস্কৃতি থেকে গৃহীত হয়েছে এবং সেইজন্যেই প্রাক্-হরপ্পীয় যুগকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে অধ্যাপক এস. সি. মালিক তার বই ইন্ডিয়ান সিভিলাইজেশন-এ প্রাক্ হরপ্পীয় যুগকে হরপ্পীয় যুগের ‘পূর্ব প্রস্তুতি’ বলে বর্ণনা করেছেন। প্রাক-হরপ্পার গ্রামীণ জনবসতির স্তর থেকে হরপ্পার নাগরিক স্তরে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব হল? এই উত্তরটির ব্যাখ্যা নানা পন্ডিতেরা নানাভাবে করার চেষ্টা করেছেন। আলোচনার সুবিধার জন্যে এদের দু’টি দলে ভাগ করা যায়; প্রথম দলের পণ্ডিতেরা হরপ্পার পরিবর্তনের জন্যে বৈদেশিক প্রভাবকে দায়ী করছেন।

মেহেরগড় উৎখননের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহ

প্রাক্-হরপ্পীয় সভ্যতা পর্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্র মেহেরগড়। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ভারতীয় সভ্যতার জন্ম বইটিতে অলচিন দম্পতি খুব জোরের সঙ্গে প্রাক্-হরপ্পীয় সভ্যতার সঙ্গে পরিণত হরপ্পীয় সভ্যতার একটি যোগসূত্রর কথা ঘোষণা করেছিলেন। পরিণত হরপ্পীয় সভ্যতা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; তার সূত্রপাত প্রাক্-হরপ্পীয় সভ্যতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। পরবর্তীকালে সভ্যতা সম্বন্ধে ক্রমাগত গবেষণা তাদের ধারণাকে সত্য বলে প্রমাণিত করেছে। মেহেরগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মধ্য দিয়ে প্রাক্-হরপ্পীয় সভ্যতা কীভাবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিণত হরপ্পীয় সভ্যতায় পৌঁছাল তার প্রামাণ্য চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়।

মেহেরগড় কচ্ছ উপত্যকায় বোলান নদীর উৎসস্থলের সন্নিকটে অবস্থিত। ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক মিশন এই প্রত্নক্ষেত্রটি আবিষ্কার করেন। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত প্রত্নক্ষেত্রটি সিন্ধুসভ্যতার সাম্প্রতিকতম গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে অসীম গুরুত্বের অধিকারী। সাতটি পর্যায়ে মেহেরগড়কে বিভক্ত করা সম্ভব। প্রথম তিনটি পর্যায় নব্য প্রস্তর যুগের অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীনতম পর্যায়ে খুব সম্ভবত বোলান নদীর উঁচু পারে একদল ভ্রাম্যমাণ পশুচারণকারীর বসবাস ছিল। ক্রমশ স্থায়ী জনবসতি ঐ এলাকায় গড়ে উঠেছিল, তার প্রমাণস্বরূপ কাদামাটির ইটের তৈরি ঘরবাড়ি এবং ব্যবহৃত জিনিসের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। খ্রিঃপূঃ ছয় সহস্রাব্দে আবিষ্কৃত (অর্থাৎ ৫১০০ খ্রিঃপূঃ) কাদা- মাটির ইটের তৈরি বেশ কিছু বাড়ি পাওয়া গেছে, এইসব কাদামাটির ইটগুলি বিশেষ কায়দার তৈরি; অর্থাৎ ইটগুলির কোণগুলি গোলাকার এবং নির্মাতাদের আঙুলের ছাপ পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় বসবাসের বাড়ি ছাড়াও ছয় কক্ষ এবং নয় কক্ষ বিশিষ্ট শস্যাগার পাওয়া গেছে।

মেহেরগড়ে এই পর্যায়ে আবিষ্কারের মধ্যে খ্রিঃপূঃ চতুর্থ সহস্রাব্দের একটি সমাধিস্থল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাতিষ্ঠানিক সমাধিক্ষেত্রগুলির মধ্যে এটি অন্যতম সমাধিক্ষেত্র। সমাধিক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে নানারকম পুঁতি পাওয়া গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় একটি তামার পুঁতি। এই পুঁতিটি তামার নির্মিত জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম এবং বোধহয় প্রথমতম। প্রলেপ দেওয়া ঝুড়ি পাওয়া গেছে; এগুলিকে বোধহয় মাটির পাত্রের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হত; অর্থাৎ কুমোরের চাকা থেকে তৈরি মৃৎপাত্র তখনও অজানা ছিল। শান দেওয়া পাথরের জিনিস অনেক দেখা গেছে। বেশ কয়েকটি পাথরের কুঠার পাওয়া গেছে যার মধ্যে বিশেষ কারিগরী কৌশল রয়েছে। এর থেকে মনে করা যেতে পারে যে নব্য প্রস্তর যুগ থেকেই এই বিশেষ ধরনের পাথরের কুঠার নির্মাণের কায়দা এই এলাকার লোকেরা আয়ত্ত করেছিল।

সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কার বোধহয় টার্কয়েজের তৈরি একটি পুঁতি। এটিও সমাধিক্ষেত্র থেকে পাওয়া গেছে। এটি স্থানীয় জিনিস নয়। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, সুপ্রাচীনকাল থেকেই মূল্যবান এবং অপেক্ষাকৃত কম মূল্যবান পাথর দূর দেশ থেকে আমদানি করা হত; অনুমান করা যেতে পারে যে, মেহেরগড়ের লোকেরা তুর্কমেনিয়া থেকে এগুলি আমদানি করতেন। তাহলে বাণিজ্যের জন্যে হরপ্পা সভ্যতার যে বিশিষ্টতা তা বহু পূর্বেই মেহেরগড়ে লক্ষ্য করা যায়। খ্রিঃপূঃ ষষ্ঠ সহস্রাব্দতেই তারা বিলাস এবং প্রসাধন দ্রব্যের এবং হয়তো আরও অনেক জিনিসের দূরপাল্লার বাণিজ্যে ব্যাপৃত ছিলেন একতা মনে করবার যথেষ্ট কারণ আছে। পরবর্তীকালে রহমান ঢেরী এবং লি-ওয়ানের প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু বাণিজ্যের তত্ত্বকে আরও জোরদার করে।

মেহেরগড় সভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায় সরাসরি প্রথম পর্যায় থেকে উদ্ভুত; এই পর্যায়ের শেষের দিকে মৃৎপাত্রের আবির্ভাব ঘটে এবং কোন কোন সময়ে সেগুলিকে চিত্রিত করবার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। মৃৎপাত্রগুলির সঙ্গে কিলি-গুল-মুহম্মদ (প্রথম পর্যায়) এবং মুন্ডিগক (প্রথম পর্যায়) প্রত্নক্ষেত্রে মৃৎপাত্রগুলির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। পাথরের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের উৎপাদন ও নির্মাণ পূর্বের মতোই অব্যাহত ছিল। দূরপাল্লার বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা প্রমাণিত হয় বিভিন্ন ধরনের শঙ্খ এবং টার্কয়েজ পাথরের অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাপ্ত অন্যান্য বস্তুর মধ্যে ছিদ্রযুক্ত দস্তার তৈরি একটি টুকরোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন; বোধহয় এটিও ব্যবসার সূত্র ধরে এখানে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু ঘটনা যাই হোক না কেন, দস্তার টুকরোটি হরপ্পা সভ্যতার আগে একমাত্র দস্তা ধাতুর নিদর্শন। বাদশান থেকে ল্যাপিস-লাজুলীও ব্যবসাসূত্র আনা হত বলে মনে করা হয়।

মেহেরগড় সভ্যতার তৃতীয় পর্যায়ে মৃৎশিল্প মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। নিয়মিত প্রথামাফিক কৃষিকার্য জনজীবনের একটি অঙ্গে পরিণত হয়েছে। প্রাক্-ষষ্ঠ সহস্রাব্দ পূর্বেই লোকেরা বার্লি, গম এবং খেজুর নিয়মিতভাবে উৎপাদন করতেন। বহু বন্য পশুকে গৃহপালিত পশুতে পরিণত করার প্রচেষ্টা দেখা গেছিল এবং তাদের কৃষিকাজেও ব্যবহার করা হয়েছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃষিজ বস্তু হল দানা জাতীয় শস্যের উৎপাদন। দানা জাতীয় শস্যের উৎপাদন খাদ্য অভ্যাসকে পরিবর্তিত করেছে সন্দেহ নেই। এরই ফলে বোধহয় প্রস্তর-ব্যবহারকারী মৃৎশিল্পের সঙ্গে অপরিচিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানারকম আকর্ষণীয় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আরও উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার বোধ হয় তুলো চাষের কৃৎকৌশল আয়ত্ত করা। হরপ্পীয় সভ্যতার আবিষ্কারের প্রায় দু’হাজার বছর আগে তুলোর চাষ এবং সুতিবস্ত্র নির্মাণের কৌশল আয়ত্ত করা সম্ভভব হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এটি একটি বৈপ্লবিক ঘটনা। হরপ্পীয় সভ্যতার কৃষির ঐতিহ্য প্রায় হরপ্পার চেয়ে দুই সহস্র বছরের প্রাচীন মেহেরগড় থেকে এসেছে বলা যেতে পারে। মেহেরগড় চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায় স্পষ্টভাবে বিবর্তনের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। জনবসতি আর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নয়। মেহেরগড়ের দক্ষিণে ঘনজনবসতির প্রমাণ মেলে। আমরী, ডাম্ব-সাদাত ইত্যাাদি স্থানের প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের সঙ্গে মেহেরগড়ে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের তুলনামূলক আলোচনার দ্বারা একটি কালানুক্রমিক সময়পঞ্জী নির্মাণ করা যায়। বিশেষ আকর্ষণের বস্তু হচ্ছে পোড়ামাটির তৈরি একটি স্ত্রী-মূর্তি। এটির সঙ্গে মধ্য এশিয়ায় প্রাপ্ত পোড়ামাটির স্ত্রী-মূর্তির সাদৃশ্য লক্ষণীয়। কুমোরের চাকা থেকে নির্মিত মৃৎপাত্র সর্বত্র প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া গেছে। এই প্রথম পাথরের এবং হাড়ের তৈরি সিলমোহর পাওয়া গেল যা পরবর্তী হরপ্পা সভ্যতায় পাওয়া গেছে। পোড়ামাটির তৈরি চার খোপ বিশিষ্ট সিলমোহরটি বিশেষ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত দ্রব্যের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। একটি বিরাট কাদা-মাটির ইঁটে তৈরি চাতাল পাওয়া গেছে। মাটির তৈরি জিনিসের মধ্যে অশ্বত্থ পাতা এবং মাছের নমুনা বেশি করে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাথর দিয়ে পাতার মতো দেখতে তীরের ফলা বেশ কয়েকটি পাওয়া গেছে। দামী এবং কমদামী পাথর, বিশেষ করে ল্যাপিস-লাজুলী দূরপাল্লার বাণিজ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে সপ্তম এবং চূড়ান্ত পর্যায় সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা গেছে। রোদে পোড়া ইটের তৈরি বাড়ি নিয়মিতভাবে ব্যবহার করা হত। একটি বিশেষ বাড়ির কথা বলা হচ্ছে যেটি মনে হয় শুধু শিল্পকাজের জন্যেই ব্যবহৃত হত। মৃৎশিল্পের ধারা অব্যাহত থাকছে এবং সেখানে নানারকম উন্নতি বিধান করা হচ্ছে। শত শত মাটির পুতুল পাওয়া গেছে যাদের মধ্যে কয়েকটির শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্টতাপূর্ণ। পোড়া মাটির সিলমোহর আরও বেশি করে তৈরি করা হচ্ছে। শান দেওয়া পাথরের তৈরি জিনিস শেষ অবধি উৎপাদন করা হচ্ছে। সুতরাং মেহেরগড়কে প্রাক্-নাগরিক প্রাথমিক পর্যায়ের সিন্ধুসভ্যতার পূর্বসূরি বলে সহজেই চিহ্নিত করা যেতে পারে। নব্য প্রস্তর যুগের স্তর থেকে পরিণত হরপ্পীয় সভ্যতার প্রায় সবকটি স্তরই মেহেরগড় সভ্যতায় ধরা পড়ে। ধারাবাহিক প্রাক্-সিন্ধুসভ্যতার নিদর্শন খুঁজতে গেলে আমাদের মেহেরগড়কে বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করতে হবে। অভারতীয় উভয়বিধ পণ্ডিতদেরই যুক্ত করতে পারি। ১৯৫৬ সালে আর. হাইনে জেলর্ডান (১৯৫৬) সিন্ধুসভ্যতার শহরগুলিকে ঔপনিবেশিক কেন্দ্র বলে চিহ্নিত করলেন। ১৯৫৮ সালে ডি. এইচ. গর্ডন অনুমান করলেন যে এলাম এবং মেসোপটেমিয়া থেকে জনবসতির অভিপ্রায় সিন্ধু অঞ্চলে এসেছিল এবং তারাই হরপ্পীয় সভ্যতার পরিবর্তন সম্ভব করেছে। মার্টিমুর হুইলার বৈদেশিক প্রভুত্বের কথা গভীরভাবে ভেবেছেন। ১৯৭২ সালে সি. সি. ল্যানবার্গ কার্লভস্কি বৈদেশিক বাণিজ্যকে সিন্ধু সভ্যতার নগরায়ণের জন্য দায়ী করলেন। শিরীন রত্নাগর (১৯৮১) বাণিজ্যকে নব ঔপনিবেশকতার একটি পর্যায় বলে মনে করলেন। হরপ্পা অঞ্চলের লোকেরা পশ্চিমের দেশগুলিতে পণ্য-সরবরাহ করত এবং তাদের চাহিদা পূরণ করত। ফ্লাম (১৯৮৪) মেসোপটেমিয়া এবং এলামের সঙ্গে আম্রি-নাল-কোটদিহি এই অঞ্চলের সম্পর্ক আবিষ্কার করলেন এবং তিনি ‘এলামের বহির্ভাগ’ বলে একটি অঞ্চলের কথা কল্পনা করেছিলেন যার মধ্যে দক্ষিণ বেলুচিস্তান, সিন্ধু প্রদেশ-কোহিস্তানকে সহজেই অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

অন্যদিকে, স্টুয়ার্ট, পিগট বহির্ভারতের প্রভাবে সিন্ধুসভ্যতার বিকাশ ঘটেছে এই সম্ভাবনাকে মানতে রাজী নন। ফেয়ার সার্ভিসের কোন স্থির মত নেই; একদিকে তিনি বলছেন এই সভ্যতার বিশিষ্ট রূপগুলি দেশীয় উৎস থেকে উঠে এসেছিল কিন্তু বিস্তারিত দিকগুলি বৈদেশিক প্রভাবে ঘটেছে। অলচিন দম্পতি এবং অমলানন্দ ঘোষ প্রাক্- হরপ্পা সভ্যতা থেকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ম অনুসারে হরপ্পীয় সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে করেন, যদিও অলচিন দম্পতি দি বার্থ অফ্ ইন্ডিয়ান সিভিলাইজেশন-এ প্রাক্-হরপ্পা পর্যায়ের মুন্ডিগক প্রত্নক্ষেত্রটি আলোচনা করবার সময় ইরানের কাছাকাছি অবস্থানের জন্য পরিবর্তনগুলি সম্ভব হয়েছিল কি না এই নিয়ে মৃদু প্রশ্ন তুলেছেন। রফিক মুঘলের কাজ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ফেয়ার সার্ভিসেস-এর সঙ্গে একমত হয়ে মন্তব্য করেছেন যে সিন্ধুসভ্যতার বিকাশের জন্যে কোন বহিরাগত প্রভাব দায়ী ছিল না। ডি. পি. আগরওয়াল (১৯৮২) হরপ্পা সংস্কৃতিকে সুমের থেকে উৎপাটিত
করে আনা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন। তবে যেহেতু সুমেরীয় সভ্যতা সিন্ধুসভ্যতার থেকে বহু বছরের পুরাতন, তাই বাণিজ্যিক বিনিময় বা অন্যান্য কোন মাধ্যমের দ্বারা যোগাযোগের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মুঘল অত্যন্ত জোরের সঙ্গে এইসব তত্ত্বকে বাতিল করে প্রাক্-হরপ্পা যুগকেই হরপ্পীয় সভ্যতার ভিত্তি বলে মনে করেছেন এবং তার মতের স্বপক্ষে সুচিন্তিত যুক্তি উপস্থিত করেছেন। অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী তাঁর দি আর্কিওলজি অফ এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান সিটিস-এ সমস্ত অধ্যাপকদের যুক্তিতর্ক উপস্থিত করবার পর তার নিজস্ব মতামত উপস্থিত করেছেন। তাঁর মতে খুব সাধারণ মানে (ক) জলসেচ ব্যবস্থা, (খ) হস্তশিল্পের ক্রমাগত বিশেষীকরণ, (গ) তামাকে গলিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করবার দক্ষতা, ইত্যাদি উপাদানগুলি প্রাক্-হরপ্পা থেকে হরপ্পীয় সভ্যতায় উত্তরণ ঘটাতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু লিখিত বিবরণের অনুপস্থিতির জন্যে এই তথ্যগুলিকে চূড়ান্ত সত্য বলে মেনে নিতে এখনও অনেক দ্বিধার মধ্যে পড়তে হয়।

হরপ্পীয় সভ্যতার বিস্তার

ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সিন্ধুসভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল এবং প্রথম দুটি শহর হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর ভৌগোলিক অবস্থান প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিস্মিত করে। কারণ শহর দুটি চারশো মাইল দূরে অবস্থিত হলেও একই সংস্কৃতির অন্তর্গত। সুতরাং সহজেই মনে করা যেতে পারে যে এই সভ্যতা কোনমতেই স্থানীয় বা আঞ্চলিক নয়, এমনকী ক্ষুদ্র ভৌগোলিক এলাকার মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়। পরবর্তীকালের ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের দ্বারা সিন্ধুসভ্যতার ভৌগোলিক বিস্তার ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হচ্ছে। এর ফলে সিন্ধুসভ্যতা সম্বন্ধে পুরাতন মতামতগুলি পরিত্যক্ত হচ্ছে এবং নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত প্রায় দুশো পঞ্চাশটি নতুন কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে এবং হরপ্পীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি আধুনিক ভারতীয় উপমহাদেশের অবিভক্ত পাঞ্জাবপ্রদেশ, সিন্ধুপ্রদেশ, বেলুচিস্তান, গুজরাট, রাজস্থান এবং আধুনিক উত্তরপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সামান্য অংশ, উত্তরের জন্মপ্রদেশ থেকে দক্ষিণের নর্মদা নদীর মোহানা পর্যন্ত বিস্তৃতও; পশ্চিমে বেলুচিস্তানের মাকারন উপকূল থেকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে মরুট পর্যন্ত বিস্তৃত। ত্রিভুজাকৃতি এই এলাকা প্রায় ৯৯,৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রসারিত এবং আধুনিক পাকিস্তানের চেয়ে আয়তনে বড়। নিশ্চিতভাবেই এটি প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং মিশরের থেকে অনেক বৃহৎ আকারের সভ্যতা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা তৃতীয় সহস্রাব্দে এত বড় সভ্যতার অস্তিত্ব আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সিন্ধুপ্রদেশে প্রয়াত ননীগোপাল মজুমদারের অনুসন্ধানের ফলে নতুন হরপ্পার সংস্কৃতি-বিশিষ্ট কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়। ফলে দক্ষিণে হায়দ্রাবাদ (সিন্ধু) থেকে উত্তরে জ্যাকোবাবাদ অবধি সিন্ধু নদীকে অনুসরণ করে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হয়। এদের অধিকাংশই সিন্ধু বা তার উপনদীগুলির ধারে অবস্থিত এবং সামান্য কয়েকটি শহর বাদ দিয়ে অধিকাংশ ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির বেন্দ্র। মহেঞ্জোদারোর দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চানহু-দারো ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং প্রায় একই দূরত্বে আম্রি প্রত্নক্ষেত্রটি অবস্থিত। প্রাক্-হরপ্পীয় সংস্কৃতির আলোচনায় আম্রি এক উজ্জ্বল নাম। এ ছাড়াও, আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বে অক্ষু নদীর উপত্যকায় শর্তুগাই পরিণত হরপ্পীয় সভ্যতার একটি কেন্দ্র এবং শর্তুগাইকে ধরা হলে হরপ্পীয় সভ্যতার সীমা ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাভাবিক ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে আরও বহুদূর বিস্তৃত হয়। স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন হরপ্পীয় অঞ্চলটিকে অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী মূল সভ্যতার মধ্যে না ধরে একটি “বাণিজ্যিক উপনিবেশ” বলে গণ্য করতে ইচ্ছুক।

স্বাধীনতার উত্তরকালে নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে পশ্চিম উপকূলে হরপ্পীয় সভ্যতা বিস্তৃত হয়েছে প্রায় ৮০০ মাইল সমুদ্র-উপকূল অঞ্চলে সিন্ধু এলাকার মধ্যে যুক্ত হয়েছে; সৌরাষ্ট্র (কাথিয়াওয়ার) থেকে কাম্বে উপসাগর অবধি প্রায় ৪০টি কেন্দ্র আবিষ্কার করা গেছে। কিম প্রণালীর উপর গেট্রভ মহেঞ্জোদারো থেকে প্রায় ৫০০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত সিন্ধুসভ্যতার দক্ষিণতম প্রসারণ। এই অঞ্চলকে মার্টিমুর হুইলার সৌরাষ্ট্র প্রদেশ বলে অভিহিত করেছেন। এই অঞ্চল মূল সভ্যতার কেন্দ্র থেকে এতদূরে অবস্থিত হয়েও সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল গুজরাট ব্যতীত, রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা যমুনা দোয়াব অঞ্চলে হরপ্পীয় সভ্যতার চিহ্নযুক্ত অঞ্চল পাওয়া যায়। পূর্বে কোশাম্বী প্রমুখ অধ্যাপকবৃন্দ গাঙ্গেয় উপত্যকার সমভূমিতে সিন্ধুসভ্যতা কেন প্রবেশ করেনি তার নানারকম ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের মেরুট জেলায় আলমগীরপুরে সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্র আবিষ্কৃত হলে গাঙ্গেয় ভূমিতে অনুপস্থিতির ব্যাখ্যাগুলি ভুল বলে প্রমাণিত হল। আলমগীরপুরের পূর্বে আর কোনও হরপ্পা সভ্যতার প্রত্নক্ষেত্র নেই। ফলে হরপ্পা সভ্যতা গাঙ্গেয় উপত্যকার সামান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তর্গত ভৌগোলিক অঞ্চলে শহরের লোকসংখ্যা মুষ্টিমেয়। অধ্যাপিকা নয়নজ্যোতি লাহিড়ীর মতে, প্রত্যেকটি শহরের অবস্থানগত গুরুত্ব রয়েছে। এদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঞ্জাবে অবস্থিত হরপ্পা, সিন্ধুপ্রদেশে অবস্থিত মহেঞ্জোদারো। হুইলারের মতে, এই দুটি শহর বোধহয় যৌথভাবে রাজধানীর কাজ করত। তিনি তাঁর মতের স্বপক্ষে পরবর্তী ইতিহাস থেকে নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর চানহু- দারো বোধহয় প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। চতুর্থ শহর লোথাল কাম্বে উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি নৌবন্দর। উত্তর রাজস্থানে অবস্থিত কালিবঙ্গান পঞ্চম শহর। হরিয়ানা প্রদেশের হিসার জেলায় অবস্থিত বানওয়ালী চার্চ গুরুত্বপূর্ণ শহর। হরপ্পা সভ্যতার পরিণত এবং সমৃদ্ধতম রূপ এই ছয়টি শহরে দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও, উপকূলবর্তী শহর ঘুটকাজেনডব এবং ঘুরকেটাডাতে পরিণত হরপ্পীয় সভ্যতা লক্ষ্য করা যায়।

হরপ্পা সভ্যতার বিস্তারের আলোচনার পর পরবর্তী যে সমস্যা আমাদের ভাবিত করে তা হল এর সময়। দুটি দিক থেকে সমস্যাটিকে দেখা দরকার। প্রথম দিকটি হল সময়ের ব্যাপ্তি অর্থাৎ সর্বনিম্ন সময় এবং সর্বোচ্চ সময়; বলা বাহুল্য এই দুটি সময়কাল আনুমানিক, যথার্থ ঐতিহাসিক সময় নয়। দ্বিতীয় দিকটি হল পদ্ধতিগত দিক, অর্থাৎ কোন্ পদ্ধতি অনুসারে সময় নির্ণয় করা যাবে। এখানেও বিভিন্ন ভাবনার অবকাশ আছে।

হরপ্পীয় সভ্যতার কোন কেন্দ্রেই লোহা পাওয়া যায়নি, সুনিশ্চিতভাবে এটি লৌহপূর্ব যুগের সভ্যতা, মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সর্বত্র খ্রিস্টপূর্ব দুই সহস্রাব্দের মাঝামাঝি লোহার প্রচলন হয়; তাহলে ঐ সময়ের কিছু আগে বা পরে সিন্ধুসভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। এই সময়টি আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিঃপূঃ বলে ধরা যেতে পারে। উচ্চতর সময়সীমাটিও এইরকম আনুমানিক। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে মহেঞ্জোদারোর সাতটি স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। সাতটি স্তরের বিকাশের জন্য এক হাজার বৎসর নির্দিষ্ট করলে উপরের সীমা ২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গিয়ে দাঁড়ায়, যদিও এই সময়সীমাকে আরও পেছিয়ে নিয়ে গিয়ে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে অনেকে নিয়ে যাচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত দুটি দিক থেকে পদ্ধতিগত বিষয়টি আলোচনা করা যায়। প্রথমটি হল আধুনিক রেডিও কার্বন পদ্ধতি, দ্বিতীয়টি হল তুলনামূলক পদ্ধতি। বিভিন্ন কারণে প্রত্নতাত্ত্বিকরা তুলনামূলক পদ্ধতিকে বেশি পছন্দ করেন। হরপ্পা সভ্যতার পরিণত পর্যায়ে মেসোপটেমিয়া, সুমের ও এলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ২৬০০ খ্রিঃপূঃ সিন্ধু এলাকায় তৈরি কার্নেলিয়ানের পুঁতি মেসোপটেমিয়াতে পাওয়া গেল। সুতরাং ২৬০০ খ্রিঃপূঃ বা তার কিছু আগে থেকেই সিন্ধুসভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া গেল। সুতরাং সেই দিক থেকে ২৭০০/২৮০০ খ্রিঃপূঃ বা তারও সামান্য আগে সিন্ধুসভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদ বিভিন্ন প্রমাণের ভিত্তিতে হরপ্পীয় সভ্যতার তারিখ নির্ণয় করেছেন। মার্শাল ৩২৫০-২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সিন্ধুসভ্যতার সময়কে সীমাবদ্ধ করেছেন; অন্যদিকে ম্যাকের মতে এই সময়সীমা খ্রিঃপূঃ ২৮০০-২৫০০। উভয়ের মতামতকেই আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদ্রা সমালোচনা করেছেন। হুইলারের মতে হরপ্পীয় সভ্যতা ২৫০০-১৫০০ খ্রিঃপূঃ অবধি স্থায়ী ছিল এবং আধুনিক রেডিও-কার্বন পদ্ধতি অনুসারে পরীক্ষা করে ডি. পি. আগরওয়াল প্রায় একই মত দিয়েছেন। তাঁর মতে, হরপ্পা সভ্যতার স্থায়িত্বকাল ২৩০০-১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সুতরাং এইসব বিভিন্ন আলোচনার পরিপ্রক্ষিতে একথা সহজেই বলা চলে যে হরপ্পীয় সভ্যতার ভৌগোলিক সীমানা এবং সময়ের পরিধি উভয়ই অত্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

সিন্ধু সভ্যতায় নাগরিক জীবন

আয়তন, বৈচিত্র্য এবং প্রত্নবস্তুর বিশিষ্টতার দিক দিয়ে বিচার করলে সমস্ত হরপ্পীয় প্রত্নক্ষেত্রগুলির মধ্যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর নাম সর্বাগ্রে করতে হয়। সিন্ধু নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত মহেঞ্জোদারো এবং আধুনিক রাভি নদীর বাম তীরে হরপ্পা অবস্থিত। যদিও কোন লিখিত প্রমাণ নেই তবুও প্রত্নতাত্ত্বিকরা হরপ্পা এবং
মহেঞ্জোদারোকে বিশাল হরপ্পীয় সাম্রাজ্যের যুগ্ম রাজধানী বলে বর্ণনা করেন। প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে এবং স্বাধীনতা- উত্তরকালে বিভিন্ন বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিকরা বহুবার এই শহর দুটিতে উৎখননের কাজ চালিয়েছেন কিন্তু নানারকম ভূ-তাত্ত্বিক এবং ভৌগোলিক অসুবিধার জন্যে সর্বনিম্নস্তরে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও বিশাল হরপ্পীয় এলাকায় এক ধরনের সহমত এবং সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন প্রায় একই ধরনের স্থাপত্য এবং নগর পরিকল্পনা, একইরকম ওজন ও মাপ, লিখন পদ্ধতি, সমস্ত হরপ্পা জুড়ে স্বাধীন বাণিজ্য, সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে কেন্দ্রিকতার লক্ষণ সুস্পষ্ট। এই কেন্দ্রিকতা কীভাবে শুরু হয়েছিল এবং পুরুষানুক্রমে তা কীভাবে স্থায়ী হয়েছিল তা ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে এক অপার বিস্ময়। হরপ্পীয় সভ্যতার নাগরিক জীবনে কেন্দ্রিকতা ও রক্ষণশীলতার ছাপ স্পষ্ট। সমস্ত হরপ্পীয় সভ্যতার নগর-পরিকল্পনা, একটি নির্দিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। ছোট ও বড় প্রত্যেকটি নগর উঁচু ও নিচু দুটি এলাকার দ্বারা বিভক্ত ছিল। উঁচু এলাকাকে প্রায় সবাই মার্শালকে অনুসরণ করে সিটাডেল বা দুর্গ এলাকা বলছেন। আয়তক্ষেত্রাকার, প্রাকার দ্বারা সুরক্ষিত এই দুর্গগুলি প্রায়শই নগরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ছিল; এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্যে সুউচ্চ তোরণ এবং পরিখার ব্যবহার দেখা যায়।

হরপ্পীয় সভ্যতার নগর পরিকল্পনায় খানিকটা নিয়মমাফিক ছক আছে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এই নগর পরিকল্পনার বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। যেমন কালিবঙ্গানের উঁচু এলাকা দুটি ভাগে বিভক্ত। এই ব্যবস্থা অন্য কোথাও নেই অন্যদিকে অধুনা আবিষ্কৃত ধোলাবিরাতে নগর তিনভাগে বিভক্ত (১) উঁচু শহর (২) মাঝের শহর ও (৩) নীচের শহর। মাঝের শহর নগরীর আর কোথাও নেই। গুজরাটের উপকূলে অবস্থিত লোথাল একটি বন্দর-নগরের ভূমিকা নিয়ে থাকতে পারে; ফলে এই নগরের পরিকল্পনা অন্যান্য হরপ্পীয় নগরের থেকে পৃথক। হরপ্পীয় শহরগুলির স্থাপত্য সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণাকে প্রত্নতত্ত্ববিদ জ্যাকমেন কিছুটা সংশোধন করেছেন। তিনি স্বীকার করছেন, এই নগর স্থাপত্যের পিছনে প্রতিভা ও মার্জিত বুচির ছাপ পাওয়া যায় কিন্তু পরিকল্পনার মূল ভিত্তি বোধহয় গ্রহ-নক্ষত্রাদির অবস্থান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। একেই তিনি “Cosmological principles” বলতে চান। সুরক্ষিত এই সিটাডেল এলাকাতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকর্মগুলি যেমন ‘বিরাট স্নানাগার’, ‘বিশাল শস্যাগার’, ‘শাসকের প্রাসাদ’ দেখতে পাওয়া যায়। নিচু এলাকা অপেক্ষাকৃত ঘনবসতিপূর্ণ এবং সাধারণ অবস্থার লোকেরা বাস করতেন। স্থাপত্যকর্মই হরপ্পীয় সমাজের শ্রেণীবিভাজনের কথা বুঝিয়ে দেয়।

নিকটবর্তী এলাকায় পাথরের ঘাটতির জন্যেই বোধহয় সমস্ত হরপ্পীয় এলাকায় ইটের ব্যবহার দেখা যায়। কাদামাটি দিয়ে তৈরি ইঁটের ভঙ্গুরতা, জলে ধুয়ে যাবার প্রবণতা রোধ করবার জন্যেই বোধহয় পরবর্তীকালে আগুনে পোড়া ইঁটের শুরু হয়েছিল। অলচিন দম্পতি যে ‘সাংস্কৃতিক ঐক্য’ বা স্টুয়ার্ট পিগট যে ‘কেন্দ্রিকতা’-র উল্লেখ করেছেন ইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা বোঝা যায়। জলনিকাশী নালা বা যেকোন স্থায়ী বস্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে এবং ধনী ব্যক্তিদের বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে পোড়া ইট ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মাপ ১১ ইঞ্চি লম্ভবা, ৫১, ইঞ্চি চওড়া ও ২০% ইঞ্চি পুরু।

সাধারণের বসতি এলাকাতে বর্গাকৃতি উঠান ছিল একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। উঠানকে কেন্দ্র করে ছোটবড় বিভিন্ন কামরাবিশিষ্ট ঘর, রান্নাঘর, স্নানাগার ইত্যাদি। আন্না সারকিনা মহেঞ্জোদারোর সাধারণের ঘরগুলি পরীক্ষা করে বিভিন্ন ধরনের উঠানের খোঁজ পেয়েছেন এবং তার বিভিন্ন ব্যবহারও লক্ষ্য করেছেন। যেমন কোনো ক্ষেত্রে উঠানগুলি বাস্তবাড়ির প্রয়োজনে, কোথাও হাতের কাজ করবার জন্যে, কোথাও বা উভয়বিধ কাজ করবার জন্যে ব্যবহৃত হত।

জনস্বাস্থ্য রক্ষার কাজে জলের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন বলেই কি বাস্তুবাড়িগুলিতে জলের সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্যে কুয়োর ব্যবস্থা ছিল? কোথাও বাড়ির নিজস্ব কুয়ো অথবা দুটি বাড়ির মাঝে কুয়োগুলিকে দেখতে পাওয়া যায়; বহু লোক যে কুয়ো ব্যবহার করতেন, সেখানে বসবার জায়গা আলাদা করে তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। জ্যানসেন হরপ্পীয় শহরের কুয়োগুলির ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশলের প্রশংসা করেছেন। মহেঞ্জোদারোতে প্রতি তিনটি পরিবার পিছু একটি কুয়ো দেখা যায়, যা সমসাময়িক মিশর বা মেসোপটেমিয়াতে বিরল। কিন্তু কালিবঙ্গানে কাছাকাছি নদীর অবস্থান থাকার জন্যে কুয়োর ব্যবহার বিরল।

মহেঞ্জোদারোতে স্নানাগার শৌচাদি কাজের জন্য পৃথক স্থান নির্দিষ্ট ছিল। স্নানাগারগুলি নির্মাণের বিশেষ পদ্ধতি এবং উঁচু তলা থেকে জল বের করবার জন্যে মাটির নল ব্যবহার করা-সবই সুচিন্তিত পরিকল্পনার পরিচায়ক। মহেঞ্জোদারোতে স্নানাগার, কুয়ো ইত্যাদির ব্যবহার ব্যাপক থাকার জন্যে ম্যাকে মার্শাল এর পিছনে ধর্মীয় ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন। উন্নত জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহেঞ্জোদারো এবং লোথালে উন্নত পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেক বাড়ির পরিত্যক্ত জল নালার মাধ্যমে বড় রাস্তায় বৃহৎ নর্দমায় এসে পড়ত। মহেঞ্জোদারোতে

বড় রাস্তায় তো বটেই-এমনকী, ছোট ছোট রাস্তাতেও নর্দমা ছিল। ইটের তৈরি পাথর দিয়ে ঢাকা এই নর্দমাগুলি মাঝে মাঝে পরিষ্কার করা হত; নর্দমার মাঝে মাঝে চৌবাচ্চা তৈরির প্রক্রিয়া থেকে তা বোঝা যায়। জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করেই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। জলনিকাশী ব্যবস্থার অস্তিত্ব থেকেই স্টুয়ার্ট পিগট একটি “পৌরকর্তৃপক্ষের” কথা চিন্তা করেছেন যাদের হাতে বেশ কিছু কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা ছিল। এই “পৌরকর্তৃপক্ষ” বোধহয় কালিবঙ্গানে ছিল না, কারণ সেখানে জনসাধারণের ব্যবহৃত জলনিকাশী ব্যবস্থার অস্তিত্ব দেখা যায় না।

নাগরিক সভ্যতার অপর একটি বৈশিষ্ট্য আমরা হরপ্পার রাস্তাগুলির মধ্যে খুঁজে পাব। একটি নির্দিষ্ট ছক অনুসরণ করে শহরগুলিতে রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। প্রধান প্রধান রাস্তাগুলি শহরের উত্তর-দক্ষিণে, পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত ছিল; এই রাস্তাগুলি শহরকে কয়েকটি প্রধান আয়তক্ষেত্রকার ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল। স্টুয়ার্ড পিগট মনে করেছেন যে যদি এই ছক মহেঞ্জোদারোতে সর্বত্র অনুসরণ করা হয়ে থাকে তাহলে দেখা যাবে যে বারোটি বড় বড় বাড়ি তিন সারি রাস্তার চারটি ভাগের মধ্যে পড়েছে এবং পশ্চিমদিকের কেন্দ্র রয়েছে সিটাডেল বা দুর্গ এলাকা। মহেঞ্জোদারোতে এইচ. আর. এলাকার ৩০ ফুট চওড়া রাস্তাগুলি কয়েক সারি চাকাওয়ালা যানবাহনের জন্যে উপযুক্ত ছিল। সমস্ত রাস্তা অত চওড়া ছিল না; লোথাল ও কালিবঙ্গানে মহেঞ্জোদারোর মতো চওড়া রাস্তা দেখা যায় না। কিন্তু প্রতিটি রাস্তা সোজাসুজি তৈরি করবার প্রবণতা দেখা যায়। বড় চওড়া রাস্তার পাশে সরু অপ্রশস্ত গলি এবং সেখানে ছিল বাড়িগুলির সদর দরজা। সোজা রাস্তা এবং দক্ষিণ দিকে বাঁক নেওয়ার প্রবণতা হরপ্পার নগর- পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু একটা জিনিস ভাবতে অবাক লাগে যে এত চওড়া রাস্তা কিন্তু পথচারীদের চলবার জন্যে ফুটপাথের কথা ভাবা হয়নি; শুধু মহেঞ্জোদারোতে ডি. কে. এলাকাতে এবং কালিবঙ্গানে সামান্য ইঙ্গিত মেলে।

নগর পরিকল্পনা করার সময় পরিকল্পনা রচয়িতারা সৌন্দর্যের চেয়ে প্রয়োজনীয়তার কথা বেশি করে ভেবেছেন। যেমন জনস্বাস্থ্য বা সমবেতভাবে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্যে মহেঞ্জোদারোতে একটি স্নানাগার নির্মাণ করা হয়েছিল। কৃত্রিম এই জলাশয়টি শহরের উঁচু এলাকায় অবস্থিত; আয়তক্ষেত্রাকার এই জলাশয়টি একটি প্রশস্ত আঙ্গিনার মাঝখানে অবস্থিত এবং লম্ভবা ও চওড়ায় ৩৯ ফুট × ২৩ ফুট এবং গভীরতায় ৮ ফুট। ওঠাবার ও নামবার সিঁড়ি; চারপাশে ছোট ছোট ঘর, উৎকৃষ্ট ইটের কাজ, কৃত্রিমভাবে জল ভরবার এবং বের করে দেবার পদ্ধতি সবই এই স্থাপত্যকর্মটিকে বিশিষ্টতা দান করেছে। কী উদ্দেশ্যে এই স্নানাগারটি ব্যবহার করা হত তা নিয়ে সবাই একমত নন। এটা ঠিক যে স্নানাগারটি এতবড় যে, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এটি ব্যবহার করা সম্ভব নয়। মার্শাল মনে করছেন যে, “জল-চিকিৎসার” জন্যে ব্যবহার করা সম্ভব; কোশাম্বী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথা ভেবেছেন; হুইলারও জলাশয়টিকে পুরোহিত তন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করেন।

বৃহৎ জলাশয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আর একটি স্নানাগার আবিষ্কার করা গেছে। ক্ষুদ্র পরিসর দ্বারা বিভক্ত এই স্নানাগারগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল গোপনীয়তা। ডাঃ ম্যাকে মনে করেন উচ্চশ্রেণীর পুরোহিতেরা এই স্নানাগারটিকে ব্যবহার করতেন এবং বৃহৎ জলাশয়টি ছিল সর্বসাধারণের জন্য নির্দিষ্ট।

অপর একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি হল বৃহৎ শস্যাগার। শস্যাগারটির স্থায়িত্ব রক্ষার জন্যে মজবুতভাবে নির্মিত; ভেতরের বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা; এবং শস্য ওঠানো ও নামানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা পূর্ব চিন্তার ফলাফল। হরপ্পাতেও অনুরূপ একটি শস্যাগার দেখতে পাওয়া যায়। এখানে শস্যাগার সংলগ্ন এলাকায় ফসল ঝাড়াই-বাছাই, মাড়াই করা হত এবং একই স্থানে দুই সারি ছোট ছোট ঘরের সন্ধান পাওয়া যায়, যেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা বসবাস করতেন। শস্যাগার দুটির ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়; মহেঞ্জাদারোর শস্যাগারটির আয়তন হরপ্পার সমবেত শস্যাগারগুলির আয়তনের সমান। শহরের জনগণকে শস্য সরবরাহ ছাড়াও মুদ্রা-অর্থনীতির অনুপস্থিতির যুগে এটিকে কোষাগার ব্যবহার করার সম্ভভাবনার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে।

প্রত্নতত্ত্ববিদ ম্যাকে অপর কয়েকটি বৃহৎ বাড়ির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মহেঞ্জোদারোর সাধারণ মাপের বাড়িগুলির মধ্যে একটি ২৫০ ফুট দীর্ঘ প্রাসাদ পাওয়া গেছে, এর কেন্দ্রে দুটি প্রশস্ত আঙিনা এবং চারপাশে ছোট ছোট ঘরগুলি বসতবাড়ি নয়। প্রধান শাসক বা প্রধান পুরোহিত, যদি সেরকম কেউ থেকে থাকেন, তাহলে এই বৃহৎ প্রাসাদ তার বাসগৃহ হওয়া সম্ভব। কিন্তু এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে লিখিত প্রমাণের অপেক্ষা করতে হবে।

মহেঞ্জোদারো শহরের পশ্চিম এলাকায় ম্যাকে একটি স্থাপত্য বস্তুকে বিশেষ গুরুত্বসহকারে আলোচনা করেছেন। বৃহৎ আকৃতির এই বাড়িটিকে তিনি ‘কলেজবাড়ি’ নাম দিয়েছেন, এমনকী এর দক্ষিণ দিকে ছাত্রদের প্রবেশগৃহ ছিল বলে তিনি মনে করেন। মার্শালকে অনুসরণে মহেঞ্জোদারোর অপর একটি উল্লেখযোগ্য বাড়িকে ‘সভাগৃহ’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। ফেয়ারসার্ভিস এই বাড়িটিকে মহেঞ্জোদারোর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকীর্তি বলতে ইচ্ছুক। বিরাট এই হলঘরটিতে ২০টি স্তম্ভ রয়েছে। ৫ ফুট × ৩ ফুট মাপের আয়তাকার স্তম্ভগুলি বাড়ির ছাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে; চারটি সারিতে পাঁচটি করে স্তম্ভ সাজানো আছে। ম্যাকে এই বিশাল হলঘরটি বণিকদের জন্যে ব্যবহৃত বলে মনে করেন।

সুচিন্তিত নগর পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত জল সরবরাহ, নিকাশী ব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্য সচেতনতা সমস্ত কিছুই একটি প্রগতিশীল পৌর ব্যবস্থার ইঙ্গিত করে। রাতের বেলায় জনপথে আলোর ব্যবস্থা, গভীর রাতের তদারকি ব্যবস্থা, দূরাগত বণিকশ্রেণীর বিশ্রামাগার, সাধারণের জন্য শস্যাগার, সাধারণ নাগরিকদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করেছিল। নগরের বাইরে বিরাট গর্তে নাগরিকদের ব্যবহৃত মাটির ভাঙা জিনিস অন্যান্য পরিত্যক্ত দ্রব্য ফেলে আসতে হত। বিভিন্ন বেষ্টনীতে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তী স্তরে পৌর শাসনের শিথিলতা জনকল্যাণমূলক অবস্থার অবনতি ঘটায়। পরিকল্পনা ছাড়াই বাড়ি নির্মাণ হতে শুরু করে; নাগরিকদের ব্যবহৃত রাস্তা আটক করে ফেলা হয়, কুমোররা শহরে এসে জড়ো হয়। মার্টিমুর হুইলার এই অবস্থার সুন্দর বর্ণনা করে বলেছেন যে শহরগুলি তাদের সৌন্দর্য ও সুষমা হারিয়ে ফেলেছে।

গ্রাম-শহরের সংযোগ

নগর ব্যবস্থা হরপ্পা সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্য হলেও এই সভ্যতায় গ্রাম ও কৃষি ব্যবস্থার ভূমিকা গৌণ সেকথা ভাবলে চলবে না। সেই যুগে গ্রাম শহরে খাদ্য যোগানের ব্যবস্থা না থাকলে নাগরিক সভ্যতা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। নাগরিক জীবন আলোচনা প্রসঙ্গে কৃষি-অর্থনীতির আলোচনা সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গ্রামের প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত খাদ্য নগরাঞ্চলে খাদ্য অনুৎপাদক সম্প্রদায়ের কাছে যোগান দেওয়া যে-কোন নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক প্রধান অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া।” (রণবীর চক্রবর্তী)

রামশরণ শর্মার মতে নীলনদ যেমন মিশরকে সৃষ্টি করেছে এবং মিশরবাসীর খাদ্যের চাহিদা পূরণ করেছে সেইরকম সিন্ধুনদ সিন্ধুপ্রদেশ সৃষ্টি করে সিন্ধু জনগণের অশেষ উপকার সাধন করেছে। ব্যাপক হারে খাদ্য উৎপাদন করবার ক্ষমতা, সিন্ধুর মতো বৃহৎ নদী যার নদী যার সাহায্য পরিবহন, জলসেচ, বাণিজ্য এই ত্রিবিধ কাজ সমাধান করা যায়। এর ফলেই আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে নয়-সিন্ধুনদের সমভূমিতে এই বিশাল সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কৃষির ক্ষেত্রে আর একটি কথা স্মর্তব্য এই যে সিন্ধু সভ্যতায় প্রায় সহস্রাধিক বৎসর পূর্ব থেকেই কৃষির ঐতিহ্য রয়েছে। দুরকম গমের চাষ হত; লোখালে ধানচাষ করা হত মনে হয়। দেশীয় কার্পাস থেকে তুলা এবং সুতিবস্ত্র উৎপাদন করা হত। হরপ্পা সংস্কৃতির অন্তর্গত বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র থেকে কলা, তিল, সর্ষের দানা ও বীজ আবিষ্কৃত হয়েছে। অলচিন দম্পতি কলাই চাষের জমির বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা মনে করেছেন যে বাণিজ্যের ফল হিসাবেই হরপ্পীয় সংস্কৃতি এলাকায় কলাই চাষের প্রবর্তন ঘটেছিল। চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে সিন্ধুবাসীরা লাঙলের দ্বারা চাষ করতে জানত কিনা এ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক ছিল। কালিবঙ্গানের উৎখনন থেকে প্রাক্-হরপ্পা পর্বের একটি কৃষিক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। তাতে হলকর্ষণের দাগ স্পষ্ট। একই সঙ্গে আড়াআড়ি ও খাড়াখাড়ি লাঙ্গল চালনার রেখা দেখা যায়। অর্থাৎ লাঙলের ব্যবহার প্রাক্-হরপ্পা আমলেই জানা ছিল। অলচিন দম্পতি মনে করছেন যে লাঙলের ব্যবহার মানে উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যবহার; এর ফলে উৎপাদনকে বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। খাদ্য উৎপাদানের এই নতুন পর্যায়কে তারা ‘কৃষি বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর ও অন্যান্য শহরের শস্যাগারে এই উদ্বৃত্ত ফসল গুদামজাত করা হত এবং সেটি নিয়মিত ও সুশৃঙ্খলভাবে করবার জন্যে একটি সাংগঠনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। হরপ্পীয় সভ্যতার পরিণত স্তরে কৃষি সংগঠন এবং কৃষি ব্যবস্থার উপর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল নিয়মিত ঘটনা।

বাণিজ্য

অধ্যাপিকা শিরীন রত্নাগর এনকাউনটার দি ওয়েস্টার্লি ট্রেড দি হরপ্পা সিভিলাইজেশন বইতে ‘বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা’-র ভৌগোলিক পরিবেশ বিশ্লেষণ করার দুটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। প্রথমত, উক্ত এলাকার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যর সঙ্গে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের চেয়ে মেসোপটেমিয়া এবং সুমেরু অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যর মিল অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, এই অঞ্চলের কয়েকটি সীমিত এলাকাকে বাদ দিলে ধাতুর উৎস বিশেষ ক্ষীণ। কিন্তু হরপ্পীয় কারিগরেরা ধাতুর ব্যবহারে দক্ষ ছিলেন এবং যেসব ধাতু হরপ্পীয় সভ্যতার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে পাওয়া যেত না তাদের বাণিজ্যের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হত। অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য এবং বহির্দেশীয় বাণিজ্যই হরপ্পার নাগরিকেরা নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং পরিণত হরপ্পীয় সভ্যতার ‘বাণিজ্য’ ছিল অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের দ্বারা বাণিজ্যের বহু উপাদান আফগানিস্তানের থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে। এমনকী, সুদূর ক্রীট, সিরিয়া ও মিশরেও হরপ্পীয় সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। উপাদানগুলির পরিমাণ এবং প্রাপ্ত বস্তুর ধারাবাহিকতা থেকে বাণিজ্য ছাড়া আর কোন সম্ভাবনার কথা প্রত্নতত্ত্ববিদদের মনে হয়নি। বস্তুত, বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে হরপ্পীয় সভ্যতাকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত শোটুগাই খ্রিঃপূঃ তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে এক প্রান্তবর্তী বাণিজ্য কেন্দ্রের ভূমিকা নিয়েছিল। হরপ্পা সভ্যতার বহু বৈশিষ্ট্য এই অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন মূল্যবান পাথর, বিশেষ করে “ল্যাপিস লাজুলী”, এখান থেকে সংগ্রহ করে পরে দূরবর্তী দেশগুলিতে রপ্তানি করা হত। বাদর্শনের ল্যাপিস লাজুলী খনির অবস্থান এবং এখান থেকে শোটুগাই-এর নৈকট্য ইত্যাদির কারণে শোটুগাইকে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হত। দক্ষিণ তুর্কমেনিয়াতে হরপ্পীয় যুগের হাতির দাঁতের খেলবার জিনিস, তামার তৈরি জিনিস, সিলমোহর, মাটির পাত্র এবং বিভিন্ন ধরনের পুঁতি পাওয়া গেছে। দক্ষিণ তুর্কমেনিয়াতে তামা বিরল ধাতু, তাই মনে হয় তাম্রনির্মিত জিনিসগুলি সিন্ধু সভ্যতার এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং অধ্যাপক কোহু-এর মতে এই যোগাযোগ ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে হয়েছিল। উত্তর ইরানে হিসার, শাহটেপি, মারলিক ইত্যাদি স্থানে হরপ্পীয় প্রত্নবস্তুর দেখা পাওয়া যায়। শাহবাদে প্রাপ্ত পুঁতিগুলি হরপ্পীয় কারিগরীর নমুনায় তৈরি এবং হরপ্পা থেকে এগুলির আমদানি করা হয়েছে। এ ছাড়াও বৃহৎ স্থাপত্য কীর্তি হিসাবে আক্কাদীয় সভ্যতার আমলে নির্মিত স্থাপত্য নমুনার সঙ্গে হরপ্পীয় শস্যাগারের মিল দেখা যায়। পারস্য উপসাগরের উপকূল অঞ্চলের বহু স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন করা হয়েছে। সেখানে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নবস্তুর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল বিভিন্ন ওজনের নমুনা। আকৃতি এবং ওজনের দিক থেকে এরা সম্পূর্ণভাবে হরপ্পীয় এলাকার ওজনের অনুরূপ। বাহরিনের প্রথম বাণিজ্য যোগাযোগ সিন্ধু সভ্যতার মাধ্যমে হয়েছিল এবং বাহরিনের কাছে মেসোপটেমিয়ার চেয়ে হরপ্পীয় বণিকরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্যাপক সিন্ধুদেশের ওজনের ব্যবহার এই প্রবণতার দিকেই ইঙ্গিত করে।

মেসোপটেমিয়াতে বিভিন্ন ধরনের হরপ্পীয় প্রত্নবস্তুর সমাবেশ দেখা যায়। এইসব কারণে স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত স্বদেশীয় এবং বিদেশীয় বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ হরপ্পা-মেসোপোটেমিয়া বাণিজ্যিক যোগাযোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। মেসোপটেমিয়ার কিশ অঞ্চলে ১৯২৩ সালে প্রথম সিন্ধুসভ্যতার বৈশিষ্ট্যযুক্ত সিলমোহর পাওয়া যায়। এর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন স্থানে হরপ্পীয় সিলমোহর আবিষ্কার হচ্ছে। সি. জে গাড মেসোপটেমিয়ার উর প্রত্নক্ষেত্র থেকে ১৮টি সিলমোহর আবিষ্কার করেন। এর সঙ্গে হরপ্পীয় সিল সাযুজ্য নিয়ে বহু আলোচনা করা হয়েছে এবং শিলমোহরগুলি যে সিন্ধু-পারস্য উপসাগরীয় এলাকা-মেসোপটেমিয়াতে বাণিজ্যের কাজে ব্যবহার করা হত তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ ছাড়া কার্নেলিয়ান পাথরে নির্মিত এবং কার্নেলিয়ান
ছাড়াও ল্যাপিস লাজুলী, চ্যালসিডনি, অ্যাগেট ইত্যাদি পাথরের তৈরি পুঁতি সংগ্রহ মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া গেছে। এই পুঁতিগুলি ভারতে তৈরি এবং ব্যবসার জন্যে প্রেরিত হয়েছিল এটা ভাববার যথেষ্ট যুক্তি আছে। মেসোপটেমিয়ার টেল আসমার, উব ইত্যাদি স্থানে ভারতীয় পাশা খেলা বোধহয় খুব জনপ্রিয় ছিল; কারণ এইসব স্থানে ভারতীয় ধাঁচে নির্মিত পাশা খেলার গুটি পাওয়া গেছে। এই দৃষ্টান্তকে বাণিজ্য থেকে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি দৃষ্টান্ত বলে ধরতে পারি। আই. ই. ম্যাক, এস. আর. রাও, দিলীপ চক্রবর্তী বিভিন্ন দৃষ্টান্ত সহযোগে দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে সিরিয়া, মিশর, ক্রীট ইত্যাদি অঞ্চলেও হরপ্পীয় সভ্যতার যোগাযোগ ছিল।

পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যদি হরপ্পীয় প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়, তাহলে হরপ্পা অঞ্চলে পশ্চিম এশিয় প্রত্নবস্তু পাওয়া দরকার, সেক্ষেত্রেই বাণিজ্য বস্তুর বিনিময় যোগ্যতা প্রমাণ করা সম্ভব। কিন্তু হরপ্পীয় এলাকায় বিদেশীয় প্রত্নবস্তুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। শিরীন রত্নাগর সমস্যাটির সমাধান করবার চেষ্টা করেছেন। তার মতে মেসোপটেমিয়া ভোগ্যপণ্য রপ্তানি করত এবং কৃষির দিক থেকে দুর্বল দেশগুলির কাছ থেকে অন্য পণ্যের বেশী করে দাবি করত।

কিছু সিলমোহর এবং অন্যান্য কিছু বিদেশীয় প্রত্নবস্তুর উপস্থিতি আলোচনা করলে দেখা যাবে যে গোলাকার বেশ কয়েকটি সিলমোহর এবং অন্যান্য কিছু বিদেশীয় প্রত্নবস্তুর উপস্থিতি আলোচনা করলে দেখা যাবে যে গোলাকার বেশ কয়েকটি সিলমোহর হরপ্পীয় এলাকায় অনুপ্রবেশকারী সিলমোহর বলা যেতে পারে; এই সিলমোহরগুলি মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, চান্তদারো, বাহারিন, ফাইলকা অঞ্চলে পাওয়া যাচ্ছে। দিলীপ চক্রবর্তী মনে করছেন যে এইগুলি সিন্ধু-পারস্য উপসাগর; মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে বাণিজ্যের জন্যই ব্যবহার করা হত (চক্রবর্তী: দি এক্সটারনাল ট্রেড অফ দি ইন্ডাস সিভিলাইজেশন, পৃঃ ৪৫)। বহু পূর্বে প্রায় ১৯৩১ সালে মার্শাল হাতির দাঁতের নির্মিত চোঙ-আকৃতির পাঁচটি সিলমোহরের উল্লেখ করেছেন।

মার্শালের অভিমত এই যে সুমাতে প্রাপ্ত সিলমোহরগুলির সঙ্গেই এদের মিল বেশি। বি. বি. লাল কালিবঙ্গানে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ চোঙ আকৃতি সিলমোহরের কথা উল্লেখ করেছেন। বিদেশী আকৃতির এই সিলমোহরটিতে কেন দেবতার কাছে নারীবলির চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে? উদ্দেশ্যটি এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। পারস্য উপসাগরে নির্মিত সিলমোহর লোথালে পাওয়া যায়, এদের প্রত্যেকটির গায়ে যেসব ছবি আঁকা আছে তা হরপ্পীয় বৈশিষ্ট্যের বিপরীত। শুধু লোথালে নয়, এরকম সিলমোহর হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোতেও খুঁজে পাওয়া যায়। নাগপুর মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি সিলমোহরের কথা আলাদা করে বলা যায়; কারণ এই সিলমোহরটির তারিখ ২০০০ খ্রিঃপূঃ বলে নির্ণয় করা সম্ভভব হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এটি ভারতে প্রবেশ করল তার সদুত্তর পাওয়া যায়নি। ফ্রারি ১৯৩৭ সালে মহেঞ্জোদারোতে একটি সুমেরীয়-ব্যাবিলনীয় লেখমালা খুঁজে পেয়েছেন; আধুনিক পন্ডিতেরা মনে করেছেন যে এর সঙ্কেতলিপিগুলি হরপ্পীয় সঙ্কেতলিপির সঙ্গে এককরম নয়; সিলমোহর ছাড়া অন্যান্য প্রত্নবস্তুর মধ্যে ডাবারকেটে প্রাপ্ত একটি একটি পাথরের নির্মিত পুরুষ-মস্তক, লোথালে প্রাপ্ত বেশ কিছু মৃৎপাত্রের কথা আলোচনা করা দরকার। লোথালের মৃৎপাত্রগুলি স্পষ্টতই স্থানীয় নির্মাণ নয় এবং যেখানে পাওয়া গেছে সেটি ছিল বণিকদের আবাসস্থল। সুতরাং সমুদ্র বাণিজ্যের সূত্র ধরেই তারা ভারতে প্রবেশ করেছিল। এ ছাড়া, মেহেরগড় (দক্ষিণ সমাধিস্থল), সিগ্রি এবং কোয়টা সমাধিক্ষেত্র থেকে বেশ কিছু হরপ্পা-বহির্ভূত প্রত্নবস্তুর উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

বাণিজ্যিক পথ

বাণিজ্যের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া গেলে পরের প্রশ্ন হচ্ছে বাণিজ্যিক পথ কী কী ছিল। দিলীপ চক্রবর্তী ও নয়নজ্যোতি লাহিড়ী বিস্তৃতভাবে এই প্রশ্নের আলোচনা করেছেন। অধ্যাপিকা লাহিড়ী স্থলপথ ও জলপথ উভয় দিকের রাস্তা সম্বন্ধে গবেষণা করে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত পেশ করেছেন। তিনি উত্তর দিকে আফগানিস্তান-উত্তর ইরান-তুর্কমেনিয়া-মেসোপটেমিয়া অক্ষকে চিহ্নিত করেছেন। আফগানিস্তান থেকে মেসোপটেমিয়ার পথে কার্নেলিয়ান পাথরের পুঁতি, সিন্ধু সভ্যতার চিহ্নিত বিশিষ্ট সিলমোহর পাওয়া গেছে। অক্ষরেখার মধ্যে শটুগাই, টেপিহিসার, শাহটেপি, কিশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য এশিয়ার মরুভূমির পশ্চিম দিক ধরে যাত্রা করলে এটি ছিল তুলনামূলকভাবে সোজা রাস্তা। দক্ষিণদিকে স্থলপথে মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে হরপ্পার যোগাযোগ রক্ষাকারী বিকল্প একটি পথের কথা অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেছেন- টেপিইয়াহিয়া-জালালাবাদ-কালেনিশার-সুশা-উর। এখানকার প্রতিটি স্থানেই সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে। আবার নরম পাথরের (যেমন ষ্টিটাইট/ক্লোরাইট) তৈরি পাত্র প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, পারস্য উপসাগর এলাকা, ইরানে অনেক পাওয়া যায়; এই পাথরের পাত্র তৈরির অন্যতম কেন্দ্র ছিল টেপি ইয়াহিয়া; মহেঞ্জোদারোতেও এরকম নমুনার একটি পাত্র আবিষ্কার করা গেছে। পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় গুজরাট-সিন্ধু উপকূল ধরে তৃতীয় একটি জলপথের রাস্তা ছিল। ডিলমুন থেকে হরপ্পার মধ্যে কয়েকটি হরপ্পীয় উপকূল এলাকার কথা জানা যায়। এদের মধ্যে মাকারন উপকূলের ঘুটকাজেন-দর এবং সোটকা-খো বেশ বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী এলাকা ছিল।

হরপ্পীয় সভ্যতা মেসোপটেমিয়া/ইরান প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল কিনা তা নিয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। এখন আলোচনা করা যেতে পারে যে বহির্বাণিজ্যের পণ্যসামগ্রী কী কী ছিল। লোথাল এবং সিন্ধু সিলমোহর থেকে এবং গজ মাপার দণ্ড থেকে এটা মনে হয় যে সুতিবস্ত্র রপ্তানির দ্রব্য ছিল। দিলীপ চক্রবর্তী এবং রত্নাগর দুজনেই মনে করেন যে, হাতির দাঁতের প্রস্তুত জিনিস ব্যাপকভাবে রপ্তানি হত। রত্নাগর ল্যাপিস লাজুলী পাথরের বিনিময় যোগ্যতা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন; চক্রবর্তী প্রশ্ন তুলেছেন যে বাদশান থেকে ল্যাপিস সংগ্রহ করে সেগুলি কি পুনরায় মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে রপ্তানি করা হত কিনা। প্রশ্নটির উত্তর সহজ নয়। জর্জিনা হেরম্যান জানাচ্ছেন যে, সিন্ধু অঞ্চল থেকে ল্যাপিস রপ্তানী হত ঠিকই কিন্তু দুটি ল্যাপিসের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের মেসোপটেমিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জানা সম্ভব নয় যে, সিন্ধু অঞ্চল থেকে কোন ধাতু বা ধাতব দ্রব্য রপ্তানি করা হত কিনা। প্রশ্নটি জরুরি, কারণ ব্রোঞ্জ যুগে যন্ত্র এবং অস্ত্র তামা ও টিন দিয়ে তৈরি হত; সমস্ত কারিগরী বিদ্যা ব্রোঞ্জ ও টিনের সংগ্রহের উপর নির্ভর করত। হরপ্পীয়রা ওমান থেকে তামা সংগ্রহ করত।

রাজস্থান ও গুজরাটে, বিশেষ করে, রাজস্থানের তাম্র খনিগুলিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হত। গৃহনির্মাণ ও অন্যান্য কাজে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে ভাল কাঠ পাওয়া যেত না। তাই প্রাচীন মেসোপটেমিয়া লেখমালায় দিলমান, মগন, মেলুহার বিভিন্ন কাঠের কথা উল্লেখ করা আছে। বাস্তবিক, দামী কাঠই বোধহয় ছিল হরপ্পা ও মেলুহার প্রাথমিক বাণিজ্যিক বিনিময় বস্তু। এ ছাড়াও, শিরীন রত্নাগর সোনা, রূপা এবং মূল্যবান পাথরের বাণিজ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে বৈদেশিক বাণিজ্য হরপ্পার অর্থনীতির সমৃদ্ধির পক্ষে কত জরুরি ছিল।

হরপ্পীয় মেসোপটেমিয়া বাণিজ্য উপলক্ষে তিনটি অঞ্চলের কথা বারবার উল্লিখিত হয়েছে, তারা হল টিলমুন/ডিলমুন, মগন ও মেলুহা। ডিলমুন-এর অবস্থান নিয়ে সন্দেহ নেই। আধুনিককালের বাহরিন ছিল সেকালের ডিলমুন। মগন ও মেলুহা-র আধুনিক ভৌগোলিক অবস্থান কিছুটা জটিলতার সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌ বিভিন্ন স্থানের নির্দেশ করেছেন কিন্তু কোন সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক সরবার্জার মনে করছেন যে মগন ও মেলুহা মেসোপটেমিয়া থেকে অত্যন্ত দূরবর্তী অঞ্চল নয়; এটি এমন স্থানে অবস্থিত যেখান থেকে সামরিক অভিযান এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক উভয় বজায় রাখা যায়। আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদ্রা মেলুহাকে সিন্ধু প্রদেশের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখেছেন। মেসোপটেমিয়ার বাণমুখলিপিতে লিখিত নথিতে মেলুহা ভাষার দোভাষীর উল্লেখও পাওয়া যায়। এটি নিম্ন সিন্ধু এলাকার সঙ্গে মেসোপটেমিয়ার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের স্পষ্ট প্রমাণ। ‘মাগান’কে আগে মাকারাস উপকূলের সঙ্গে সনাক্ত করা হত। সম্প্রতি পুরাবিন্দ্রা ‘মাগান’কে ওমান উপকূলের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন। কারণ হিসাবে তারা বলেছেন যে লেখমালায় মেলুহা থেকে আগত বস্তুগুলি অধিকাংশই সিন্ধু অঞ্চলের নিজস্ব জিনিস। মেলুহার ময়ূর মেসোপটেমিয়ার রাজপ্রাসাদে শোভা পেত এবং কালো জাতের বিশেষ মেলুহার মুরগীর কথা বারবার বলা হয়েছে যাদের হাড় হরপ্পীয় অঞ্চলের রূপারে পাওয়া গেছে। তা ছাড়া, মেলুহার কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের কথাও তাঁরা লিখেছেন। তৃতীয়ত, মেলুহার নৌকা, মূল্যবান ও কম মূল্যবান পাথর, বিভিন্ন ধরনের পাথর ইত্যাদির উল্লেখ প্রাচীন মেসোপটেমিয় গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে এই সমস্ত জিনিসই ছিল সিন্ধু এলাকার নিজস্ব জিনিস। সমুদ্রপথে ২৩৩৪-২২৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে মেলুহার সঙ্গে সমুদ্রপথে ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এবং এই যোগাযোগ পরবর্তীকালেও অব্যাহত ছিল; সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে এখন এটা বলা যাবে যে সিন্ধু উপত্যকাকে প্রাচীন মেসোপটেমিয় লেখতে মেলুহা বলে উল্লেখ করা হত। বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা শেষ করার আগে বাণিজ্যের প্রকৃতি কী ছিল তা জানা দরদকার। বাণিজ্য শুধু এক স্থানের পণ্য অন্য স্থানে বিতরণ নয়। এর মধ্যে পণ্যদ্রব্যগুলির উৎপাদন এবং ভোগ করাকে যুক্ত করতে হবে।

সমাজ ও ধর্মীয় জীবন

হরপ্পীয় সভ্যতার পতনের কারণ বিশ্লেষণের আগে তাদের সমাজ ও ধর্মীয় জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের প্রয়োজন আছে বলে আধুনিক ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। সিলমোহরগুলি অপঠিত থাকা সত্ত্বেও প্রত্নবস্তুর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে হরপ্পীয় জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যায়। যদিও কোনো প্রথাগত মন্দির পাওয়া যায়নি তবুও মহেঞ্জোদারোতে দুর্গ এলাকায় এবং নীচের তলার শহরের বেশ কয়েকটি বাড়িকে মন্দির বলে ভাবা যেতে পারে, কারণ বহু ধর্মীয় মূর্তি এইসব বাড়িগুলি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মার্শাল হরপ্পীয় সভ্যতার ধর্ম আলোচনার সময় কতকগুলি মূল বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। পোড়া মাটির নির্মিত স্ত্রীমূর্তিগুলিকে তিনি মাতৃকা শক্তির আধাররূপে কল্পনা করেছেন। মার্শালই প্রথম বিশেষ একটি মূর্তিকে শিব-মূর্তি বলে দাবী করেছেন কারণ তাঁর মতে, পরবর্তীকালে শিবের বৈদিক ধারণার সাথে এই মূর্তির আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যোগাসনে উপবিষ্ট এবং বিভিন্ন পশু দ্বারা বেষ্টিত; মস্তকে মহিষের শিং শোভিত এই মূর্তিকে শিব ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায়নি। পাথরের লিঙ্গ মূর্তি এবং যেসব বাড়িতে এই লিঙ্গ মূর্তিগুলি পাওয়া গেছে তা বোধহয় এই দেবতাকেই উৎসর্গ করা হয়েছিল।

অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস

তাবিজ এবং সিলমোহরে অন্য আর এক ধরনের মূর্তি পাওয়া গেছে যার মধ্যে একরকমের অতিপ্রাকৃতিক ধারণা লক্ষ্য করা যায়। এই মূর্তিগুলির মাথায় শিং এবং পশ্চাদ্দেশে একটি লেজ আছে এবং কোন কোন সময় এই মূর্তিগুলির পা-গুলি খুরবিশিষ্ট। এ ছাড়াও তাবিজ, সিলমোহরের তামার ফলকে নানা ধরনের মূর্তি পাওয়া যায় যা বিশেষ ধরনের দৈবী বিশ্বাসের ইঙ্গিত করে, যেমন-একটি সিলমোহরে সর্প পরিবেষ্টিত যোগী চেহারার মূর্তি দেখা যায়। এই মূর্তিটিকে দেবমূর্তি ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। সিন্ধু অধিবাসীদের কল্পনায় বৃক্ষদেবতাও উপস্থিত ছিলেন। কোন কোন মূর্তিতে মেসোপটেমিয়ার পুরাণে উল্লিখিত গিলগামেশের ছাপ পাওয়া যায়; এই ছাপে দেখা যায় যে একজন মানুষ দুহাতে দুটি বাঘকে ধরে আছেন; আবার শৃঙ্গবিশিষ্ট একটি মানুষ পাওয়া গেছে যার পা এবং লেজ ঠিক বলদের মতো যাকে মেসোপটেমিয়াতে এনকিছু নামে পশু মানুষ ভাবে কল্পনা করা হয়েছে। কোন কোন সময় ষাঁড় বা বাইসনের মাথা থেকে একটি গাছের সৃষ্টির কথা কল্পনা করা হয়েছে। ষাঁড় এবং গরুকে দেব-দেবীর মূর্তি কল্পনার সময় নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিমূর্ত ধর্মীয় কল্পনার মধ্যে স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহার করার কথা ভাবা যেতে পারে যার ধারাবাহিকতা আজকের ভারতীয় হিন্দুধর্মে অব্যাহত। কয়েকটি বাড়ি পাওয়া গেছে। ইটের গাঁথুনি বেশ কয়েক সারি উঁচুতে উঠে গেছে এবং উঁচু চাতালটিতে অগ্নিবেদী, কূপ, স্নান করবার স্থান পাওয়া যাচ্ছে এবং ইটের তৈরি একটি গর্ত শুধুমাত্র ছাই এবং পশুর হাড়ে ভর্তি। এই এলাকাটি নিশ্চিতভাবে সমবেত দেবার্চনার স্থান ছিল-যেখানে পশুবলি, পূণ্যস্থান, অগ্নি উপাসনা নিয়মিতভাবে করা হত। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের দ্বারা দেখা যাচ্ছে যে দুর্গ এলাকা ছাড়াও নীচের তলার বাড়িগুলিতে একটি স্থান অগ্নিসংরক্ষণের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছে। এই কক্ষটিকে অগ্নিশালা বলে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই প্রথাটি গৃহস্থদের প্রাত্যহিক অনুষ্ঠানের অন্তর্গত ছিল বলে মনে করা হয়। অন্য জায়গায় অগ্নিবেদী আবিষ্কার করা হয়েছে; পাশাপাশি ছাই-এর গর্তও পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু আর কিছু নয় কেন? অলচিন দম্পতি মনে করেন যে নীচের তলার লোকেরা শহর এলাকার লোকেদের চেয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব দিত।

সংক্ষিপ্তভাবে এটা বলা যেতে পারে যে-পরিণত হরপ্পীয় সভ্যতার ধর্মীয় ধারণায় নানারকম স্রোত এসে মিশেছে। একটি স্রোত অবশ্যই প্রাক্-হরপ্পীয় সভ্যতা থেকে উপস্থিত হয়েছে এবং তাকে বেগবান করেছে; কিন্তু বৈদিক সভ্যতার ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য যখন হরপ্পার সভ্যতায় লক্ষ্য করি তখনই জটিলতার সৃষ্টি হয়। অগ্নি-উপাসনা সুনিশ্চিতভাবে ইন্দো-আর্যদের উপাসনা পদ্ধতি। অগ্নিশালা পূজা-বেদির দ্বারা আমরা কি প্রমাণ করতে পারি যে, আর্যরা ১৫০০ খ্রীষ্টপূব্দাদের বহু পূর্বে ভারতে উপস্থিত হয়েছিলেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার আগে আরও অনেক বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ এই প্রশ্নটির সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার পতনের কারণ-সম্পর্কিত সমস্যাটি বিশেষভাবে জড়িত আছে।

ধর্মবিশ্বাস ও ক্ষমতাবিভাজন

ব্রিজেট অলচিন সম্পাদিত- সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজি পুস্তকে ইলডিকো পুস্কাস্ সিন্ধুসভ্যতার ধর্মসম্বন্ধে নতুনভাবে আলোকপাত করেছেন। তাঁর মতে, সিন্ধুসভ্যতার সাম্রাজ্যবাদী বিকাশ এবং পতনের সঙ্গে সিন্ধু অধিবাসীদের ধর্মের বিশেষ সম্বন্ধ আছে। তাঁর মতে, কোনও একজন ব্যক্তি নয়, পুরোহিতগোষ্ঠী সমবেতভাবে সিন্ধুসভ্যতার রাষ্ট্রব্যবস্থা, উৎপাদন, বিপণন এবং দূরপাল্লার বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। অধ্যাপিকা পুস্কাসের কথা ঠিক হলে আমরা কোশাম্বীর কথা মেনে নেব যে এই পুরোহিতগোষ্ঠী পরিবর্তনে বাধা সৃষ্টি করত-কারণ পরিবর্তন তাদের কাছে লাভজনক নয়; এর ফলে যে অচল অবস্থা ও স্থাণুত্ব দেখা যায় তা সিন্ধুসভ্যতার পতনকে ডেকে আনে। পুরোহিতগোষ্ঠী, বণিক-সম্প্রদায়, কারিগর এবং বোধ হয়, গ্রামের প্রধান যারা (গ্রামণী) ক্ষমতা ভোগ
করতেন এবং গ্রাম ও শহরের শ্রমজীবী জনগণের উপর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতেন। স্বাভাবিকভাবেই শহর ও গ্রাম এবং ক্ষমতাহীন এবং ক্ষমতাভোগী শ্রেণীর মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব বিরাজ করত এবং এর থেকেই কি পরে আর্যদের বর্ণব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল? এই দ্বন্দ্বকে সমাধান করবার ব্যর্থতাই পরবর্তীকালে হয়তো পুরাহিততন্ত্র-পরিচালিত সিন্ধু রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ডেকে এনেছিল। এ ছাড়াও, অধ্যাপিকা পুস্কাস্ সিন্ধুসভ্যতার দেব-দেবীকে দুভাগে ভাগ করেছেন। একটি ভাগে লোকায়তদের দেবীকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি; মাতৃকাশক্তি, লিঙ্গ পূজাকে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায়; একটি ভাগকে হরপ্পীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে ভাবা যেতে পারে। চতুর্মুখবিশিষ্ট দেবতা-যিনি সৃষ্টি এবং ধ্বংসের প্রতীক, তিনি সাম্রাজ্যবাদী সিন্ধুবাসীদেরও দেবতা ছিলেন বলে মনে করা যায়। বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কীভাবে এইসব দেবতারা হিন্দুধর্মে স্থান করে নিয়েছিলেন তা গভীর গবেষণার বিষয়। সিন্ধুসভ্যতার সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর বোধহয় এইসব দেবতারা তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন। কীভাবে এবং কেন? তার উত্তর ভবিষ্যৎ-গবেষকদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে। স্বাভাবিকভাবে এই কাজে সমাজের একাধিক শ্রেণী যুক্ত থাকে। শ্রেণীগুলির সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের উপর বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে।

সাম্প্রতিককালে হরপ্পার বাণিজ্য নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে এবং হরপ্পীয় বাণিজ্য নিয়ে তারা নানারকম মতামত প্রকাশ করেছেন। হরপ্পীয় সভ্যতার ভূমিকায় বাণিজ্যের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে শিরীণ রত্নাগর হরপ্পাকে মেসোপটেমিয়ার উপনিবেশ বলে আখ্যায়িত করেছেন। হরপ্পার শ্রমজীবী জনগণ মেসোপটেমিয়ার মন্দির এবং বণিকশ্রেণীর চাহিদা মেটাবার জন্যে উৎপাদন করত। অধ্যাপক বি. এম. পান্ডে এবং অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। অধ্যাপক চক্রবর্তী হরপ্পীয় বাণিজ্যের সংগঠিত এবং অসংগঠিত দুটি চরিত্র ছিল বলে মনে করেন। হরপ্পা এবং মেসোপটেময়ার অন্তর্বর্তী উপজাতীয় গোষ্ঠীরা বাণিজ্য- প্রক্রিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করতেন। ঘটনা যাই ঘটে থাকুক, খ্রিস্টপূর্ব দুই সহস্রাব্দের মধ্যে এই বাণিজ্য লুপ্ত হয়ে যায়।

সভ্যতার পতন

এখানে সভ্যতার উত্থানের মতো তার পতনও ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের বিস্মিত করে। কীভাবে সহস্রাধিক বছরকাল স্থায়ী হবার পর কোনরকম উত্তরসূরি না রেখে হরপ্পীয় সভ্যতার বিলোপ ঘটল? কোন্ কোন্ ঐতিহাসিক ঘটনা এর পিছনে দায়ী? কীভাবে এই পতনকে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? ভারতীয় সভ্যতার পরবর্তী বিকাশের ক্ষেত্রে হরপ্পীয় সভ্যতার প্রভাব আছে কি? এ সমস্ত এবং আরো অনেক প্রশ্ন ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতত্ত্ববিদের আলোড়িত করে। এই প্রশ্নগুলির সন্তোষজনক উত্তরের মধ্য দিয়েই কোন একটি সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। হরপ্পীয় সভ্যতার পতনের জন্যে নানারকম কারণ নির্দেশ করা হলেও দুটি প্রধান কারণের কথা প্রায় সকলেই আলোচনা করেছেন। (এক) প্রাকৃতিক দুর্যোগ (দুই) হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা। হুইলার মনে করছেন, এই সভ্যতার শেষও শুরুর মতো কম আকর্ষণীয় নয়। দ্বিতীয়ত, হরপ্পীয় সভ্যতা বহুদূর বিস্তৃত; প্রত্যেক স্থানে একই রকম কারণের জন্য পতন আসেনি। আধুনিককালের প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা সেই কথাই প্রমাণ করে।

বন্যা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়

নীলনদের বন্যার মতো সিন্ধুনদের বন্যা ছিল প্রতি বৎসরের এক স্বাভাবিক ব্যাপার। এই বন্যার ফলে জমির উর্বরতা বাড়ত এবং অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন হত। কিন্তু অস্বাভাবিক এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্যা মহেঞ্জোদারো শহরের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছিল। খননকার্যের ফলে অনুমান করা সম্ভব হয়েছে যে কমপক্ষে তিনবার ব্যাপক হারে বন্যা দেখা দেয় যার হাত থেকে শহরকে রক্ষা করা সম্ভভব হয়নি। বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে বাড়িগুলি কাঁচা ইঁটের বদলে পাকা ইঁট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। বন্যার জল যাতে নগরদুর্গকে ধ্বংস করতে না পারে সেজন্য প্রায় ৪৫ ফুট চওড়া একটি বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। উঁচু পাটাতনের উপর বাড়িগুলি তৈরি করা হত। লোথালের কাছে কোলহ নামে একটি জায়গায় জমাট পলিমাটির অবস্থিতির দরুন এটা অনুমান করা সম্ভব হয়েছে যে এই জায়গাটি বন্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। এস. আর. রাও মনে করেন যে লোথাল, দোলপারা, রংপুর বন্যার ফলে ধ্বংস হয়েছিল। ভূপৃষ্ঠগত ভয়াবহ পরিবর্তনের ফলে এরকম বন্যা সম্ভব হয়েছিল।

বন্যার ফলে শহর পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষে পরবর্তীকালে দেখা গেছে। অধ্যাপক ফেয়ারসার্ভিস বন্যার আর একটি দিকের কথা আলোচনা করেছেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে কিন্তু মহেঞ্জোদারোর নগরীয় আয়তন বোধহয় প্রসারিত হয়নি; তার ফলে জনসাধারণের মধ্যে একটা তাগিদ ছিল বন্যা-অধ্যুষিত অঞ্চলের কাছাকাছি বাস করার; বিশেষ করে কৃষিজীবী জনগণের মধ্যে এই চাহিদা বেশি হওয়া সম্ভব; অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে নগরীয় পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন

আকর্ষণীয় আর একটি সমস্যা হল হরপ্পার খাদ্য-উৎপাদন। হরপ্পীয় সভ্যতার প্রায় সমস্ত অঞ্চল প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল গম-উৎপাদক অঞ্চল। গুজরাট, আলমগীরপুর, তাপ্তী নদীর উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে বোধহয় পরবর্তীকালে চাল উৎপাদনের একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে হরপ্পীয় কৃষকেরা গম উৎপাদক-এলাকার বাইরে কোন বসতি করেনি; কারণ সেখানে তাদের কৃষিপদ্ধতি প্রয়োগ করা যাবে না। গম থেকে চালের উৎপাদনে চলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে-গাঙ্গেয় উপত্যকা এবং দাক্ষিণাত্যের উপকূল এবং মালভূমি এলাকা তাদের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল। হরপ্পীয় অঞ্চল পরিত্যাগ করে নতুন এলাকায় জনবসতি স্থাপন করার পক্ষে কোন বাধা রইল না। যদিও এটি অনুমান কিন্তু এটি সত্য যে, আর্যরা আসবার আগে প্রাক্-আর্য জনগণ মধ্যগাঙ্গেয় এবং নিম্নগাঙ্গেয় উপত্যকায় ধান চাষ করতে পারত। এই প্রাক্-আর্য কারা ছিলেন?

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অপর একটি কারণ বোধহয় বৃক্ষচ্ছেদন; গৃহস্থালীর প্রয়োজনে, শিল্পের প্রয়োজনে, বিশেষ করে, লক্ষ লক্ষ ইট তৈরির কাজে অসংখ্য গাছ উৎপাটিত করতে হয়েছিল। এর ফলে, সবুজ বনানী শুষ্ক মরুপ্রায় এলাকায় পর্যবসিত হয়েছিল। এ ছাড়াও, একই জমি বারংবার চাষ করা, জলসেচের নালাগুলির অবহেলা ইত্যাদিও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের গৌণ উপকরণ বলে ধরা হবে।

হরপ্পা সভ্যতার নগরায়ণ-প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে পৌর-কর্তৃপক্ষের অস্তিত্বের কথা বারংবার বলা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে হয় এরা ক্ষমতাবিহীন হয়েছিলেন অথবা পরিবর্তিত পরিস্থিতির চাপে তাদের কিছু করার ছিল না। মহেঞ্জোদারোতে পরবর্তী পর্যায়ে নগর-স্থাপত্যের ক্রম-অবনতির ছাপ স্পষ্ট। পুরোনো ইট ব্যবহার করে নতুন বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে; জনসাধারণের ব্যবহৃত রাস্তা অবরোধ করা হচ্ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে শহরটির প্রায় বিপর্যস্ত অবস্থা লক্ষ্য করা যায়।

আবার আভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ের প্রসঙ্গ আলোচনাক্রমে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ কৃষির পশ্চাৎপদতা নিয়ে আলোচনা করেন। জনসংখ্যার বৃদ্ধি সত্ত্বেও গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি-অর্থনীতি প্রসারিত না হওয়ায় অর্থনৈতিক জীবনে জড়ত্ব দেখা দিয়েছিল। কোশাম্বী মনে করেন যে, লৌহজাত উপকরণের সঙ্গে পরিচয় না থাকার ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকার ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে ব্যাপক পরিমাণে কৃষি উৎপাদন ঘটানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া, সেচ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পক্ষান্তরে যখন আমরা লক্ষ্য করব যে সুমেরীয় এলামাইটদের তুলনায় হরপ্পীয়দের ধাতুবিদ্যার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত এবং সাধারণ মানের, তখন বুঝতে হবে বিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যায় তারা সমসাময়িক সভ্য জাতিদের তুলনায় পিছিয়ে ছিল। ল্যামবার্গ কার্লোভস্কির মতে, হরপ্পা সভ্যতার প্রথম থেকে শেষ অবধি কারিগরী বিদ্যা-বিশেষ করে, ধাতব বিদ্যার ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া, প্রতিরক্ষার অস্ত্র যেমন কুঠার, ছোরা ইত্যাদির ঢালাই-ছাঁচ অতি সাধারণ মানের। হরঙ্গীয় প্রত্নবস্তুর মধ্যে কৃষিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলির অতি সামান্যই ব্রোঞ্জ নির্মিত; অতিশয় রক্ষণশীল চিন্তাভাবনার ফলে বোধহয় কৃষিতে ধাতুর ব্যবহার সীমিত। কাস্তে, লাঙল, নিড়ানিগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় পাথর বা শক্ত কাঠের তৈরি। কৃষিতে তামা- ব্রোঞ্জ ইত্যাদির ব্যবহার সীমিত, কিন্তু প্রস্তর-শিল্পে, হাতির-দাঁতের জিনিস নির্মাণের সময় নানা ধরনের তামা- ব্রোঞ্জের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। কেন? মুষ্টিমেয় জনগণের শৌখিনতা মেটাবার প্রয়োজনে উন্নত কারিগরী বিদ্যার প্রয়োগ হচ্ছে অথচ বৃহত্তর জনগণের প্রয়োজনীয়তা পূরণের সময় রক্ষণশীলতা, এটা কি সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতার পরিচায়ক নয়?

বাণিজ্যমুখী অর্থনীতির ভূমিকা

শিরীন রত্নাগর প্রমাণ করেছেন যে হরপ্পীয় নাগরিক সভ্যতার অস্তিত্বের জন্যে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রয়োজন ছিল। শিল্পের প্রয়োজনে বহু জিনিস ব্যবহার করতেন যা স্থানীয় ভাবে সংগ্রহ করা যেত না। হরপ্পীয় নাগরিক সভ্যতা বজায় রাখবার জন্যে দূরপাল্লার বাণিজ্য একান্তভাবে প্রয়োজন ছিল। বিপরীতক্রমে-দূরপাল্লার বাণিজ্য ছিল বলেই বোধহয় হরপ্পীয় নাগরিক সভ্যতা বিকাশলাভ করেছিল। পাঁচশত বছরের অধিক এই বাণিজ্য-সম্পর্ক টিকে ছিল এবং এর ফলে, রত্নাগরের মতে হরপ্পীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং তার কেন্দ্রাতীত ব্যবস্থা এবং উৎপাদনের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থা গড়ে উঠে। বাণিজ্যের ফলে পরিশীলিত নাগরিক সভ্যতা, বণিকশ্রেণী গড়ে উঠে। যদি এই বৈদেশিক বাজার, হরপ্পীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং বণিকশ্রেণী হাতছাড়া হয়ে যায়, নিশ্চিতভাবে তার গুরুতর প্রতিক্রিয়া হরপ্পা সভ্যতার উপর পড়বে। রাষ্ট্রের সম্পদ ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়েছিল; সামগ্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছিল-যার ফল গ্রামীণ জনতাকেও ভোগ করতে হয়েছিল। কর্মহীন শহরবাসীগণ নগর পরিত্যাগ করে গ্রামের দিকে যাত্রা করলে সনাতনগ্রামীণ জীবনযাত্রার ধারাবাহিকতায় আঘাত করে। এই অবস্থায় হরপ্পীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সভ্যতার পতন ঘটবে কোন সন্দেহ নেই।

অভিনবত্ব-সৃজনের অভাব

হরপ্পীয় সভ্যতায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অভিনবত্বের সুযোগ ছিল অল্প। পুরাতন প্রথার দুর্বলতাকে দূর করে তাকে যুগোপযোগী করে নেওয়ার মানসিকতা তাদের ছিল না। অধ্যাপক কোশাম্বী এই পরিবর্তনহীনতাকে দুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম সম্ভাবনা হিসাবে তিনি ধর্মের প্রাধান্যের কথা চিন্তা করেছেন। সামাজিক জীবনের স্থাণুত্বের জন্যে ধর্মকে দায়ী করা যায়। কয়েক সহস্রাধিক বছর ধরে হরপ্পীয় সভ্যতায় অবক্ষয় লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু কোন পরিবর্তন নয়। মেসোপটেমিয়া এবং সুমেরীয় শহরগুলি ধ্বংস হয়ে যাবার পর নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। মহেঞ্জোদারোর শহর বন্যায় ধ্বংস হয়ে যাবার পর একইভাবে তৈরি করা হয়, মৃৎপাত্র নির্মাণের কৌশল এবং আকৃতি প্রথম থেকে শেষ অবধি একই থাকে, ব্রোঞ্জের যন্ত্রগুলি একই রকম দেখতে এবং একই রকম তাদের উপযোগিতা। সবচেয়ে বড় কথা, লিখিত বর্ণমালার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই হরপ্পীয় লিপিতে কোন বৈচিত্র্য নেই; স্থায়ী বিষয়বস্তুতে দীর্ঘস্থায়ী কোন বক্তব্য উপস্থিত করার প্রবণতা দেখা যায় না। হরপ্পীয় সংস্কৃতির এই অস্বাভাবিকতাকে কোশাম্বী ব্যাখ্যা করেছেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। সমাজের সমস্ত সুযোগসুবিধা যদি মুষ্টিমেয় শ্রেণী ভোগ করে তাহলে পরিবর্তন তাদের কাছে লাভজনক নয়; অপর শ্রেণীর কাছে পরিবর্তন অপ্রয়োজনীয়।

কিন্তু অলচিন দম্পতি তাদের সাম্প্রতিক দি অরিজিন অফ দি ইন্ডিয়ান সিভিলাইজেশন বইতে এই সমস্যা আর একভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সমগ্র হরপ্পীয় সভ্যতায় কোন পরিবর্তন হয়নি তা তারা মানতে চান না; কারণ তাহলে (ক) হরপ্পীয় সভ্যতাকে প্রাক্-হরপ্পীয় এবং পরিণত হরপ্পীয়-এই দুই পর্যায়ে ভাগ করার কোনো দরকার হত না; (খ) তাদের মতে আনুমানিক ২৬০০ খ্রিঃপূঃ সময় থেকে কয়েকটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা যায়। পরিবর্তনের ক্ষেত্র হিসেবে কয়েকটি দিককে তারা ধরেছেন, একটি হল: (১) লিখিত লিপির উদ্ভব, (২) শিল্প ও কলাবিদ্যার কয়েকটি দিকে বিশেষীকরণ, (৩) বাণিজ্য। কিন্তু অলচিন দম্পতির বক্তব্য দ্বারা কোশাম্বীর বক্তব্যকে অস্বীকার করা যায় না। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই যাঁরা ক্ষমতা ভোগ করেছেন পরিবর্তনের সুযোগ তাঁরাই নিয়েছেন।

অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক অনুমান

হুইলার অনুমানভিত্তিক এসব কারণকে এড়িয়ে প্রত্নতত্ত্বভিত্তিক কারণকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তার বক্তব্য এই যে আভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ের দ্বারা এই সভ্যতা যখন জরাজীর্ণ তখন বৈদেশিক আক্রমণ চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিল। হরপ্পা- মহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টান্ত থেকে অন্তত ছ’টি নমুনা তিনি তুলে ধরেছেন যেখানে অস্বাভাবিক মৃত্যু সম্বন্ধে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। ডি. কে. এলাকাতে চারিটি কঙ্কাল নিয়ে বিশ্লেষণ করার সময় দেখা যাচ্ছে তাদের মৃত্যু হত্যা থেকে হয়েছে। এইচ. আর. এলাকায় পাঁচ নম্ভবর বাড়িতে তেরো জন বয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষ এবং একজন শিশুর কঙ্কাল দেখা যায়; মনে হয় এদের একই সঙ্গে মৃত্যু ঘটেছে। এদের মধ্যে কোন একটি কঙ্কালের মাথায় ১৪৬ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের একটি ক্ষতচিহ্নের দাগ আছে। জীবিত অবস্থায় কোন ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করার ফলে এই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীকালের আরও কয়েকটি কঙ্কালের কথা বলা হয়েছে, যেখানে কোনরকম রীতি না মেনেই মৃতদেহগুলিকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। কুয়োর ধারে শায়িত অবস্থায় একটি স্ত্রীলোকের কঙ্কাল-সমস্ত কিছুই আক্রমণ ও বিপদের দিকে আঙুল নির্দেশ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আক্রমণকারী কারা? এরা আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তানের পাহাড়ী এলাকা থেকে আগত উপজাতি হতে পারে অথবা, মধ্য এশিয়া থেকে আগত আর্যজাতিও হতে পারে। হুইলার যেখানে দুটি বিকল্পের কথা ভেবেছেন। কোশান্তবী কিন্তু স্থির নিশ্চিত যে আক্রমণকারীরা আর্য। ঋগবেদ-এ প্রায়শঃ “অশ্বময়ী নগরী” ও “পুর” ধ্বংস করার কথা বলা হয়। পুর ধ্বংস কারণ বলে আর্যদেবতা ইন্দ্রকে “পুরন্দর” বলে অভিহিত করা হয়। যতদিন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর প্রাচীর-বিশিষ্ট দুর্গগুলি আবিষ্কৃত হয়নি ততদিন এই শ্লোকগুলিকে কল্পনা বলে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু এখন এইসব বক্তব্যের পিছনে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য আছে ভাবা যেতে পারে, বিশেষ করে হরপ্পীয় সভ্যতা এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যাকে আর্যরা “সপ্তসিন্ধবঃ” বলে উল্লেখ করেছেন।

আর. এ. ই. কানিংহাম আর্কিওলজি অফ্ আর্লি হিস্টরিক্ সাউথ এশিয়া বইটিতে এই ব্যাপারটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৭০০ অব্দ পর্যন্ত হরপ্পা-সভ্যতা একটি পর্যায়ে উন্নীত হয় যাকে নাগরিক সভ্যতার পরবর্তী পর্যায় বলা যায়; এই পর্যায়ে শিল্পায়ন এবং বর্ণমালা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ ছাড়া, পশ্চিম এশিয়ার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সেখানকার জনগণের উন্নততর দক্ষিণ এলাকায় গমন করার প্রবণতা থাকতে পারে। চানহুদারো, ঝুকার, আম্রি প্রভৃতি এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের দ্বারা বহিরাগতদের আগমনের তত্ত্ব ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। চানহুদারোতে এই পর্যায়ে যেসব মৃৎপাত্র পাওয়া যাচ্ছে তা হরপ্পীয় মৃৎপাত্রের কারিগরী ও শৈলী থেকে পৃথক। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এই পর্যায়ে চানহুদারোতে কোন হরপ্পীয় সিলমোহর পাওয়া যায়নি। পাথর, ধাতু ইত্যাদি নির্মিত যেসব সিলমোহর পাওয়া গেছে তা পশ্চিম থেকে আগত বিদেশীদের উপস্থিতি প্রমাণ করে; কারণ অনুরূপ সিলমোহর পূর্ব ইরান, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়াতে পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও কয়েক ধরনের তামার যন্ত্র এবং পিচের কথাও বলা দরকার যারা কোনক্রমেই স্থানীয় নয়, বিদেশী কারিগরদের হাতের তৈরি। হরপ্পীয় সিলমোহরের অনুপস্থিতি কি হরপ্পীয় রাষ্ট্র-ক্ষমতার অনুপস্থিতি বলে ধরে নেওয়া যাবে? শুধু চানহুদারো, বুঝুকার নয়, মেহেরগড়ের সাম্প্রতিকতম পর্যায়ে, কোয়েটা এবং তার নিকটবর্তী পিয়ক অঞ্চলের সর্বত্র হরপ্পা-বহির্ভূত এক ঐতিহ্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পশ্চিম পাঞ্জাবের হরপ্পাতে “সিমেট্রি এইচ.”-এ এক বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছিল। হরপ্পার দুর্গ এলাকার এ. বি. টিবিতেও অনুরূপ মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। “সিমেট্রি এইচ.”-এর মৃৎপাত্রগুলি পরীক্ষা করে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, কুমোর-সমাজ পুরোনো কারিগরী বিদ্যার সাহায্যে নতুন খরিদ্দারের চাহিদা মিটাবার জন্যে নতুন ভঙ্গি অনুসরণ করছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌ ভাট এই নবাগতদের ইন্দো-আর্য বলে অভিহিত করেছেন। শুধু মৃৎপাত্র নয়, এরা নতুন ধরনের ছিদ্রযুক্ত শিল, নতুন ধরনের কুঠার ব্যবহার করেছেন যা পূর্বে কখনোই ব্যবহৃত হত না। আরও পূর্ব দিকে কালিবঙ্গানে উপস্থিত বলে দেখতে পাওয়া যাবে-একেবারে উপরের দিকে এক ধরনের পাত্র যা ইন্দো-আর্যরা অগ্নি উপাসনার সময় ব্যবহার করতেন এবং এই চিহ্নটি যদি ঠিক হয় তাহলে হরপ্পীয় সভ্যতার মাঝেই আর্যদের উপস্থিতি ঘটেছিল এরকম ভাবা যেতে পারে। “সিমেট্রি এইচ.”-এর বহিরাগতরা জনগণের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে, তাদের শিল্প-কৌশল করায়ত্ত করে নতুন ব্যবস্থা তাদের জমির উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে-যার স্পষ্ট প্রমাণ বোঝা যায় সমাধিস্থলে পরিবর্তিত নিয়মের মধ্য দিয়ে। কিন্তু হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তর্গত যে বিশাল সাম্রাজ্য তাকে কি আর্যরা এককভাবে ধ্বংস করতে পেরেছিল? সমগ্র হরপ্পীয় অঞ্চলের পতনের জন্য কোন একটি কারণকে দায়ী করা যাবে না, আভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ের সঙ্গে অন্যান্য কারণগুলি বিভিন্ন সময়ে কম-বেশি যোগ দিয়ে এই সভ্যতার পতনকে ডেকে এনেছিল বলে মনে হয়।

অনুশীলনী

রচনাভিত্তিক প্রশ্ন

১। উপযুক্ত দৃষ্টান্ত সহযোগে প্রাক্-হরপ্পা স্তর থেকে পরিণত হরপ্পা-সভ্যতায় বিভিন্ন পর্যায়গুলি আলোচনা করুন।

২। হরপ্পীয় সংস্কৃতির বৈদেশিক বাণিজ্য কীভাবে পরিচালিত হত? বাণিজ্যের সংগঠন, বিষয়বস্তু, বাণিজ্যপথ ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতামত ও পরস্পর বিরোধিতার উল্লেখ করুন।

৩। আর্যরা বা কোন বৈদেশিক জাতি হরপ্পীয় সভ্যতা ধ্বংস করেছিল-প্রত্নতত্ত্বের সাহায্যে কীভাবে তা প্রমাণ করা যায়?

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

১। হরপ্পীয় সভ্যতার বিস্তার কীভাবে হরপ্পীয় সভ্যতা সম্বন্ধে নতুন আলোকপাত করে?

২। হরপ্পীয় সভ্যতার পতনের জন্যে আভ্যন্তরীণ অবক্ষয়কে কীভাবে দায়ী করা যায়?

৩। সিন্ধুসভ্যতার বদলে আধুনিক কালে কেন হরপ্পা-সভ্যতা বলা হয়?

বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন

১। মহেঞ্জোদারোর স্নানাগারটির আয়তন কত ছিল?

২। লাপিস-লাজুলী কোথায় পাওয়া যেত?

৩। ডিলমান, মগন, মেলুহার কোথায় অবস্থিত বলে অনুমান করা হয়?

Leave a Comment