মিশ্র কৃষি কাকে বলে? মিশ্র কৃষির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

Rate this post

মিশ্র কৃষি কাকে বলে? মিশ্র কৃষির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো: যে কৃষি ব্যবস্থায় অনুকূল প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ একই কৃষি খামারে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিজ ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি দুধ, মাংস ও জৈব সারের চাহিদা মেটাতে পশুপালন করা হয়, সেই অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিবিহীন বাজার কেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থাকে মিশ্র কৃষি বলে।

মিশ্র কৃষির পদ্ধতি

বিশ্বের যে সমস্ত অঞ্চলে মিশ্র কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেখানে অতিরিক্ত শৈত্যের কারণে কিংবা অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে সারা বছর কৃষিকাজ করা যায় না। ফলে অনুকূল পরিবেশে সার, কীটনাশক ওষুধ ইত্যাদি প্রয়োগ করে শত্যাবর্তন পদ্ধতিতে অধিক শস্য উৎপাদনের চেষ্টা করা হয় এবং সাথে সাথে দুধ, মাংস ও অন্যান্য প্রাণীজাত দ্রব্যের চাহিদা মেটাতে গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি, গুটিপোকা ইত্যাদি প্রতিপালন করা হয়।ফলে কৃষকদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

মিশ্র কৃষির অবস্থান

মিশ্র কৃষি প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলিতে প্রসার লাভ করেছে।

1)ইউরোপ-উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে মিশ্র কৃষি ব্যবস্থা দেখা যায়।

2)উত্তর আমেরিকা-উত্তর আমেরিকা মহাদেশের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়, ইন্ডিয়ানা, ওহিও, জর্জিয়া, ক্যালিফার্ণিয়া, ওকলাহোমা, টেক্সাস, টেনেসি, ইত্যাদি প্রদেশে মিশ্র কৃষি ব্যবস্থা দেখা যায়।

3)দক্ষিণ আমেরিকা-দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনার পারানা অববাহিকা, ব্রাজিলের দক্ষিণাংশ, চিলি অঞ্চলে ইত্যাদি অঞ্চলে মিশ্র কৃষি ব্যবস্থা উন্নত লাভ করেছে।

4)ওশিয়ানিয়া-ওশিয়ানিয়া মহাদেশের অন্তর্গত অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাংশ ও পূর্বাংশ মিশ্র কৃষি ব্যবস্থার জন্য বিখ্যাত।

5)আফ্রিকা-আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণাংশে মিশ্র কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

মিশ্র কৃষির বৈশিষ্ট্য

A) প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য

1)বৃষ্টিপাত-মিশ্র কৃষিতে বছরে গড়ে 50-150 সেন্টিমিটারের মতো বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয় এবং বৃষ্টিপাত প্রধানত উষ্ণ ঋতুতেই হয়ে থাকে।

2)উষ্ণতা-এই কৃষি ব্যবস্থায় মৃদু থেকে মাঝারি উষ্ণতার প্রয়োজন হয়।

3)মৃত্তিকা-উৎকৃষ্ট চর্নোজেম মৃত্তিকা মিশ্র কৃষির পক্ষে উপযুক্ত।

4)ভূমিরূপ-সমতল ভূমি যা যন্ত্রচালিত ও হস্তচালিত উভয় যন্ত্রাদি ব্যবহারের অনুকূল সেই জমিতে মিশ্র কৃষি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

B)অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য

1)জমির প্রকৃতি-মিশ্র কৃষি ব্যবস্থায় ব্যবহৃত কৃষি খামারগুলির আয়তন 50-120 হেক্টর হয়।খামারের অধিকাংশ জমিতে কৃষিকাজ করা হয় এবং সামান্য কিছু অংশে স্বাভাবিক ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায়। শস্য উৎপাদন ও পশুপালনের জন্য বরাদ্দ জমির পরিমাণ অঞ্চলভেদে আলাদা হলেও মোট জমির অধিকাংশই ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

2)শস্য উৎপাদন ও পশুপালন-এই কৃষি পদ্ধতিতে শস্য উৎপাদন ও পশুপালন একই খামারের অন্তর্গত। ফলে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি গবাদিপশু, ভেড়া, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি পালন করে দুধ, মাংস, চামড়া, উল প্রভৃতি বিক্রয়ের জন্য উৎপাদন ও সংগ্রহ করা হয়। এইসব পশুপালনের জন্য পশুখাদ্য উৎপাদন করা হয়। প্রধানত পশুখাদ্য, জীবনধারণের জন্য উপযুক্ত শস্য এবং বিক্রয়ের জন্য অর্থকরী ফসল-এই তিন ধরনের ফসল মিশ্র কৃষি ব্যবস্থায় উৎপাদন করা হয়।

3)শস্যাবর্তন-মিশ্র কৃষিতে জমির স্বাভাবিক উর্বরতা বজায় রাখার জন্য একই জমিতে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ফসল উৎপাদন করা হয়। কারণ একই জমিতে বারবার একই রকম ফসল উৎপাদন করলে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। তাই একটি ফসলের মাঝে আরেকটি শুঁটি সঠিক জাতীয় ফসলের চাষ করে জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। একে শস্যাবর্তন বলে।

4)শ্রমিক-মিশ্র কৃষি ব্যবস্থায় একই সঙ্গে শস্য উৎপাদন ও পশুপালন করা হয় বলে প্রচুর অভিজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন হয়।বিভিন্ন শস্য বছরের বিভিন্ন সময় উৎপাদন করা হয় বলে সারা বছরই কৃষি শ্রমিকের চাহিদা থাকে। মিশ্র কৃষি অর্থকরী হওয়ায় কৃষকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি এই কৃষি ব্যবস্থার একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।

5)কৃষি ইনপুট-মিশ্র কৃষি ব্যবস্থায় নিবিড় ভাবে সর্বাধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে ফসল উৎপাদন করা হয় বলে উন্নত বীজ ও পর্যাপ্ত জৈব সারের ব্যবহার দেখা যায়। জমিতে পশুপালনের জন্য এই জৈব সার অতি সহজেই পাওয়া যায়।

6)যন্ত্রপাতি ব্যবহার-মিশ্র কৃষি ব্যবস্থায় যন্ত্রের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। লাঙ্গল, কোদাল ইত্যাদি কৃষি যন্ত্রপাতির পাশাপাশি ট্রাক্টরের ব্যবহার রয়েছে। আবার ইউরোপে মিশ্র কৃষিতে ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত অধিকাংশ কাজই যন্ত্রপাতির সাহায্যে করা হয়।

7)মূলধন-অধিক কৃষি ইনপুটের জন্য অর্থাৎ কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, উন্নত বীজ, কীটনাশক ওষুধ, শ্রমিকের মজুরি ইত্যাদির জন্য প্রচুর মূলধন প্রয়োজন হয়।

8)পরিবহন ব্যবস্থা-উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা মিশ্র কৃষি ব্যবস্থার সাফল্যের মূল উপকরণ।যে সকল মিশ্র কৃষি ব্যবস্থাযুক্ত অঞ্চলে সরকারি আয় বেশি সেখানে বিভিন্ন পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি লক্ষ্য করা যায় ‌। এই উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদিত ফসল ও পশুজাত দ্রব্য অতি সহজেই বাজারজাত করা যায়।

9)চাহিদা-মিশ্র কৃষি ব্যবস্থা বৈদেশিক বাজারে চাহিদার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়।কারণ এই কৃষি ব্যবস্থায় উৎপাদিত বেশিরভাগ শস্যই অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হয় বাকি শস্য রপ্তানি করা হয়। এই কৃষি ব্যবস্থায় উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য ও পশুজাত সামগ্রীর মধ্যে তুলনামূলকভাবে পশুজাত সামগ্রীর চাহিদা বেশি এবং কৃষকের কাছে তা অনেক বেশি লাভজনক।

10)অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

অ)এই কৃষি ব্যবস্থায় একদিকে জীবিকা সত্ত্বাবৃত্তিক ও অন্যদিকে বাণিজ্যিক কৃষি পদ্ধতির সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে।

আ)এই কৃষি ব্যবস্থায় মাথাপিছু কৃষিজ ফসল উৎপাদন যথেষ্ট বেশি, কিন্তু হেক্টর প্রতি উৎপাদন যথেষ্ট বেশি নয়।

ই)জনসংখ্যার ঘন কেন্দ্রীভবন ঘটায় মানুষ ও জমির পরিমাণ অধিক।

ঈ)ক্রেতার উচ্চ ক্রয় ক্ষমতার জন্য কৃষিজ ফসল ও মাংসের বিরাট বাজার সৃষ্টি হয়।

উ)এই ব্যবস্থায় কৃষকেরা সাধারণত নিবিড় পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে।

Leave a Comment