মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন কি? মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রণয়নের পটভূমি কি ছিল? মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের বিষয়বস্তু, ত্রুটি ও গুরুত্ব আলোচনা করো।
ভূমিকা
1861 ও 1892 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন ভারতীয়দের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাই শাসনকার্যে ভারতীয়দের বেশি করে অংশগ্রহণের দাবিতে অসন্তুষ্ট ভারতীয়রা অসন্তোষ প্রকাশ করে। এই পরিস্থিতিতে 1905 খ্রীঃ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের কিছু দাবি দাওয়া পূরণ করে তাদের খুব প্রশমনের উদ্যোগ নেন এবং ভারত সচিব জন মর্লে ও বড়লাট লর্ড মিন্টোর উদ্যোগে 1909 খ্রীঃ এক নতুন সংস্কার আইন পাস করেন। এই আইন মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন বা 1909 খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইন নামে পরিচিত।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রণয়নের পটভূমি
1909 খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রণয়নের পটভূমি ছিল নিম্নরূপ-
1)1892 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের ত্রুটি-1892 খ্রিস্টাব্দের শাসন আইনে কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদে ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়ানো হলেও ভারত শাসনের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। ভারতীয়দের হাতে কেবলমাত্র লোক দেখানো কিছু সামান্য ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাই ওই আইনে অসন্তুষ্ট ভারতীয়রা তাদের হাতে বেশি করে ক্ষমতা প্রদান ও শাসনকার যে আরো বেশি করে সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন।
2)জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবাদ-পূর্বে প্রবর্তিত ভারত শাসন আইনগুলি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাদের রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার অন্যতম বিষয় ছিল ভারতীয় আইন পরিষদে বেশি সংখ্যা নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করা এবং তাদের হাতে আরও বেশি করে ক্ষমতা প্রদান করা। পূর্বের ভারত শাসন আইনগুলিতে যেহেতু আইন পরিষদে বেশি সংখ্যক নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য গ্রহণের সুযোগ ছিল না, তাই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার নতুন আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে থাকেন।
3)বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন-1905 খ্রিস্টাব্দে সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার বিপাকে পড়েন। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে 1907 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটলে ব্রিটিশ সরকারের সমস্যা আরো বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের সন্তুষ্ট করার জন্য ব্রিটিশ সরকার নতুন আইন প্রণয়নের কথা চিন্তা করেন।
4)মুসলিম লীগের দাবি-1906 খ্রিস্টাব্দে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ আগাখানের নেতৃত্বে সিমলায় অবস্থানরত বড়োলাট মিন্টোর কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত একটি স্মারকলিপি জমা দেন এবং মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানান। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম লীগের দাবি মেনে নিয়ে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন পাশ করেন।
5)বিপ্লবী আন্দোলন-বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে একটি ধারা বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে পরিণত হলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারকে যথেষ্ট বিকাশে ফেলে দেয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন পাশ করেন।
উপরিউক্ত পরিস্থিতির মোকাবিলায় এবং ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করার জন্য ভারত সচিব জন মর্লে ও বড়লাট লর্ড মিন্টো কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ ও মুসলিম সম্প্রদায়কে খুশি করার উদ্দেশ্যে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন বা 1909 খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইন পাশ করেন।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের বিষয়বস্তু
1909 খ্রী মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন বা কাউন্সিল আইনের দুটি দিক ছিল। যথা-
1)কার্য নির্বাহ পরিষদ-1909 খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে বড়লাটের কার্যনির্বাহ পরিষদে এবং প্রতিটি প্রাদেশিক আইন পরিষদে একজন করে ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রদেশের গভর্নরের কার্যনির্বাহ পরিষদের সদস্য সংখ্যা 2 জন থেকে বাড়িয়ে 4 জন করা হয়।
2)আইন পরিষদ-মর্লে-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় পারসিক আইন পরিষদের গঠন ও ক্ষমতার বিষয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন-
a)কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি-মিন্টো সংস্কার আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা 16 জন থেকে বাড়িয়ে 60 জন করা হয়, যাদের মধ্যে 28 জন সদস্য সরকারি কর্মচারী, 27 জন সদস্য জমিদার শ্রেণি, মুসলমান সম্প্রদায় এবং কলকাতা ও বোম্বাইয়ের বণিক সভা ও প্রাদেশিক আইনসভা দ্বারা নির্বাচিত হতেন। বাকি 5 জন সদস্যকে ভাইসরয় বা বড়লাট বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায় থেকে মনোনীত করতেন।
b)বাজেট পরিকল্পনা-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলি বাজেট তৈরি, বাজেট পেশ এবং বাজেট সম্পর্কে আলোচনা ও ভোট দানের অধিকার পায়।
c)সুপারিশ ক্ষমতা-এই আইনের দ্বারা আইন পরিষদ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা ও সুপারিশ করার ক্ষমতা পায়।
d)মুসলমান সম্প্রদায়ের পৃথক নির্বাচন-এই আইনে সর্বপ্রথম মুসলমান সম্প্রদায়কে পৃথক ভাবে সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।
e)প্রাদেশিক আইন পরিষদ-এই আইনের দ্বারা প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা 30-50 জনের মধ্যে রাখা হয় এবং নির্বাচিত সদস্যের তুলনায় মনোনীত সদস্যের সংখ্যা বেশি থাকবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।।
f)সদস্যদের অপসারণ-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের দ্বারা গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নর তাদের অপছন্দের যেকোনো সদস্যকে আইন পরিষদ থেকে অপসারণের অধিকার পান।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের ত্রুটি
ভারতীয়দের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্যে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন পাশ করা হলেও এই আইনের বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি হল-
1)বড়লাটের চূড়ান্ত ক্ষমতা-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের মাধ্যমে বড়লাটের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। এই আইনের দ্বারা বড়লাট আইনসভার যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সংশোধন ও বাতিল করতে পারতেন। বড়লাট নিজের পছন্দ অনুসারে আইনসভার বেসরকারি সদস্যদের মনোনীত করতেন এবং তারা বড়লাটের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতেন। ফলে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সরকারি ও মনোনীত সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে পরিণত হয়।
2)ভোটাধিকার-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের দ্বারা মুষ্টিমেয় ভারতীয়কে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। এই আইনে ভারতীয়দের সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়নি।
3)অধিকারহীনতা-এই আইনের দ্বারা দেশীয় রাজ্য, সামরিক বিভাগ, বিদেশ নীতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে প্রস্তাবনার অধিকার আইনসভার হাতে ছিল না।
4)দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার অভাব-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের দ্বারা কেন্দ্র ও প্রদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিশেষ কোন গুরুত্ব না থাকায় ভারতে কোন দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
5)জাতীয় কংগ্রেসের ক্ষোভ-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী উভয় গোষ্ঠীকে অসন্তুষ্ট করে। কারণ এই আইনে চরমপন্থীদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নিলে চরমপন্থীরা ক্ষুব্ধ হয়। অপরদিকে এই আইনের দ্বারা নরমপন্থীদেরও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পূরণ হয়নি। ফলে তারাও এই আইনের বিরোধিতা করতে থাকেন।
6)সাম্প্রদায়িক নির্বাচন-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন দেয়। ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার এই আইনকে “পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রথম সরকারি উদ্যোগ” বলে অভিহিত করেছেন।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের গুরুত্ব
বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই আইনের বিভিন্ন গুরুত্বগুলি হল নিম্নরূপ-
1)বেসরকারি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের দ্বারা ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে বেসরকারি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।
2)শাসন বিভাগে অংশগ্রহণ-এই আইনের দ্বারা বড়লাটের শাসন পরিষদে একজন ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করে সরকারি প্রশাসনে ভারতীয়দের যুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়।
3)স্বায়ত্ত শাসনের সোপান-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের দ্বারা ভারতে স্বায়ত্ব শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ব্রিটেনের সাংসদ হেনরী কটন এই আইনকে “ভারতের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি ধীর পদক্ষেপ” বলে বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার মনে করেন “ভারতের স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন ছিল।”
4)আইনের শাসনের ভিত্তি স্থাপন-মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের দ্বারা মুঘল যুগ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজ্যের সাংবিধানিক রীতিনীতি ও আইনের শাসনের ধারণা যুক্ত হয়। ফলে এদেশে আইনের শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।