বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতার তারতম্যের কারণগুলি আলোচনা করো: বায়ুমন্ডলের উষ্ণতার প্রধান উৎস হলো সূর্য। বায়ু স্বচ্ছ পদার্থ বলে তা সরাসরি সূর্যালোকে উত্তপ্ত হতে পারে না। সূর্যকিরণ বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূ-পৃষ্ঠে এসে পৌঁছালে প্রথমে কঠিন ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয় এবং তারপর ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়। ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র আবার এই বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা সমান নয়। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন উষ্ণতা পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে বায়ুমন্ডলের উষ্ণতার এই তারতম্যের কারণ গুলি আলোচনা করা হলো-
1)আগত সৌরকিরণ: সূর্য থেকে যে পরিমাণ তাপশক্তি ও আলোক রশ্মি পৃথিবীতে আসে, তাকে আগত সৌর কিরণ বলে। সূর্য থেকে আগত এই সৌরকিরণের 66% বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করে এবং বাকি 34% মহাশূন্যে ফিরে যায়। আগত সৌরকিরণের যে 66% বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করে তাকে, কার্যকরী সৌর বিকিরণ এবং যে 34% মহাশূন্যে ফিরে যায়, তাকে অ্যালবেডো বলে। এইভাবে দিনের বেলায় সূর্যরশ্মি থেকে তাপ গ্রহণ করে ভূপৃষ্ঠ ও ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয় এবং রাত্রিবেলায় তাপ বিকিরণ করে বায়ুমণ্ডল শীতল হয়ে পড়ে।
2)অক্ষাংশের পরিবর্তন: অক্ষাংশের পরিবর্তনের ফলে আগত সৌর কিরণের তারতম্য ঘটে বলে বায়ুমন্ডলের উষ্ণতারও তারতম্য ঘটে। নিরক্ষরেখার উপর সূর্য সারাবছর লম্বভাবে কিরণ দেয় বলে নিরক্ষীয় অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বেশি হয়। এরপর নিরক্ষরেখা থেকে যতই উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর দিকে যাওয়া যায় সূর্যকিরণ ততই তির্যকভাবে পতিত হয় বলে নিরক্ষরেখা থেকে উভয় মেরু অঞ্চলের দিকে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা ক্রমশ কমতে থাকে।
3)উচ্চতার পার্থক্য: সমুদ্র সমতল থেকে যতই উপরে ওঠা যায় বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা ততই কমতে থাকে। সাধারনত সমুদ্র সমতল থেকে প্রতি 1000 মিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা 6.4 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হারে হ্রাস পায়। উচ্চতা অনুসারে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা হ্রাসের এই হারকে উষ্ণতা হ্রাসের স্বাভাবিক হার বলে। এই উষ্ণতা হ্রাসের স্বাভাবিক হারের কারণেভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডল অধিক উত্তপ্ত হয় এবং তারপর যতই উপরে ওঠা যায়( ট্রপোস্ফিয়ারের মধ্যে) বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা তত কমতে থাকে। এই কারণে একই অক্ষাংশে অবস্থিত হওয়া সত্বেও শিলং এর উচ্চতা এলাহবাদের থেকে বেশি বলে এলাহাবাদের উষ্ণতা শিলং এর থেকে বেশি।
4)সমুদ্র থেকে দূরত্ব: গ্রীষ্মকালে স্থলভাগ যতটা উষ্ণ হয় জল ভাগ ততটা উষ্ণ হয়না। আবার শীতকালে স্থলভাগ যতটা শীতল হয় জলভাগ ততটা শীতল হয় না। এই কারণে স্থলভাগের অভ্যন্তরে গ্রীষ্মকালে খুব গরম এবং শীতকালে খুব ঠান্ডা অনুভূত হয়। কিন্তু সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্ম কোনটাই তীব্র আকার ধারণ করে না। যেমন- সুরাট সমুদ্রের তীরে এবং নাগপুর স্থলভাগের অভ্যন্তরে অবস্থিত বলে সুরাটের উষ্ণতা সমভাবাপন্ন এবং নাগপুরে উষ্ণতা চরমভাবাপন্ন।
5)সমুদ্রস্রোতের প্রভাব: সমুদ্র স্রোতের প্রভাবে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে বায়ুমন্ডলের উষ্ণতার পরিবর্তন ঘটে। যে সমুদ্র উপকূলের পাশ দিয়ে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয় সেখানকার বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং যে সমুদ্র উপকূলের পাশ দিয়ে শীতল স্রোত প্রবাহিত হয় সেখানকার বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা হ্রাস পায়।যেমন: উষ্ণ উত্তর আটলান্টিক স্রোতের প্রভাবে লন্ডন শহরে তীব্র শীত অনুভূত হয় না। কিন্তু শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে নিউইয়র্ক শহরে প্রচন্ড ঠান্ডা অনুভূত হয়।
6)বায়ুপ্রবাহ: ভূপৃষ্ঠের যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হয় সেখানকার বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বেশি হয় এবং যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে শীতল বায়ু প্রবাহিত হয় সেখানকার বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা কম হয়। যেমন’উষ্ণ লু বায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং শীতল সাইবেরীয় বায়ুর প্রভাবে শীতকালে চিনদেশের উষ্ণতা হ্রাস পায়।
7)ভূমির ঢাল: ভূমির ঢাল বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা কে বহুলাংশে প্রভাবিত করে। ভূমির ঢাল নিরক্ষরেখার দিকে হলে সূর্যকিরণ লম্বভাবে পড়ে বলে উষ্ণতা বেশি পাওয়া যায়। ফলে বায়ুমন্ডল বেশি উষ্ণ হয়। অপরপক্ষে ভূমির ঢাল নিরক্ষরেখার বিপরীত দিকে হলে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়ে বলে উষ্ণতা কম পাওয়া যায়। ফলে বায়ুমণ্ডল কম হয়। যেমন- হিমালয় পর্বতের দক্ষিণভাগ নিরক্ষরেখার দিকে এবং উত্তরভাগ নিরক্ষরেখার বিপরীত দিকে ঢালু বলে একই উচ্চতায় উত্তর দিকের তুলনায় দক্ষিণদিকের বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বেশি হয়।
8)অন্যান্য কারণ: উপরিলিখিত বিষয়গুলি ছাড়াও ভূপৃষ্ঠের ভূতাত্ত্বিক গঠন, মৃত্তিকার প্রকৃতি, পর্বতের অবস্থান, জলভাগ ও স্থলভাগের বন্টন, মেঘাচ্ছন্নতা, বনভূমির অবস্থান এবং মানুষের কিছু কার্যাবলীও বায়ুমন্ডলের উষ্ণতার তারতম্যের অন্যতম কারণ।