কাশীরাম দাসের (Kashiram Das) জীবনী
”মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান ।।”
এই পরিচিত ভণিতা প্রায় তিনশ বছর ধরে বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে চলেছে। ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মহাভারত। এটি কেবল পুণ্য কাহিনী মাত্র নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আকর স্বরূপ। ভারত তথা মানব জাতির সর্বজনীন বিধি নীতির আধার।
প্রাচীন ভারতের বেদ উপনিষদ সহ সমস্ত পুরাণের সার হল মহাভারত মহাগ্রন্থ। তাই তাকে বলা হয় পঞ্চম বেদ। আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওত প্রােত ভাবে জড়িত দেব-দেবী, যােগী, গৃহী, রাজা, প্রজা, পাপী, পুণ্যবান, দৈত্য-দানব, যক্ষ-রাক্ষস, পিশাচ, মাতঙ্গ, ভুজঙ্গ, কুরঙ্গ, পর্বত, জঙ্গম, সমুদ্র প্রভৃতি, এককথায় বিশ্বের সমস্ত জীবের ইতিহাস স্বরূপ এই গ্রন্থ।
যাট লক্ষ শ্লোকে মহাভারত প্রথম রচনা করেন মহামুনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। এই ষাট লক্ষ শ্লোকের মধ্যে ত্রিশ লক্ষ দেব লােকে, পনেরো লক্ষ পিতৃলােকে চৌদ্দ লক্ষ গন্ধর্ব লােকে এবং বাকি লক্ষ শ্লোক মর্ত লােকে প্রচারিত হয়েছিল। এই লক্ষ শ্লোক পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের প্রাজ্ঞ পন্ডিত মন্ডলী মূল সংস্কৃত থেকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করেন। বাংলা ভাষায় যে অনুবাদটি সর্বজনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত তা রচনা করেছিলেন কাশীরাম দাস। তার আগে আরও অনেক কবি মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন, কিন্তু কালজয়ী হয়েছেন কাশীরাম দাস নিঃসন্দেহে।
কাশীরামের পূর্ববর্তী অনুবাদকগণ পান্ডিত্যপূর্ণ ভাষায় মূল গ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ করেছিলেন। ভক্তি ও ভাব তাদের চিন্তাকে সঞ্জীবিত করেনি। কাশীরামের সঙ্গে এখানেই এই সকল কবিদের রচনার প্রভেদ। তিনি কেবল অনুবাদ করেই ক্ষান্ত হননি। নিজের অন্তনিহিত ভাব ও ভক্তিধারায় তার রচনাকে পুষ্ট করেছিলেন। সরল, প্রাঞ্জল অথচ সুন্দর সরস ভাষায় পয়ার ছন্দে রচিত কাশীরাম দাসের মহাভারত যুগের পর যুগ বাংলার গ্রামে গঞ্জে, নগরে, বন্দরে ভক্ত ও রসিক নরনারীর কণ্ঠে ঝঙ্কৃত হয়ে চলেছে।
পুণ্যশ্লোক কাশীরাম দাসের (Kashiram Das) জীবন কাহিনী আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তিনি নিজের রচনায় যেটুকু আত্ম পরিচয় প্রকাশ করেছেন, তাই আমাদের সম্বল। কবি লিখেছেন,
“ইন্দ্রানী নামেতে দেশ পূৰ্ব্বাপর স্থিতি।
দ্বাদশ তীর্থেতে যথা বৈসে ভাগীরথী।।
কায়স্থ-কুলেতে জন্ম বাস সিদ্ধি গ্রাম।
প্রিয়ঙ্কর দাস সুত সুধাকর নাম।।
তৎপুত্র কমলাকান্ত কৃষ্ণদাস পিতা।
কৃষ্ণ দাসানুজ গদাধর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।। “
কাশীরাম দাস এর জন্ম স্থান ও পিতামাতা: Birth Place And Parents Of Kashiram Das
এই পাঠ থেকে জানা যায় ইন্দ্রানী পরগনার অন্তর্গত সিদ্ধি নামক গ্রাম কবির জন্মস্থান। তার বাসস্থান ছিল ভাগীরথীর কূলে আর সেখানে বারটি তীর্থ অবস্থিত বিশেষ অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্ধমান কাটোয়ার অন্তর্গত ইন্দ্রাণী নামক পরগনায় প্রাচীনকালে সিদ্ধিগ্রাম অবস্থিত ছিল। এই গ্রামের কাছেই গঙ্গার কুলে বারটি তীর্থ অর্থাৎ ঘাটের ধ্বংসাবশেষ এখনও বর্তমান। কাশীরামের কৌলিক উপাধি ছিল দেব। কিন্তু দেব দ্বিজে ভক্তি শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য তিনি নিজেকে ‘দাস’ যুক্ত করে বিনয় নম্রতা প্রকাশ করেছেন । মহাভারতে নিজ রচনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি দাস শব্দ প্রয়ােগ করেছেন। কাশীরামের প্রপিতামহের নাম ছিল প্রিয়ঙ্কর। পিতামহের নাম সুধাকর এবং পিতার নাম কমলাকান্ত। কাশীরাম (Kashiram Das) ছিলেন পিতার মধ্যম পুত্র। তার অগ্রজের নাম কৃষ্ণদাস ও কনিষ্ঠের নাম গদাধর।
কাশীরাম দাস এর রচনা: Written by Kashiram Das
উত্তরাধিকার সূত্রেই কমলাকান্তের পুত্রগণ কবি প্রতিভার অধিকারী হয়েছিলেন। জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণদাস ভাগবতের বঙ্গানুবাদ করে শ্রীকৃষ্ণবিলাস কাব্য রচনা করেন। কনিষ্ঠপুত্র গদাধর জগন্নাথ মঙ্গল কাব্যের রচয়িতা। কাশীরাম দাস (Kashiram Das) মহাভারতের আদি, সভা, বন ও বিরাট পর্ব পর্যন্ত রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। ইতিমধ্যেই তার অকালমৃত্যু ঘটলে মহাভারতের অবশিষ্ট পর্বের অনুবাদ করে যেতে পারেননি। গদাধরের পুত্র নন্দরামকে অন্তিম সময় তিনি তাঁর আর কাজ সম্পূর্ণ করার আদেশ কবে যান। জ্যেষ্ঠতাতের আদেশে নন্দরাম মহাভারতের অনুবাদ সম্পূর্ণ করেন।
কাশীরামের (Kashiram Das) মহাভারতের প্রথম চার পর্ব সর্ব প্রথম শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে 1801-03 খ্রিঃ ছাপা হয়। 1836 খ্রিঃ এই প্রেস থেকেই জয়গােপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় মহাভারতের সম্পূর্ণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কাশীরামের বাসস্থান সিদ্ধিগ্রাম বর্তমানে সিঙ্গিগ্রাম নামে পরিচিত। অনুমান করা হয় সিদ্ধিগ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের জমিদার এই গ্রাম নিজ গ্রামের সঙ্গে যুক্ত রায় সিদ্ধিগ্রাম নামটি লােপ পায়। অনেকের মতে দাইহাটের নিকট সিদ্ধিগ্রাম অঞ্চলেই কবির পৈতৃক ভিটা বর্তমান ছিল। কবি কাশীরাম দাস মেদিনীপুর জেলার আবাসগড়ের রাজার আশ্রয়ে একটি পাঠশালা স্থাপন করে শিক্ষকতা করতেন। প্রায়ই রাজ বাড়িতে কথক-গায়কদের সেই সময় আগমন ঘটত এবং তার মহাভারত পুরাণাদি পাঠ করতেন। কথকদের মুখে কথকতা শুনেই কবির মনে বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনার আগ্রহ জন্মে। পরবর্তী কালে তাঁর রচিত মহাভারতই কালােত্তীর্ণ হয়ে বাঙালীর ঘরে ঘরে স্থান লাভ করে। কাশীরামের জীবনে আর যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তা থেকে জানা যায়, কবি নিজ গ্রামে অপর সকলের উপকারের কথা চিন্তা করে একটি পুকুর খনন করান। সেই পুকুর এখনাে বর্তমান, কেশপুকুর নামে তার পরিচিতি। কবির বাস্তুভিটা তার পুত্র 1085 খ্রিঃ তাদের কুলপুরােহিতকে দান করেন। এই দানপত্র থেকে অনুমান করা হয় কাশীরাম 1000 খ্রিঃ কিছুকাল পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কাশীরামের রচিত অপর গ্রন্থগুলাে হল, সত্য নারায়ণের পুঁথি, স্বপ্নপর্ব, জলপর্ব ও নলােপাখ্যান।