ভারতের জনসংখ্যা বন্টনের বা জনঘনত্বের তারতম্যের কারণগুলি আলোচনা করো।

Rate this post

ভারতের জনসংখ্যা বন্টনের বা জনঘনত্বের তারতম্যের কারণগুলি আলোচনা করো: পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলের পরিবেশ অনুকূল ও বন্ধুভাবাপন্ন, সেই সমস্ত অঞ্চলেগুলিতে সাধারণত বেশি মানুষ বসবাস করেন। অন্যদিকে যে সমস্ত অঞ্চলের পরিবেশ প্রতিকূল, সেই সমস্ত অঞ্চলে জীবনধারন কষ্টসাধ্য বলে কম মানুষ বসবাস করেন। ভারতের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। ভারতের সমভূমি অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব যেমন খুব বেশি, তেমনি পার্বত্য অঞ্চলে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব খুব কম এবং মালভূমি অঞ্চলের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব মাঝারি ধরনের।ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসংখ্যা বন্টনের বা জনঘনত্বের তারতম্যের কারণগুলি হল নিম্নরূপ-

A)ভারতের জনসংখ্যা বন্টনের বা জনঘনত্বের তারতম্যের প্রাকৃতিক কারণ

1)ভূ-প্রকৃতি-ভূ-প্রকৃতি ভারতের জনসংখ্যা বন্টনের বা জনঘনত্বের তারতম্যের একটি অন্যতম কারণ।এদেশের গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য নদী অববাহিকা অঞ্চল এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল সমতল হওয়ায় তা কৃষি, শিল্প, ব্যবসা বণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থায় উন্নত। তাই সমভূমি অঞ্চলগুলিতে বেশি মানুষ বসবাস করেন এবং জনঘনত্ব বেশি হয়। আবার হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল ও বিভিন্ন মালভূমি অঞ্চলগুলির ভূ-প্রকৃতি উঁচু-নিচু বা বন্ধুর হওয়ায় সেখানে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা- বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা কষ্টসাধ্য এবং ব্যয় সাপেক্ষ। তাই এই সমস্ত অঞ্চলে কম মানুষ বসবাস করেন এবং জনঘনত্ব কম হয়।

২)জলবায়ু-ভারতের জনসংখ্যা বন্টনের বা জনঘনত্বের তারতম্যের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো এদেশের জলবায়ু।ভারতের সমুদ্র উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির জলবায়ু মনোরম হওয়ায় সেগুলির জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বেশি।অপরদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলির জলবায়ু স্যাঁতসেঁতে বলে এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলির জলবায়ু শুষ্ক বলে সেগুলির জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব অপেক্ষাকৃত কম।

৩)মৃত্তিকা-ভারতের যে সমস্ত অঞ্চলের মৃত্তিকা উর্বর সেই সমস্ত অঞ্চলে কৃষিকাজ ভালো হয় বলে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বেশি হয়। অপরদিকে যে সমস্ত অঞ্চলের মৃত্তিকা অনুর্বর, সেই সমস্ত অঞ্চলে কৃষিকাজ ভাল হয় না বলে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব কম হয়। যেমন-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের মৃত্তিকা উর্বর হওয়ায় সেখানে কৃষিকাজের উন্নতি হেতু বেশি মানুষ বসবাস করেন। অপরদিকে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা অনুর্বর হওয়ায় সেখানে অপেক্ষাকৃত কম মানুষ বসবাস করেন।

৪)নদ-নদী-উত্তর ভারতের গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র এবং দক্ষিণ ভারতের মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি নদী অববাহিকার জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বেশি। কারণ এইসব নদী থেকে কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় জলসেচ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, জলপথে পরিবহন, পানীয় জল সরবরাহ ইত্যাদি নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। এছাড়া এইসব নদী অববাহিকার উর্বর সমতলভূমিতে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে বলেও বেশি সংখ্যক মানুষ বসবাস করেন।

৫)খনিজ সম্পদ প্রাপ্তি-খনিজ সম্পদের প্রাপ্তির ওপর কোন অঞ্চলের জনসংখ্যার বন্টন বা জনঘনত্বের তারতম্য নির্ভর করে। কোন অঞ্চলে মূল্যবান খনিজ সম্পদ পাওয়া গেলে সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটে বলে অধিক সংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে।ফলে ওই অঞ্চলটির জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। যেমন-একসময় ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল জনবিরল ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন মূল্যবান খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে বর্তমানে ওই অঞ্চলের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

B)ভারতের জনসংখ্যা বন্টনের বা জনঘনত্বের তারতম্যের অর্থনৈতিক কারণ

১)শিল্প ও বানিজ্য-শিল্প ও বানিজ্য অঞ্চল হল বহুমুখী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম প্রসারের অনুকূল ক্ষেত্র। ভারতের যে সকল অঞ্চলে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি ঘটেছে সেই সকল অঞ্চলের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বেশি। এই কারণে হাওড়া-হুগলি শিল্পাঞ্চল, দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চল এবং মুম্বাই-আমেদাবাদ শিল্পাঞ্চলের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব অত্যন্ত বেশি।

২)পরিবহন ব্যবস্থা-ভারতের যে সমস্ত অঞ্চলের সড়ক, রেল ও জলপথ পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত, সেই সমস্ত অঞ্চলের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বেশি।ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব এই কারণে বেশি।অপরদিকে যে সমস্ত অঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত নয়, সেই সমস্ত অঞ্চলের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব কম। মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যার বেশ কিছু অঞ্চলে উক্ত কারণে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব কম।

৩)কৃষিকাজ ও পশুপালন-ভারতের যে সমস্ত অঞ্চলের মৃত্তিকা উর্বর, জলসেচ ব্যবস্থা উন্নত সেই সমস্ত অঞ্চলে কৃষিকাজর সুবিধা থাকায় অধিক লোক বসবাস করেন। আবার যে সমস্ত অঞ্চলে পশুপালনের সুবিধা দেখা যায়, সেই সমস্ত অঞ্চলেও পশু পালনের কারণে অধিক মানুষ বসবাস করেন।ফলে কৃষিকাজ ও পশু পালনের সুবিধা যুক্ত অঞ্চলগুলির জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বেশি হয়। গুজরাটের উত্তরাংশের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব এই কারণে বেশি। অপরদিকে কৃষিকাজ ও পশুপালনের সুবিধাহীন অঞ্চলগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব কম হয়।

৪)শিক্ষা কেন্দ্রের অবস্থান-ভারতের বিভিন্ন বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করতে আসেন।ফলে ভারতের বিভিন্ন বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জনসংখ্যা ও জনঘনত্বের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। আলিগড় ও শান্তিনিকেতনের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব উক্ত কারণে বেশি।

৫)অন্যান্য কারণ-উপরিলিখিত বিষয়গুলি ছাড়াও ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানে পর্যটকের আগমন হেতু পর্যটন শিল্পের বিকাশ, বৃহদায়তন শিল্প ও শিল্পাঞ্চলের অবস্থান, সরকারি নীতি ইত্যাদি বিষয়গুলিও ভারতের জনসংখ্যার বন্টন ও জনঘনত্বের তারতম্যের অন্যতম।

Leave a Comment