লাজারো স্পালানজানি জীবনী – Lazzaro Spallanzani Biography in Bengali

Rate this post

লাজারো স্পালানজানি জীবনী: gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Lazzaro Spallanzani Biography in Bengali. আপনারা যারা লাজারো স্পালানজানি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী লাজারো স্পালানজানি র জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।

লাজারো স্পালানজানি কে ছিলেন? Who is Lazzaro Spallanzani?

Lazzaro Spallanzani (12 জানুয়ারী 1729 – 11 ফেব্রুয়ারী 1799) একজন ইতালীয় ক্যাথলিক ধর্মযাজক, জীববিজ্ঞানী এবং ফিজিওলজিস্ট যিনি প্রাণীবিদ্যার গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। প্রজনন, এবং প্রাণীর প্রতিধ্বনি।বায়োজেনেসিসের উপর তার গবেষণা স্বতঃস্ফূর্ত প্রজন্মের তত্ত্বের পতনের পথ প্রশস্ত করেছিল, সেই সময়ে একটি প্রচলিত ধারণা যে জীবগুলি জড় পদার্থ থেকে বিকাশ লাভ করে, যদিও এই ধারণাটির চূড়ান্ত মৃত্যু ঘা ফরাসি বিজ্ঞানী দ্বারা মোকাবিলা করা হয়েছিল।

লাজারো স্পালানজানি জীবনী – Lazzaro Spallanzani Biography in Bengali

নামলাজারো স্পালানজানি
জন্ম12 জানুয়ারী 1729
পিতাGianniccolò Spallanzani
মাতাLucia Zigliani
জন্মস্থানস্ক্যান্ডিয়ানো, ডাচি অফ মোডেনা এবং রেজিও
জাতীয়তাইতালীয়
পেশাজীববিজ্ঞানী
মৃত্যু11 ফেব্রুয়ারি 1799 (বয়স 70)

লাজারো স্পালানজানি র জন্ম: Lazzaro Spallanzani’s Birthday

লাজারো স্পালানজানি 1729 সালের 12 জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন।

বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে জীববিজ্ঞানীদের জীববিজ্ঞানী (Biolo gists’ Biologist) বলে পরিচিত ল্যাজারো স্পালাঞ্জানির আবির্ভাব হয়েছিল অষ্টাদশ শতকের এমন এক সময়ে যখন সমাজে ছিল কুসংস্কারও তথাকথিত ধর্ম বিশ্বাসীদের দাপট। যা প্রচলিত সংস্কারে মেলে না, যা শাস্ত্র বহির্ভূত, সেই অন্ধকার যুগে তাকে সত্য বলে প্রমাণ করা ছিল দুঃসাধ্য।

গোটা পৃথিবীর আবহাওয়াই ছিল এই রকম। অথচ সেই যুগে অদম্য প্রাণশক্তি ও অধ্যবসায় বলে দুঃসাধ্য সাধন করেছিলে স্পালাঞ্জানি। তার অনুসন্ধিৎসা ও গবেষণা জীববিজ্ঞানের অসংখ্য জটিল জিজ্ঞাসার বৈজ্ঞানিক মীমাংসা দানে সক্ষম হয়েছিল। জীববিজ্ঞান পেয়েছিল আধুনিকতার আলোর সন্ধান ! বিজ্ঞান – সাধক স্পালাঞ্জানি পেয়েছিলেন এক বিচিত্র জীবন। সেই জীবনে বিজ্ঞানের সংস্পর্শ নিরবচ্ছিন্ন ছিল না।

একাধিকবার পেশা পরিবর্তন করেছেন, নেশা পাল্টেছেন। কখনো হয়েছেন পাদ্রী, কখনো আইনজীবী। তবে সর্বক্ষেত্রেই সত্যসন্ধানের আকুলতা তার মধ্যে সদাজাগ্রত ছিল। যুক্তি আর জিজ্ঞাসা হয়েছিল তার বাহন।

লাজারো স্পালানজানি র পিতামাতা ও জন্মস্থান: Lazzaro Spallanzani’s Parents And Birth Place

স্পালাঞ্জানির জন্ম ইতালির মোদেনা প্রদেশের ছোট শহর স্কান দিয়ানোয় ১৭২৯ খ্রিঃ। তার পিতা ছিলেন আইনজীবী। তাই ছেলেকেও আইনজীবী হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্নই তিনি দেখতেন। শৈশবে স্পালাঞ্জানি শিক্ষালাভ করলেন স্থানীয় রেজিও মহাবিদ্যালয়ে।

লাজারো স্পালানজানি র শিক্ষাজীবন: Lazzaro Spallanzani’s Educational Life

তখনকার দিনে এসব শিক্ষালয়ে প্রাচীন গ্রিস ও রোমের সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চাই ছিল প্রধান। অসাধারণ মেধাবলে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এই সকল বিষয়ে ব্যুৎপন্ন হয়ে উঠলেন। পাশ করবার পর সেই মহাবিদ্যালয়েই গ্রিক ভাষা ও দর্শনের শিক্ষকতার কাজ পেয়ে গেলেন। শিক্ষা স্পালাঞ্জানিকে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। জীবনের রহস্য ভেদ করার আকুলতা ক্রমেই্ তাঁর মধ্যে তীব্র হয়ে উঠতে লাগল।

সৃষ্টি – রহস্যের উৎস – মূলের সন্ধান লাভের জন্য তিনি পিতার অনুমতি নিয়ে সেমিনারিতে নাম লেখালেন ৷ সেমিনারি হল ধর্মশিক্ষার কেন্দ্র। এখানে ভর্তি হবার পর থেকেই তাঁর জন্মগত প্রতিভার উন্মেষ ঘটতে থাকে। গীর্জার অনুশাসনের মধ্যে থেকে বাইবেল ও শাস্ত্র বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। লাভ করলেন যাজকের পদ — অ্যাবে উপাধি। কিন্তু তৃপ্ত হতে পারলেন না। অন্তরে যে জিজ্ঞাসা অহরহ জাগছে তার কোন সদুত্তর ধর্মগ্রন্থের মধ্যে তিনি পেলেন না।

লাজারো স্পালানজানি র প্রথম জীবন: Lazzaro Spallanzani’s Early Life

গভীর অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে গেলেন রিজিও মহাবিদ্যালয়ের চাকরিতে। গ্রিক ভাষা পড়াতে পড়াতেও চলল সত্যের সন্ধান — অন্যতর জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার পালা। এমনি সময়ে অতি সাধারণ একটি ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল আকস্মিকভাবে। কদিনের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন মাসির এক মেয়ে লরা বাসি – এর বাড়িতে। লরা সেসময়ে অধ্যাপনা করতেন বোলগনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার বিষয় অঙ্ক ও পদার্থ বিজ্ঞান। মস্ত সংসার লরার। এগারোটি ছেলেমেয়ের জন্মদাত্রী তিনি।

সংসারের সব ঝামেলা জঞ্ঝাট মিটিয়েও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও বিজ্ঞানের চর্চা বজায় রেখে চলেছেন। মাসতুতো দিদির অদম্য প্রাণশক্তি ও বিজ্ঞানের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ মুগ্ধ করল স্পালাঞ্জানিকে। তিনি বুঝতে পারলেন, বিজ্ঞান চর্চার মধ্যে নিশ্চয় এমন দুর্লভ তৃপ্তির স্পর্শ রয়েছে যা লরাকে সমস্ত কর্মক্লান্তির মধ্যেও সজীব ও সক্রিয় করে রেখেছে। স্পালাঞ্জানি মনস্থির করে ফেললেন, তিনি বিজ্ঞানের চর্চায় আত্মনিয়োগ করবেন ৷

সত্যকে জানার, অজানার রহস্য উন্মোচনের একমাত্র চাবিকাঠি রয়েছে বিজ্ঞানের কোষকক্ষে। স্পালাঞ্জানির বয়স তখন একত্রিশ। ইতিপূর্বে তিনি কৌতূহল চারিতার্থ করবার জন্য প্রকৃতির নানা বিষয় নিয়ে নিজের মত করে পরীক্ষা – নিরীক্ষা বিস্তর করেছেন। তিনি স্থির করলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানই হবে তার জীবনে সত্য সন্ধানের মাধ্যম।

লাজারো স্পালানজানি র কর্ম জীবন: Lazzaro Spallanzani’s Work Life

বাড়ি ফিরে এসে চাকরি বদল করলেন। মোদেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতি বিজ্ঞানের অধ্যাপনা আরম্ভ করলেন। সেই সঙ্গে চলল গবেষণা। অধ্যাপক হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। সেই সঙ্গে তাঁর নতুন নতুন গবেষণার সংবাদ যুক্ত হয়ে সমগ্র ইতালিতেই খ্যাতিমান বিজ্ঞান করে তুলল তাকে। প্রকৃতি বিজ্ঞানের পাঠ নেবার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্ররা এসে মোদেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় করতে লাগল। স্পালাঞ্জানির সুখ্যাতি একদিন ইতালির রানী মারিয়া থেরেসার কানে পৌঁছল।

রানী ব্যক্তিগত চিঠি পাঠালেন তাঁর কাছে। পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আহ্বান জানালেন। স্পালাঞ্জনি সেই আহ্বান সাদরে গ্রহণ করলেন। তিনি জানতেন রানীর বিশেষ উৎসাহে পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানের পঠন – পাঠনের বিশেষ সুবন্দোবস্ত হয়েছে। তৈরি হয়েছে, বিজ্ঞান যাদুঘর, বিশাল লাইব্রেরি। গবেষণাকাজের ব্যাপক সুযোগ সুবিধার কথা বিবেচনা করে ১৭৬৮ খ্রিঃ স্পালাঞ্জানি পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের নতুন বিভাগে যোগদান করলেন। অধ্যাপনা ও গবেষণা পাশাপাশি চলতে লাগল। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বহুবিধ ৷

জীবনের উৎস, প্রজনন, পুনরুৎপাদন, সংজ্ঞাবাহী ইন্দ্রিয়, পরিপাক, রক্ত পরিবহন, শ্বসন — কি ছিল না তার অনুসন্ধানের তালিকায় ? একথা সর্ববাদিসম্মত যে স্পালাঞ্জানির গবেষণার ভিত্তিতেই জন্ম নিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের জীবপ্রযুক্তি (Bioengineering) নামের শাখাটি। স্পালাঞ্জানির গবেষণার প্রথম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল Reproduction বা পুনরুৎপাদন যা আধুনিক জীব প্রযুক্তিবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা সচবাচর দেখতে পাই টিকটিকির লেজ খসে যায়। আবার যথাস্থানে কিছুদিন পরেই নতুন লেজ গজিয়ে উঠেছে।

প্রকৃতির রাজ্যের এই রহস্যময় কান্ডটি স্পালাঞ্জানির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তিনিও লক্ষ্য করলেন, জল গোধিকা বা water lizard আকস্মিক একটি ঘটনায় পা হারিয়ে প্রকৃতির রহস্যময় নিয়মে কিছুদিনের মধ্যেই আবার স্বাভাবিক পা ফিরে পেয়েছে। এই ঘটনা যে সব প্রাণীদেহে ঘটে না তা তার অজানা নয়। মানুষ, কুকুর বা বেড়ালের ক্ষেত্রে যে ব্যাপার ঘটে না কেবল মাত্র জলগোধিকার ক্ষেত্রে কেন ঘটছে — এই জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার চেষ্টায় ব্রতী হন।

পরীক্ষা – নিরীক্ষার পর তিনি বুঝতে পারেন জলগোধিকার শরীরে কোষকলা বা টিসুরাই এই অসম্ভব কান্ডটি সংঘটিত করে। এর মধ্যে এমন স্বাভাবিক রিপেয়ারিং ব্যবস্থা রয়েছে যা অন্য প্রাণীদের নেই। এই সারাইব্যবস্থার রহস্যটিকেই জানতে হবে। গবেষণায় নিমগ্ন হলেন স্পালাঞ্জানি। সময়টা ১৭৮৬ খ্রিঃ। পরীক্ষা আরম্ভ করলেন একটা স্যালামান্ডার বা গিরগিটি নিয়ে। প্রাণীটির একটি পা ও লেজ কেটে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই কর্তিতস্থানে নতুন পা ও লেজ দেখা দিল। তিন মাসের মধ্যে পাঁচবার একই কাজ করলেন তিনি আর পাঁচবারই গিরগিটির শরীর নতুন করে পা ও লেজ তৈরি করে ফেলল।

স্পালাঞ্জানি অনুধাবন করলেন, ভ্রুণাবস্থায় যে অবস্থায় গিরগিটির অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠে সেই অবস্থাটি তার শরীরে বজায় থাকে বলেই জীবনের যে কোন বয়সে সে নতুন করে হাত পা লেজ গড়ে নিতে পারে। তার মনে প্রশ্ন জাগে, ভূণাবস্থায় একটি পর্যায়ে অঙ্গগঠনের কাজ তো সব প্রাণীরই ঘটে থাকে। তাহলে অন্য প্রাণীর দেহে ভ্ৰূণাবস্থার অঙ্গগঠন পর্যায়টি কেন নষ্ট হয়ে যায় ? ব্যাঙ নিয়ে পরীক্ষা করলেন। লক্ষ করলেন, ব্যাঙাচির লেজ কাটা গেলেও নতুন লেজ গজিয়ে উঠছে। কিন্তু ব্যাঙের জীবনচক্রে অঙ্গগঠনের প্রবণতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় বলে ব্যাঙের পা কাটা গেলে আর নতুন পা গজায় না।

এই ব্যাপারটির পেছনে জলের কোন ভূমিকা আছে কিনা অর্থাৎ পরিবেশগত প্রভাব বর্তমান কিনা তা পরীক্ষা করবার জন্য স্পালাঞ্জানি গিরগিটির পা ও লেজ কেটে জলের বাইরে রেখে লক্ষ্য করতে লাগলেন। জলের বাইরেও এমনই ফল দেখা গেল। কিছুদিনের মধ্যেই গিরগিটি তার দেহের কাটা অংশে পা ও লেজ তৈরি করে ফেলল। তিনি নিশ্চিত হলেন যে ব্যাঙাচির জীবনের শরীরের কোষবিন্যাস ব্যাঙজীবনের পরিণত দশায় পাল্টে যায়। কিন্তু গিরগিটির শরীরে বজায় থাকে। বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও স্পালাঞ্জানির পক্ষে এ বিষয়ে আর অধিক দূর অগ্রসর হওয়াসম্ভবহল না।

পরবর্তিকালে আধুনিক জীব – প্রযুক্তিবিদরাও গবেষণাগারে জীবদেহে পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত করবার জন্য বহুতর গবেষণা করেছেন। এর ফলে সার্থকতা এটুকুই এসেছে যে সজীব কোষের জৈব রাসায়নিক ও শারীর বৃত্তীয় বিষয়ে অনেক অজ্ঞাত তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে। আয়ার্ল্যান্ডের এক পাদ্রী জে.টি.নীডহ্যাম ১৭৪৮ খ্রিঃ একটি পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেছিলেন যে জীবণুরা স্বয়ংসৃষ্ট। একটা কাচের বয়ামে একটুকরো মাংস রেখে মুখ ছিপি দিয়ে আটকে রাখলে দু সপ্তাহের মধ্যেই বয়ামের ভেতরে জীবাণুরা আপনা থেকেই জন্মলাভ করে।

ছিপি দিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেও বয়ামের ভেতরে জীবাণুর জন্ম রোধ করা যায় না। তারপর থেকে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নীডহ্যাম – এর মতই প্রচলিত ছিল। সকলেই মেনে নিয়েছিলেন যে জীবজগতে জীবাণুদের স্বয়ংসৃষ্টি অবাস্তব নয়। স্পালাঞ্জানি এই সূত্র ধরে তার দ্বিতীয় পর্যায়ের গবেষণা আরম্ভ করলেন। তিনি মাংসের টুকরোকে ভাল করে ফুটিয়ে বয়ামে ভরে ছিপি আটকালেন। এক দুই তিন করে পরপর পাঁচ সপ্তাহ কেটে গেল। দেখা গেল সিদ্ধ মাংস পূর্বে যেমন জীবাণুমুক্ত ছিল তেমনিই জীবাণুশূন্য বা স্টেরাইল রয়ে গেছে।

এরপর তিনি সর্বসমক্ষে সেদ্ধ করা জীবাণুমুক্ত মাংস দুদিন পরে বোতলের ভেতর থেকে বার করে এনে দেখালেন দুদিনের মধ্যেই মাংসের মধ্যে জীবাণুর আবির্ভাব ঘটছে। এইভাবে তিনি নীডহ্যামের জীবোৎপাদনের স্বতঃস্ফুর্ত তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণ করে দিলেন। এ বিষয়ে পরবর্তিকালে পাস্তুর সঠিক সিদ্ধান্তটি জানিয়ে বলেছিলেন, জীবাণুরা স্বয়ংসৃষ্ট নয়। বাতাসে দূষিত সজীব কণা বর্তমান, তাদের দ্বারাই জীবাণু জন্ম সম্ভব হয়। স্পালাঞ্জানি যে সত্য উপলব্ধি করেছিলেন, সেই সত্য জীববিজ্ঞানে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন পাস্তুর একশো বছর পরে।

এনজাইম বা জৈব অনুঘটকের বার্তা তিনিই প্রথম শুনিয়েছিলেন। এনজাইম বা প্রোটিন জাতীয় উৎসেচক যে প্রাণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জৈব অনুঘটকের কাজ করে এই তত্ত্ব স্পালাঞ্জানির যুগের বিজ্ঞানীদের কারোই জানা ছিল না। কিন্তু উৎসেচকের সন্ধান না জেনেও স্পালাঞ্জানি নতুন ভাবনার ইশারা দিয়েছিলেন। শরীরের খাদ্য পরিপাক ব্যাপারটাকে নিছক যান্ত্রিক ঘটনা বলে মানতেন না পালাঞ্জানি। তাঁর বক্তব্য ছিল, হজম ব্যাপারটা পুরোপুরি রাসায়নিক, যান্ত্রিক নয়। তার এই ঘোষণার সূত্র ধরেই পঞ্চাশ বছর পরে পাচক রসে পেপসিন অবস্থান আবিষ্কৃত হয়।

পেপসিনই হল প্রথম আবিষ্কৃত এনজাইম। হজমের ক্ষেত্রে এই এনজাইমটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকস্থলীর রস বা গ্যাসট্রিক জুস থেকে পেপসিনকে আবিষ্কার করেছিলেন জীববিজ্ঞানী থিওডোর শ্যোহান ১৮৩৬ খ্রিঃ। তার অনেক আগেই পাচক রসের ওপর নানা পরীক্ষা – নিরীক্ষা করেছিলেন স্পালাঞ্জানি। আধুনিক জীববিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন লালার এনজাইম টায়ালিন। এই টায়ালিন মুখের খাদ্যের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে খাদ্যের মূল উপাদান স্টার্চ বা শ্বেতসার যৌগটিকে বিশ্লিষ্ট করে মালটোজ শর্করা উৎপাদন করে। যা পরিপাক ক্রিয়ার প্রধান সহায়ক। বহুপূর্বে ” পালাঞ্জানি লক্ষ করেছিলেন রুটির টুকরো ক্রমাগত চিবোতে থাকলে ক্রমেই মিষ্টত্ব বাড়ে।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রুটিচূর্ণ লালারসে মিশে এমন এক রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায় যার ফলে চিনি জাতীয় মিষ্ট জিনিস তৈরি হয়। গ্যাসট্রিক রসের ওপরেও গবেষণা করেছিলেন স্পালাঞ্জানি। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তিনি ধারণা করেছিলেন গ্যাসট্রিক রস শরীরের তাপের সহায়তায় খাদ্যবস্তুকে গালিয়ে দেয়। এতটা এগিয়েও তিনি গ্যাসট্রিক রসের অম্লটির সন্ধান করতে পারেন নি। স্পালাঞ্জানির পদ্ধতি অনুসরণ করেই ১৮০৩ খ্রিঃ মার্কিন শারীরবিদ ইয়ং গ্যাসট্রিক রসের রহস্য ভেদ করেছিলেন।

লাজারো স্পালানজানি র রচনা: Written by Lazzaro Spallanzani

জীবজন্তুর প্রজননের ওপর নানা পরীক্ষা – নিরীক্ষা ও ব্যাখ্যার বিবরণ নিয়ে ১৭৮৫ খ্রিঃ স্পালাঞ্জানি একটি বই প্রকাশ করেন। বইটির নাম Experiments up on the Generation of Animals and Plants ইতিপূর্বে উইলিয়ম হারভে নামে এক বিজ্ঞানী জীবজন্তুর প্রজননের ওপর প্রথম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে স্তন্যপায়ী প্রাণীর ডিম্বকোষকে শুক্ররসের বাষ্পে ভিজিয়ে নিলে নিষেকের কাজটি দ্রুততর হয়।

স্পালাঞ্জানি তার পরীক্ষা দ্বারা হারভে – এর ব্যাখ্যাটি যে ভ্রান্ত তা প্রমাণ করেছিলেন। তিনি স্পষ্টই তার বইতে এ সম্পর্কে বলেছেন শুক্ররসের বাষ্প কখনোই ডিম্বকোষকে নিষিক্ত করতে পারে না। কেননা শুক্র রসের সঙ্গে ডিম্বকোষের মিলনের ফলে ডিম্বকোেষ ভেঙ্গে যায় ও ভ্রুণবিকাশের কাজ শুরু হয়। কাছাকাছি পৌঁছেও দুর্ভাগ্যবশতঃ স্পালাঞ্জানি ধরতে পারেননি যে শুক্ররসে থাকে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র লেজওয়ালা কীট বা শুক্রাণু স্পারমেটোজোয়া। এই শুক্রকীটই নিষেকে অংশ গ্রহণ করে ভূণে রুপান্তরিত হয়। শুক্ররস ব্লটিংপেপারে ছেঁকে তার পরিশ্রুত অংশটি দিয়ে যে নিষেকের কাজ হয় না তা – ও তিনি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। কিন্তু কেন তা হয় না তা তিনি ধরতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন।

১৮৫৪ খ্রিঃ স্পালাঞ্জানির গবেষণার সূত্র ধরে জীববিজ্ঞানী জর্জ নিউপোর্ট অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে শুক্ররসে লেজওয়ালা শুক্রকীট আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এরাই ডিম্বকোষে ঢুকে নিষেকের কাজ সম্পন্ন করে। প্রকৃতিতে যা কিছু রহস্যময় ঠেকেছে তা নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় মেতে উঠেছেন স্পালাঞ্জানি। কখনো রহস্য উদঘাটনে সমর্থ হয়েছেন, কখনো ব্যর্থ হয়েছেন। যেসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন, সেসব ক্ষেত্রে তার অগ্রগতির পদ্ধতি যে সঠিক ছিল তা পরবর্তীকালে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বাদুড় কি করে রাতের অন্ধকারে নির্বিঘ্নে উড়ে যেতে সক্ষম হয় তার কারণ অনুসন্ধানেও তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন।

শেষপর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্তে আসেন বাদুড়ের কানের মধ্যে এমন কিছু বিশেষত্ব রয়েছে যার ফলে বাদুড় অন্ধকারে কোথাও অতটুকু বাধা না পেয়ে নিশ্চিন্তে উড়তে পারে। তিনি একবার কয়েকটা বাদুড়কে একটা অন্ধকার হল ঘরে উড়িয়ে দেন। আগে থেকেই সেই ঘরে নানাজায়গায় কিছু ব্যারিকেড করে রেখেছিলেন। দেখাগেল, অন্ধকার ঘরে বাদুড়গুলো কোন ব্যারিকেডে বাধা না পেয়ে দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে। এরপর তিনি বাদুড়গুলোর প্রত্যেকের কান কাপড়ের টুকরো দিয়ে বেঁধে দিয়ে আবার উড়িয়ে দিলেন। এবারে দেখা গেল, বাদুড়গুলো উড়তে গিয়ে বিভিন্ন ব্যারিকেডে বাধা পেয়ে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে।

এই কম্পাঙ্ক আমাদের শ্রুতিগোচর শব্দ সীমার অনেক হাজার গুণ বেশি হওয়ায় আমরা শুনতে পাই না। স্পালাঞ্জানি তার বিজ্ঞানের গবেষণার ভাণ্ডারে যে রসদ সঞ্চিত করেছিলেন, উত্তরকালে তার সাহায্যে বিজ্ঞানীরা জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিটি বিষয়ের গবেষণার মধ্যেই নিহিত ছিল ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বীজ। পরবর্তীকালে তারই পুষ্টরূপ বিজ্ঞানের ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধতর। মাত্র কয়েক বছরের বিজ্ঞান সাধনার ফলে তিনি এই বিস্ময়কর কাজ করেছিলেন। এই কারণেই জীববিজ্ঞানের প্রধান পুরোধা পুরুষরূপে তিনি স্বীকৃত।

লাজারো স্পালানজানি র মৃত্যু: Lazzaro Spallanzani’s Death

১৭৯৯ খ্রিঃ এই বিজ্ঞান সাধকের জীবনাবসান হয়।

Leave a Comment