মৃত্তিকা গঠনের উপাদান হিসাবে জীবজগতের ভূমিকা আলোচনা করো: ভূত্বকের উপরিভাগে ক্ষয়িত ও বিকৃত শিলাচূর্ণের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার জৈব ও অজৈব বস্তু সংমিশ্রণে যে নরম আস্তরণ সৃষ্টি হয় তাকে সাধারণভাবে মৃত্তিকা বলে। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ভি.ভি.ডকুচেভ উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে জলবায়ু, জীবজগৎ, ভূপ্রকৃতি, আদি শিলা ও সময়-এই পাঁচটি উপাদানের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। এদের মধ্যে জীবজগৎ হল মৃত্তিকা গঠনের প্রকৃতি ও হারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক। নিম্নে মৃত্তিকা গঠনে জীবজগতের ভূমিকা আলোচনা করা হলো-
A)মৃত্তিকা গঠনে উদ্ভিদের ভূমিকা
বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থিত ভিন্ন ভিন্ন স্বাভাবিক উদ্ভিদ মৃত্তিকা গঠনের ক্ষেত্রে নিন্মলিখিত ভাবে প্রভাব বিস্তার করে-
১) জৈব পদার্থ উৎপাদন ও সংযোজন: বিভিন্ন উদ্ভিদের জৈব অবশেষের পরিমাণ ও তার রাসায়নিক গঠন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে এবং তা মৃত্তিকায় সংযোজিত হয়ে মৃত্তিকার ভৌত ও রাসায়নিক গঠন কে প্রভাবিত করে। মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমাণ আবার প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন- ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্যে অধিক জৈব অবশেষ উৎপাদিত হলেও বিয়োজনের হার বেশি বলে মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমাণ কম থাকে। অন্যদিকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বিয়োজনের হার কম বলে মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি হয়।
২) খনিজ পদার্থের পরিবহন ও সঞ্চয়: স্থানীয় স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর মৃত্তিকায় খনিজ পদার্থের পরিবহন ও তার সঞ্চয় নির্ভর করে। যেমন-স্তেপ ও প্রেইরী ভূমি অঞ্চলে জৈব পদার্থসমৃদ্ধ ক্ষারকীয় চারনোজেম মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে সরলবর্গীয় অরণ্যে অম্লধর্মী মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।
৩) মৃত্তিকার পরিলেখ গঠন: উদ্ভিদের ডালপালা, পাতা, বাকল ইত্যাদি মৃত্তিকার পরিলেখ গঠন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রন করে। যেমন-পাইন উদ্ভিদের অবশেষ সমূহে ক্ষারীয় পদার্থের পরিমাণ কম থাকায় এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জল আম্লিক হয় এবং মৃত্তিকা অম্লধর্মী হয়ে পড়ে। এরূপ ক্ষেত্রে মৃত্তিকার A স্তরটি বিস্তীর্ণ ও সুস্পষ্ট হয়।
৪) খনিজ পদার্থের মুক্তি ও উর্বরতা বৃদ্ধি: উদ্ভিদের অবশেষ থেকে উৎপন্ন জৈব অ্যাসিড মূল উপকরণ থেকে বা আদি শিলা থেকে খনিজ পদার্থের মুক্তি ঘটাতে সাহায্য করে; যা জলে দ্রবীভূত হয়ে উদ্ভিদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এককথায় উদ্ভিদরা মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
উপরিলিখিত বিষয়গুলি ছাড়াও উদ্ভিদের জৈব দেহাবশেষ মৃত্তিকার গঠনকে সুসংবদ্ধ করে, মৃত্তিকার জল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং মৃত্তিকার ক্ষয়শীলতাকে রোধ করে।
B) মৃত্তিকা গঠনে প্রাণিজগতের ভূমিকা
মৃত্তিকায় বসবাসকারী প্রাণী তথা ইঁদুর, পিঁপড়ে, খরগোশ, উইপোকা, কেঁচো, প্রেইরী কুকুর ইত্যাদি প্রাণীগুলি বিভিন্ন ভাবে মৃত্তিকার গঠন কে প্রভাবিত করে। যেমন-
১) মাটিতে গর্ত করে নিচের মাটিকে উপরে নিয়ে আসে।
২) মৃত্তিকায় তৈরি গর্তের মধ্যে বায়ু চলাচল বৃদ্ধি পায়।
৩) মৃত্তিকা মধ্যস্থ অনুছিদ্রের বৃদ্ধি ঘটায়।
৪) মৃত্তিকাতে জৈব পদার্থ ও হিউমাসের পরিমাণ বৃদ্ধির দ্বারা মৃত্তিকায় রাসায়নিক চরিত্রের পরিবর্তন ঘটায়।
৫) কেঁচোর মল নাইট্রোজেন ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ বলে মৃত্তিকা নাইটোজেন ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হয়।
এইভাবে ওই সমস্ত প্রাণী মাটির উর্বরা শক্তি তথা উৎপাদন ক্ষমতা, জল ধারণ ক্ষমতা বায়ু চলাচল ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে মৃত্তিকার গঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
C) মৃত্তিকা গঠনে আণুবীক্ষণিক জীবের ভূমিকা
মৃত্তিকার মধ্যে বসবাসকারী বিভিন্ন আণুবীক্ষণিক জীব তথা প্রোটোজোয়া, নিমাটোড, বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, অ্যালগি, ছত্রাক ইত্যাদি জৈব পদার্থের পচন মৃত্তিকায় হিউমাস গঠন করে তথা নাইট্রোজেন সংযোজন ও বিয়োজন, অ্যামোনিয়া উৎপাদন ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপ কে নিয়ন্ত্রণ করে।