অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো: 1920-1922 খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে হিন্দু-মুসলমান, ধনী-দরিদ্র, কৃষক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ তথা সমগ্র ভারতবাসীর মধ্যে এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বাংলা তথা ভারতের নারী সমাজ এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সুদূর পল্লীগ্রামের নারীদের মধ্যেও এই আন্দোলন সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সরোজিনী নাইডু, বাসন্তী দেবী, ঊর্মিলা দেবী, মোহিনী দেবী, হেমপ্রভা মজুমদার প্রমুখ মহিলা এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ভারতীয় নারী সমাজের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে এক অন্যমাত্রায় পৌঁছে দেয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের পত্নী বাসন্তী দেবী বাংলার বিভিন্ন জেলা পরিভ্রমণ করে অসহযোগ আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। তোমার অনুপ্রেরণায় মহিলারা তিলক স্বরাজ তহবিলে ব্যাপকভাবে টাকা করি ও গহনা দান করেন। 1921 খ্রীঃ 17ই নভেম্বর ইংল্যান্ডের যুবরাজ ভারত পরিদর্শনের জন্য বোম্বাই বন্দরে পদার্পণ করলে বোম্বাইয়া প্রায় এক হাজার মহিলা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখান। এই কারণে 1921 খ্রীঃ 18ই নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার সকল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে বেআইনি এবং সভা সমিতিকে রাজদ্রোহ মূলক বলে ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে 7ই ডিসেম্বর বাসন্তী দেবী, ঊর্মিলা দেবী ও সুনীতি দেবী কলকাতার রাস্তায় প্রকাশ্য বিক্ষোভে অংশ নেন এবং গ্রেপ্তার হন। ভারতের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাসে এটাই প্রথম নারী গ্রেফতারের ঘটনা। তাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে নারী সমাজে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন। 10ই ডিসেম্বর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসকে গ্রেফতার করা হলে বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব বাসন্তী দেবীর হাতে অর্পিত হয়। তিনি ‘বাংলার কথা’ পত্রিকার মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করতে থাকেন।1922 খ্রীঃ এপ্রিল মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে বাসন্তী দেবী সভা নেতৃত্ব করেন এবং এই অধিবেশনে নারী সমাজের উপস্থিতি পূর্বেকার অন্য সব সম্মেলনকে ম্লান করে দেয়।
বাসন্তী দেবী যখন সভা সমিতির মাধ্যমে নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করছেন ঠিক তখন দেশবন্ধু ভগিনী ঊর্মিলা দেবী স্বরাজের মূলমন্ত্র প্রচার এবং চরকা ও খাদিকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে 1921 খ্রীঃ ভবানীপুরে ‘নারী কর্ম মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তাঁত, চরকা কাটা প্রভৃতি শিল্প শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি মহিলাদের অসহযোগ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করা হতো। কুমিল্লার রাজনৈতিক কর্মী বসন্তকুমার মজুমদারের স্ত্রী হেমপ্রভা মজুমদারও এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উর্মিলা দেবীর অসুস্থতার সময় তিনি কলকাতার বিভিন্ন স্থানের সভা সমিতিগুলি পরিচালনা করতে থাকেন।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের আরো একজন উল্লেখযোগ্য নেত্রী ছিলেন মোহিনী দেবী। একজন উচ্চপদস্থ সরকারির কর্মচারী স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি খালি পায়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে খদ্দর বিক্রি, সভা সমিতিতে বক্তৃতা দান ও স্বরাজের বার্তা প্রচার করতে থাকেন।
পূর্ব বাংলার ঢাকার গেন্ডারিয়ায় আশালতা সেন শ্বশুরবাড়িতে ‘শিল্পাশ্রম’ নামে মহিলাদের জন্য একটি বয়ন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানে মহিলারা নিজেরা খদ্দর বুনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেগুলি বিক্রি করতেন। এখানে তৈরি শিল্প সামগ্রী বিক্রির জন্য প্রতিবছর শিল্প মেলা অনুষ্ঠিত হতো। গান্ধীজীর বাণী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি 1924 খ্রীঃ ‘গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি’ গঠন করেন।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার বিভিন্ন জেলাতেও বেশ কিছু মহিলা নেত্রীর আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে তাদের যুক্ত করেন। এ ব্যাপারে সিলেটের সরলাবালা দেবী, বালুরঘাটের প্রভা চট্টোপাধ্যায়, ভোলার সরযূবালা সেন, বরিশালের ইন্দুমতি গুহঠাকুরতা, নোয়াখালীর সুশীলা মিত্র, খুলনার স্নেহশীলা চৌধুরী, বর্ধমানের সুরমা মুখোপাধ্যায়, সিরাজগঞ্জের বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী, ময়মনসিংহের ঊষা গুহ, বরিশালের প্রফুল্লকুমারী বসু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পতিতারাও অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই তাদের পেশা ত্যাগ করে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত চরকা ও খাদি প্রতিষ্ঠান ‘কুটির শিল্পাশ্রম’ এ যোগদান করেন।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ভারত তথা বাংলার নারী সমাজের যোগদান এই আন্দোলনকে একটি আলাদা তাৎপর্য এনে দিয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী অহিংস অসহযোগ আন্দোলন থেকে সমাজসেবার কাজে অংশগ্রহণ, সভা সমিতি থেকে সভাযাত্রায় অংশগ্রহণ, স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার থেকে অন্যান্য রাজনৈতিক কার্যকলাপে যোগদানকে যেভাবে সহজ ও সাবলীল করে তুলেছিলেন তাতে নারী সমাজের একটা বড় অংশ এগিয়ে আসতে দ্বিধাবোধ করেননি। এই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে নারী সমাজের এই যোগদান ও সক্রিয়তা পরবর্তীকালে আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে আরো ব্যাপক হয়ে ওঠে।