মহারানীর ঘোষণাপত্র – Queen’s Proclamation

Rate this post

মহারানীর ঘোষণাপত্র – Queen’s Proclamation: 1857 সালের মহাবিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, এই বিদ্রোহের অভিঘাতে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংস না হলেও তার ভিত কেঁপে উঠেছিল। ফলে ভারতের ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় প্রভূত পরিবর্তন করা হয়। ভারতের মুঘল শাসন ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতের শাসন ক্ষমতা কোম্পানির হাত থেকে রানীর হাতে হস্তান্তর করা হয়।

মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতীয়দের ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রশমনের জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা সমেত একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন যা মহারানীর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিত।

  1. মহারানীর ঘোষণাপত্রের পটভূমি:

1857 সালের মহাবিদ্রোহের পর ইংল্যান্ড সরকার বুঝতে পেরেছিল যে একদল বণিকের হাতে ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশের শাসনভার ছেড়ে দেওয়াটা বিপজ্জনক ঝুঁকি হতে পারে। সুতরাং শেষ পর্যন্ত কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে শাসনভার গ্রহণ করলেন (1858)। শাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠনের মাধ্যমে রানী এবং তাঁর পার্লামেন্টের প্রত্যক্ষ শাসনে এল এক বিরাট সমৃদ্ধ দেশ।

  1. ভারত শাসন আইন (1858):

মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 1858 সালের 2রা আগস্ট ভারত শাসন আইন (An Act for the Better Government of India, 1857) পাস করে কোম্পানির শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটায় এবং মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে শাসনব্যবস্থা স্থানান্তরিত হয়। এতে বলা হলো যে, রানীর হয় ভারত শাসন করবেন তাঁরই একজন সচিব বা মন্ত্রী। তিনি হলেন ভারত সচিব এবং তাকে সাহায্য করবে ইন্ডিয়া কাউন্সিল নামে পরিচিত একটি শাসন-পরিষদ।

  1. মহারানীর ঘোষণাপত্র প্রকাশ:

মহাবিদ্রোহের সময় বড়লাট ছিলেন লর্ড ক্যানিং এবং তিনি রানীর তথা ভারতের প্রথম ভাইসরয়ও বটে। 1858 সালের 1 নভেম্বর এলাহাবাদে একটি দরবারের আয়োজন করে, মহারানী ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধিরূপে মহারানীর ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই ঘোষণাপত্রে ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় নতুন নীতি ও আদর্শের কথা প্রকাশ করা হয়।

  1. মহারানীর ঘোষণাপত্রের মূল বক্তব্য:

মহাবিদ্রোহের দুটো প্রধান কারণ যে দেশীয় রাজন্যবর্গের অধিকারে হস্তক্ষেপ এবং সনাতন হিন্দু সমাজে পশ্চিমী সংস্কারের ঢেউ তোলা – সেটা ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পেরেছিলেন। সুতরাং এই ঘোষণাপত্রে দেশীয় রাজন্যবর্গ এবং সনাতন সমাজ দুটোকেই আশ্বস্ত করা হল। মহারানীর ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে –

I. স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করা হবে।

II. দেশীয় রাজাদের দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার দেওয়া হবে।

III. ব্রিটিশ সরকার ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি ত্যাগ করবে।

IV. দেশীয় রাজাদের সঙ্গে কোম্পানির যেসব চুক্তি ইতিপূর্বে স্বাক্ষরিত হয়েছে সেগুলো মেনে চলা হবে।

V. ভারতীয়দের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার কোনরকম হস্তক্ষেপ করবে না।

VI. জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ভারতবাসী সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারবে।

পলাশীর যুদ্ধ (1757) থেকে মহাবিদ্রোহ (1857) পর্যন্ত দীর্ঘ 100 বছর ধরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে যে অপশাসন চালিয়েছিল, মহারানীর ঘোষণাপত্র সেই অপশাসনে মধুর প্রলেপ দিয়েছিল। মহারানীর ঘোষণাপত্রে ভারতীয়দের বহু আশ্বাস দেয়া হলেও বাস্তবে সেগুলির অধিকাংশই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তাই ভারতীয়দের ক্ষোভও প্রশমিত হয়নি। এই ক্ষোভ থেকে ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতির প্রতিষ্ঠাতা শুরু হয়। পরবর্তীকালে মহারানীর ঘোষণাপত্র নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক আন্দোলনে বিস্তর ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।

যাইহোক মহারানীর ঘোষণাপত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জনগণের, বিশেষত দেশীয় রাজন্যবর্গের, নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষার আশ্বাস দিয়ে তাঁদের আনুগত্য অর্জন করা এবং তাঁদের আনুগত্য লাভের মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে নতুন করে স্থায়ী করা।

Leave a Comment