মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পরিণতি কি হয়েছিল?: ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন শ্রমিক আন্দোলন। 1925 খ্রিস্টাব্দের 26শে ডিসেম্বর কানপুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই পার্টি দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের জাতীয় আন্দোলনের সামিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। খুব অল্পদিনের মধ্যেই ভারতে বামপন্থী আদর্শের প্রসার ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারকে আতঙ্কিত করে তোলে। তাই ব্রিটিশ সরকার এদেশে বামপন্থার অগ্রগতি রোধ ও শ্রমিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল 1929 খ্রিস্টাব্দের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট
1929 খ্রীঃ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ-
1)শ্রমিক অসন্তোষ-1925 খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতের বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান, কাজের সময় হ্রাস, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিরোধ, সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের স্বাধীনতা প্রভৃতির দাবিতে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। 1928 খ্রিস্টাব্দে এস. এ. ডাঙ্গের নেতৃত্বে গিরনি কামগার ইউনিয়ন বিভিন্ন কলকারখানায় ধর্মঘট পালন করে। এইভাবে শ্রমিক অসন্তোষ কে কাজে লাগিয়ে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রচার ব্রিটিশ সরকারকে চিন্তায় ফেলে দেয়।
2)হুইটলি কমিশন গঠন-ক্রমবর্ধমান শ্রমিক অসন্তোষের পরিপেক্ষিতে শ্রমিকদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার 1929 খ্রিস্টাব্দে হুইটলি কমিশন গঠন করেন। আপাত দৃষ্টিতে শ্রমিকদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যে এই কমিশন গঠিত হলেও এই কমিশনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কমিউনিস্টদের কাছ থেকে শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। কিন্তু শ্রমিকরা এই কমিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
3)শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আইন প্রণয়ন-হুইটলি কমিশন ব্যর্থ হলে বড়লাট লর্ড আরউইন শ্রমিকদের আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে শিল্প বিরোধ বিল ও জন নিরাপত্তা বিল নামক দুটি শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আইন পাশ করেন। শিল্প বিরোধ বিলের দ্বারা শ্রমিক ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয় এবং সালিশি কমিটির মাধ্যমে মালিক-শ্রমিক বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলা হয়। আর জননিরাপত্তা বিলের দ্বারা কমিউনিস্টদের দমনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
4)কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার-শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী দুটি আইন পাশ করা সত্ত্বেও শ্রমিক আন্দোলন চলতে থাকলে ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।1929 খ্রিস্টাব্দে 33 জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। মুজাফফর আহমেদ, এস. এ. ডাঙ্গে, পি.সি.যোশী, বেঞ্জামিন ব্রাডলি, ফিলিপ স্প্রাট প্রমুখ ছিলেন এই মামলায় অভিযুক্ত কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতা।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পরিণতি
1929 খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলেই জওহরলাল নেহেরু, এম.সি.চাকলা প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতা কমিউনিস্ট নেতাদের পক্ষে সওয়াল করেন।1933 খ্রিস্টাব্দে এই মামলার রায় ঘোষিত হয়। এই মামলার রায় অনুসারে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ করা হয় এবং মুজাফফর আহমেদ, এস. এ. ডাঙ্গে, পি.সি.যোশী, বেঞ্জামিন ব্রাডলি, ফিলিপ স্প্রাট, সওকত ওসমানী প্রমুখো কমিউনিস্ট নেতাদের দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ড দেওয়া হয়।1934 খ্রিস্টাব্দের 23শে জুলাই ব্রিটিশ সরকার ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সকল শাখাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তা সত্ত্বেও কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব অক্ষুন্ন থাকে। জেলবন্দি বামপন্থী নেতাদের আদর্শ ও বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পৌঁছালে ভারতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দ্রুত প্রসার লাভ করে। এমনকি কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধীও এই মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতাদের সমর্থন করেন এবং জেলে গিয়ে জেলবন্দি নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।