ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস জীবনী | Ramakrishna Paramahamsa Biography in Bengali

Rate this post

রামকৃষ্ণ পরমহংস জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Ramakrishna Paramahamsa Biography in Bengali. আপনারা যারা ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস (গদাধর চট্টোপাধ্যায়) সম্পর্কে জানতে আগ্রহী রামকৃষ্ণ পরমহংস র জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।

রামকৃষ্ণ পরমহংস কে ছিলেন? Who is Ramakrishna Paramahamsa?

রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৬ – ১৬ই আগস্ট, ১৮৮৬) (পূর্বাশ্রমের নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায়) ঊনবিংশ শতকের এক প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু। তার প্রচারিত ধর্মীয় চিন্তাধারায় রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন তার প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। তারা উভয়েই বঙ্গীয় নবজাগরণের এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম পুরোধাব্যক্তিত্ব। তার শিষ্যসমাজে, এমনকি তার আধুনিক ভক্তসমাজেও তিনি ঈশ্বরের অবতাররূপে পূজিত হন।

রামকৃষ্ণ পরমহংস জীবনী – Ramakrishna Paramahamsa Biography in Bengali

নামরামকৃষ্ণ পরমহংস (গদাধর চট্টোপাধ্যায়)
জন্ম18 ফেব্রুয়ারি 1836
পিতাক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়
মাতাচন্দ্রমণি দেবী
জন্মস্থানকামারপুকুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারত
পেশাযোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু
মৃত্যু16 আগস্ট 1886 (বয়স 50)

রামকৃষ্ণ পরমহংস র জন্ম: Ramakrishna Paramahamsa’s Birthday

রামকৃষ্ণ পরমহংস 18 ফেব্রুয়ারি 1836 জন্মগ্রহণ করেন।

ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক জাগরণের ইতিহাসে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সূর্যের ন্যায় দেদীপ্যমান এক ব্যক্তিত্ব। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে তিনি অবতার রূপে স্বীকৃত। বস্তুতঃ তাঁর অতিলৌকিক জীবন, তার অলৌকিক কর্মধারাও অতিমানবিক অবদানের মধ্যেই রয়েছে তার স্বরূপের প্রকাশ।

সমাজ যখন সর্বতোভাবে কলুষিত হয়ে ওঠে, স্বভাবতঃই সমানুষদের ঈশ্বরোদ্দেশ্যে কাতরতা অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। তাদের আন্তরিক আবেদনে আমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করতে স্বয়ং ঈশ্বরের শক্তি নেমে আসে মানুষের ধূলিমলিন পৃথিবীতে। সাধারণ মানুষদের মধ্যে থেকেই তারা যাপন করেন অসাধারণ জীবন। মানুষের চলার পথের পাথেয় রেখে তারা আবার বিদায় নেন মাটির পৃথিবী থেকে।

এই বিশ্বাস কেবল ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক চেতনার বিশ্বাস নয়, আদিকাল থেকে সমস্ত পৃথিবীর মানুষই ঈশ্বর প্রেরিত এই শক্তি তথা অবতারের কথা স্বীকার করে গেছে এবং তাদের আরাধনা করে এসেছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় হজরত মহম্মদের কথা, যিশু খ্রিস্টের কথা। আমাদের দেশেও রয়েছেন এমনি গৌতম বুদ্ধ, শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ অবতারী জীবন।

এই মহাপুরুষদের জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি তাদের ঈশ্বরীয় সত্তাকে যা একদিকে অলৌকিক জগৎ এবং অপর দিকে লৌকিক জগৎকে ধারণ করে রয়েছে। ঈশ্বরের অবতার রূপে মানুষের পৃথিবীতে যাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের জীবনেই শুরু থেকেই অলৌকিকতার প্রকাশ ঘটেছে।

নেজরেথবাসী যোশেফের সঙ্গে বিবাহের পূর্বেই কুমারী মেরী হয়ে উঠেছিলেন গর্ভবতী। একটি দীনহীন আস্তাবলের মধ্যে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন শিশু পুত্রের। তিনিই কালে অত্যাচারী রাজার সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে হয়ে উঠেছিলেন তাপিত মানুষের পরিত্রাতা। ভারতবর্ষে এই ধরনের ঘটনাকে বিভিন্ন পুরাণে বহুভাবে স্বীকার করা হয়েছে। ইতিহাসে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের জন্ম – কথা।

সিদ্ধার্থ গৌতমের মাতা মায়াদেবী পুত্রের জন্মের পূর্বে স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি শ্বেত হস্তি ধেয়ে এসে তাঁর সত্তায় মিশে যাচ্ছে। এই ধরনের অপার্থিব ঘটনার যথাযথ ব্যাখ্যা বা যুক্তি আমরা পাই না। কিন্তু ইতিহাসই সাক্ষ্য প্রদান করে পৃথিবীতে এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে বহুবার।

রামকৃষ্ণ পরমহংস র পিতামাতা ও জন্মস্থান: Ramakrishna Paramahamsa’s Parents And Birth Place

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও এমনি অলৌকিকত। কিছু কম ছিল না। তবে তাঁর জীবনের অলৌকিকতা আরও কিছুটা বিস্তৃত হয়েছিল। মাতা চন্দ্রমণির গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন দর্শন ও ব্যবহার আমাদের কাছে আরও মধুর, স্বর্গীয় হয়ে উঠেছে। কামারপুকুরের দরিদ্র ব্রাহ্মণ ক্ষুদিরাম আর তার স্ত্রী চন্দ্রমণির ছিল ধর্মের সংসার। দুজনেই সমান সরল ও ঈশ্বরঅন্ত প্রাণ। একবার ক্ষুদিরাম গয়াধাম দর্শনে গেছেন। সেখানে স্বপ্ন দেখলেন, স্বয়ং নারায়ণ তাঁকে বলছেন, তিনি ক্ষুদিরামের সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন।

এদিকে ঠিক একই সময়ে, কামারপুকুরে একটি শিবমন্দিরের সামনে চন্দ্রমণিদেবী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। সেই অবস্থায় তিনি দেখলেন মন্দিরের বিগ্রহ থেকে একটা জ্যোতির্বলয় বিচ্ছুরিত হয়ে তার দেহে মিলিয়ে গেল। এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই চন্দ্রমণি অনুভব করলেন, তিনি গর্ভবতী হয়েছেন। প্রতিবেশী রমণীরা চন্দ্রমণির কথা বিশ্বাস না করলেও গয়াধাম থেকে ফিরে এসে ক্ষুদিরাম কিন্তু অবিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনিও তো এই রকমই স্বপ্ন দেখেছিলেন।

ঈশ্বরের অহৈতুকী অনুগ্রহে দুজনেই পরিতৃপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। গর্ভাবস্থায় চন্দ্রমণি একদিন দুপুরে ঘরের দাওয়ায় বিশ্রামরত অবস্থায় দেখতে পেলেন হাঁসে – চড়া তিনমুখো এক দেবতা উঠোনে উপস্থিত হয়েছেন। তার মুখটা বড় লাল। রোদে দেবতার কষ্ট হচ্ছে ভেবে দেবতাকে অনুরোধ জানালেন খানিক বিশ্রাম করে কিছু মুখে দিয়ে যাওয়ার জন্য। দেবতা হেসে মিলিয়ে গিয়েছিলেন।

এমনি দর্শন উপলব্ধি এই অবস্থায় একাধিকবার ঘটেছে চন্দ্রমণির জীবনে। এই মত দর্শনের মাধ্যমে তার বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল যে তিনি গর্ভে লালন করছেন এই জগতের রক্ষাকর্তাকে। ঠাকুর যে অবতার রূপে আবির্ভূত হয়েছেন, সেই কথা অতি স্পষ্টভাবে নিজেই একদিন প্রকাশ করেছিলেন সংশয়ী নরেনের কাছে।

১৮৮৬ খ্রিঃ কাশীপুরের বাগানবাড়িতে রয়েছেন ঠাকুর। দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে মৃতপ্রায় অবস্থ। তাঁর। সেই অবস্থাতেও ভক্তদের মধ্যে অমৃতকথা বিতরণের বিরাম নেই। একদিন নরেন বসেছিলেন শয্যাপাশে। ঠাকুরের রোগক্ষীণ অবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনে হল, এই অসহনীয় কষ্টের মধ্যেই যদি ঠাকুর স্বীকার করেন যে তিনিই ঈশ্বরের কার্য সম্পাদনের জন্য প্রেরিত অবতার তবেই বোঝা যাবে ঠাকুর সত্যিই তাই।

ঠাকুর নরেনের অনুচ্চারিত মনের কথার জবাব দিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, “নরেন, এখনও তোর অবিশ্বাস …. যে রাম যে কৃষ্ণ, ইদানীং এই দেহে শ্রীরামকৃষ্ণ”। এরপর শ্রীশ্রী ঠাকুরের দিব্য জীবনের বিশিষ্ট ঘটনাগুলো আমরা স্মরণ করব। তার জন্ম তারিখ ১৮ ই ফেব্রুয়ারী, ১৮৩৬ খ্রিঃ। বাংলা ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথি— বুধবার দিন। তার ডাকনাম ছিল গদাধর এবং গদাই।

রামকৃষ্ণ পরমহংস র শিক্ষাজীবন: Ramakrishna Paramahamsa’s Educational Life

বাল্যবয়সে সামান্য পড়াশোনা যা করেছেন তা কামারপুকুর গ্রামে জমিদার লাহাবাবুদের পাঠশালায়। বাল্য বয়সেই ভাল গান গাইতে পারতেন, অভিনয় করতে পারতেন। ছবিও আঁকতেন, মাটি দিয়ে কুমোরদের মত মূর্তি গড়তে পারতেন। ছ’বছর বয়সের মধ্যেই মোটামুটি লিখতে পড়তে শিখে গিয়েছিলেন। তবে ‘ চাল – কলা বাঁধা বিদ্যেতে ‘ বিশ্বাস ছিল না।

লাহাবাবুদের অতিথিশালায় সাধুদের কাছে এবং কথকদের কাছে রামায়ণ – মহাভারত শুনে ধর্মজগতের অনেক তত্ত্ব জেনেছিলেন। পুরাণের গল্প সুন্দর করে অন্যদের শোনাতে পা হন। ছয় থেকে সাত বছরের মধ্যেই দুবার ভাবসমাধি হয়। জগতের অন্যান্য অবতার পুরুষদের মতো রামকৃষ্ণও শিশুকাল থেকেই অবতার বলে পূজিত হয়েছিলেন। কামারপুকুর গ্রামে চিনু শাঁখারী নামে একজন বয়স্ক ভক্তিমান ব্যক্তি ছিলেন।

তিনি একদিন গদাধরকে পুজো করে বলেছিলেন, গদাই, জগৎ যেদিন তোমাকে পূজা করবে তখন এই পৃথিবীতে আমি থাকব না। এই চীনু শাঁখারীই শ্রীরামকৃষ্ণকে ভগবানরূপে প্রথম আরাধনা করেছিলেন। ১৮৫৪ খ্রিঃউপনয়ন হয়। সেই সময় শাস্ত্রের নির্দেশ অমান্য করে শূদ্রানী কামারনীর কাছে প্রথম ভিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণির উদ্যোগে মা ভবতারিনীর মন্দির নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৮৪৭ খ্রিঃ ৬ ই সেপ্টেম্বর।

তিন বছরের মাথায় ১৮৫০ খ্রিঃ রামকৃষ্ণের দাদা রামকুমার কলকাতার ঝামাপুকুরে চতুষ্পাঠী নামে টোল খোলেন। টোলের কাজে সাহায্য করার জন্য রামকুমার ছোটভাই গদাইকে কলকাতায় নিয়ে আসেন ১৮৫৩ খ্রিঃ। সেই সময় তাঁর বয়স সতেরো। গদাই কিন্তু এখানেও পড়াশুনার দিকে আর ঝুঁকলেন না। টোলের কাজের ফাকে দু – একটা বাড়িতে কিছুদিন পুজো করেছেন। রাসমণির ভবতারিনীর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫৫ খ্রিঃ ৩১ শে মে স্নানযাত্রার দিনে।

এই মন্দির প্রতিষ্ঠাই ছিল ধর্মপ্রাণ রানী রাসমণির জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। রামকুমার হয়েছিলেন মন্দিরের পুরোহিত। গদাধর মা কালীর বেশকারীর কাজ মেনে নিলেন। তার সহকারী নিযুক্ত হলেন ভাগ্নে হৃদয় ওরফে হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায়। সময়টা ১৮৫৫ খ্রিঃ। সেই বছরই গদাধর দাদার কাছে কালীপূজা শিখে নিলেন আর শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা নিলেন কেনারাম ভট্টাচার্যের কাছে।

রামকৃষ্ণ পরমহংস র কর্ম জীবন: Ramakrishna Paramahamsa’s Work Life

১৮৫৬ খ্রিঃ রামকুমার দেহত্যাগ করলেন। সেই সময় গদাধর কালীমন্দিরের পূজারীর পদে স্থায়ী হয়েছেন। এই বছর থেকেই তাঁর দেবোত্তমভাব এবং অলৌকিক দর্শন ইত্যাদি ঘটতে লাগল। ১৮৫৯ খ্রিঃ গদাধর কামারপুকুরে এলে বৈশাখমাসে সারদামণির সঙ্গে বিয়ে হল। শ্বশুরবাড়ির কৃত্যাদি সম্পন্ন করে পরের বছর দক্ষিণেশ্বরে ফিরে এলেন।

তাঁর অবর্তমানে কালীমন্দিরে পূজারী নিযুক্ত হয়েছিলেন হলধারী। রাসমণি গদাধরকে সাধারণ পুরোহিত জ্ঞান করতেন না। তাঁর মধ্যে ঈশ্বরীয় শক্তির প্রকাশ নানা সময়েই তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং মাকালীর অংশ জ্ঞানেই তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। তার জামাতা মথুরেরও গদাধরের মধ্যে আশ্চর্য দর্শন হয়েছিল। তিনিও তাঁকে গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধাভক্তি করতেন।

১৯৬১ খ্রিঃ রাসমণির দেহত্যাগের একবছর আগেই ভৈরবী ব্রাহ্মণী যোগেশ্বরীর আগমন ঘটেছিল দক্ষিণেশ্বরে। তিনি গদাধরকে তন্ত্রমতে দীক্ষা দিয়েছিলেন এবং শাস্ত্রবিদ পন্ডিতদের সমাবেশে তার বিভিন্ন সাধনলক্ষণ বুঝিয়ে দিয়ে ঈশ্বর প্রেরিত অবতার বলে ঘোষণা করলেন। ব্রাহ্মণীর যুক্তি সভার সকলেই মেনে নিতে বাধ্য হলেন। রামকৃষ্ণের সাধনজীবন ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। সখ্য, বাৎসল্য, মধুর সকল ভাবের সাধনাতেই তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন।

১৮৬৩ খ্রিঃ জটাধারীর কাছে রামমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে তিনি বাৎসল্যভাবের সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। সেই সময়ের কলকাতার পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন আদি ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। একদিন ব্রাহ্মসমাজে ধ্যানরত অবস্থায় তাঁকে দেখে ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওরই ঠিক ফানা ডুবেছে ”।

১৯৬৫ খ্রিঃ গদাধর তোতাপুরীর কাছে সন্ন্যাস নিয়ে নতুন নাম প্রাপ্ত হলেন — রামকৃষ্ণ। ঠাকুরের এই নামই সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। বেদান্ত মতে সাধন গ্রহণের পর তিনি সিদ্ধি লাভ করেন। যুগের প্রয়োজনে আবির্ভূত হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। সমস্ত ধর্ম সমন্বয়ের বাণী তিনি প্রচার করেছিলেন। আমরা এক আশ্চর্য ঘটনা ঠাকুরের মধ্যে প্রত্যক্ষ করি যা পূর্বপূর্ব কোন অবতারের ক্ষেত্রে ঘটেনি। প্রতিটি ধর্মকেই তিনি নিজ জীবনে গ্রহণ করে তা সাধন করেছিলেন।

এইভাবে তার মধ্যে ঘটেছিল বিভিন্ন অবতারের সমাবেশ। শম্ভু মল্লিকের বাগানে বাইবেল শুনে খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন রামকৃষ্ণ। এই ধর্মের সাধন অবস্থায় তিন দিন তিনি যিশুর ভাবে আবিষ্ট হয়ে থাকেন। তারপর পঞ্চবটীতে একদিন যখন যিশুর কথা ভাবছেন, সেই সময় দেখতে পেলেন অপূর্ব দ্যুতিময় এক সুন্দর পুরুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার মধ্যে বিলীন হয়ে গেলেন। রামকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন ইনিই ঈশ্বরপুত্র যিশু ঈশামসি। আর একবার ইসলাম ধর্মের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন।

গোবিন্দ রায় নামে এক সুফি সাধকের কাছে দীক্ষা নিলেন। ইসলাম ধর্ম সাধনকালে তিনি দীর্ঘ শ্মশ্রুবিশিষ্ট, গম্ভীর জ্যোতির্ময় পুরুষের সাক্ষাৎ লাভ করেন। এইভাবে বিভিন্ন সময়ে রামকৃষ্ণের জীবনে দিব্যদর্শনের মাধ্যমে মহাপুরুষদের দর্শন ও মিলন সম্পূর্ণ হবার পরে এল ভাবপ্রচারের শুভকাল। এই সময় থেকেই তাঁর চিহ্নিত ভক্তদের একে একে সমাগম হতে থাকে— পরবর্তীকালে এঁরাই তাঁর বাণী দেশে বিদেশে বহন করে যুগাবতারের আবির্ভাবকে সার্থক করে তুলেছিলেন।

তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সমাগম ঘটেছিল দক্ষিণেশ্বরের পাঁচটাকা মাইনের কালীমন্দিরের পূজক রামকৃষ্ণের কাছে। ১৮৬৮ খ্রিঃ রাসমণির সম্পত্তির ব্যাপারে আইনজ্ঞ হয়ে দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন মাইকেল মধুসূদন। এই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে ঠাকুর নিজে এরকম বিবরণ দিয়েছেন— “নারায়ণ শাস্ত্রী যখন ছিল, মাইকেল এসেছিল। মথুরবাবুর বড়ছেলে দ্বারিকবাবু সঙ্গে করে এনেছিল। ম্যাগাজিনের সাহেবদের সঙ্গে মোকদ্দমা হবার যোগাড় হয়েছিল। তাই মাইকেলকে এনে বাবুরা পরামর্শ করেছিল। দপ্তরখানার সঙ্গে বড় ঘর। সেইখানে মাইকেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি নারায়ণ শাস্ত্রীকে কথা কইতে বললাম। সংস্কৃতে কথা ভাল বলতে পারলে না। ভুল হতে লাগল। তখন ভাষায় কথা হল। নারায়ণ শাস্ত্রী বললেন, তুমি নিজের ধর্ম কেন ছাড়লে ? মাইকেল পেট দেখিয়ে বলে, পেটের জন্য ছাড়তে হয়েছে। নারায়ণ শাস্ত্রী বললে, যে পেটের জন্য ধর্ম ছাড়ে, তার সঙ্গে কথা কি কইব ? তখন মাইকেল আমায় বললে, আপনি কিছু বলুন। আমি বললাম, কে জানে কেন, আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার মুখ কে যেন চেপে ধরেছে।”

তবে সেদিন কিছু না বললেও রামকৃষ্ণ মাইকেলকে দুখানি রামপ্রসাদী গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। শ্রীমা সারদা দেবী প্রথম দক্ষিণেশ্বরে আসেন ১৮৭২ খ্রিঃ মার্চ মাসে মথুরবাবুর মৃত্যুর পরের বছরে। রামকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রীকে সাক্ষাৎ জগদম্বা রূপে ফলহারিনী কালীপুজোর দিনে পুজো করেছেন। পুজোর পরে সারদা দেবীর শ্রীচরণে তাঁর সাধনার সমস্ত ফল সমর্পণ করেছিলেন। স্বামী – স্ত্রীর এরকম আশ্চর্য সম্পর্কের কথা জগতে রামকৃষ্ণলীলাতেই প্রথম দেখা গিয়েছিল। রামকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রথম প্রচার করেন কেশবচন্দ্র সেন— ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকায়। তাঁর সেই লেখা প্রকাশিত হলে শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল মহলই তার নাম জানতে পারে।

এরপরে ‘ পরমংহসের উক্তি ‘ নামে কেশবচন্দ্রের বই প্রকাশিত হলে রামকৃষ্ণ সম্পর্কে সকল মহলেই আগ্রহ ও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের চিহ্নিত ভক্তরা হলেন, লাটু বা রাঘতু – রাম, বলরাম বসু, রাখালচন্দ্র ঘোষ, নরেন দত্ত, যোগিন্দ্রনাথ, নিত্যনিরঞ্জন, মহেন্দ্র গুপ্ত, বাবুরাম, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী, শশিভুষণ চক্রবর্তী, কালীপ্রসাদ চন্দ্র, হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, হরিনাথ চট্টোপাধ্যায়, গোপালচন্দ্র ঘোষ, সারদাপ্রসন্ন মিত্র, গঙ্গাধর গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র ঘোষ, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।

১৮৮০ খ্রিঃ থেকে ১৮৮৫ খ্রিঃ মধ্যে এঁদের সকলের আগমন ঘটে। ১৮৮২ খ্রিঃ ৫ ই আগস্ট ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাইয়ের বাদুড় বাগানের বাড়িতে ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয়। দুজনের এই সাক্ষাৎকার ইতিহাস হয়ে আছে। ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলে বিদ্যাসাগর অভিভূত তৃপ্ত হয়েছিলেন। নন্দনবাগান ব্রাহ্মসমাজে ১৮৮৩ খ্রিঃ ২২ শে মে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে গান শুনেছেন ঠাকুর। পরের বছর ২১ শে সেপ্টেম্বর স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা নাটক দেখতে যান।

চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নটী বিনোদিনী। ঠাকুর তাকে আশীর্বাদ করে বলেন, মা ! তোর চৈতন্য হোক। গিরিশের সঙ্গে সেদিনই প্রথম পরিচয় হয়েছিল তাঁর। শোভাবাজারে অধরলাল সেনের বাড়িতে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঠাকুরের কথা হয়েছিল ১৮৮৪ খ্রিঃ। দেবী চৌধুরানী, কৃষ্ণ চরিত্র প্রভৃতি বঙ্কিমের লেখা নিয়ে ঠাকুর যুক্তিনিষ্ঠ সমালোচনা করেছিলেন।

১৮৮৩ খ্রিঃ ১ লা জানুয়ারি ঠাকুর কল্পতরু হয়ে এগারো জন চিহ্নিত ভক্তকে গেরুয়া কাপড় এবং রুদ্রাক্ষের মালা দান করেন। এঁরা পরে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। একখানা কাপড় রেখে দিয়েছিলেন গিরিশের জন্য। নরেনকে লোকশিক্ষার চাপরাস দান করেন ১৮৮৬ খ্রিঃ। নরেন আপত্তি প্রকাশ করলে মন্তব্য করেছিলেন, ‘তোর ঘাড় করবে ‘।

সেই বছরেই কলকাতার লোকদের ভার দিয়েছিলেন সারদাদেবীকে। বলেছিলেন “কলকাতার লোকগুলো অন্ধকারে কিলবিল করছে। তুমি তাদের দেখো।” ঠাকুরের গলার রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসার জন্য তাঁকে দক্ষিণেশ্বর থেকে প্রথমে নিয়ে আসা হয়েছিল বাগবাজারে, পরে শ্যামপুকুরে ও কাশীপুরে উদ্যানবাটীতে। এখানেই ১৮৮৬ খ্রিঃ নরেনকে যথাসর্বস্ব দিয়ে বললেন, ‘ আজ যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে ফকির হলুম। তুই এই শক্তিতে জগতের কাজ করবি। কাজ শেষ হলে ফিরে যাবি।

শেষবারের মত নরেনকে আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন ওই বছরেই। বলেছিলেন, “সত্যি সত্যি বলছি, যে রাম, যে কৃষ্ণ, সেই ইদানীং এই শরীরে রামকৃষ্ণ। তবে তোর বেদান্তের দিক দিয়ে নয়।” শ্রীমা সারদাদেবীর কাছে বিদায় নিলেন ১৮৮৬ খ্রিঃ ১৫ আগস্ট। বললেন, “মনে হচ্ছে, জলের মধ্যে দিয়ে অনেক দূর চলে যাচ্ছি।”

রামকৃষ্ণ পরমহংস র মৃত্যু: Ramakrishna Paramahamsa’s Death

১৮৮৬ খ্রিঃ ১৬ আগস্ট রাত একটা ২ মিনিটে ঠাকুর মহাসমাধিতে প্রবেশ করেন। পরদিন সন্ধ্যা ছটায় কাশীপুর মহাশ্মশানে ঠাকুরের পবিত্র ভাগবতী তনু চিতাগ্নিতে আহূতি দেওয়া হয় ৷

Leave a Comment