আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো: ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত আইন অমান্য আন্দোলন ছিল একটি বৃহত্তর গণআন্দোলন। 1930-1931 খ্রীঃ এবং 1932-1934 খ্রীঃ-আইন অমান্য আন্দোলনের এই দুটি পর্বেই ভারতীয় নারী সমাজের যোগদান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যাপক তর। এই আন্দোলনে সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত তথা শিক্ষিত নারীদের যোগদান রক্ষণশীল পুরুষ সমাজকে সচকিত করে তোলে এবং জাতীয় আন্দোলনে নারীদের যোগদান আইন অমান্য আন্দোলনকে সর্বভারতীয় রূপদান করে।
আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা
1930 খ্রীঃ 12ই মার্চ মহাত্মা গান্ধী গুজরাটের সবরমতি আশ্রম থেকে লবণ আইন ভঙ্গের উদ্দেশ্যে 78 জন অনুগামী নিয়ে ডান্ডির দিকে যাত্রা করেন এবং ডান্ডিতে পৌঁছে 5ই0 এপ্রিল লবণ আইন ভঙ্গের দ্বারা আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন। এই ডান্ডি অভিযান ও লবণ আইন ভঙ্গ আন্দোলনে বহু নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের নেতৃত্ব দান
1930 খ্রীঃ 10ই এপ্রিল ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকার মাধ্যমে গান্ধীজি ভারতীয় নারী সমাজকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদানের আহ্বান জানান। তাঁর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কলকাতা, দিল্লি, বোম্বাই, এলাহাবাদ, লখনউ, লাহোর প্রভৃতি স্থানের অসংখ্য নারী আইন অমান্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কস্তুরবা গান্ধী, কমলা নেহেরু, স্বরূপ রাণী নেহেরু, নেলি সেনগুপ্তা, সরলা দেবী, বাসন্তী দেবী, লীলা নাগ প্রমুখো মহিলা এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা
১)আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন বাংলায় মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। এই সংগঠনের নেতৃত্বে হাজার হাজার মহিলা জনসভা, সভাযাত্রা ও বিদেশী পণ্যাগারের সামনে পিকেটিং করতে থাকেন। তাঁরা বিদেশি বস্ত্র বর্জনে ও মদের দোকানের সামনে অবরোধ করতেও সক্রিয় ভূমিকা নেন।
২)1930 খ্রীঃ 13ই জুলাই কলকাতায় নারী সত্যাগ্রহ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের ঊর্মিলা দেবী, মোহিনী দেবী, জ্যোতির্ময় গঙ্গোপাধ্যায়, শান্তি দাস, নিস্তারিনী দেবী, আশালতা দাস প্রমুখ মহিলা সদস্যার নেতৃত্বে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় মিছিল, সভাযাত্রা ও বিদেশী পণ্যাগারের সামনে পিকেটিং চলতে থাকে। মাদকদ্রব্য বর্জন, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, তাঁত ও চরকা প্রচলন, খাদির প্রচার প্রভৃতি গঠনমূলক কর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
৩)1930 খ্রীঃ 31শে মে গান্ধীজীর নির্দেশে সরোজিনী নাইডু প্রায় 2000 মহিলা স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে ধারসোনা লবণগোলা অবরোধ করলে পুলিশের লাঠি আঘাতে অবরোধকারী মহিলা স্বেচ্ছাসেবীগণ ছত্রভঙ্গ হন এবং সরোজিনী নাইডু গ্রেপ্তার হন। কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায় ও বোম্বাইয়ের একটি লবণ উৎপাদন কেন্দ্রে আক্রমণ চালিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।
৪)আইন অমান্য আন্দোলনে দলিত নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। দলিত নারী চম্পুবাঈ ও গোপিকাবাঈ আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া ধুলিবেন সোলাঙ্কি ও সোলান সোলাঙ্কি নামক দলিত মহিলা দেরও আইন অমান্য আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে দেখা যায়।
৫)আইন অমান্য আন্দোলনে মুসলিম নারীরা পিছিয়ে ছিলেন না। দীর্ঘদিনের অবরোধের প্রাচীর ভেঙে চব্বিশ পরগনার হারোয়া থানার হোসেনারা বেগম, সিলেটের জোবেদা খাতুন, গাইবান্ধার দৌলতুন্নেসা খাতুন, ময়মনসিংহের রাজিয়া খাতুন ও হালিমা খাতুন, বিক্রমপুরের ফুলবাহার বিবি প্রমুখ মুসলিম মহিলা গান্ধীজি ডাকে সাড়া দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
৬)শুধু কলকাতা শহরেই নয়, জেলা স্তরেও নারীরা আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তমলুকে মাতঙ্গিনী হাজরা, ঢাকায় আশালতা সেন, কুমিল্লায় লবণ্যলতা চন্দ্র, বীরভূমের সত্যবালা দেবী, বাঁকুড়ায় শান্তিশীলা পালিত, হাওড়ায় পারুল মুখোপাধ্যায়, দিনাজপুরে প্রভা চট্টোপাধ্যায়, নোয়াখালীতে সুশীলা মিত্র, বরিশালে ইন্দুমতি গুহঠাকুরতা ও প্রফুল্লমুখী বসু প্রমুখ মহিলারা আইন অমান্য আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মূল্যায়ন
আইন অমান্য আন্দোলনে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মহিলাদের যোগদান এবং আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন এই আন্দোলনকে সর্বভারতীয় রূপ দান করেছিল। তাঁরা প্রমাণ করেছিলেন যে ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নারীরাও পিছিয়ে নেই।।