স্বামী বিবেকানন্দ জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Swami Vivekananda Biography in Bengali. আপনারা যারা স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী স্বামী বিবেকানন্দ র জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
স্বামী বিবেকানন্দ কে ছিলেন? Who is Swami Vivekananda?
স্বামী বিবেকানন্দ (১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ – ৪ জুলাই ১৯০২) (জন্মনাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত) ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য। তার পূর্বাশ্রমের নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিন্দুধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শনের প্রচারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অনেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপন এবং হিন্দুধর্মকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রচার করার কৃতিত্ব বিবেকানন্দকে দিয়ে থাকেন।
ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাটি প্রবর্তন করেন। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতাটি হল, “আমেরিকার ভাই ও বোনেরা …,” ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত চিকাগো বক্তৃতা, যার মাধ্যমেই তিনি পাশ্চাত্য সমাজে প্রথম হিন্দুধর্ম প্রচার করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ জীবনী – Swami Vivekananda Biography in Bengali
নাম | স্বামী বিবেকানন্দ |
জন্ম | 12 জানুয়ারী 1863 |
পিতা | বিশ্বনাথ দত্ত |
মাতা | ভুবনেশ্বরী দেবী |
জন্মস্থান | কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতীয় প্রজাতন্ত্র) |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ |
মৃত্যু | 4 জুলাই 1902 (বয়স 39) |
স্বামী বিবেকানন্দ র জন্ম: Swami Vivekananda’s Birthday
স্বামী বিবেকানন্দ 12 জানুয়ারী 1863 জন্মগ্রহণ করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী কেবল এটুকুই তাঁর পরিচয় নয়। তিনি ছিলেন জাতির সর্বাঙ্গীন মুক্তির সাধক। ঈশ্বর প্রেম ছিল তাঁর কাছে মানব প্রেম ও স্বদেশ প্রেমের নামান্তর। এক কথায় মানুষই ছিল তার আরাধ্য দেবতা। আর এই মানুষের কল্যাণই ছিল তার জীবনের ব্রত। এই কারণেই তিনি ভারতের এক যুগন্ধর পুরুষ। আর জগতের সকল মানুষের কাছেই এক আদর্শ মহামানব।
সর্বযুগে সর্বদেশে বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিকতা তাই হয়ে থাকবে চির আধুনিক। ঊনবিংশ শতক হল বাংলার নবজাগরণের যুগ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে – শিক্ষা সাহিত্য ধর্ম সংস্কৃতিতে উঠেছে পরিবর্তনের ঢেউ। পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে আলোকপ্রাপ্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাই সমাজে ঘটিয়ে চলেছেন আধুনিকতার আলোক সম্পাত। এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে বিবেকানন্দের আবির্ভাব।
স্বামী বিবেকানন্দ র পিতামাতা ও জন্মস্থান: Swami Vivekananda’s Parents And Birth Place
১৮৬৩ খ্রিঃ ১২ ই জানুয়ারি কলকাতার সিমুলিয়া পল্লীতে এক শিক্ষিত ধনী পরিবারে বিবেকানন্দের জন্ম। তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতার নামকরা আইনজীবী। মা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন দয়ালু ধৰ্মপ্ৰাণ মহিলা। বিবেকানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তাঁর ডাক নাম বিলে, পোশাকী নাম নরেন্দ্রনাথ।
স্বামী বিবেকানন্দ র শিক্ষাজীবন: Swami Vivekananda’s Educational Life
ছেলেবেলা থেকেই নরেন্দ্রনাথ ছিলেন অসম্ভব সাহসী আর কৌতূহলী। সব কিছুই তার যাচাই করে দেখার অভ্যাস। মায়ের দয়া, মমতা আর পিতার উদারতা তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। বাড়ির শিক্ষা শেষ হলে নরেনকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় মেট্রোপলিটন ইনসটিটিউটে। স্বভাব – চঞ্চল হলেও পড়াশুনায় তার ছিল গভীর আগ্রহ। ফলে স্কুলে সব বিষয়েই তিনি ছিলেন সবার সেরা ছাত্র।
খেলাধুলা এবং শরীরচর্চাতেও তাঁর প্রবল উৎসাহ ছিল। ছেলেবেলা থেকেই শরীর চর্চা করতেন, কুস্তি বক্সিং ও ক্রিকেট খেলায়ও ছিল সমান দক্ষতা। সুঠাম দেহের অধিকারী নরেন্দ্রনাথের উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ১৮৯৭ খ্রিঃ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নরেন্দ্রনাথ জেনারেল এসেম্বলী ইনসটিটিউশনে এফ.এ . ক্লাশে ভর্তি হন।
এই কলেজের অধ্যক্ষ কবি দার্শনিক হেস্টির সান্নিধ্যে এসে তিনি বিভিন্ন দেশের দর্শন শাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এই শাস্ত্রে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। সেই সময়ে সমাজের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে ব্রাহ্মসমাজ। প্রথম জীবনে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকর্ষণ বোধ করলেও তাদের অতিরিক্ত ভাবাবেগ এবং মানুষকে ঈশ্বরের অবতার সাজিয়ে পূজা করা তিনি পছন্দ করতেন না। তবে আহারে পোশাকে, আচারে ব্যবহারে ব্রাহ্মদেরই অনুসরণ করতেন তিনি। ব্রাহ্মদের সংস্পর্শে এসে নিয়মিত ধ্যান করাও অভ্যাস করেছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ র প্রথম জীবন: Swami Vivekananda’s Early Life
পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শন অনুশীলনের ফলে সত্যকে জানবার প্রবল ব্যাকুলতা জন্মেছিল নরেন্দ্রনাথের মধ্যে। ঈশ্বর কে ? জীবন কি ? এইসব প্রশ্ন তার অন্তরে প্রতিনিয়ত আলোড়ন তুলত। অনেক সাধু সন্ন্যাসী পন্ডিত ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞাসা রেখেও কোন সদুত্তর পাননি তিনি। ১৮৮০ খ্রিঃ ঘটনা। সিমলা পল্লীতে সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে প্রথম ঠাকুর রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তরুণ নরেন্দ্রনাথের। নরেনের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে ঠাকুর তাকে দক্ষিণেশ্বরে যাবার আমন্ত্রণ জানান।
অবশ্য এফ.এ পরীক্ষার ব্যস্ততার জন্য নরেন সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেন নি। পরীক্ষার পরে নরেনের সামনে উপস্থিত হল এক কঠিন পরীক্ষা। বিশ্বনাথ দত্ত স্থির করলেন পুত্রের বিবাহ দেবেন। কিন্তু সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হবার কোন ইচ্ছাই নরেনের ছিল না। তিনি সরাসরি তার অভিমত অভিভাবকদের জানিয়ে দিতে বিলম্ব করলেন না। এই সময় একদিন তিনি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে এলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে।
তিনি শুনেছিলেন ঠাকুরের কাছে গেলেই তিনি সত্যের সন্ধান জানতে পারবেন। রামকৃষ্ণের সরল ব্যবহার, আন্তরিক কথাবার্তা এবং ভাববিহ্বলতা দেখে মুগ্ধ হলেন নরেন ৷ ঠাকুরও তাকে দেখামাত্র তার সুপ্ত প্রতিভা ও আধ্যাত্মিক শক্তির সন্ধান পেলেন ৷ নরেনকে তিনি যথার্থ ত্যাগী বলে সম্বোধন করলেন। নরেনের যুক্তিবাদী মন যথাযথ পরীক্ষা না করে কোন কিছুকে মানতে রাজি ছিল না। তাই ঠাকুরকে তিনি আদর্শ পুরুষ হিসেবে প্রথমে মেনে নিতে পারেন নি।
তবু ঠাকুরের মধুর ব্যবহারের আকর্ষণে নরেন বারবার দক্ষিণেশ্বরে ছুটে যেতেন। ঠাকুরের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন, কখনো অনুরুদ্ধ হয়ে তাঁকে গানও শোনাতেন। তার অন্তরে থাকত ব্যাকুল ঈশ্বর জিজ্ঞাসা। একদিন নরেনের জিজ্ঞাসার উত্তরে ঠাকুর সহজ বে উত্তর দিলেন, ঈশ্বরকে তিনি দেখেছেন, তার সঙ্গে কথা বলেছেন, নরেনকেও তিনি ঈশ্বর দর্শন করাতে পারেন।
নরেন ঠাকুরের আন্তরিক কথাগুলিকে অবশ্য ভাবাবেগের উক্তি বলেই ধরে নিয়েছিলেন। তাঁর সংশয় দূর হতে চায় না। একদিন ঠাকুর নরেনকে স্পর্শ করলেন। সেই ক্ষণিকের স্পর্শ মাত্রই নরেনের অন্তর্জগতে যেন এক আলোড়ন সৃষ্টি হল। অর্ধচেতন অবস্থায় উপলব্ধি করলেন তিনি যেন এক অসীম অনন্তলোকে বিলীন হয়ে যাচ্ছেন। আতঙ্কে তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন, ওগো, তুমি আমার একী করলে, আমার যে বাবা আছেন, মা আছেন— পুনরায় স্পর্শ করে ঠাকুর নরেনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।
সুস্থ হয়ে নরেন ভাবলেন, ঠাকুর এক মস্ত যাদুকর, সম্মোহন করে তাঁর মনের পরিবর্তন ঘটাবার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর থেকে যখনই তিনি দক্ষিণেশ্বরে আসতেন, সর্বদা সতর্ক থাকতেন যাতে ঠাকুর তাঁকে সম্মোহিত করতে না পারেন। এদিকে বি.এ পরীক্ষা দেবার কিছুদিন পরেই নরেনের পিতার মৃত্যু হল। বিশ্বনাথ দত্ত ওকালতি ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন কিন্তু মৃত্যুকালে সংসারের জন্য কোন সঞ্চয়ই রেখে যেতে পারেন নি। ফলে সংসারে নেমে এল বিপর্যয়।
এই অবস্থায় সদ্যবিধবা জননীর অসহায় অবস্থা, ছোট ভাইবোনদের দুঃখ ভরা মুখ দেখে নরেনের অন্তর বেদনায় ভরে উঠত। এই দুঃসময়ে সংসারের অকৃতজ্ঞ মানুষের এক কদর্য রূপ তিনি প্রত্যক্ষ করলেন। শিশু সন্তানদের মুখে অন্ন যোগাবার জন্য মায়ের পরিশ্রম ও কষ্ট দেখে নরেন আর সহ্য করতে পারছিলেন না।
স্বামী বিবেকানন্দ র কর্ম জীবন: Swami Vivekananda’s Work Life
তিনিও পথে নামলেন চাকরির সন্ধানে। এর মধ্যেই তিনি যেতেন দক্ষিণেশ্বরে। তার অন্তরের বেদনা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ঠাকুর। তার একটা কাজের সংস্থান করে দেবার জন্য নানাজনকে তিনি বলতে লাগলেন। ঠাকুরের আশীর্বাদে ও নরেনের চেষ্টায় কিছুদিনের মধ্যেই এটর্নি অফিসে নরেনের একটা চাকরি জুটল। কিছুদিন পরেই তিনি বিদ্যাসাগর মশায়ের মেট্রোপলিটন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেন।
কিন্তু যাঁর কর্মক্ষেত্র বিশ্বমানবের কর্মশালায় সামান্য শিক্ষকতার চাকরি কিংবা সংসার বা অর্থ ইত্যাদির বন্ধনে তিনি আবদ্ধ থাকেন কি করে ? ঠাকুরের প্রতি আকর্ষণ ক্রমশঃই দুর্নিবার হয়ে উঠছিল। ঠাকুরের দর্শন ও সঙ্গ পাবার আশায় তিনি ব্যাকুল হয়ে দক্ষিণেশ্বরে ছুটে আসতেন। ঠাকুরও কথায় কথায় নির্দেশ করতেন বিশ্বমানবের দুঃখ মোচনের জন্যই নরেনের আবির্ভাব হয়েছে — তিনি স্বর্গের সপ্ত ঋষির এক ঋষি।
ইতিমধ্যে ১৮৮৫ খ্রিঃ গলায় ক্যানসার রোগ পড়ল। নে উদ্যোগে ভক্তরা তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এলো কাশীপুরে একটি ভাড়া বাড়িতে। কাশীপুর উদ্যানবাটী নামে যা পরে তীর্থমর্যাদা লাভ করেছে। ঠাকুরের সেবাযত্নের জন্য রইলেন রাখাল, বাবুরাম, শরৎ, শশী, লাটু প্রমুখ ভক্তরা। চাকরি ছেড়ে দিয়ে নরেন এসে মিলিত হলেন ওঁদের সঙ্গে — চিরদিনের মতো আশ্রয় নিলেন ঠাকুরের শ্রীচরণে। গুরুসেবার সঙ্গে সঙ্গে এখানে চলত সাধন ভজন ধ্যান ও শাস্ত্রচর্চা।
ঠাকুরকে ঘিরে উদ্যানবাটী হয়ে উঠল রামকৃষ্ণ ভক্ত – শিষ্যদের আশ্রম। উত্তরকালে যে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ গঠিত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এখানেই তার সূচনা হয়েছিল। রামকৃষ্ণ তার আদর্শ ও উপদেশ জগতে প্রচারের জন্য শিষ্যদের মধ্যে আঠারোজনকে সন্ন্যাস প্রদান করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে নরেন ছিলেন অন্যতম। ঠাকুর তাঁকেই সবচেয়ে ভালবাসতেন। ১৮৮৬ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্ট রামকৃষ্ণ মহাসমাধি লাভ করলেন।
দেহত্যাগের পূর্বে তিনি তার আধ্যাত্মিক শক্তি নরেনকে সমর্পণ করে গিয়েছিলেন যাতে তিনি তার আরব্ধ কর্ম সম্পাদান করতে পারেন। নরেন গুরুর উদার ধর্মভাবনা, সর্বজীবের প্রতি সেবা, সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শকে আত্মস্থ করেছিলেন। ঠাকুরের দেহাবসানের পর এবারে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হল বৃহত্তর ভারতের দিকে। ঠাকুরের সন্ন্যাসী শিষ্যদের থাকবার জন্য এবারে উদ্যানবাটী ছেড়ে দিয়ে বরানগরে একটি বাড়ি ঠিক করা হল। সেখানেই আশ্রয় নিলেন সকলে।
ঠাকুরের অবর্তমানে নরেনই হয়ে উঠলেন সন্ন্যাসী সংঘের প্রধান। তারই পরিচালনায়, সকল দুঃখ কষ্টকে জয় করে সাধনা, ত্যাগ, সহিষ্ণুতা বলে সকলেই হয়ে উঠেছিলেন রামকৃষ্ণের আদর্শ শিষ্য। কাশীপুর এবং বরানগরের আশ্রমজীবন ছিল শক্তি সংগ্রহের কাল। কিছুদিন গুরুর সান্নিধ্যে এবং নিয়মিত ধ্যান তপস্যা, শাস্ত্রপাঠ, আলোচনার মাধ্যমে সন্ন্যাসী ভক্তরা সেই শক্তিই সংগ্রহ করলেন।
এরপর একদিন নরেন তার সতীর্থদের পরামর্শ দিলেন, এবারে ঠাকুরের আদর্শ প্রচারে নামতে হবে — ভারতবর্ষের কোটি কোটি নরনারীর মধ্যে গিয়ে ঠাকুরের কথা শোনাতে হবে। বহুযুগ সঞ্চিত কুসংস্কার ও কুশিক্ষা দূর করে সকলকে আলোকের সন্ধান দিতে হবে। ১৮৮৮ খ্রিঃ নরেন ভারত পরিক্রমায় বহির্গত হলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে তিনি ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালেন।
দেশজুড়ে অশিক্ষা দারিদ্র্য, আর ধর্মের নামে অধর্মের প্রসার প্রতিপত্তি দেখে তিনি বিচলিত ও মর্মাহত হলেন। পরিব্রাজক জীবনে ভারতের সামগ্রিক পরিচয় যেমন প্রত্যক্ষ করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ তেমনি নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজেও ধীরে ধীরে অহংমুক্ত হয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অন্তর থেকে দূর হয়েছিল জাত্যাভিমান, নারী পুরুষে ভেদজ্ঞান। এই পরিব্রাজন কালে নরেন যেখানে গেছেন হিন্দুধর্মের বাণী প্রচার করেছেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ হবার শিক্ষা দিয়েছেন। সর্বত্রই তিনি সাদরে গৃহীত হয়েছেন।
যাঁরা তার সান্নিধ্যে এসেছেন তাঁর অলোকসামান্য ব্যক্তিত্ব, পান্ডিত্য জ্ঞান ও উপলব্ধির গভীরতার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ অভিভূত হয়েছেন। এই সময়েই খেতুরির মহারাজা অজিত সিংহ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরিব্রাজক জীবনে নরেন কোথাও বিদিষানন্দ কোথাও সচ্চিদানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন। খেতুরির মহারাজাই তাঁকে বিবেকানন্দ নাম গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। তখন থেকে স্বামীজি এই নামেই নিজের পরিচয় দিতেন।
সমস্ত ভারত ভ্রমণ শেষ করে ১৮৯২ খ্রিঃ বিবেকানন্দ এসে পৌঁছলেন দক্ষিণ ভারতের কন্যাকুমারিকায়। এখানে সমুদ্রের বুকে ভারত ভূখন্ডের শেষ প্রস্তরখন্ডের ওপরে ধ্যানাসনে বসে তিনি তার প্রিয় মাতৃভূমি ভারতের এক নতুন ছবি যেন দেখতে পেলেন। গভীর বেদনার সঙ্গে তিনি উপলব্ধি করলেন আপামর ভারতবাসীর সর্ববিধ মুক্তির সাধনাই তার প্রকৃত সাধনা। ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলিকে জাগিয়ে তোলার কাজই হবে তার জীবনব্রত। কন্যাকুমারীকা থেকে মাদ্রাজে এলেন বিবেকানন্দ।
এখানকার শিক্ষিত সম্প্রদায় ও ছাত্রসমাজ তার উদার ধর্মালোচনা ও উপদেশ শুনে মুগ্ধ হলেন। তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন তারা। বিবেকানন্দের প্রভাব লক্ষ করে মাদ্রাজ কলেজের খ্রিস্টান অধ্যাপক মুধলিয়র স্থির করলেন এই নবীন হিন্দু সন্ন্যাসীকে তর্কে পরাস্ত করে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করবেন। তার ধারণা ছিল বিজ্ঞান নির্ভর যুক্তির দ্বারা স্বামীজির আধ্যাত্মবাদকে পরাস্ত করে খ্রিস্ট ধর্মের জয় ঘোষণা করা। যথাকালে কিন্তু সবই গেল পাল্টে।
স্বামীজির দিব্যরূপ, শান্ত পবিত্র মুখশ্রী আর তার যুক্তিনিষ্ঠ উপদেশাবলী শুনে মুধলিয়র হয়ে পড়লেন হতভম্ব স্তব্ধবাক। ঈশ্বরের প্রতি গভীর অনুরাগে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। সমস্ত অহংকার চূর্ণ হল তাঁর, তিনি স্বামীজির শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। এই সময়ে আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্ব ধর্মমহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই সংবাদ বিবেকানন্দ কয়েকজন মাদ্রাজী ভক্তের মুখে জানতে পারলেন। তাঁর শিষ্যবর্গ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে স্বামীজি এই সম্মেলনে যোগদান করেন।
সোৎসাহে চাঁদা তুলে ৫০০ টাকা তারা স্বামীজীকে দিয়ে তাঁদের অভিপ্রায়ের কথা নিবেদন করলেন। আকস্মিক এই প্রস্তাবে বিহ্বল হয়ে পড়লেন স্বামীজী। কিন্তু তিনি তাঁর কর্তব্য সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ সচেতন। শিষ্যদের সংগৃহীত সমস্ত অর্থ দরিদ্র সেবায় ব্যয় করার উপদেশ দিয়ে তিনি বললেন, আমি সন্ন্যাসী, সংকল্প করে কোন কাজ করা ঠিক নয়। যদি তা ভগবানের ইচ্ছা হয়; তিনিই উপায় নির্ধারণ করবেন। তোমাদের ব্যস্ত হবার প্রয়োজন নেই। মাদ্রাজ থেকে স্বামীজী এলেন হায়দ্রাবাদে। এখানে বিপুল অভ্যর্থনা পেলেন তিনি।
এখানেও সকলে তাকে অনুরোধ করলেন শিকাগো ধর্মসভায় যোগদানের জন্য। কিন্তু স্বামীজি তখনো পর্যন্ত মনস্থির করে উঠতে পারেননি। তিনি তাঁর অন্তরের আহ্বান শোনার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে রইলেন। এই সময়ে একদিন স্বামীজির ভাব দর্শন হল। তিনি দেখলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ তাঁকে সমুদ্র পার হয়ে বিদেশযাত্রার স্পষ্ট ইঙ্গিত জানালেন। তবুও তার সংশয় দূর হচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত তিনি মাতা সারদা দেবীর কাছে তার বিদেশযাত্রার বিষয়ে মতামত চেয়ে পত্র দিলেন।
স্নেহময়ী মাতা সানন্দে পুত্রকে বিদেশযাত্রায় অনুমতি দিলেন। মায়ের অনুমতিপত্র পেয়ে স্বামীজি নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি বিদেশযাত্রার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে লাগলেন। শিষ্যরাও তার যাত্রার আয়োজন করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে খেতুরির মহারাজার দূত এসে জানাল, স্বামীজির আশীর্বাদে মহারাজার পুত্রসন্তান লাভ হয়েছে। রাজদূত তাকে আমন্ত্রণ করে খেতুরিতে নিয়ে গেল। মহারাজই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্বামীজির আমেরিকা যাত্রার সব ব্যবস্থা করে দিলেন।
তাঁর জন্য রেশমের আলখাল্লা, পাগড়ি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সবই কেনা হলো। জাহাজের একটি প্রথম শ্রেণীর কেবিনও স্বামীজির জন্য রিজার্ভ করা হল। স্বামীজি শিকাগো অভিমুখে যাত্রা করলেন বোম্বাই বন্দর থেকে ১৮৯৩ খ্রিঃ ৩১ শে মে। শিকাগো ধর্ম মহাসভায় উপস্থিত হবার কোন আমন্ত্রণপত্র স্বামীজির ছিল না। ছিল না প্রয়োজনীয় অর্থও। তিনি যখন আমেরিকায় পৌঁছলেন তখন নিতান্তই, একজন অপরিচিত অনাহূত সন্ন্যাসী মাত্র ৷ তখনো ধর্ম সম্মেলনের বেশ কিছুদিন বাকি ছিল।
অজানা দেশে অচেনা পরিবেশে দৈবাৎ বিবেকানন্দের দেখা হয়ে গেল মিঃ জে.এইচ রাইটের সঙ্গে। স্বামীজির ব্যক্তিত্ব ও পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি ধর্মমহাসভার সঙ্গে যুক্ত মিঃ বনিককে এক চিঠি লিখে বিবেকানন্দের হাতে দিলেন। শিকাগো যাওয়ার টিকিটও তিনি কিনে দিলেন। সন্ধ্যা নাগাদ বিবেকানন্দ শিকাগো এসে পৌঁছলেন। আশ্রয়হীন ভারতীয় সন্ন্যাসী প্রবল শীতের রাতটা কাটালেন স্টেশনের মালগুদামের সামনে এক প্যাকিংবাক্সের মধ্যে বসে।
এরপর মিসেস জর্জ ডবলিউ হেইল নামে এক বয়স্ক মহিলা বিবেকানন্দকে ধর্মসভায় যোগদানের ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়তা করলেন। যথাসময়ে বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে ধর্মসভার অন্তর্ভুক্ত হলেন। এর পরই ঘটল ভারতীয় সন্ন্যাসীর আমেরিকা বিজয় তথা বিশ্ববিজয়ের অভূতপূর্ব ঘটনা।
১৮৯৩ খ্রিঃ সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ধর্মসভার প্রথমদিনেই বক্তৃতা দিয়ে অসামান্য স্বীকৃতি লাভ করলেন তিনি। এই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ নিজেই লিখেছেন, যখন আমি আমেরিকাবাসী ভগ্নী ও ভ্রাতৃগণ বলিয়া সভাকে সম্বোধন করিলাম তখন দুই মিনিট ধরিয়া এমন করতালি ধ্বনি হইতে লাগিল যে কান যেন কালা করিয়া দেয়। তারপর আমি বলিতে শুরু করিলাম।……. পরদিন সব খবরের কাগজ বলিতে লাগিল আমার বক্তৃতাই সেইদিন সকলের প্রাণে লাগিয়াছে। সুতরাং তখন সমগ্র আমেরিকা আমাকে জানিতে পারিল।”
এরপর বিবেকানন্দ বোস্টন, ডিট্রয়েট, নিউইয়র্ক, বাল্টিমোর, ওয়াশিংটন, ব্রুকলীন প্রভৃতি শহরে বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তব্য ও ধর্মমতে আকৃষ্ট হয়ে ইংলন্ড ও আমেরিকায় বহু নরনারী বিবেকানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। তাদের মধ্যে মিস মার্গারেট নোবল অন্যতম। পরবর্তীকালে তিনি গুরুর সঙ্গে ভারতবর্ষে এসে ভারতবাসীর কল্যাণেই জীবন উৎসর্গ করেন। তিনিই হলেন ভগিনী নিবেদিতা।
১৮৯৭ খ্রিঃ বিবেকানন্দ দেশে ফিরে আসেন। লাভ করেন বীরোচিত সংবর্ধনা। দেশসেবার কাজে তিনি যুবকদের উদ্দেশ্যে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “ওঠো, জাগো, –লক্ষ্যে পৌঁছবার আগে থেমো না।” ১৮৯৭ খ্রিঃ বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন এবং মিশনের কেন্দ্র হিসেবে বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯৯ খ্রিঃ। মানবসেবাই হল এই মিশনের মূল আদর্শ।
এরপর শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা ও বেদান্ত প্রচারের উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দ বাংলায় উদ্বোধন এবং ইংরাজিতে প্রবুদ্ধ ভারত নামে দুটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। বিবেকানন্দ দ্বিতীয়বার আমেরিকা যান ১৮৯৯ খ্রিঃ। সেখানে বেদান্ত শিক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে দেশে ফিরে তিনি রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, ব্রহ্মচর্যাশ্রম, রামকৃষ্ণ হোম ও রামকৃষ্ণ পাঠশালা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। বিবেকানন্দ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে থেকেও বক্তৃতা ও রচনার মাধ্যমে ভারতের যুবকদের মধ্যে অভূতপূর্ব প্রেরণার সৃষ্টি করেছিলেন।
পরোক্ষভাবে পরাধীন দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁর গভীর প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছিল। বস্তুতঃ বিবেকানন্দ ছিলেন আধুনিক ভারতের অন্যতম স্রষ্ঠা। দেশকে নতুন জাতীয়তা ও মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছেন বিবেকানন্দ। সংস্কার ও আচারের অবরণ মুক্ত করে ভারতাত্মার প্রকৃত স্বরূপকে জাগ্রত করেন। বিশ্বমানবতার অঙ্গনে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বিশ্বের সম্মুখে তিনি উপনিষদের বাণীকেই তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন, “মানুষেরঅন্তরে যে দেবত্ব আছে তাকে জাগিয়ে তোলাট্ মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ ধর্ম।” বাংলা সাহিত্যেও বিবেকানন্দের দান অসামান্য। সরল কথ্যভাষার অন্যতম প্রধান প্রচারক তিনি। অত্যধিক পরিশ্রমে বিবেকানন্দের শরীর ভেঙ্গে পড়েছিল। শেষদিকে তিনি বেশির ভাগ সময়ই ধ্যানমগ্ন থাকতেন।
স্বামী বিবেকানন্দ র রচনা: Written by Swami Vivekananda
ইংরাজি ও বাংলায় বহু গ্রন্থ রচনা করেন বিবেকানন্দ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, পরিব্রাজক, বর্তমান ভারত, ভাববার কথা, প্রাচ্য ও পাশ্চত্য, Karmayoga, Rajayoga, Tnanayoga, Bhaktiyoga প্রভৃতি।
স্বামী বিবেকানন্দ র মৃত্যু: Swami Vivekananda’s Death
১৯০২ খ্রিঃ ১ লা জুলাই রাত ৯ টা ৫০ মিনিটে এই ধ্যানের মধ্যেই তিনি মহাসমাধিতে লীন হন। এই সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৯ বছর ৬ মাস।