সার্ক কি ? What is SAARC? সার্ক (SAARC) প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য, সমস্যা ও সাফল্য: দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা হলো South Asian Association For Regional Co-operation (SARRC) বা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা পর্ষদ। প্রতিষ্ঠালগ্নে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ-দক্ষিণ এশিয়ারি 7টি দেশ সার্কের সদস্য ছিল। পরবর্তীকালে আফগানিস্তান যোগ দেওয়ায় সার্কের বর্তমান সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা 8। এই সংস্থা সদর দপ্তর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অবস্থিত।
সার্ক (SAARC) প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
1985 খ্রিষ্টাব্দের 8ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিকে নিয়ে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা পর্ষদ বা SAARC গঠিত হয়। এই সংস্থা গঠনের প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ-
জিয়াউর রহমানের শ্রীলঙ্কা সফর
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিকে নিয়ে কোন আঞ্চলিক সংস্থা গড়ে তোলার সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেন স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। 1979 খ্রীঃ শ্রীলংকা সফর কালে তিনি সর্বপ্রথম দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে একটি আঞ্চলিক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন এবং এব্যাপারে তিনি নিজে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সার্ক (SAARC) গঠনের সিদ্ধান্ত
জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের বিদেশ মন্ত্রীগণ 1981 খ্রীঃ শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও নেপালের কাঠমান্ডুতে , 1982 খ্রীঃ পাকিস্তানের ইসলামাবাদে এবং 1983 খ্রীঃ বাংলাদেশের ঢাকাতে একাধিক সম্মেলনে মিলিত হন। উক্ত দেশসমূহের বিদেশ মন্ত্রীগণ 1983 খ্রীঃ দিল্লি সম্মেলনে সমবেত হয়ে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা পর্ষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
সার্ক (SAARC) প্রতিষ্ঠা
দিল্লি সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এবং জিয়াউর রহমানের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য 1985 খ্রীঃ 7-8ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ার 7টি দেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা পর্ষদ বা South Asian Association For Regional Co-operation (SAARC) গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
সার্কের সদস্যপদ গ্রহণের শর্তাবলী
র্দিষ্ট শর্ত মেনে সার্কের সদস্য গ্রহনের ব্যবস্থা রয়েছে। সেই শর্তগুলি হলো-
1)সার্কের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগুলিকে নতুন সদস্য গ্রহণে সর্বসম্মতি দিতে হবে।
2)সদস্যপদ গ্রহণে ইচ্ছুক রাষ্ট্রটিকে দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত হতে হবে।
3) সদস্যপদ গ্রহণের ইচ্ছুক রাষ্ট্রটিকে সার্কের সনদ মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার করতে হবে।
সার্ক (SAARC) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা পর্ষদ প্রতিষ্ঠার পিছনে বিভিন্ন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আছে। সেগুলি হল-
1)উন্নয়ন-সদস্য রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো।
2)জনকল্যাণ-সদস্য রাষ্ট্রগুলির জনগণের কল্যাণ সাধন ও তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ঘটানো।
3)সহযোগিতা-সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কারিগরি, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
4)আত্মনির্ভরতা-সদস্য রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা রক্ষা ও যৌথ আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি করা।
5)সংবেদনশীল পরিবেশ গঠন-সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, বোঝাপড়া ও সংবেদনশীল পরিবেশ গঠন করা।
6)উৎসহ প্রদান-অর্থনৈতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় সক্রিয় সহযোগিতার বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে উৎসাহিত করা।
7)সাংস্কৃতিক আদান প্রদান-সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটানো।
8)নিরাপত্তা বিধান-দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ করা।
9)শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান-সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা।
10)অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা-সদস্য রাষ্ট্রগুলির ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং কোন সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।
সার্ক (SAARC)-এর সমস্যা
বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হলেও সার্ক তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সার্কের সামনে যে সমস্ত সমস্যাগুলি বর্তমান সেগুলি হল-
1)রাজনৈতিক অস্থিরতা-দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা সার্কেল সাফল্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। পারস্পরিক অবিশ্বাস, আঞ্চলিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, সামরিক প্রতিযোগিতা, সীমান্ত সংঘর্ষ প্রভৃতি ঘটনার প্রভাব সার্কের অভ্যন্তরে যথেষ্ট বাধা সৃষ্টি করেছে। যেমন-1997 খ্রীঃ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কার্গিলে অনুপ্রবেশের ঘটনা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটিয়েছে।
2)তামিল জঙ্গি সমস্যা-শ্রীলঙ্কার তামিল জঙ্গিদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ঘটনায় শ্রীলঙ্কা সন্দেহ করে যে শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি কার্যকলাপের পিছনে ভারতের মদত রয়েছে। ফলে এই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।
3)ভারসাম্যহীনতা-ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের বন্টন এবং শক্তি ও আর্থিক ব্যবধান সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করেছে। ফলে সার্কের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।
4)মতভেদ সৃষ্টি-সার্কের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ সমস্যা বৃদ্ধি করেছে।
5)সহযোগিতার অভাব-সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অনেক সময় পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সদস্য দেশগুলির উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।
সার্ক (SAARC)-এর সাফল্য
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে সার্ক প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। সদস্য রাষ্ট্রগুলির নানাবিদ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সার্ক যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছে। যেমন-
1)সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক আদান-প্রদান ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
2)নেপালের কাঠমান্ডুতে স্থায়ী সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্কের কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
3)সার্ক সংস্থাভুক্ত দেশগুলির আর্থ সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
4)সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে মোটামুটি সন্তোষজনক সাফল্য এসেছে ।
5)খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
6)শিশু কন্যাদের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে সার্ক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।