মহাকবি কালিদাসের জীবন পরিচয় | Kalidas Biography In Bengali

Rate this post

মহাকবি কালিদাস ভারতবর্ষের প্রাচীন কবিদের মধ্যে বাল্মীকি ও বেদব্যাসের পরেই নাম করা হয় কবি কালিদাসের। বর্তমান কালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পন্ডিতগণ ও এবিষয়ে একমত হয়েছেন যে পৃথিবীতে সর্ব দেশে সর্বকালে যত কবি আবির্ভূত হয়েছেন মহাকবি কালিদাস তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে স্থান পাবার যােগ্য। কালিদাসের কাব্যই তাকে এই দুর্লভ গৌরবের অধিকারী করেছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, কালিদাসের ব্যক্তিগত জীবন এবং তার কাল সম্বন্ধে খুব কমই জানা সম্ভব হয়েছে। ভারতবর্ষে কালিদাস সম্বন্ধে লােকশ্রুতিতে অনেক গল্প প্রচলিত। কিন্তু কেবল লােকশ্রুতি নির্ভর করে কোন মানুষের জীবনকাহিনী জানা যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হয় না।

কালিদাসকে নিয়ে যেসব গল্প প্রচলিত তাতে এরকম একটা ধারণা স্পষ্ট হয় যে নিতান্ত অজ্ঞ অবস্থা থেকে তিনি নিজের চেষ্টায় কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।

শিপ্রা নদীর কুলে উজ্জয়িনী নগরের কাছে বাস করতেন কালিদাস। তার এমনই জ্ঞান বুদ্ধির বহর যে কাঠের সন্ধানে গাছে উঠে, যে ডালে বসতেন তারই গােড়া কাটতে শুরু করতেন। কাটা ডালের সঙ্গে একসময় যে তাঁকেও মাটিতে ছিটকে পড়তে হবে সেই সামান্য বােধটুকুও নাকি তার ছিল না।

যাইহােক, ঘটনাচক্রে এই কালিদাসের সঙ্গে এক বিদুষী রাজকন্যার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের রাতেই রাজকন্যা তার স্বামীর মুর্খতার পরিচয় পেয়ে গেলেন। সকালে তিনি অপমান করে কালিদাসকে তাড়িয়ে দিলেন।

মুর্খ হলেও স্ত্রীর কাছ থেকে অপমান পেয়ে কালিদাস যে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য। তিনি রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নদীর ধারে গিয়ে বসলেন। নদীর পাথর বাঁধানাে ঘাটে মেয়েরা জল নিতে আসে। তখন সবে দিন শুরু হয়েছে। গ্রামের মেয়েদের আনাগােনা শুরু হয়েছে ঘাটে। কালিদাস লক্ষ্য করলেন, ঘাটের পরে একটি পাথর ক্ষয়ে গেছে। মেয়েরা জল তুলে কলসীটা কাঁখে তুলে নেবার আগে ওই পাথরে একবার রাখে। কলসীর এই সামান্য ছোঁয়াতেই পাথর ক্ষয়ে গেছে।

এই দৃশ্য কালিদাসের বােপােদয় ঘটাল। তার হঠাৎ মনে হল, তাহলে তাে চেষ্টা করলে তিনিও নিজের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। বিদ্যা নেই বলেই আজ তাকে অপমানিত হয়ে বিতাড়িত হতে হয়েছে। এখন থেকে চেষ্টা করলে তার পক্ষেও বিদ্যা অর্জন করা অসম্ভব নয়।

তারপর থেকেই কালিদাস বিদ্যাশিক্ষায় ব্রতী হলেন। এবং দীর্ঘ দিনের শ্রম, একাগ্র নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় বলে তিনি রামায়ণ, মহাভারত, অন্যান্য পুরাণ, ছন্দ, অলঙ্কার প্রভৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করলেন। সেই যুগে রামায়ণ এবং মহাভারতের বাইরে সংস্কৃত সাহিত্যে উল্লেখযােগ্য কবিতা লিখিত হয়নি। কালিদাস স্থির করলেন, তিনি কাব্য রচনা করবেন। সেইভাবে চেষ্টা করতেই তাঁর ভেতরের সুপ্ত কবিত্ব প্রতিভা জেগে উঠল।

এরপরই একে একে তার কলম থেকে কবিতার মত ছন্দে সৃষ্টি হল অভিজ্ঞান শকুন্তলম, রঘুবংশম, কুমারসম্ভবম, মেঘদূতম প্রভৃতি অসাধারণ রচনা। এ সকল জনশ্রুতি ছাড়া কিছুই নয়। তবে একটিমাত্র জনশ্রুতি পন্ডিতদের কাছে গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হয়েছে। সেটি হল, কালিদাস বিক্রমাদিত্যের রাজসভার একজন বরণীয় কবি ছিলেন।

এই ক্ষীণ সূত্রটিই কালিদাসের জীবনকাল নির্ণয়ের প্রধান সহায়ক হয়ে উঠেছে। ভারতীয়গণ মনে করেন যে খ্রিঃ পূঃ ৫৭ অব্দে বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে কালিদাস বর্তমান ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল, ঐতিহাসিকগণ উক্ত সময়ে কোন বিক্রমাদিত্যের সন্ধান পাননি। অথচ লােকশ্রুতি বলে, সম্রাট বিক্রমাদিত্যেরই নবরত্ন সভার অন্যতম রত্ন ছিলেন মহাকবি কালিদাস। ভারতের ইতিহাসে শকারী বিক্রমাদিত্য নামে যিনি খ্যাত হয়ে আছেন তিনি শক আক্রমণকারীদের বিতাড়ন করে শকারী নাম গ্রহণ করেছিলেন ৫৪৪ খ্রিষ্টাব্দে। তিন তার ছয়শাে বছর পূর্ববর্তী কালকে আরম্ভ ধরে নিজের নামে ভারতবর্ষে বিক্রমাব্দ প্রতিষ্ঠা করেন।

কোন কোন ঐতিহাসিকের এই মত বিচারে টিকল না। কেন না, পঞ্চম শতকে পশ্চিম ভারত গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কাজেই ষষ্ঠ শতকে হূণ বিতাড়নের প্রশ্ন অবান্তর। এই শতকের গােড়ায় যিনি হূণদের ভারত থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, তিনি কোন বিক্রমাদিত্য নন। তার নাম যশােবর্মন বিষ্ণুবর্মন। পন্ডিতগণ মনে করেন যে, গুপ্তযুগের চরম সমৃদ্ধি যার রাজত্বকালে সম্ভব হয়েছিল, তিনি হলেন সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০ ৪১৩ খ্রিঃ)। ইনিই বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন এবং রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে উজ্জয়িনীতে স্থানান্তরিত করেছিলেন।

মহাকবি কালিদাস ছিলেন এই বিক্রমাদিত্যেরই সভাকবি। ইনি সম্ভবতঃ বিক্রমাদিত্যের পুত্র কুমারগুপ্ত (৪১৩-৮৫৫ খ্রিঃ ) এবং তার পুত্র স্কন্দগুপ্তের কালেও বর্তমান ছিলেন। প্রাচীন ভারতের সাহিত্য রচিত হয়েছে সংস্কৃত ভাষায়। মহাকবি কালিদাসের রচনা সংস্কৃত সাহিত্যের কাব্য গীতিকাব্য ও নাটক এই তিনটি ধারাকেই পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর রচিত মহাকাব্য কুমারসম্ভব এবং রঘুবংশ, গীতিকাব্য মেঘদূত এবং নাটক অভিজ্ঞান শকুন্তলম, মালবিকাগ্নিমিত্র এবং বিক্রমাের্বশী। অপর একটি গীতিকাব্য ঋতুসংহার সাধারণ ভাবে তার রচনা বলে স্বীকৃত হলেও কেউ কেউ ভিন্নমত পােষণ করেন। এছাড়াও কালিদাসের রচনা নয় অথচ তার নামে প্রচারিত এমন কিছু গ্রন্থও রয়েছে, যেমন নােদয়, পুষ্পবাণবিলাস, শৃঙ্গারতিলক, চিদ্গগনচন্দ্রিকা, ভ্রমরাষ্টক, ঞতবােধ, শৃঙ্গারসার, মঙ্গলাষ্টক প্রভৃতি।

প্রাচীন ভারতের সভ্যতা সংস্কৃতি, রাজাদের রাজ্যশাসন প্রণালী এমন কি বিভিন্ন স্থানের নিখুঁত ভৌগােলিক বিবরণ কালিদাসের বিভিন্ন রচনা থেকে পাওয়া যায়। তার রচনায় ব্যবহৃত অনুপম উপমাও তার কৃতিত্বের পরিচায়ক। তাই দেশে বিদেশে কালিদাস বিদগ্ধজনের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছেন।

Leave a Comment