মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ভারতীয় ধর্মীয় জীবনে গুরু রূপে পূজিত যে মহান তাপস তিনিই হলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। এই কারণে তার জন্মতিথি শ্রাবণী পূর্ণিমাকে গুরুপূর্ণিমা রূপে পালন করা হয়। একই সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় মহর্ষি দ্বৈপায়ন ব্যাসের মধ্যে। তিনি ভারতের পুরাণ ও মহাকাব্যের এক উল্লেখযােগ্য ঋষি চরিত্র।
ভারতের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মহাভারতের রচয়িতা সে তিনিই। কেবল তাই নয়, তিনি মহাভারতের নায়কও বটে। মহাকাব্য – কাহিনীর প্রতিটি সঙ্কটময় মুহর্তে তাঁর উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। বেদের বহু মন্ত্রের রচয়িতা এবং বহু শাস্ত্রের জনক ঋষি পরাশর ছিলেন দ্বৈপায়ন বাসের পিতা। মাতার নাম সত্যবতী।
তার নামের প্রতিটি শব্দই অর্থময়। যমুনা নদীর একটি দ্বীপে জন্মেছিলেন বলে দ্বৈপায়ন, গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ তাই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। আর অখন্ড বেদশাস্ত্রকে গুণানুযায়ী বিভক্ত করেছিলেন বলে বেদব্যাস। মহাভারতে তার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা মােটেই ঋষিসুলভ ছিল মনে হওয়ার কারণ নেই। ঘাের কৃষ্ণবর্ণের বিশাল বপু ব্যাসদেবের মাথাজুড়ে ছিল পিঙ্গল জটাভার। রীতিমত ভীতি উদ্রেককারী চেহারা।
তার জন্মকাহিনী মহাভারতেই লিপিবদ্ধ আছে। রাজা উপরিচর বসু এবং অদ্রিকার কন্যা ছিলেন সত্যবতী। তার শরীর থেকে মাছের গন্ধ নির্গত হত বলে তার আরেক নাম হয়েছিল মৎস্যগন্ধা। সত্যবতী প্রতিপালিত হয়েছিলেন যমুনার তীরবর্তী এক দাসরাজের গৃহে । যৌবনে পালক পিতার নির্দেশে সত্যবতী নদীর ঘাটে নৌকা পারাপারের কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। বনের মধ্যে একাকী সত্যবতী লােকজনকে নদী পারাপার করে দিতেন। একবার তীর্থপর্যটনে বেরিয়ে ঋষি পরাশর নদীর কাছে এসে অপূর্বসুন্দরী সত্যবতী তথা মৎস্যগন্ধাকে দেখতে পান। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে ঋষি তাকে গ্রহণ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
সত্যবতী তাকে তার দুঃখের কথা জানালেন। পরাশর আশ্বাস দিয়ে বললেন, তােমার দেহের মৎস্যগন্ধ আমার বরে পদ্মগন্ধ হবে। এবং তাই হল, এই কারণে তার আর এক নাম হল পদ্মগন্ধা। এক যােজন দূর থেকে এই গন্ধ পাওয়া যেত বলে, যােজনগন্ধা বলেও সত্যবতী পরিচিত হয়েছিলেন। ঋষি পরাশরের বরে দুই জনের মিলনের অল্প সময় পরেই এক দ্বীপে জন্ম হয় কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের। তপস্যাপ্রবণ এবং বৈরাগ্যবান হয়েই জন্মালেন তিনি। জন্মের পরেই পিতা পরাশরের সঙ্গে তপস্যা করতে চলে যান। যাওয়ার সময় মাতা সত্যবতীকে বলে যান, আমাকে যখনই তুমি স্মরণ করবে, সেই মুহূর্তেই আমি তােমার কাছে উপস্থিত হব।
পরবর্তী সময়ে সত্যবতীর বিয়ে হয় হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর সঙ্গে। রাজগৃহে তার চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্র হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দুজনেই যুবা বয়সে মারা যান। দুই পুত্রের অকাল মৃত্যুতে হস্তিনাপুরের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যাকুল হন সত্যবতী । তিনি শান্তনু ও গঙ্গার পুত্র ভীষ্মের সঙ্গে পরামর্শ করে কনাকা অবস্থার পুত্র ব্যাসদেবকে স্মরণ করেন। মাতার আহ্বানে ব্যাস উপস্থিত হন এবং মাতার অনুরােধে তৎকালীন সামাজিক ও ধর্মসম্মত রীতি অনুযায়ী বিচিত্রবীর্যের স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান উৎপন্ন করেন। এইভাবে অম্বিকার গর্ভে জন্ম হল অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের এবং অম্বালিকার গর্ভে জন্মান পান্ডুবর্ণের হতশ্রী পুত্র পান্ডু।
মাতা সত্যবতীর অনুরােধে ব্যাসদেব এক ভক্তিমতী দাসীর গর্ভে যে পুত্রের জন্ম দেন তিনিই হলেন সর্বগুণান্বিত মহাজ্ঞানী বিদুর। ঋষির ঔরসজাত এই তিন পুত্র হলেন কুরুবংশের উত্তরাধিকারী এবংমহাভারতের কাহিনীর তিন স্তম্ভ। বাসদেবের আশ্রম ছিল সরস্বতী নদীর তীরে, সেখানেই তিনি তপস্যাকরতেন। একদিন তিনি দেখতে পেলেন একটি চড়াই পাখি তার দুই ছােট্ট শাবককে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে ব্যাসদেবের অপত্যস্নেহ জাগরিত হয়। তিনি দেবর্ষি নারদকে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর পরই অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে বাসদেবের যে পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে তার নাম শুক।কুরুবংশে ধৃতরাষ্ট্র এবং পান্ডুর জন্মদানের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাসদেব প্রকৃতপক্ষে বিশাল মহাভারত কাহিনীর প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবেজড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর আশীর্বাদেই গান্ধারীর শতপুত্রের জন্ম সম্ভব হয়েছিল। তার উপদেশেই প্রসূত মাংসখণ্ডটিকে একশত একটি টুকরাে করে গান্ধারী শতপুত্র ও একটি কনার জননী হতে পেরেছিলেন।
পান্ডবদের সঙ্গে পাঞ্চালী দ্রৌপদীর বিবাহ নিয়ে সঙ্কট উপস্থিত হলে ব্যাসদেব উপস্থিত হয়ে সময়ানুগ উপদেশ দেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলে ব্যাসদেব একদিন রাজসভায় উপস্থিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্যদৃষ্টি দান করতে চাইলেন, যাতে তিনি এই ধর্ম অধর্মের যুদ্ধ নিজচোখে দেখতে পান। বস্তুত পক্ষে বাহ্যত দৃষ্টিহীন এবং পুত্রস্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রই ছিলেন অধর্মের পালক। তাই তিনি এই ধর্মযুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে ভীত হয়ে দিব্যদৃষ্টি গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হন। তখন ব্যাসদেব সারথী সঞ্জয়কে দিব্যদৃষ্টি দান করেন। সেই দৃষ্টিবলেই সঞ্জয় আঠারাে দিনের কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের বিবরণ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে শুনিয়েছিলেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শতপুত্রের মৃত্যু হলে শােকাতুরা গান্ধারী অভিশাপ দিয়ে পান্ডবদের ধ্বংস করার সঙ্কল্প করেন। ব্যাসদেবই তাকে এই সর্বনাশা কর্ম থেকে নিরস্ত করেন। এইভাবে মহাভারতের প্রতিটি উল্লেখযােগ্য নাটকীয় মুহূর্তে ব্যাসদেবের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। এ যেন নিজের সৃষ্ট এক জগতে বহুরূপে তার নিজেরই জগৎ ও জীবনকে উপভােগ করার এক দুঞ্জেয় লীলা।
সঞ্জয়ের অনুরােধেই মহাযুদ্ধের পর মহাভারতের কাহিনী লেখায় প্রবৃত্ত হন ব্যাসদেব। কথিত হয় তিনি মহাভারতের শ্লোকগুলি রচনা করেছেন মুখে মুখে আর তা লিপিবদ্ধ করেছেন সিদ্ধিদাতা গণেশ। মহাভারত কেবল ঐতিহাসিক কাহিনী মাত্র নয়, এতে বিবৃত হয়েছে ভারতবর্ষের চিরশলীন ধর্ম, দর্শন, তপস্যা, রাজনীতি, জীবনচর্যা, লােকাচার প্রভৃতি।
বস্তুত সর্ব অঙ্গ ও প্রাণ নিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষই বিবৃত হয়েছে মহাভারত কাহিনীতে। এই কাহিনীর বিশালতা ও ব্যাপ্তি অনস্বীকার্য। মহাকাব্য মহাভারত রচনা ছাড়াও, সমগ্র বেদকে ঋক, সাম, যজু , অথর্ব- এই সদেব। মহাভারতকে বলা হয়ে থাকে পঞ্চমবেদ। বেদান্তের রচয়িতাও ব্যাসদেব।
এছাড়া ভারতের ঋষিকুলে প্রচলিত সুপ্রাচীন কাহিনী সংগ্রহ করে আঠারােটি পুরাণ ও আঠারােটি উপপুরাণ রচনা করেছেন তিনি। মহাভারত থেকে ব্যাসদেবের যে শিষ্যদের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন, অগ্নিবৰ্চস, অকৃতব্রন, অসিত, দেবল, মিত্ৰায়ুস, বৈশম্পায়ন, সাবর্ণি, সুমন্ত, সুত। নিজপুত্র শুককেও তিনি শিষ্যত্বে বরণ করেছিলেন। শিষ্যদের তিনি বেদ ও মহাভারত শিক্ষা দিয়েছিলেন। মহাভারতের বিশাল ঘটনা কণ্ঠস্থ করে তারাই তা প্রকাশ ও প্রচার করেছিলেন বিভিন্ন দিকে। সরস্বতী তীরে নিজ সাধনভূমি বদরিকাশ্রমে সমাধি অবস্থায় ইহলােক ত্যাগ করেছিলেন ব্যাসদেব।