কার্ল মার্কসের জনসংখ্যা বৃদ্ধি তত্ত্ব: কার্ল মাকস একজন জার্মান চিন্তাবিদ । তিনি সাম্যবাদের অন্যতম প্রবক্তা। কার্ল মার্কস সাম্যবাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দ্বান্দ্বিক চিন্তার আঙ্গিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কীত তত্ত্ব টি মানুষের সামনে তুলে ধরেন।
মাকসের জনসংখ্যা তত্ত্বের মূলকথা – মাকসের মতে সমাজে দুটি শ্রেণী আছে – যথা ধনী এবং গরীব । ধনীরা হল মালিক শ্রেণী এবং গরীবরা হল শ্রমিক শ্রেণী। মুনাফার মাধ্যমে মালিক শ্রেণী নিজেদের মধ্যে পুজি সঞ্চয় করে এবং শ্রমিক শ্রেণী জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে শ্রমের পুজি বা সঞ্চয় গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ফলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ধনী – গরীব অর্থাৎ মালিক – শ্রমিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে দরিদ্র জনগণের মধ্যে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে।
কার্ল মাকসের মতে জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একটি উন্মুক্ত প্রনালী। ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কুফল হিসাবে শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
যেখানে সাম্যবাদে প্রযুক্তি গত পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার শ্রমকে আরো উন্নত করা যায়, শ্রমিককে আরো সুদক্ষ করা যায়। ফলে উৎপাদন বাড়ে । সমাজ অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রসর হয়। তখন ওই জনসংখ্যা কে অতিরিক্ত বলে মনে করার কোন কারণ থাকে না।
মাকস বলেছেন, ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বে যে অত্যাধিক জনসংখ্যা (Over Population) সংক্রান্ত সমস্যার কথা বলা হয়েছে তা প্রতিক্রিয়াশীল দের কাছে জনপ্রিয় হলেও জনাধিক্যের কোন বাস্তব সম্মত ভিত্তি নেই। বস্তুতপক্ষে, ধনী শ্রেণী নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য মানুষের একটি বড়ো অংশকে সবসময়ের জন্য পিছিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। ওই বঞ্চিত মানুষ গুলির মধ্যে দারিদ্র, অশিক্ষা প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধি গুলি বাসা বাধে ফলে অন্যান্য সামাজিক সমস্যার সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবনতাও বাড়ে।
তাই জনসংখ্যা আধিক্যের ধারণা শুধুমাত্র ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই সম্ভব। কারণ ধনতান্ত্রিক মালিকানা উদ্বৃত্ত শ্রমিক এবং বেকারত্বের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় – জনসংখ্যা উন্নয়নের অন্তরায় নয় বরং অতিরিক্ত শ্রম উৎপাদনের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করে।
মার্কসীয় ধারণায় জনসংখ্যা তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য গুলি হল:
১. শ্রমিক শ্রেনী শ্রমের মাধ্যমে পুজি বৃদ্ধি করে নিজেরাই উৎপাদনের উপাদান হিসাবে কর্মসংস্থানের দৃষ্টিকোন থেকে উদ্বৃত্ত ঘোষিত হয়। এই সামাজিক কাঠামো ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বে প্রাসঙ্গিক। কারণ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাতে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সেই একই হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পায় না।
২. পুজিবাদি উৎপাদন ব্যবস্থাতে শ্রমিক নিয়োগের স্বাধীনতা যাতে অক্ষুন্ন থাকে এবং বিশাল শ্রমিক শ্রেনীকে যাতে শোষণ করা যায় সেই কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির স্বাভাবিক হারকে অতিরিক্ত বলে দেখা যায়।
৩. ধনতান্ত্রিক কাঠামোতে জমির বহন ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পরিমানে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা হয় না। কারণ তাতে ধনী শ্রেণীর স্বার্থ বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা থাকে। এই কারণে জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার কে জনস্ফীতি বলে মনে হয়।
কার্ল মার্ক্সের তত্ত্বের গুরুত্ব
মার্ক্সের জনসংখ্যা সম্বন্ধে যে ধারণা দিয়েছেন তা সম্পূর্ন ভাবে ম্যালথাসের তত্ত্বের বিপরীত । প্রকৃতপক্ষে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব ব্যক্তি স্বাতন্ত্র, সীমাহীন ভোগের আকাঙ্খা, ব্যক্তি মালিকানা প্রভৃতি বিভিন্ন ধরণের শ্রেণী স্বার্থের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে।
বস্তুত পক্ষে, মানুষের সমাজ ভাবনা যেহেতু এই সমস্ত ধারনার বিপরীত মেরুতে অবস্থিত, তাই মার্কসের জনসংখ্যা তত্ত্ব মূলত কল্যানতত্ত্বের আদর্শের উপর নির্ভরশীল।
সমালোচনা – মার্ক্সের জনসংখ্যা সম্পর্কীত ভাবনা তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্টিত এবং তার চিন্তা আদর্শ স্বরূপ। তবে বাস্তবের উপর ভিত্তি করে বলা যায় –
১. যদি মার্ক্সের জনসংখ্যা তত্ত্ব সর্বদা প্রয়োগ যোগ্য হত, তাহলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য বা জার্মানির মতো ধনতান্ত্রিক দেশে বেকারত্ব সৃষ্টি হত না।
২. মানুষের প্রজনন ক্ষমতা বা প্রজননের ইচ্ছা কোনো মতবাদের মেনে চলে না । সেই কারণে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতেও জনসংখ্যা চাপ বাড়ে। যেমন – চিন।
৩. যদি দেখা যায়, সম্পদের সম্পূর্ন বিকাশ সত্ত্বেও জনসংখ্যার চাপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে, সেক্ষেত্রে কার্যকর প্রতিষেধক পদক্ষেপ গ্রহন করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন করা আবশ্যক। যেমন – চিন ।
৪. শ্রমিক শ্রেনির মজুরি হ্রাস পাওয়া বা বেকারত্বের সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোন সম্পর্ক নেই। আসলে উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে বলে মৃত্যুহার কম। একই হারে জন্মহার কমেনি। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।