সুনামি কি ও সুনামি সৃষ্টির কারণ:
সুনামি বলতে কি বোঝ, সুনামির কারণ প্রভৃতি সুনামি সম্পর্কিত প্রশ্ন গুলি এখানে তুলে ধরা হলো।
জাপানি শব্দ সুনামি (Tsunami) দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, যথা – সু (tsu) অর্থে পোতাশ্রয় ও নামি (nami) অর্থে তরঙ্গ অর্থাৎ সুনামি শব্দের অর্থ হল পোতাশ্রয় তরঙ্গ। সুনামি কে আবার seismic sea wave বা সামুদ্রিক ভূ কম্পীয় তরঙ্গও বলা হয়। সুনামি একপ্রকার শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
সুনামি – সমুদ্রের নিচে প্রবল ভূমিকম্প বা বিধ্বংসী অগ্নুৎপাত জনিত কারণে নির্গত প্রবল শক্তির ফলে সমুদ্রের বিপুল জলরাশি হঠাৎ করে প্রবল বেগে সমুদ্র উপকূলের ওপর বিশাল ঢেউ এর আকারে আছড়ে পড়লে তাকে সুনামি বলে।
পৃথিবীর মোট সুনামির প্রায় 70% প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলীয় অঞ্চলে, 9% ক্যারিবিয়ান সাগরে, 15% ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরে এবং 6% ভারত মহাসাগরের সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় বলয় কে কেন্দ্র করে অবস্থিত আলাস্কা, জাপান, ফিলিপিনস ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলোতে বেশিমাত্রায় সুনামি দেখা যায়।
সুনামির বৈশিষ্ট্য
1. অনেক গুলি ঢেউ বা তরঙ্গের সমন্বয়ে একটি সুনামি গঠিত হয়। যা কয়েক মিনিট থেকে এক ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
2. সুনামি তার উৎপত্তির কেন্দ্র বিন্দু থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কখনো কখনো একটি সুনামি সমগ্র সমুদ্র কে বেষ্টন করে থাকে।
3. সুনামি পূর্বে থেকে অনুমান করা সম্ভব হয় না। যে কোন স্থানে, যে কোন সময়, যে কোন মাত্রার সুনামি সৃষ্টি হতে পারে।
4. পৃথিবীর বেশির ভাগ সুনামি মূলত তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে হয়ে থাকে। কিন্তু সব ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করে না।
5. যেহেতু সুনামি যে কোন সময় যে কোন উপকূলে আঘাত হানতে পারে, তাই উপকূলের মানুষের কাছে সুনামি ভয়াবহতার একটি অন্যতম প্রধান কারণ।
6. সুনামির গতিবেগ সমুদ্র জলের গভীরতার ওপর নির্ভর করে। গভিরসমুদ্রের তুলনায় অগভীর সমুদ্রে সুনামির গতিবেগ বেশি হয়।
7. গভীর সমুদ্রে সুনামির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অনেক টাই বেশি হয় কিন্তু উপকূলের অগভীর সমুদ্রের নিকট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমে গিয়ে তরঙ্গের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। একটি সুনামি তরঙ্গের উচ্চতা কয়েক সেমি থেকে কয়েক মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
সুনামির কারণ – সমুদ্র তলদেশের ভূপ্রকৃতি র হঠাৎ করে বিশাল আকারে বিচ্যুতি ঘটলে যে শক্তি নির্গত হয়, তার জন্য সমুদ্র বক্ষে সুনামি ঘটে থাকে। সমুদ্র তলদেশে প্রচন্ড তীব্রতার ভূমিকম্প সুনামির অন্যতম প্রধান কারণ হলেও ভূমি ধ্বস, অগ্ন্যুৎপাত, উল্কাপাত, আবহাওয়া জনিত কারণ ও পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে র ফলে সুনামি ঘটে থাকে। নিচে কারণ গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
1. ভূমিকম্প – সমুদ্র তলদেশে দুটি পাতের মুখোমুখি সংঘর্ষ জনিত কারণে যে প্রবল তীব্রতার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, তার ফলে যে বিপুল শক্তি নির্গত হয় তা সমুদ্রের বিশাল জলরাশি কে উপরের দিকে ফোয়ারার আকারে উত্থিত করে দেয়, যা বিশাল সুনামির আকারে উপকূলের উপর আছড়ে পড়ে। যেমন – 2004 সালে ভারত মহাসাগরে ভূমিকম্প জনিত কারণে সুনামি সংঘটিত হয়েছিল।
2. ভূমিধ্বস – ভূ ভাগের কোন একটি অংশ যখন জল ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে নিচের দিকে অবনমিত হয়, তখন তাকে ভূমি ধ্বস বলে। এই ভূমি ধ্বসের কারণেও সুনামি ঘটে থাকে। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের বিশাল ভূ ভাগ দ্রুত গতিতে সমুদ্রে পতিত হলে সুনামির সৃষ্টি হয়। ভূমি ধ্বস জনিত কারণে সৃষ্ট সুনামির প্রসার সেই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকে। যেমন – 1998 সালে পাপুয়া নিউ গিনির সুনামি ভূমি ধ্বস জনিত কারনেই সংগঠিত হয়ে ছিল।
3. অগ্ন্যুৎপাত – সমুদ্র তলদেশে হঠাৎ করে অগ্ন্যুৎপাত ঘটলে, তার ফলে সমুদ্রের জলরাশি ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়ে সুনামির সৃষ্টি করে। যেমন। – 1883 সালে ক্রাকাতোয়া আগ্নেয় গিরির অগ্ন্যুৎপাতের দরুন সুনামি সৃষ্টি হয়ে ছিল।
4. উল্কাপাত – বিশাল আকারের কোন মহাজাগতিক বস্তু বা উল্কা সমুদ্রে বক্ষে পতিত হলে তার ফলে প্রবল শক্তি সম্পন্ন সুনামি সৃষ্টি হতে পারে। যদিও এখনও অবধি উল্কাপাত জনিত কারণে এই রকম কোন বড়ো সুনামি সৃষ্টি হয় নি।
5. আবহাওয়া জনিত সুনামি – সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুচাপ জনিত অস্থিরতার কারণে প্রবল বায়ু প্রবাহের সৃষ্টি হলে সমুদ্রে প্রবল তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, যা স্বল্প শক্তি সম্পন্ন সুনামির সৃষ্টি করে।
6. পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ – পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার জন্য অনেক সময় সমুদ্রের মধ্যে প্রবল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যার ফলে যে বিপুল শক্তি নির্গত হয় তা সমুদ্রে সুনামির বিকাশ ঘটায়।