ভারতের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল – The Northern Mountains of India

Rate this post

ভারতের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল – The Northern Mountains of India: পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশ বৈচিত্র্যময়। এইদেশে সুউচ্চ ও সুবিস্তৃত বিশাল হিমালয় ও অন্যান্য পর্বতশ্রেণী যেমন দেখা যায়, তেমনই প্রাচীন কেলাসিত শিলা ও লাভা দ্বারা গঠিত মালভূমি, পলি সমৃদ্ধ উর্বর সমভূমি, উপকূলীয় সমভূমি, মরু ও মরু প্রায় অঞ্চল ও দ্বীপ অঞ্চল প্রভৃতি দেখা যায়। প্রকৃতিগত বৈচিত্র অনুযায়ী ভারত কে 7 টি প্রধান ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের ভাগ করা যায়। তার মধ্যে অন্যতম হলো ভারতের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল। ভারতের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল টি হিমালয় পর্বত শ্রেণী, কারাকোরাম পর্বত শ্রেণী, লাদাখ পর্বতশ্রেণী ও উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে গঠিত।

ভারতের জম্বু কাশ্মীরের নাঙ্গা পর্বত থেকে শুরু করে পূর্বে অরুণাচল প্রদেশের নামচাবারওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হিমালয় পর্বতমালা ভারতের উত্তর সীমানা নির্দেশ করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আট হাজার কিলোমিটারের অধিক উঁচু এই নবীন ভঙ্গিল হিমালয় পর্বতমালা the abode of snow নামে পরিচিত। হিমালয় পর্বতমালা ভারতের উত্তর সীমানা বরাবর প্রায় 2500 কিলোমিটার পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। উত্তর দক্ষিণে পর্বতমালা প্রায় 140 থেকে 450 কিলোমিটার প্রশস্ত এবং ভারতের অন্তর্গত হিমালয় পর্বত শ্রেণীর আয়তন প্রায় 5 লক্ষ বর্গ কিমি।

প্রস্থ বরাবর হিমালয় পর্বতের শ্রেণীবিভাগ

হিমালয় চারটি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণী দ্বারা গঠিত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ভূ-আলোড়নের ফলে এই সমান্তরাল পর্বতশ্রেণী গুলি গঠিত হয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে এই পর্বতশ্রেণী গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল। 

A. টেথিস বা তিব্বত হিমালয় 

⬕ হিমালয়ের সর্বাধিক উত্তরাংশের নাম তিব্বত বা টেথিস হিমালয়।

⬕ হিমালয়ের এই অংশে পূর্বে টেথিস সাগর অবস্থান করতো।

⬕ এই হিমালয় পরস্পরের সমান্তরালে অবস্থিত প্রধান চারটি পর্বতশ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত, যেমন – জাস্কার, লাডাক, কৈলাস ও কারাকোরাম।

⬕ উত্তর থেকে দক্ষিণে এই পর্বতশ্রেণী গুলি হল কারাকোরাম, কৈলাস, লাদাখ ও জাস্কার।

⬕ তিব্বত হিমালয়ের গড় উচ্চতা প্রায় 3000 মিটার।

⬕ তিব্বত হিমালয়ের অন্তর্গত প্রধান প্রধান হিমবাহ গুলি হল – কারাকোরাম পর্বতের অন্তর্গত সিয়াচেন (ভারতের দীর্ঘতম হিমবাহ), হিসপার, বিয়াফো, বলটারো।

⬕ ভারতের উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ K2 বা গডউইন অস্টিন এই তিব্বত হিমালয়ে অবস্থিত। যা বর্তমানে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের অন্তর্গত। 

B. হিমাদ্রি হিমালয়

⬕ তিব্বত হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত হিমালয়ের মূল অংশ হল হিমাদ্রি হিমালয়। এটি গ্রেট বা বৃহৎ হিমালয় নামে পরিচিত।

⬕ হিমাদ্রি হিমালয় পূর্ব থেকে পশ্চিমে অবিচ্ছিন্ন ভাবে বিস্তৃত হয়েছে।

⬕ আজ থেকে প্রায় 20-25 মিলিয়ন বছর আগে হিমাদ্রি হিমালয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

⬕ এই হিমালয়ের উচ্চতা প্রায় 6000 মিটার ও চওড়া 120 – 190 কিলোমিটার।

⬕ পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ গুলি হিমালয়ের এই অংশে অবস্থিত। যেমন – মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, ধবলগিরি, নন্দাদেবী, মাকালু, নাঙ্গা পর্বত, অন্নপূর্ণা পর্বত  ও কেদারনাথ পর্বত প্রভৃতি পর্বত শৃঙ্গ। 

⬕ কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত শৃঙ্গ ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত ভারতের উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ ও পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ।

⬕ হিমালয়ের এই অংশে অবস্থিত প্রধান প্রধান গিরিপথ গুলি হল – জম্বু কাশ্মীরের বুর্জিলা, জোজিলা; হিমাচল প্রদেশের বারালাচা লা, শিপকি লা; উত্তরাখণ্ডের থাংলা, নীতি পাস ও সিকিমের নাথুলা পাস।

⬕ হিমাদ্রি হিমালয় মূলত আর কোন যুগের গ্রানাইট ও সিস্ট শিলা দ্বারা গঠিত।

⬕ পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট নেপালে সাগরমাতা ও তিব্বতে চামলা গোমা নামে পরিচিত।

⬕ হিমাদ্রি হিমালয়ের অন্তর্গত যমুনোত্রী ও গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে যথাক্রমে যমুনা নদী ও গঙ্গা নদীর উৎপত্তি ঘটেছে।

⬕ হিমাদ্রি হিমালয় পশ্চিমে নাঙ্গা পর্বতের নিকট ও পূর্বে নামচাবারোয়া পর্বতের নিকট দক্ষিনে বেঁকে গেছে।

C. হিমাচল হিমালয়

⬕ হিমাদ্রি হিমালয়ের দক্ষিণ অবস্থিত হিমালয়ের এই অংশটি মধ্য হিমালয় বা অবহিমালয় নামে পরিচিত।

⬕ হিমাচল হিমালয়ের গড় উচ্চতা প্রায় 3500-4500 মিটার এবং প্রস্থ 60-80 কিমি।

⬕ এই হিমালয়ের অন্তর্গত প্রধান প্রধান পর্বতশ্রেণী গুলি হল – জম্বু কাশ্মীরের পিরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণী, হিমাচল প্রদেশের ধওলাধর পর্বতশ্রেণী, উত্তরাখণ্ডের মুসৌরি পর্বতশ্রেণী ও নেপালের মহাভারত পর্বতশ্রেণী।

⬕ জম্বু ও শ্রীনগর কে জাতীয় সড়কের মাধ্যমে যুক্তকারী বানিহাল গিরিপথ টি হিমাচল হিমালয়ের অন্তর্গত।

⬕ ভারতের কিছু বিখ্যাত Hill resorts, যেমন – সিমলা, মুসৌরি, নৈনিতাল, আড়মোড়া, দার্জিলিং, কুল্লু, মানালি প্রভৃতি এই হিমালয়ে অবস্থিত।

⬕ হিমাচল হিমালয়ের মূলত রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত।

⬕ হিমাচল হিমালয়ের পিরপাঞ্জাল পর্বত শ্রেণী ও হিমাদ্রি হিমালয়কে পৃথক করেছে কাশ্মীর উপত্যকা।

⬕ লাহুল, স্পিটি ও কুল্লু উপত্যকা হিমাদ্রি ও হিমাচল হিমালয়ের মাঝে অবস্থিত।

D. শিবালিক হিমালয়

⬕ হিমালয়ের নবীন তম অংশ হল এই শিবালিক হিমালয়।

⬕ শিবালিক হিমালয় ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন –  জম্বুতে জম্বু হিল, অরুণাচল প্রদেশে এটি মিরি, আবর, মিশমি, উত্তরাঞ্চলে ধ্যং নামে পরিচিত।

⬕ শিবালিক হিমালয়ের গড় উচ্চতা 900-1500 মিটার ও উত্তর দক্ষিণে এর বিস্তৃতি প্রায় 15 থেকে 50 কিমি।

⬕ শিবালিক ও হিমাচল হিমালয়ের মাঝে সমতল তলদেশ বিশিষ্ট যে সব উপত্যকা দেখা যায়, তাদের দুন বলা হয়। যেমন – দেরাদুন, পটলি, কথরী, কাঠমান্ডু, চুম্বি প্রভৃতি।

⬕ এই হিমালয় মূলত বেলেপাথর, কাদাপাথর, কংগলোমারেট, চুনাপাথর দ্বারা গঠিত।

⬕ এই পার্বত্য অঞ্চলটি ঘন ক্রান্তীয় পর্ণমোচি অরণ্য দ্বারা আচ্ছাদিত।

হিমালয়ের বিভিন্ন অংশ পৃথক কারী প্রধান চ্যুতি সীমানা গুলি হল – 

1. হিমাদ্রি হিমালয় ও হিমাচল হিমালয় এর মাঝে রয়েছে – The Main Central Thrust

2. হিমাচল হিমালয় ও শিবা লিক হিমালয়ের মাঝে রয়েছে – The main Boundary Thrust

3. শিবালিক হিমালয় ও বৃহৎ সমভূমির মাঝে অবস্থিত – The Himalayan Front Fault

দৈর্ঘ্য বরাবর হিমালয় এর শ্রেণীবিভাগ

স্যার Sydney Burrard পশ্চিম থেকে পূর্বে বিস্তৃত হিমালয় কে চারটি প্রধান অংশে ভাগ করেন। এই ভাগ গুলি সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হলো।

A. পাঞ্জাব হিমালয় – হিমালয়ের পশ্চিমের অংশটি পাঞ্জাব হিমালয় নামে পরিচিত। পশ্চিমে সিন্ধু নদী থেকে পূর্বে শতদ্রু নদী পর্যন্ত বিস্তৃতি পাঞ্জাব দৈর্ঘ্য প্রায় 560 কিলোমিটার। এই হিমালয়ের একটি বৃহৎ অংশ জম্বু কাশ্মীর ও হিমাচল প্রদেশের বিস্তৃত রয়েছে বলে একে কাশ্মীর হিমালয় ও হিমাচল হিমালয়ও বলা হয়। কারাকোরাম, লাদাখ, পিরপাঞ্জাল, জাস্কার 

এই হিমালয়ের প্রধান প্রধান পর্বতশ্রেণী। হিমালয়ের এই অংশে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথ গুলি হল – বানিহাল, জোজিলা, রোহটাগ, বারা লাচা লা প্রভৃতি। 

B. কুমায়ুন হিমালয় – শতদ্রু নদী থেকে পূর্বে কালী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হিমালয়ের অংশটি কুমায়ুন হিমালয় নামে পরিচিত। পূর্ব-পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য প্রায় 320 কিলোমিটার। কুমায়ুন হিমালয়ের পশ্চিমাংশ টি গাড়োয়াল হিমালয় নামে পরিচিত। এই হিমালয়ের প্রধান প্রধান পর্বত শৃঙ্গ গুলি হল নন্দাদেবী, ত্রিশূল, বদ্রিনাথ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী প্রভৃতি। কুমায়ুন হিমালয় এর অন্তর্গত বিভিন্ন গিরিপথ, যেমন – থাঙ্গলা, মানা পাশ, নীতি পাশ, লেপু লেখ প্রভৃতি।

C. নেপাল হিমালয় – কালি নদী থেকে তিস্তা নদীর মধ্যবর্তী হিমালয় নেপাল হিমালয় নামে পরিচিত। হিমালয়ের বেশিরভাগ অংশ নেপালের অন্তর্ভুক্ত এবং ভারতের সিকিম ও  দার্জিলিং এর খুব সামান্য পরিমাণ অংশ এই হিমালয়ের মধ্যে পরে। নেপাল হিমালয়ের দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি, প্রায় 800 কিলোমিটার। এটি হিমালয়ের সর্বোচ্চ অংশ এবং এখানে হিমালয় উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ গুলি অবস্থিত। যেমন – মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাকালু, ধৌলাগিরি ও অন্নপূর্ণা প্রভৃতি পর্বত শৃঙ্গ। ভারতের সিকিমে অবস্থিত নাথুলা ও জিলিপ লা পাশ সিকিম ও তিব্বত কে যুক্ত করেছে।

D. আসাম হিমালয় – তিস্তা থেকে ব্রহ্মপুত্র নদী পর্যন্ত প্রায় 750 কিমি দীর্ঘ হিমালয়ের এই অংশটি আসাম হিমালয় নামে পরিচিত। মূলত সিকিম, আসাম, অরুণাচল প্রদেশ ও ভুটান হিমালয় এর অন্তর্গত। নেপাল হিমালয়ের প্রধান প্রধান পর্বত শৃঙ্গ গুলি হল নামচাবারওয়া, কুলাকাংড়ি প্রভৃতি। গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথ গুলির মধ্যে অন্যতম হলো বোমডিলা, থাঙ্গা, দিফু, দিবাং, দিহাং প্রভৃতি।

Prof. S.P. Chatterjee ও Prof. R.L. Singh হিমালয় কে পূর্ব – পশ্চিমে তিনটি প্রধান অংশে ভাগ করেছেন। যথা – A) পশ্চিম হিমালয়,  (i. কাশ্মীর হিমালয় ও ii. হিমাচল হিমালয়।), B) মধ্য হিমালয় (i. উত্তরাখণ্ড হিমালয় ও ii. নেপাল হিমালয়), C) পূর্ব হিমালয় (i. আসাম হিমালয় ও ii. পূর্বাঞ্চল হিমালয়।)।

Leave a Comment