কোল বিদ্রোহ কী এবং কোল বিদ্রোহের কারণ, ফলাফল এবং গুরুত্ব কী?: কোল বিদ্রোহ হল বিহারের ছোটনাগপুর, সিংভূম, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে কোল উপজাতির বিদ্রোহীদের দ্বারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত হওয়া বিদ্রোহ। শোষণ, জীবিকায় আঘাত, কোল ঐতিহ্য ধ্বংস, রাজস্ব বৃদ্ধি, নগদ খাজনা আদায় ইত্যাদি কারণে এই বিদ্রোহ হয়েছিল। বুদ্ধ ভগৎ, জোয়া ভগৎ, সুই মুন্ডা, ঝিন্দরাই মানকি প্রমুখরা কোল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। মুন্ডা, ওরাওঁ, হো ও ভূমিজ সহ ছোটনাগপুরের আদিবাসীদের কোল বলা হত।
শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনা নির্মম দমন-পীড়নের মাধ্যমে এই বিদ্রোহ দমন করে। তাছাড়া সুযোগ্য নেতার অভাব, আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা, শিক্ষিত মানুষের সমর্থনের অভাব, বিদ্রোহীদের মধ্যে যোগাযোগের অভাব প্রভৃতি কারণে কোল বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
কোল বিদ্রোহ:
বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতি গোষ্ঠী কোল নামে পরিচিত। কোলরা আবার মুন্ডা, হো, ওঁরাও প্রভৃতি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। তারাই ইংরেজ, জমিদার ও দেশীয় মহাজনদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিল তা ইতিহাসে কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
কোল বিদ্রোহের কারণ:
- রাজস্ব বৃদ্ধি: ইংরেজ কোম্পানির ছোটনাগপুর অঞ্চল দখল করার পর সেখানে নতুন নতুন ভূমি রাজস্ব নীতির ফলে কোলরা ক্ষুব্ধ হয় এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
- জীবিকা সমস্যা: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা তাদের চিরাচরিত অরণ্য অধিকার হারায় ফলে তাদের জীবিকা সমস্যা দেখা দেয়।
- জমিদার ও মহাজনদের শোষন ও অত্যাচার: ছোটনাগপুর অঞ্চলে মহাজন’ জমিদাররা বিভিন্নভাবে কোলদের উপর শোষণ ও অত্যাচার চালায়। তারা অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
- নগদ খাজনা আদায়: সরকারও জমিদাররা কোলদের নগদ খাজনা দিতে বাধ্য করে। ফলে কোলরা নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে মহাজনদের দ্বারা প্রতারিত ও শোষিত হয়।
বিদ্রোহের ব্যাপ্তি: 1831 খ্রিস্টাব্দে রাচি অঞ্চলে কোল সম্প্রদায় প্রথম বিদ্রোহ করে এবং 1831-32 খ্রিস্টাব্দে কোল বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। রাচি, হাজারীবাগ, সিংভূম ও পালামৌ প্রভৃতি অঞ্চলে কোল বিদ্রোহ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চাষী, কামার, কুমোর, গোয়াল প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষ কোলদের সঙ্গে এই বিদ্রোহে যোগ দেয়।
বিদ্রোহীরা তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লম, কুড়ুল প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। ইংরেজ কর্মচারীর, জমিদার ও অত্যাচারী দিকু ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করে এবং তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
বিদ্রোহের নেতা: কোল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব ছিলেন বুদ্ধ ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা ও ঝিন্দিরাই মানকি প্রমূখ।
বিদ্রোহের দমন: আধুনিক অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে অসম লড়াইয়ে কোলরা পরাজিত হয়। নরনারী ও শিশুসহ অসংখ্য কোল নিহত হয় এবং কোল বিদ্রোহ দমিত হয়।
কোল বিদ্রোহের গুরুত্ব: মাতৃভূমি রক্ষায় কোলদের অসম লড়াই ব্যর্থ হলেও এ বিদ্রোহের গুরুত্ব অপরিসীম। এই বিদ্রোহের ফলে সরকার –
- ছোটনাগপুর অঞ্চলে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামে একটি নতুন অঞ্চল গঠন করে।
- এই অঞ্চলে জমিদারদের হাত থেকে জমি গ্রামপ্রধানদের হাতে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
- ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলে তাদের আইন-কানুন কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নেয়।