বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো: বিংশ শতকের উষালগ্নে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের (1905 খ্রীঃ) সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারা বাংলা জুড়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে বাংলার নারী সমাজও এই আন্দোলনে শামিল হন। এই আন্দোলনের প্রথম দিকে প্রকাশ্য সভা সমিতিতে নারীদের যোগদানের হার খুব বেশি না থাকলেও এই সময় নারীরা বিক্ষোভ দেখানোর জন্য কোন বিশেষ বিশেষ বাড়িতে সমবেত হতেন এবং স্বদেশকে বঙ্গলক্ষী কল্পনা করে বঙ্গলক্ষীর ব্রতকথা শুনতেন ও অরন্ধন দিবস পালনের প্রতিজ্ঞা করতেন। স্বদেশী ব্রত পালনের জন্য লীলাবতী মিত্র, কুমোদিনী মিত্র, হেমাঙ্গিনী দাস, নির্মলা সরকার প্রমুখ মহিলা গ্রামে গ্রামে চরকায় সুতো কাটা, আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ, স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার, কাঁচের চুড়ি ভেঙে ফেলা, বিলেতি লবণ বর্জন করা প্রভৃতি কার্যে লিপ্ত হন।তাঁরা গৃহে কোন বিদেশি দ্রব্য, এমনকি বিদেশি ওষুধ ঢুকতে দিতেন না।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনে সরলা দেবী চৌধুরানী সম্পাদিত “ভারতী” এবং সরযূবালা দত্ত সম্পাদিত “ভারত মহিলা” গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দুই পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় এবং দেশের পুরুষদের সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সরলা দেবী চৌধুরানী তাঁর ‘স্বদেশীর ভান্ডার’কে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ রূপে পরিচিত করেন। এই আন্দোলনকালে বাংলার মেয়েরা গ্রামে গ্রামে ও শহরে শহরে ঘুরে পুরুষদের মতো সভা সমিতি করে দেশবাসীকে বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্যাদি ব্যবহারের আবেদন জানান। এক্ষেত্রে ময়মনসিংহের মহিলারা সর্বপ্রথম সভা করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
ময়মনসিংহের মহিলাদের মতোই কলকাতার মহিলারাও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সভা সমিতির আয়োজন করেন। কলকাতায় মহিলাদের প্রথম বড়সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৩১২ বঙ্গাব্দের ৫ই আশ্বিন। নাটোরের মহারানী গিরিবালা দেবীর আহবানে এবং শ্রীমতি অবলা বসুর উদ্যোগে প্রায় ১ হাজার মহিলা মেরী কার্পেন্টার হলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং স্বদেশীর শপথ গ্রহণ করেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্যে রাখি বন্ধন উৎসবের পরিকল্পনা করেন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সারা বাংলায় এক অদ্ভুত উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। বাংলার নারী সমাজ প্রবল উৎসাহের সঙ্গে এই উৎসবে সামিল হন। কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে, মন্দির প্রাঙ্গণে, স্নানের ঘাটে সর্বত্রই চলে এই উৎসব অনুষ্ঠান। সেদিন কলকাতায় দুই বাংলার মিলনের প্রতীক মিলন মন্দিরের ভিত্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে যে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে প্রায় ৫০০ জন মহিলা উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনে বাংলার নারী সমাজের যোগদান এই আন্দোলনকে একটি আলাদা তাৎপর্য এনে দিয়েছিল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নারীদের যোগদান এবং বিদেশী দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশীদ্রব্য ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ এই আন্দোলনকে সর্বভারতীয় আন্দোলনের রূপ দিয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনে মহিলাদের যোগদান প্রমান করেছিল ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে বাংলা তথা এদেশের নারীরাও পিছিয়ে নেই।