তেহরি গাড়োয়াল বাঁধ আন্দোলন – Tehri Dam Uttarakhand

Rate this post

তেহরি গাড়োয়াল বাঁধ আন্দোলন – Tehri Dam Uttarakhand: উত্তরাখন্ডের গাড়োয়াল হিমালয়ে ভাগীরথী নদীর ওপর তেহরি বাঁধটি নির্মান করা হয়েছিল এবং এই তেহরি বাঁধ কে কেন্দ্র করে ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন আন্দোলন বা বিরোধীতা সংঘটিত হয়েছিল। যা তেহরি গাড়োয়াল আন্দোলন নামে পরিচিত। এই তেহরি আন্দোলন প্রমানিত করেছিল যে, ভারতবর্ষে যে কোনো বৃহৎ আকারের পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়নের পূর্বে সঠিক বৈজ্ঞানিক ও আর্থ সামাজিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। রাশিয়ার সহযোগিতায় গড়ে ওঠা এই বিশালাকার বাঁধ প্রকল্পটির বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগনদের দ্বারা ব্যাপক আকারের অহিংস আন্দোলন শুরু হয়। 

তেহরি বাঁধ নির্মানের উদ্দেশ্য

হিমালয়ের দুটি গুরুত্বপূর্ন ভাগীরথী ও ভিলগঙ্গার জলকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হওয়া তেহরি বাঁধটি সম্পূর্ন হল এটি ভারত তথা পৃথিবীর উচ্চতম বাঁধে পরিনত হবে। তেহরি বাঁধের উচ্চতা হবে প্রায় ২৬০.৫ মিটার এবং জলধারণ ক্ষমতা প্রায় ৩.২২ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই জলাধার থেকে প্রায় ২,৭০০,০০০ হেক্টর জমি জলসেচ করা সম্ভব হবে এবং ৩৪৬ মেগা ওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। প্রথম দিকে ১৯৭৮ সালে এই প্রকল্পের জন্য ১৯২ কোটি টাকা ব্যয় হয় এবং ১৯৯৮ সালে সেই খরচ প্রায় ৬০০০ কোটিতে এসে পৌঁছায়। আরো বলা হয় এই প্রকল্প থেকে দিল্লি শহরের প্রয়োজনীয় ৩০০ কিউসেক জলের জোগান দেওয়া হবে। 

তেহরি বাঁধ নির্মানের প্রভাব 

এই বাঁধটির নির্মান বাস্তবায়িত হলে প্রচুর পরিবেশগত ক্ষতি হওয়ায় সম্ভাবনা ছিল। হিমালয়ের নবীন ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে গঠিত হওয়ায় এটি ভূমিকম্প প্রবন অঞ্চলের অন্তর্গত, যার ফলে যেকোন সময় এই বাঁধ ভেঙে পরার আশঙ্কা থেকে যায়। বাঁধ বা জলাধার ভেঙে পড়লে প্রচুর বনভূমি ও কৃষি জমি, এমনকি ঐতিহাসিক শহর তেহরির ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং সেই জলাধারে বসবাসকারী প্রানীর জীবন বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বাঁধ নির্মানের জন্য ভাগীরথী নদী অববাহিকা বরাবর প্রচুর পরিমানে বৃক্ষচ্ছেদনও করা হবে, যা পরিবেশের ক্ষতি সাধন করবে। 

তেহরি গাড়োয়াল আন্দোলনের সূচনা 

তেহরি বাঁধ নির্মানের উপরিক্ত বিরূপ প্রভাব গুলিকে অনুধাবন বা বুঝতে পারার পর পরিবেশবিদদের, এমনকি চিপকো আন্দোলনের নেতা সুন্দরলাল বহুগুনা অগনিত প্রশ্ন ও বিরোধিতা শুরু করেন। যার ফলস্বরূপ বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরেন্দ্র দত্ত সাকলানির নেতৃত্বে তেহরি বাঁধ বিরোধী সংঘর্ষ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। যা প্রায় এক দশক ধরে এই বাঁধ নির্মানের বিরোধিতা করেন। 

তেহরি বাঁধ সম্পর্কীত যে সব বিতর্কিত বিষয় পরিবেশবিদ ও তেহরি বাঁধ বিরোধী সংঘর্ষ সমিতি কর্তৃক উপস্থাপনা করা হয়, সেগুলি হল –

স্থানচ্যুত বা উৎখাত – এই বাঁধটি উত্তরাখণ্ডের ছোট্ট শহর তেহরি ও তার পার্শ্ববর্তী ২৩ টি গ্রামকে নিমজ্জিত করবে। শুধু তাই নয় এই বাঁধ ভাগীরথী নদী তীরবর্তী আরো ৭২ টি গ্রামকে অর্ধ নিমজ্জিত করবে। এই ২৩ টি গ্রামের মধ্যে ২১ টি গ্রামের ৭০ হাজার মানুষ কে বাঁধ নির্মান শুরুর পূর্বেই নতুন ভাবে তৈরি নিউ তেহরি শহরে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু সেখানে তাদের সঠিক ভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি বলে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। 

বাঁধের জীবনকাল – যে সব অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে বাঁধ টি নির্মান করা হচ্ছে সেই সব সুবিধা গুলি কী বাঁধটি তার জীবনকালে পূরন করতে পারবে অর্থাৎ বাঁধটির স্থায়িত্ব কত দিন? এই প্রশ্ন পরিবেশবিদ দের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ন জিজ্ঞাসা হিসাবে উপস্থাপিত হয়। বলা হয়েছিল যে বাঁধটির জীবনকাল প্রায় ৬১.৪ বছরের বেশি নয় কিন্তু বাঁধ টি তার জীবনকালের পঞ্চাশ বছরের মধ্যেও প্রত্যাশিত বা কাঙ্খিত উদ্দেশ্য গুলি পূরন করতে সক্ষম হবে না বলে মনে করা হয় বরং এই সময়ে জলাধারটি পলি দ্বারা পরিপূর্ন হয়ে পড়বে। 

বাঁধের সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রশ্ন – বাঁধটির নিরাপত্তা নিয়েও অনেক প্রশ্নের সূচনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বাঁধটির ভূমিকম্প নিরাপত্তা খতিয়ে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। ভয়ই ছিল তেহরি বাঁধ বিরোধী আন্দোলন উত্থানের অন্যতম কারণ। ১৯৯১ সালে ঊর্ধ্ব ভাগীরথী উপত্যকায় ভূমিকম্পের পর এই প্রশ্ন আরো জোড়াল ভাবে উত্থিত হতে থাকে। 

তেহরি বাঁধ বিরোধী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইস্যু – কিছু কিছু পরিবেশবিদ ও সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা পবিত্র গঙ্গা নদী নিয়ে হিন্দু ধর্মীয় কিছু রীতি নীতি কে কেন্দ্র করে এই বাঁধের বিরোধীতা শুরু করেন। কারণ যেখানে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করা হবে সেই স্থানটি হিন্দু ধর্মে পবিত্র ধর্মীয় স্থান হিসাবে ভূষিত  হয়।

সরকারী পদক্ষেপ 

এই সমস্ত ব্যাপক বিরোধীতার সম্মুখিন হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বাঁধের প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য রায় কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়, যার প্রধান ছিলেন সুনীল কুমার রায়। ১৯৮০ সালের মার্চ রায় কমিটি তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করেন এবং সেখানে তারা পরিবেশগত দিকটি পর্যালোচনা না করার জন্য অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেন। ১৯৯১ সালের ভূমিকম্পের পর বাঁধটি সুরক্ষা নিয়ে আরো প্রশ্নের উত্থান হলে কেন্দ্রীয় সরকার আবার বাঁধটির ভূমিকম্প সংক্রান্ত নিরাপত্তা দেখার জন্য রোরকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ জয় কৃষ্ণ এর নেতৃত্বে পাঁচ জন সদস্যের একটি দল গঠন করেন। পরের সরকার গুলিও কেবলমাত্র বাঁধটির নিরাপত্তা পর্যালোচনার জন্য কেবল বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন, তারা পরিবেশগত ও পুনর্বাসন সম্পর্কীত সমস্যা গুলি সম্পর্কে কোন গুরুত্ব প্রদান করেননি। 

তাই সুন্দরলাল বহুগুনা পরিবেশবিদ দের চাহিদা গুলি পূরন করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপে ফেলতে ১৯৯২, ১৯৯৫ ও ১৯৯৭ সালে অনেক বার অনশনে বসেন। কিন্তু তাদের এই দীর্ঘ বিরোধীতা শেষ পর্যন্ত কোন কাজে আসেনি।

Leave a Comment