বৈদিক যুগ | Vedic Age

5/5 - (1 vote)

বৈদিক যুগ | Vedic Age : ভারতীয় সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনা বৈদিক সাহিত্য। এই বৈদিক সাহিত্য শুধু ভারতীয় নয় সমগ্র ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীরও সবচেয়ে পুরাতন সাহিত্যসৃষ্টি। এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সংস্কৃত ছাড়াও ইরানীয়, গ্রীক, লাতিন, জার্মানিক, স্লাভিক ভাষায় বৈদিক সাহিত্যের মাধ্যমে প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা তথা আর্যভাষা ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর এক সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে উপস্থিতির কথা জানা যায়। বৈদিক সাহিত্য এই আর্যভাষী জনগোষ্ঠীসৃষ্ট রচনা। বিগত কয়েক শতাব্দীর ভাষাগত গবেষণার ফলে প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর উৎপত্তি ও আদি বাসস্থান সংক্রান্ত নানা বিতর্কের ঝড় উঠেছে। এই বিতর্কের অবসান আজও ঘটেনি। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকালে এই আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ নেই।

ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব, এই চারটি সংহিতা ও তৎসহ এই রচনার অন্তর্গত ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদগুলি নিয়েই বৈদিক সাহিত্য গঠিত। এই সাহিত্য-রচনাগুলি যে সমাজজীবনের ছবি তুলে ধরেছে তাকে বৈদিক যুগের সমাজ বলা হয়। কালসীমার ধারণা করতে গেলে ভাষাগত দিক থেকে বিচার করে আধুনিক গবেষকদের মতামত এই যে, বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনা ঋগ্বেদ আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সম্পাদিত হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য সংহিতা ও সমস্ত ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ সাহিত্য-সম্বলিত উত্তর-বৈদিক বা পরবর্তী-বৈদিক সাহিত্যের রচনাকাল এর পরে, অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে পড়ে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়।

ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর যে শাখা ভারতে আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, বা তারও কিছু পূর্বে, আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ পৌঁছেছিল তারা ইরানের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করেছিল। সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশের পূর্বে তারা কিছুকাল ইরানে বসতি স্থাপন করেছিল। গবেষকদের মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্যভাগ থেকেই বহু ক্ষুদ্র উপজাতি ভারতে প্রবেশ করে। এ ছাড়া, অন্য একদল ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠী খাইবার গিরিপথ ধরে কাবুল উপত্যকায় উপস্থিত হয়। অন্য আর একটি দলও কিছুকাল পরে হিন্দুকুশ পর্বত দিয়ে বালথ্ এলাকায় প্রবেশ করে। বৈদিক আর্যরা এর যে-কোন একটির বা সম্মিলিত শাখার উত্তরসুরি বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করা হয়। ঋগ্বেদে যে সমাজের বিবরণ পাওয়া যা তা মূলত যাযাবর পশুচারণ-ভিত্তিক জীবনের ছবি। ইন্দো-ইউরোপীয়দের বিচরণশীলতার চিত্রটি উপরের আলোচনাতেও প্রমাণিত। এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ ঘোড়ার ব্যবহার জানত এবং সম্ভবত, সর্বপ্রথম বন্য ঘোড়াকে পালনের আওতায় নিয়ে আসে। এ প্রচেষ্টা সর্বপ্রথম সম্ভবপর হয়েছিল পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় এবং এর সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব সহস্রাব্দের কিছু পূর্বে। এই কারণে এবং ভাষাগত দিক থেকে বিচার করে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর আদি বাসভূমি সম্পর্কে গবেষকরা নানা তথ্য ও তত্ত্ব পেশ করেছেন। গবেষকদের মতানুযায়ী ইন্দো-ইউরোপীয়দের আদি বাসভূমি হাঙ্গেরীর নিচু সমতল ভূমিতেই হোক অথবা পূর্বতন সেভিয়েত রাশিয়ার দক্ষিণাংশের তৃণভূমি অঞ্চলেই হোক, পশুচারণই ছিল এদের প্রধান জীবিকা এবং ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশের পরও তা বর্তমান ছিল। এঁরা যাযাবর এবং গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন এবং ইরানীয় পার্বত্য অঞ্চল ধরে পূর্বে অগ্রসর হয়ে একসময়ে, আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, তাঁরা আফগানিস্তানে ও ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশে কিছুকাল বসতি স্থাপন করেন। ঋগ্বেদ-

এর বর্ণনায় এই চিত্রটি পাওয়া যায়। ঋগ্বেদ-এ যে ভৌগোলিক বিবরণ রয়েছে তা থেকে অনুমান করা যায় যে, এই আর্যভাষা ব্যবহারকারী যাযাবর পশুপালক জনগোষ্ঠীগুলি কুমু অর্থাৎ আধুনিক কুররম, কুভা অর্থাৎ আধুনিক কাবুল, রসা ও অনিতভা নামক সিন্ধুনদের পশ্চিম দিকের উপনদী এবং মেহৎনু নদীগুলির অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থান করেছিল। এই নদীগুলি প্রধানত আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। এর পরবর্তীকালে বৈদিক আর্যগণ আরও পূর্বাভিমুখী হয়েছিলেন তার প্রমাণ ঋগ্বেদ-এ মেলে। ঋগ্বেদ-এর অন্তর্গত সবথেকে পরবর্তীকালের রচনা দশম মন্ডলের নদীসূক্তে যে নদীগুলির বিবরণ পাওয়া যায় তা থেকে আর্যদের এই ক্রমশ পূর্বে অগ্রসর হওয়ার চিত্রটি ফুটে ওঠে। পাঞ্জাবের পঞ্চনদের মধ্যে শতদ্রু বা সাটলেজ, পরুক্ষ্মী বা ইরাবতী অর্থাৎ রাভী, অসিক্রী অর্থাৎ চন্দ্রভাগা বা চেনাব, আর্জিকিয়া বা বিপাশা ও সুযোমা বা সিন্ধুর কথাও বলা হয়েছে। বিতস্তা বা ঝিলমেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং একই সঙ্গে গঙ্গা ও যমুনার কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ দশম মণ্ডলের রচনাকালে পঞ্চনদ অঞ্চল থেকে বৈদিক আর্যরা গঙ্গার নিকট অবধি অগ্রসর হয়েছিলেন বা গঙ্গার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।

তবে আফগানিস্তানের নদীর উপত্যকা থেকে প্রথমে বৈদিক আর্যরা সিন্ধু অঞ্চল ও পূর্বে পাঞ্জাবের পঞ্চনদ ও সরস্বতীর পূর্বতন অববাহিকা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তী কালে তাঁরা আরো পূর্বে অগ্রসর হয়ে যমুনা ও গঙ্গার সঙ্গে পরিচিত হন। এই পঞ্চনদ ও সরস্বতী অববাহিকা অঞ্চলে বসতিকালেই স্থায়ী বসবাস ও কৃষির সূচনা হয়েছিল বলে মনে করা যেতে পারে। ঋগ্বেদ-এ সপ্তসিন্ধুর অর্থাৎ সিন্ধু, সরস্বতী ও পাঞ্জাবের পঞ্চনদ অঞ্চলকে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অঞ্চলে প্রথম বৈদিক আর্যগণ দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করেন ও তাঁদের আর্থ-সামাজিক জীবন বিকশিত হয়। যে সময়ে তাঁরা এই পাঞ্জাব ও নিম্নসিন্ধু অঞ্চলে এলেন সে সময় সেই স্থানে প্রাক্-বৈদিক হরপ্পীয়দের উত্তরসূরি কিছু সংস্কৃতির অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। এ ছাড়া, অন্যান্য তাম্র প্রস্তর সংস্কৃতিরও উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এই স্থানে এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। বৈদিক আর্যরা এই সংস্কৃতিগুলির সংস্পর্শে এসেছিলেন। প্রথমত, মহেঞ্জোদারোয় হরপ্পীয় সংস্কৃতির অন্তিম পর্বে আর্যদের আগমন ঘটে থাকতে পারে, এমন অভিমত কোনও কোনও ঐতিহাসিক পোষণ করেন। এ ছাড়া, সামাজিক জীবনের ক্রমবিবর্তনের ধারায় বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য অনার্য সংস্কৃতির আদান-প্রদানের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানরূপে আফগানিস্তানে প্রাপ্ত গান্ধার সমাধি সংস্কৃতি রাজস্থান, হরিয়ানা ও পশ্চিম-উত্তরপ্রদেশে প্রাপ্ত গৈরিক মৃৎপাত্র ও এর সামান্য পরবর্তী কালের চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতিগুলির উপস্থিতি ও পরিচিতি বৈদিক সাহিত্যে উল্লিখিত বর্ণনার সঙ্গে তুলনীয়। প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক এই দুই উপাদানের ভিত্তিতে বলা যায় যে পশ্চিমে সিন্ধুনদ অঞ্চল থেকে পূর্বের শতদূর অববাহিকা অঞ্চল ও উত্তর আফগানিস্তান থেকে দক্ষিণ-রাজস্থানের উত্তরাংশ অবধি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয় ভাগ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে মানব সমাজে পরিবর্তনের দ্বিতীয় স্তর সূচিত হয়। সামাজিক বিবর্তনের যে প্রাথমিক ধারা হরপ্পীয় সভ্যতার বিকাশে লক্ষণীয় হয়েছিল এই নতুন ধারাটি তার থেকে বহুলাংশে পৃথক হলেও হরপ্পীয় সংস্কৃতির সার্বিক প্রভাবে এই নূতন সভ্যতার বিকাশে উপলব্ধ।

গোষ্ঠীবদ্ধতা

মধ্যএশিয়া তথা ইরান থেকে আগত যাযাবর পশুপালক এই আর্যভাষী মানুষেরা গবাদি পশু, মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে দীর্ঘ সময় ধরে একস্থান থেকে আরেক স্থানে নিরন্তর যাতায়াত করতেন। এ সময় বৈদিক আর্যদের সামাজিক পরিচয় পশুধন ও পশুধনের যৌথ অধিকারী এক-একটি গোষ্ঠীর দ্বারা নির্মিত ছিল। ধীরে ধীরে সমাজ স্থিতিশীলতার দিকে অগ্রসর হলে এই গোষ্ঠীগুলি সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে উপজাতীয় স্তরে। ঋগ্বেদ-এ কয়েকটি উপজাতির প্রাধান্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। পুরু, যদু, লুহ্য, তুর্কশ, অনু, ভরত ইত্যাদি উপজাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের চিত্রও পাওয়া যায়। আর্য উপজাতিগুলির মধ্যে কখনো অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কখনো মৈত্রীবন্ধনের উল্লেখও রয়েছে। আর্থ-সামাজিক ক্রমবিকাশের ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলি ক্রমশ পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বৃহত্তর জনজাতিতে পরিণত হয়। রোমিলা থাপার মনে করেন যে এই ধরনের সামাজিক প্রসারের একটি নিদর্শন পাঞ্চাল উপজাতি যা সম্ভবত পাঁচটি গোষ্ঠী-সংবদ্ধ একটি উপজাতীয় সংগঠন।

বৈদিক সমাজের কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল সবথেকে ক্ষুদ্র সামাজিক একক, পরিবার। গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজজীবনে পরিবারের অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। এই পরিবারের অভিভাবক ছিলেন পিতা বা কর্তা। এক-একটি পরিবারের আয়তন ছিল বৃহৎ কারণ দুই-তিন পুরুষ ধরে পরিবারের সদস্যরা যৌথভাবে একই সাথে বসবাস করতেন। এই পরিবারের উদ্ভব কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কৃষির সূচনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এইরূপ একই বৃহদায়তন যৌথ পরিবারের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে গঠিত হয়েছিল এক-একটি কূল। এই কুলের শীর্ষে অধিষ্ঠিত ছিলেন কুলপতি। পরিবারের অভিভাবকরূপে গৃহপতি বা পিতা, সন্তান ও স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব করতেন। সন্তানের সঙ্গে পিতার সুমধুর সম্পর্কের কথা ঋগ্বেদ- এ জানা যায়। তবে এও দেখা যায় যে পিতা একশোটি ভেড়া মারার অপরাধে পুত্রকে অন্ধ করে দিয়েছেন। ঋগ্বেদ-এ রচনার গোড়ার দিকে পরিবার ও কুলগুলি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্মিলিত ছিল এবং গোষ্ঠীগুলি কৌম সংগঠনে রূপায়িত ছিল।

ঋগ্বেদ-এ সাধারণ জীবনের বর্ণময় চিত্র পাওয়া যায়। এই রচনাতে বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত। একদিকে যেমন এতে নিসর্গ সম্ভবন্ধে সূক্ষ্ম বোধ লক্ষ্য করা যায়, অপরদিকে, দৈনন্দিন জীবনের ছবিতে জুয়াড়ির খেদ ও আত্মগ্লানি, যুদ্ধজয়ের আনন্দ, গাভীচুরির বর্ণনা, নববধূর প্রতি আশীর্বাদ ইত্যাদির উল্লেখ থেকে সজীব সমাজের চরিত্র অনুধাবন করা যায়। উপমাগুলি থেকে যে সমাজের কথা জানা যায় তা কঠোর নীতিনিষ্ঠ জীবনের থেকেও একটি স্বতঃস্ফূর্ত, সজীব জীবনীমুখী অস্তিত্বের কথাই বলে।

ঋগ্বেদিক যুগের গোড়ায় ভারতে সদ্য আগত বৈদিক আর্যদের অন্যান্য গোষ্ঠী এবং এমনকী আর্যদের নিজেদের মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরন্তর লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। এরই সাথে চলেছিল নিরন্তর নূতন স্থানে পরিক্রমা ও ধন আহরণের প্রচেষ্টা। ধন বলতে বৈদিক আর্যদের প্রধান সম্ভবল ছিল গবাদি পশু ও ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন ঘোড়া। লুণ্ঠন, যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব জীবনের অঙ্গ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রাগার্য কৃষিচারী উপজাতিগুলির প্রভাবে বৈদিক আর্যরা ক্রমশ পশুপালনের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকর্মে যুক্ত হয়ে পড়ে। এর পর ক্রমশ কৃষি, অর্থনীতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত অর্থনীতি, শ্রেণী ও বর্ণ বিভেদের পটভূমি রচনা করেছিল। পশুপালন অর্থনীতিতে ‘ধন’-এর ধারণা কৃষি-অর্থনীতিতে ‘সম্পদ’- এ পরিণত হয় ও সম্পদকে কেন্দ্র করে পরিবার কুল তথা গোষ্ঠীর পরিচয় ও অধিকার গুরুত্ব লাভ করে। প্রথমে উপজাতিগুলি গণতান্ত্রিক সমবায়িক হলেও ঋগ্বেদের যুগেই ক্রমশ সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল, ‘বিশ’ বা সাধারণ মানুষ ও ‘রাজন্য’বর্গের মধ্যে। ধনী ও নির্ধন, সমাজে ক্ষতাশীল ও সাধারণের মধ্যে বিভেদ-শুধু সম্পদ নয়, জাতি ও পরিস্থিতিগত দিক থেকেও ঘটেছিল। ঋগ্বেদ-এ বর্ণিত হয়েছে ‘দাস’-এর কথা। কোন কোন বর্ণনায় দাসদের কৃষ্ণ-গাত্রবর্ণের বর্ণনা রয়েছে যা থেকে দাসদের কিছু অংশ অনার্য উপজাতির মানুষ বলে মনে করা যেতে পারে। যুদ্ধে বিজিত বা পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে আর্য অথবা অনার্য মানুষও দাসে পরিণত হয়ে থাকতে পারেন। অন্যদিকে অবশ্য দাসগণ ‘পূর’ বা শহরের অধিবাসী এবং ধনশালী বলেও বর্ণিত। লুডভিবগ, জিমার ও মেয়ার এর মতে ঋগ্বেদ-এ বর্ণিত দাস বলতে অনার্য শত্রুদের কথা বলা হয়েছে। হিলেব্রা এর মতে ‘দস্যু’ বা ‘আসুর’ বলতেও ঋগ্বেদে অনার্য উপজাতি গোষ্ঠীগুলির কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু এই অনার্যদের প্রতি বৈদিক আর্যদের ঘৃণার মনোভাবটি বারবার ব্যক্ত হয়েছে। এই আচরণকে সমর্থন করার জন্য স্বভাবতই দৈবী স্বীকৃতি প্রমাণ করার প্রয়াস রয়েছে। ঋগ্বেদ-এ বলা হয়েছে-ইন্দ্রই দাসদের সমাজে নিচু স্থান দিয়েছেন।

সমাজে শ্রেণীবিভাজন

আর্য ও অনার্য উপজাতির মধ্যে বিভেদ ছাড়াও ধনী-নির্ধনের বিভেদের কথা আরো জানা যায় দারিদ্র্যের বর্ণনায়। দারিদ্র্য নিবারণ করবার জন্য ভক্ত দেবতার দ্বারস্থ হচ্ছে এমনও দেখা যায়। বামদেব অভাবে পড়ে কুকুরের নাড়িভুঁড়ি রান্না করে খেয়েছিলেন। গরিব ছুতোর পরিশ্রমে ও ক্লান্ডিতে হাই তুলছে এ বর্ণনাও পাওয়া যায়। জুয়াড়ি সর্বস্বান্ত হয়ে অনুতাপ করছে তাও জানা যায়। চুরির নজিরও বহু পাওয়া যায় ঋগ্বেদ-এ। সুতরাং অভাব ও অভাবজনিত অপরাধ দুইই বর্তমান ছিল। অন্যদিকে ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞাদিতে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবেই স্বচ্ছল ছিল বলে জানা যায়। ধনী ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীপতির বর্ণনাও রয়েছে। এমনকী ধনার্থী বণিকের কথাও বলা হয়েছে যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ধনলাভের জন্য সমুদ্রে গমন করবেন বলে সমুদ্রকে স্তুতি করেন বলে জানা যায়। একদিকে এই শ্রেণীবিভাজন ঘটেছিল, অন্যদিকে ঋগ্বেদ-এরই পুরুষ সূক্তে বর্ণভেদের প্রথম স্পষ্ট বিন্যাস দেখা যায়। এই সুক্তে বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণেরা পুরুষ অথবা ব্রহ্মের মুখ থেকে, রাজন্য বাহু থেকে, বৈশ্য উরু থেকে এবং শূদ্র পা থেকে সৃষ্ট হয়েছিল। ঋগ্বেদ-এর দশম মণ্ডলের রচনাকাল পরবর্তী সময়ের বলে ধরা হয়। তাই এই বর্ণনায়, যে পরিচ্ছন্ন বর্ণ-বিভাজনের ইঙ্গিত রয়েছে তা ঋগ্বেদ-এর গোড়ার যুগে ততটা প্রকট ছিল না বলে মনে করা হয়।

ঋগ্বেদ-এ দেখা যাচ্ছে এক কবির পিতা, উপার্জনক্ষম, অন্যের উপর নির্ভরশীল, তাঁর মাতা ধান পেষাই করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সম্ভবত গোড়ায় জীবিকা বর্ণভিত্তিক এবং বংশানুক্রমিক হয়ে ওঠেনি, তবে ‘দাস’- এর উল্লেখ ঋগ্বেদ-এ বারংবার এসেছে এবং সম্ভবত গাত্রবর্ণের জন্য বর্ণবিভেদের প্রথম সূচনা, বিশেষত প্রথম তিনটি বর্ণের বিন্যাস হয়েছিল। রোমিলা থাপারের মতে বর্ণ-বিভাজন বৈদিক যুগের ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট একটি তাত্ত্বিক কাঠামো-সে যুগে প্রচলিত সমস্ত জীবিকাকেই এক আকৃতির মধ্যে সাজাতে চেয়েছিলেন। এরই মধ্যে যে যে বিভিন্ন ধরনের জীবিকার উদ্ভব স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছিল সেগুলিও মিশ্র-বর্ণরূপে সাজিয়ে পরিবেশিত হল। এই বিভাজন ধীরে ধীরে ঘটে এবং পরবর্তী বৈদিক যুগে শ্রেণীবৈষম্য ও বর্ণবৈষম্য দুইই পরিণতি লাভ করে। দরিদ্র শ্রেণী, অনার্য এবং মিশ্র জাতির মানুষেরা চতুর্থ বর্ণভুক্ত হন। এই শূদ্রদের সঙ্গে সম্ভবত ঋগ্বেদের বর্ণিত ‘দাস’-এরাও যুক্ত হন।

বিবাহ:

একটি প্রতিষ্ঠান ও নারীর ভূমিকা পরিবার ও কুলের সংগঠনকে দৃঢ় করতে বিবাহের প্রতিষ্ঠানটি বৈদিক সমাজে গুরুত্ব পেয়েছে এবং বিবাহের উপযোগিতা সম্পর্কে যথেষ্ট নির্দেশ রয়েছে। তবে অবিবাহিতা নারীর উল্লেখও পাওয়া যা যাঁদের ‘অমার্জ’ ও ‘জরযপ্তি’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বিবাহিত দম্পতি গৃহের কর্তৃত্ব ভোগ করে নিতেন। নারী-পুরুষের বৈবাহিক চুক্তির আভাস সীতা-সাবিত্রী উপাখ্যানে পাওয়া যায়-যিনি সোমকে কতকগুলি চুক্তির পরিবর্তে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছিলেন। উর্বশীও পুরুরাজার সাথে চুক্তিবদ্ধ বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলেন। বিবাহে কন্যাপণের কথা পাওয়া যায়, যেমন উযার ক্ষেত্রে। অন্যদিকে উপমায় দেখা যায়-ইন্দ্র আর অগ্নি ভক্তকে ধন দেন। আবাঞ্ছিত জামাতা, প্রচুর ধন দিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকদের প্রীতিভাজন হতে সচেষ্ট হয়। নারীহরণের উল্লেখও পাওয়া যায় ঋগ্বেদ-এ।

অপ্রাপ্ত-বয়স্ক বা শিশু-বিবাহের কথা ঋগ্বেদ-এ পাওয়া যায় না। নারীর প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তবেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন এবং কন্যা ও বরের পারস্পরিক গুণাগুণ বিবাহের ক্ষেত্রে বিচার্য ছিল। নারী নিজেই জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারতেন। ঋগ্বেদ-এর দশম মন্ডলে বিবাহ সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে তা থেকে অনুমেয় যে বিবাহে বর ও কন্যার পরস্পরের ঈপ্সিত প্রীতিপূর্ণ সংযোগ ঘটাই স্বাভাবিক ছিল। নারী-পুরুষের বিবাহ কাম্য ছিল, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে বিবাহ বাধ্যতামূলক ছিল না। ঋগ্বেদের যুগে প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহের প্রচলিত ধারা এবং অবিবাহিত থাকার রীতি নারীর শিক্ষার সুযোগের ইঙ্গিত বহন করে। বিশ্ববারা, ঘোষা, অপালা ইত্যাদি ঋষিকার উল্লেখ পাওয়া যায়, যাঁরা জ্ঞানে ঋষিপদ অর্জন করেছিলেন। বিশ্ববারা শুধু শ্লোক রচনাই করেননি-ঋত্বিকরূপে যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার অধিকারীও ছিলেন। শিক্ষিতা নারীর মধ্যে প্রকারভেদ ছিল। ছাত্রীরা দু-প্রকারের ছিলেন ব্রহ্মবাদিনী নারীরা শাস্ত্র ও দর্শন চর্চায় রত ছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই শ্লোক রচনা করেছেন। ব্রহ্মবাদিনীদের অনেকেই শাস্ত্র অধ্যাপনার কাজে লিপ্ত ছিলেন এবং ঋগ্বেদে আচার্যা’র উল্লেখও রয়েছে। অন্যদিকে ছিলেন সদ্ব্যোদ্বাহ নারী যাঁরা বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত অধ্যয়নে রত থাকতেন। এ যুগের নারী জনসভায় অংশগ্রহণ করতেন। বিশেষ করে ‘বিদথ’ নামক সভায় পরিবারের প্রাপ্য রসদের অংশটুকু তিনি সংগ্রহ করতেন। এ ছাড়াও, ঋগ্বেদের নারীকে যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। বীরনারী বিষ্পলা যুদ্ধে তাঁর পা হারিয়েছিলেন। মুগলানী ইন্দ্রের তীরের ন্যায় তীব্র গতিতে রথ চালনা করে যুদ্ধে জয় ও ধন আহরণ করেন।

বিবাহিতা নারী গৃহে সম্মানিত ছিলেন। বিবাহিতা স্ত্রী কল্যাণী ও পবিত্র ‘শিবতমা’। তিনি গৃহের সম্রাজ্ঞী। স্বামীর মৃত্যুতে তাঁর সতী হওয়ার কোন নির্দেশ বৈদিক সাহিত্যে নেই। বিধবা নারীর কুল বা জ্ঞাতির মধ্যেই পুনর্বিবাহ হওয়ার রীতি ছিল। ঋগ্বেদ-এর দশম মন্ডলে দেখা যাচ্ছে বিধবা নারী যখন মৃত স্বামীর পাশে শুয়ে আছেন তখন দেবর এসে তাঁকে আহ্বান করবেন মৃতলোক থেকে জীবলোকে। সুতরাং সহমরণ এমনকী কঠোর বৈধব্যযাপন কোনটাই খগ্বৈদিক যুগে প্রচলিত ছিল না। পরবর্তী কালে অথর্ববেদ-এর জীবিত নারীকে মৃতের বধূ হতে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে এবং একটি নারী পতিলোকে যাচ্ছে প্রাচীন রীতি অনুসরণ করে-একথাও বলা হয়েছে। সুতরাং বৈদিক সমাজে নয় সম্ভভবত তারও পূর্বে বর্তমান কোন সমাজের এই রীতি ছিল, বৈদিক সাহিত্যে তারই ছবি রয়েছে। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যেও বিধবা নারীর জীবিতাবস্থা বর্ণিত হয়েছে। অথর্ববেদ-য়েই রয়েছে নারীর দ্বিতীয় বিবাহের কথা। আবার এ কথাও রয়েছে যে, কোন নারীর দশটি পতি থাকলেও ব্রাহ্মণ-পতিই অগ্রাধিকার পাবেন কারণ সে ক্ষেত্রে রাজন্য বা বৈশ্য পতিদের কোন অধিকার থাকে না। এ থেকে নারীর বহুবিবাহ ও সমাজে ব্রাহ্মণ বর্ণের সর্বোচ্চ স্থানাধিকারের কথা জানা যায়। পুরুষের বহুবিবাহের কথাও বৈদিক সাহিত্যে গোড়া থেকেই পাওয়া যায়। নারীর সপত্নী-যন্ত্রণার কথাও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়। তৈত্তিরীয় সংহিতা-তে কোন নারীকে প্রার্থনা করতে দেখা যায় তিনি যেন ইন্দ্রাণীর মতো অবিধবা হন। তবে নারীর বহুবিবাহ সম্ভবত ক্রমশ সমাজে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। সে সম্ভাবনা অথর্ববেদ-য়েই দেখা যায় যখন দ্বিতীয় পুরুষকে লাভ করে তখন সামাজিক এবং শাস্ত্রীয় মতে পঞ্চৌদন অজ দান করলে তাতে কোন অন্যায় হয় না। এই দানের গ্রহীতা স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্মণ এবং ধীরে ধীরে সমাজে নারীর বহুবিবাহ নিয়ম-বহির্ভূত দৃষ্টান্তরূপে তুলে ধরা হয়েছে অথর্ববেদ-এ।

সমাজে নারীর স্থান ও তার অবনমন

ঋগ্বেদ-এ নারী সমাজে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিল পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের নারী সে স্থান থেকে বিচ্যুত। সুকুমারী ভট্টাচার্য পরবর্তী বৈদিক সমাজের জটিলতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন যা অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এই সামাজিক জটিলতার শিকার হলেন নারী ও শূদ বর্ণের মানুষেরা। সম্পদের উপর অধিকার জ্ঞাপনের একটি মাধ্যম হল শ্রমিকের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে তাই বর্ণ-ব্যবস্থা প্রকট হয়েছে। শ্রমজীবি বৈশ্য ও বিশেষত শূদ্রের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রচলন বৃদ্ধি পেলে পারিবারিক পরিধি ক্রমশ সুসংগঠিত হতে থাকল। প্রজননের মাধ্যমরূপে নারীর ভূমিকা চিরকালই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা ও উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি যখন প্রধান হয়ে উঠল, তখন নারীকে পরিবারের সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার প্রয়াস বৃদ্ধি পেল। এ ছাড়া কৃষির প্রসারে বলদ ও লাঙলের ব্যবহার প্রচলিত হওয়ায় শারীরিক কারণে নারী কৃষি উৎপাদন থেকেও অপসারিত হলেন। বস্ত্রবয়ন ছাড়া অন্যান্য উৎপাদনেও নারীর ভূমিকা ক্রমশ গৌণ হয়ে পড়ল। শুধু তাই নয়, পরবর্তী বৈদিক যুগে বহু অনার্য নারী আর্য-পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আর্য সমাজে প্রবেশ করলেন। কিন্তু এই নারীদের আর্য সমাজে যথার্থ স্বীকৃতি ছিল না। এর জন্য সামগ্রিকভাবে সমস্ত নারীর অবমূল্যায়ন ঘটে গেল। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর গতিবিধি, বৈবাহিক ও ব্যক্তিজীবন নিয়ন্ত্রিত হতে থাকল পরিবার ও প্রজননের স্বার্থে। নারীর দ্বিপতিত্ব নিষিদ্ধ হল তৈত্তিরীয় সংহিতা-য়। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-এ কিন্তু পুরুষের বহুবিবাহের প্রথাটি বজায় থাকল। মৈত্রায়ণী সংহিতা-এ মনুর দশটি ও চন্দ্রের সাতাশটি স্ত্রীর উল্লেখ রয়েছে। রাজার বহুপত্নীত্বের কথাও বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে এবং এঁদের নানা নামে অভিহিত করা হয়েছে, যথা- মহিষী, বাবাতা, পরিবৃক্তি ইত্যাদি। নারী এযুগে কুলনারীতে রূপান্তরিত এবং গৃহের বাইরে তাঁর ভূমিকা নগণ্য হয়ে পড়েছিল। বেদ অধ্যয়নের অধিকার তিনি হারিয়েছেন। গার্গী, মৈত্রেয়ী ও শাশ্বতীর মতো বিদুষী নারীর কথা পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া গেলেও তা ব্যতিক্রম মাত্র। শিক্ষিতা নারীর প্রসঙ্গে তৈত্তিরীয় আরণ্যক-এর বক্তব্য যে তাঁরা নারী হয়েও পুরুষ। এই মন্তব্যে নারীর যথার্থ ভূমিকা সম্বন্ধে বৈদিক সমাজের মনোভাব সুস্পষ্ট। কন্যাসন্তান যে জন্মকাল থেকেই পুত্রসন্তানের থেকে আকৃষ্ট বলে গণ্য তা ঋগ্বেদ-এও লক্ষ্য করা যায়। অথর্ববেদ এ এই মনোভাব আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। নানা যজ্ঞানুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে এই সংহিতায় যার মাধ্যমে কন্যাসন্তানের পরিবর্তে পুত্রের জন্ম হবে বলে মনে করা হয়েছে। অবশ্য বৃহদারণ্যক উপনিষদ-এ একটি যজ্ঞের উল্লেখ রয়েছে যা অনুষ্ঠিত হত বিদূষী কন্যাসন্তানের কামনা করে। কিন্তু এটি সামগ্রিক চিত্র নয়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ কন্যাকে অভিশাপ বলে মনে করা হয়েছে। সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে মাটিতে ফেলে রেখে পুত্রকে কোলে তুলে নেওয়ার রীতির বিবরণ পাওয়া যাবে তৈত্তিরীয় সংহিতা-য়। এই চিত্রই নারীর প্রতি পরবর্তী বৈদিকে সমাজের মনোভাব সঠিক নির্দেশ করে। এ যুগে নারীকে পুরুষের ভোগ্যরূপেই দেখা হয়েছে। নারীকে বলপূর্বক দমন করার নির্দেশ রয়েছে শতপথ ব্রাহ্মণ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদ-এ। সর্বগুণান্বিতা শ্রেষ্ঠা নারীও অধমতম পুরুষের থেকে হীন বলে গণ্য ছিলেন।

বর্ণবৈষম্য

এই বৈষম্য-বৃদ্ধির প্রতিফলনস্বরূপ দেখা যায় যজ্ঞানুষ্ঠান থেকে শূদ্রকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সৃষ্ট নিয়মাবলী; শূদ্র অপরের দ্বারা পীড়িত হওয়াই স্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল। শূদ্রকে সহজেই জমি থেকে উৎখাত করা যায় এবং শূদ্রকে হত্যাও খুব ভয়ংকর অপরাধরূপে গণ্য হত না। যাগযজ্ঞাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান সমাজ-জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে পড়ায় ব্রাহ্মণ-পুরোহিত সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেলে বর্ণবৈষম্যও বৃদ্ধি পায় এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি সমাজে শ্রেণী-বৈষম্যের পটভূমি রচনা করে।

যজুর্বেদ-এ বর্ণ-বিভেদের পূর্ণ রূপ বিকশিত। এছাড়া অনার্য-উপজাতিগুলির সঙ্গে বৈদিক আর্যদের বৈবাহিক সংমিশ্রণ বৃদ্ধির ফলে প্রধান চারটি বর্ণ ছাড়াও নূতন বর্ণের সৃষ্টি হয়। নতুন নতুন কর্মভিত্তিক শ্রেণীগুলিও প্রায়শই বর্ণে রূপান্তরিত হয়। বাজসনেয়ী সংহিতা-য় কারিগরী শিল্প ও শিল্পীর তালিকাটি থেকে এর পরিচয় পাওয়া যায়। এতে উল্লেখ রয়েছে যে শিল্পকর্মীদের যাঁরা বর্ণজাতিতে পরিণত হয়েছেন-কৌলাল বা কুমোর, কামার, রজক, চর্মকার, শৈলুষ বা অভিনেতা, গোপালক বা পশুপালক, সূত বা নট, ইত্যাদি। এ থেকে সমাজে বিবিধ জীবিকার রূপটি পাওয়া যায়।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে পরবর্তী বৈদিক যুগে বর্ণবৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে বৈশ্য ও বিশেষত শূদ্র বর্ণের মানুষের অবস্থার অবনতি ঘটেছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণের পারস্পরিক তারতম্য সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সমাজের শীর্ষে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের যুগপৎ অধিষ্ঠানে যে আরো দৃঢ়সংবদ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ রয়েছে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ বলা হয়েছে, “ক্ষত্রিয় জন্মগ্রহণ করলেন, তিনি সমস্ত মানব সমাজের প্রভু, তিনি সর্বসাধারণকে ভোগ করবেন এবং ব্রাহ্মণদের রক্ষা করবেন। সুতরাং বিশ্ অথবা বৈশ্য ও শূদ্রবর্ণের মানুষরা রাজন্যের আনন্দবর্ধন করবেন এ কথা ধরেই নেওয়া হয়েছে। অথর্ববেদ-য়েও দেখা যায়-রাজা “বিশমত্তা”, অর্থাৎ প্রজাগণকে তিনি ভক্ষণ করতে সক্ষম। বিশে’র অন্তর্গত বৈশ্য ও শূদ্রবর্ণ একদিকে এবং রাজন্যবর্গ আরেকদিকে সমাজকে দ্বিস্তরে বিভক্ত করে। ব্রাহ্মণরা এই স্তরীভূত সমাজের আধ্যাত্মিক পরিচালনার ভারই শুধু নেননি, রাজন্যবর্গের ক্ষমতা প্রসারে তত্ত্বের উপস্থাপনা করে রাজনৈতিক গুরুত্বও লাভ করেছিলেন। পরবর্তী বৈদিক যুগের জীবনে পূজা, যাগযজ্ঞের গুরুত্ব ও বাহুল্য বেড়েছিল। এই অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে ব্রাহ্মণ বর্ণের সাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। এছাড়া এ সময়ে রাষ্ট্র ও রাজশক্তির উত্থান এক স্তরীভূত সমাজের সৃষ্টি করে যেখানে, একদিকে ক্ষমতাশীল রাজন্যবর্গ ও ব্রাহ্মণ-পুরোহিত এবং অপরদিকে বিশ্ বা বৈশ্য ও শূদ্রবর্ণের মধ্যের দূরত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

খাদ্যাভ্যাস

সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসের চিত্রও বৈদিক সাহিত্যে বর্তমান। সব্জী, ফল, দুগ্ধ, যবচূর্ণের পিন্ড, দুগ্ধজাত ঘি বা দধি এবং মাংস ঋগ্বেদের যুগেও আর্যদের খাদ্যতালিকার অন্তর্গত ছিল। এছাড়া সোমরস অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হত। সাধারণত উৎসবেই সোমরস পান করা হত এবং সুরা জাতীয় পানীয়র নিত্য সেবনও প্রচলিত ছিল। দৈনন্দিন জীবনে প্রমোদের অনুষঙ্গ ছিল পাশা খেলা, জুয়া খেলা, রথচালনা, মুষ্টিযুদ্ধ ইত্যাদি। নৃত্যগীতাদিও অনুষ্ঠিত হত। অবসর বিনোদনের ক্ষেত্রে সভাগৃহের উল্লেখ করা হয়েছে বারবার। ঋগ্বেদের যুগে নারী-পুরুষের বেশভূষারও বিশেষ পার্থক্য ছিল না। তাঁরা নিম্নাঙ্গে নীবি ও ঊর্ধ্বাঙ্গে বাস পরিধান করতেন। এর উপর অনেকে ঊর্ধ্বাঙ্গে অধিবাসও পরতেন। পোশাকের ক্ষেত্রে বহুলাংশে পশমের ব্যবহারই প্রচলিত ছিল। তবে ঋগ্বেদ-এ কৌষেয় (রেশম) বস্ত্রের কথাও বলা হয়েছে। পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষির প্রসারের ফলে খাদ্যের তালিকা দীর্ঘ হয়। গোধূম ও ধান্য নতুন শস্যরূপে সংযোজিত হল। ফল ও সব্জীর সংখ্যা ও বৈচিত্র্যেরও বৃদ্ধি হয়। মাংসভক্ষণ প্রচলিত ছিল, তবে গোমাংস ভক্ষণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু নির্দেশ দেখা যায়। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ও বাজসনেয়ী সংহিতা-য় দেখা যায় গোহননকারী বা গোঘাতককে গোহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। গোভক্ষণ নিন্দিত হয়েছে শতপথ ব্রাহ্মণ এ এবং গাভীকে ‘অঘ্না’ অর্থাৎ অবধ্য বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে গোভক্ষণ পরবর্তী বৈদিক সমাজে প্রচলিত ছিল ও সোমযাগে বন্ধ্যা গাভী বলি দেওয়ার রীতি ছিল।

বৈদিক যুগের অর্থনীতি

ঋগ্বেদ-এর বিবরণ থেকে অর্থনৈতিক জীবন ও বৃত্তির যে কথা জানা যায় তা প্রধানত পশুপালন-নির্ভর। ঋগ্বেদিক আর্যদের যাযাবর জীবনযাপন ও কৌমগোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের কথা বলা হয়েছে। সাহিত্যে দেখা যায় এই গোষ্ঠীগুলির স্বীকৃত সম্পদ ছিল পালিত পশু, অর্থাৎ প্রধানত অশ্ব, গাভী ও বলদ ইত্যাদি। ঋগ্বেদ-এ দেবতাদের উদ্দেশ্যে রচিত প্রায় অধিকাংশ প্রার্থনায় দেবতাদের কাছে এই পশুধন কামনা করা হয়েছে। গোমাতাকে সুরভীরূপে কল্পনা পশুপালন অর্থনীতিরই পরিচায়ক।

পশুচারণ ও পশুনির্ভর অর্থনীতির গুরুত্ব ঋগ্বেদ-এর শ্লোকে ফুটে ওঠে-“হে সোম। তুমি সুবর্ণ ও ধন, জন বিতরণ করতে করতে ক্ষরিত হও। তুমি গোধন ও খাদ্যদ্রব আনয়ন কর”। ঋগ্বেদ-এর দশম মণ্ডলে গোমাতাকে খাদ্যরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। গোমাতাকে পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে পরবর্তীকালে শতপথ ব্রাহ্মণ-এ। গোসম্পদের গুরুত্ব গোষ্ঠী সংগঠনের নামকরণ থেকেই বোঝা যায়। ঋগ্বেদিক যুগের জীবনযাত্রায় গোসম্পদই মূলধন যা আহরণ করার জন্য লুণ্ঠন ও যুদ্ধ প্রত্যহ জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়েছিল।

যা কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় ও জীবনধারণের আধার তাকেই ঋগ্বেদিক আর্যগণ তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারের কেন্দ্রবস্তুতে রূপান্তরিত করতেন। পশুসম্পদ বৈদিক ধর্মীয় বিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে পড়েছিল। বৈদিক আর্যরা প্রথমে পূষণ ও পরে রুদ্রকে গোসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দেবতারূপে কল্পনা করেছেন। পুষা বা পূষন, আদিত্য অথবা সূর্যেরই আদি রূপকল্প; পূষণকে ‘অঘৃণি’ অর্থাৎ ‘জ্বলন্ত’ বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। সুদীর্ঘ তৃণে আচ্ছন্ন দূর্গভূমিতে পথভ্রষ্ট গোসম্পদের পুনরুদ্ধার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই দুরূহ কাজে পূষণ অর্থাৎ সূর্যের কিরণ পথ আলোকিত করবে। ঋগ্বেদ-এর ষষ্ঠ মণ্ডলে পূষণ-দেবতাকে হারানো গোসম্পদ পুনরুদ্ধার করার জন্যে আবাহন করা হয়েছে। এমনকী, একশ্রেণীর বিশেষ গোপালকের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে যাঁরা পশু পুনরুদ্ধার করার কাজে পারদর্শী ছিলেন। পশুচারণের জন্য বিশেষ পারদর্শিতার প্রয়োজন ছিল। সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতে পূষণের কল্পনা প্রাকৃবৈদিক পশুপালনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি রথের পরিবর্তে ছাগবাহন, তাঁর চুল বেণীবদ্ধ, ‘করম্ভ’ অর্থাৎ যবচূর্ণমিশ্র তাঁর খাদ্য। এতে মনে হয় যে, ভারতবর্ষে উপনীত হওয়ার পথে আর্যরা খুব সম্ভবত মোঙ্গোলিয়ার মধ্যে দিয়ে যখন এসেছিলেন। সেই সময় মোঙ্গোলিয় আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যভ্যাসযুক্ত বিশিষ্ট কোনো দেবতার কল্পনা তাঁরা পথে সংগ্রহ করেছিলেন। “…. কালক্রমে তিনি পথিক মানুষ ও বিচরণশীল পশুর পথপ্রদর্শক দেবতার ভূমিকাও গ্রহণ করেন….”।

গোধন ছাড়া অন্য যে পশুটি বৈদিক আর্যদের জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তা হল অশ্ব। ভারতীয় উপমহাদেশে অশ্বের প্রচলন সম্ভবত বৈদিক আর্যরাই প্রথম করেছিলেন। ঘোড়ার ব্যবহার বৈদিক সভ্যতাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন বলশালী এই পশুটি তার ব্যবহারকারী মানুষকে দিয়েছিল গতি ও শক্তি যা আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা দুই ক্ষেত্রেই বিপুল সহায়তা করেছে। এ ছাড়া, গোচারণ বা গো-আহরণের কাজেও ঘোড়ার ব্যবহার সুবিধা দিয়েছিল। বৈদিক সভ্যতায় অশ্বের গুরুত্ব আর্যদের অনুষ্ঠিত নানা যাগযজ্ঞে ও মন্ত্রপাঠে প্রতিফলিত হয়েছে। অশ্বমেধ যজ্ঞ বৈদিক ধর্মের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অনুষ্ঠান। রাজনৈতিক বিজয়লাভের প্রতীকী ঘোষণার জন্য এই যজ্ঞে রাজপ্রতিভূরূপে অশ্বের ব্যবহার এই কথাই নির্দেশ করে, অশ্বকে পশুদের মধ্যে ক্ষত্রিয় বলে মনে করা হয়েছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এর সফল ব্যবহার আর্যদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। অশ্বের উপস্থিতির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনরূপে অস্থি পাওয়া গেছে ইরান ও আফগানিস্তানে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশে ও বেলুচিস্তানের পিরাকে এবং গান্ধার সমাধি সংস্কৃতিতে পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকায় এবং গুজরাটের সুরকোটাডাতে অস্থি ও অন্যান্য উপকরণ পাওয়া গেছে যা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের কিছু পরে প্রাপ্ত। হরপ্পীয় সভ্যতার পরবর্তী স্তরেও অশ্বের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, রূপার ও লোথালে। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে অশ্বের নিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি বৈদিক সাহিত্যে গোড়া থেকেই লক্ষ্য করা যায় এবং চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র- সংস্কৃতির প্রত্নক্ষেত্র হস্তিনাপুর, অত্রজ্ঞিখেড়া, ভগবানপুরা ইত্যাদি স্থানে অশ্বের উপস্থিতি বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে এই সংস্কৃতির সম্পর্কের সম্ভাবনা তুলে ধরে।

গাভী ও অশ্ব ছাড়া অন্যান্য যে সব পালিত পসুর প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক নিদর্শন মেলে তা হল, অজা অর্থাৎ ছাগল, অবি বা ভেড়া, অশ্বেতর বা গাধা ইত্যাদি। হরপ্পীয় পশুপালন অর্থনীতিতেও গাভী ও এই পশুদের বহুল ব্যবহার ছিল। পূর্বের অর্থনীতিতে গোসম্পদ ভোগের ক্ষেত্রে গোভক্ষণ অশুদ্ধ ছিল না। বরং তৈত্তিরীয় সংহিতা র একটি অংশে এই ধারণা প্রকাশিত হয়েছে যে বৈশ্যদের মতোই গবাদি পশুও প্রজাপতির দ্বারা সৃষ্ট এবং তাদের ভক্ষণ করা স্বাভাবিক, কারণ খাদ্য হিসাবে ক্ষুধানিবৃত্তির জন্যই তাদের প্রজাপতি সৃষ্টি করেছেন। এই কারণেই তারা সংখ্যায় এত গরিষ্ঠ। এই সংহিতারই অপর অংশে দেখা যাচ্ছে যে নবচন্দ্রিকার দিনে মিত্র এবং বরুণের আবাহনে গাভী বলি দেওয়া হচ্ছে। সোমযজ্ঞেও মিত্র ও বরুণের পূজায় বন্ধ্যা গাভী বলি দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে পূর্ববর্তী বৈদিক জীবনযাত্রায় গোভক্ষণ একটি প্রাত্যহিক ও স্বাভাবিক রীতি ছিল। কিন্তু অর্থনীতির বিকাশ ও পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, কৃষির বিকাশের সঙ্গে গবাদিপশু খাদ্য ছাড়াও কৃষিকর্মে বিকল্প ব্যবহার হতে শুরু হল। শুধু তাই নয় বিকল্প খাদ্যও এই কৃষিই মানুষের জীবনে এনে দিল। ফলে ধীরে ধীরে গোভক্ষণ একটি বিরুদ্ধচারণে পরিণত হল, গোধন অবধ্য বলে নির্দেশিত হয়। গোধন বর্ণিত হয় অঘ্না বলে; যদিও গোভক্ষণের রীতিটি সম্ভবত তখনো চালু ছিল।

কৃষির প্রসার

কৃষির সূচনায় ইঙ্গিত ঋগ্বেদ-য়েই পাওয়া যায়। ঋগ্বেদ-এ বর্ণিত নদী ও তার অববাহিকা থেকে খোদিত প্রণালীকে গাভীমাতা ও গোবৎসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। প্রাণদাত্রী নদী ও তার প্রণালী কৃষিক্ষেত্রের নিকটে প্রবাহিত হয়ে ক্ষেত্রে জল প্রদান করে। কর্ষিত জমিকে ক্ষেত্র বলা হয়েছে। স্থান-বিশেষে জমির স্তরভাগ করা হয়েছে, যথা উর্বরা ও অর্তন। ফসল প্রধানত দু’বার ফলানো হত সারা বৎসরে। সাধারণত যব ও ধান্য এই দুই শস্যের কথা ঋগ্বেদ-এ পাওয়া যায়। পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাহ্মণে গোধূম, প্রিয়ঙ্গ, মুক্ত, মাষ, মসুর ইত্যাদি শস্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।

বৈদিক সাহিত্যে অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় তা সামগ্রিকভাবে একটি জনজাতির ভৌগোলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত। এই পরিবর্তন ধাপে ধাপে সাধিত। ঋগ্বেদ-এ যে কৃষি, যব শস্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তা পরবর্তীকালে বহুলাকার ধারণ করেছে। মনে রাখতে হবে যে বৈদিক আর্যদের মধ্যে কৃষির বিকাশে ঋগ্বেদিক যুগের সমসাময়িক, পরবর্তী হরপ্পা সংস্কৃতি ও অন্যান্য তাম্রপ্রস্তর সংস্কৃতিগুলির ভূমিকা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ শতকে উত্তর ভারতের রাজস্থানে গৈরিক বর্ণ-মৃৎপাত্র ব্যবহারকারী সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাম্রভাণ্ডারগুলির চিহ্নও স্থানে স্থানে পাওয়া গেছে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সঙ্গে ঋগ্বেদিক সংস্কৃতি জড়িত বলেও কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন। সুতরাং কৃষি-অর্থনীতি বা কারিগরী শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রেও সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার অবদান অনস্বীকার্য। বৈদিক সভ্যতা দ্বীপের মতো নির্জনে, বিচ্ছিন্ন ধারায় বৃদ্ধি পায়নি। হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী ধারা ও অন্যান্য তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতিগুলি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়া থেকেই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও গুজরাটের কিছু অঞ্চলে বর্তমান ছিল। এদের মধ্যে নগরসভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি ক্ষীণ হয়ে পড়লেও জীবনধারণের প্রধান উপজীবিকাগুলি বজায় ছিল। এই জনগোষ্ঠীগুলি ধান, গম, যব, মসুর, কলাই, তুলা ও তৈলবীজের চাষ করতেন। মুরগী, ছাগল, ভেড়া, গবাদিপশু ইত্যাদিও পালন করতেন। এদের মধ্যে মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, বয়নশিল্প, দারুশিল্পও প্রচলিত ছিল। এই সমস্ত জীবিকা ও বৃত্তিগুলি বৈদিক সমাজেও প্রচলিত হল। তবে হস্তশিল্পর ক্ষেত্রে ধাতুর ব্যবহার বৈদিক আর্যরা সম্ভবত ভারতে আসার পূর্বেও করেছেন।

ঋগ্বেদ-এ যবের উল্লেখ বারংবার করা হয়েছে। এযুগের প্রধান শস্য ছিল যব। ‘ধান্য’ শব্দটিও পাওয়া যায়। সম্ভবত এ সময়ে ‘ধান্য’ শব্দটি সাধারণভাবে খাদ্যশস্য বোঝাতেই ব্যবহৃত হত। পরবর্তী কালে অবশ্য ধানা ও গোধূম, দুটি পৃথক খাদ্যশস্যের উল্লেখ রয়েছে। ঋগ্বেদ-এ ‘কৃষি’, ‘কর্ষক’, বা ‘কৃষ্টি’ শব্দগুলি পাওয়া যায়। কৃষককে বলা হত কৃষ্টি এবং স্বাভাবিকভাবেই কৃষিজীবি মানুষ সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এই শব্দটি সমগ্র জনসমষ্টি সম্পর্কে প্রয়োগ করা হত। শব্দের এই প্রয়োগ বিশ্লেষণ করলে বৈদিক সমাজে প্রধান জীবিকারূপে কৃষির বিকাশ ও সম্প্রসারণের চিত্রটি পরিস্ফুট। ভারতীয় উপমহাদেশে আগমনের পরে যে অঞ্চলটিকে কেন্দ্র করে বৈদিক সভ্যতার সর্বপ্রথম উন্মেষ ঘটে, তা নির্ধারণ করা যায় ঋগ্বেদ-এ উল্লিখিত নদীগুলির বিবরণ থেকে। কুম বা কুরুম, কুভা বা কাবুল, সিন্ধু, মেইনু ইত্যাদি নদীগুলি আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এর সঙ্গে উল্লেখ রয়েছে গোমতী বা গোমাল, সরস্বতী, বিতস্তা (ঝিলম), বিপাশা (বিয়স), অসিক্সী (চন্দ্রাভাগা বা চেনাব), পরুক্ষ্মী বা ইরাবতী (রাভি) ও শতদ্রু (সাটলেজ) নদীর। এই নদীগুলি পাকিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, কাশ্মীর ও পাঞ্জাব রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। সুতরাং বৈদিক আর্যরা যে ধীরে ধীরে ঋগ্বেদিক যুগেই পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন তা প্রমাণিত। কিন্তু গঙ্গা বা যমুনার কথা শুধু একবারই ঋগ্বেদ-এর প্রক্ষিপ্ত দশম মণ্ডলে উল্লিখিত। ঋগ্বেদিক আর্যদের জীবনযাত্রা সম্ভভবত পাকিস্তানের সিন্ধু নদী ও তার অন্যান্য উল্লিখিত উপনদীগুলির অববাহিকা অঞ্চলে অর্থাৎ আফগানিস্তান, পশ্চিম পাঞ্জাব, পূর্ব পাঞ্জাব এবং কাশ্মীরে সীমাবদ্ধ ছিল।

কৃষির দিক থেকে দেখা যায় যে এই নদীমাতৃক অঞ্চল পূর্বের অধ্যুষিত ইরান ও পশ্চিম আফগানিস্তান অঞ্চলের থেকে অনেক বেশি সম্ভাবনাময় ও সুজলা। এরই সঙ্গে এই অঞ্চলে অবস্থিত পরবর্তী হরপ্পীয় ও অন্যান্য তাম্র- প্রস্তর সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বৈদিক আর্যরা নতুন নতুন শস্য ও উন্নত কৃষিপদ্ধতির সাথে পরিচিত হয়। ঋগ্বেদ- এর প্রথম মণ্ডলে আমরা লাঙলের ব্যবহার ও শস্য রোপণের উল্লেখ পাচ্ছি। ভৌগোলিক দিক থেকে এই অঞ্চলগুলি প্রধানত যব, খেসারি ও শণ চাষের উপযুক্ত। ঋগ্বেদের গোড়ার দিকে তাই যবের ব্যবহার প্রচলিত ছিল, কিন্তু কৃষিকর্মে গোড়া থেকেই আর্যরা সরাসরি যুক্ত ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। যাযাবর পশুচারক এই আদি আর্যদের কৃষিকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাটা সম্ভবপর নয়। কিন্তু ঋগ্বেদ-এর রচনার কাল যদি আমরা খ্রিঃপূঃ ১৫০০ থেকে খ্রিঃপূঃ ১২০০ বলে ধরে নিই তবে এই প্রায় তিনশো বছরের শেষের দিকে তাঁদের কৃষিকর্মে প্রবেশ ও অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এই পদ্ধতিতে তাঁরা প্রাগার্য ও সমকালীন অন্যান্য কৃষিনির্ভর সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বলে ধরে নেওয়া ভুল হবে না। ঋগ্বেদ-এর একটি শ্লোকে সম্ভবত কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় অরণ্য পরিষ্কার করে ভূমিসংস্কারের উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে দেবতারা স্বধিতি হস্তে (কুঠার) সঙ্গী পরিবৃত হয়ে কাঠ কাটতে কাটতে অগ্রসর হচ্ছেন। সেই কাঠ অগ্নিতে নিক্ষেপিত হচ্ছে। গ্রিফিথ তাঁর অনুবাদে এই স্তবকে কৃষি সম্প্রসারণের ইঙ্গিত বলে লক্ষ্য করেছেন এবং লুডত্ত্বিও এই শ্লোকে কৃষির বিকাশ বর্ণিত হচ্ছে বলে মনে করেন এ কথা গ্রিফিথ উল্লেখ করছেন।

পশুপালন

ঋথৈদিক ধর্মে দেবগণের মধ্যে অশ্বিনীকুমারদ্বয় একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছিলেন। এঁরা গবাদি পশুর সংরক্ষণ ও কৃষিকার্যের হিতসাধন করেন বলে বৈদিক আর্যদের বিশ্বাস। অশ্বিনীদ্বয় যব রোপণ করে ও লাঙ্গলে অধিষ্ঠিত হয়ে জনসাধারণের জন্য খাদ্য উৎপাদন করে প্রশংসিত হয়েছেন। ইন্দ্রেরও আরাধনা হয়েছে কৃষিকাজে মঙ্গলসাধনের জন্য। ইন্দ্রকে লাঙ্গলের সিরার উপর অধিষ্ঠান করার জন্য আবাহন করা হয়েছে। পূষণের প্রতি প্রার্থনা করা হয়েছে যাতে তিনি লাঙ্গলের সিরাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। কৃষিক্ষেত্রকে ব্যক্তিবিশেষরূপে কল্পনা করা হয়েছে এবং সাংবাৎসরিক ভাবে কৃষিক্ষেত্রের জল নিষ্কাশনের রীতিও বর্ণিত হয়েছে। ঋগ্বেদ-এর প্রথম ও অষ্টম মণ্ডলে ষণ্ড-চালিত লাঙ্গলের দ্বারা ক্ষেত্র কর্ষণের চিত্রটি পাওয়া যায়। এই লাঙ্গলের ফলা গোড়ার দিক উদুম্বর বা ডুমুর এবং খরিদ বা খয়েরের মতো কঠিন কাষ্ঠনির্মিত। লোহার প্রচলন তখনো হয়নি। লাঙ্গল, সিরা, কর্ষিত রেখা বা সীতা ইত্যাদির পূজা ও ব্যক্তি-কল্পনা ঋগ্বেদ-এর বহু অংশে বর্ণিত হয়েছে। সুণী বা কান্তে দিয়ে শস্য কাটার কথাও রয়েছে। কৃষিকর্মের সঙ্গে জড়িত বহু ধর্মীয় রীতি, অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসের সূচনা ঋগ্বেদ- এ পাওয়া যায় যা থেকে ক্রমশ কৃষির প্রসারণের ছবি ফুটে ওঠে।

উৎপাদন-প্রযুক্তি ও শস্যসম্ভভার

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কৃষিক্ষেত্রে লাঙলের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শতপথ ব্রাহ্মণ-এ খদির কাষ্ঠ নির্মিত লাঙ্গলকে অস্থির ন্যায় কঠিন বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। লাঙলের সিরাটি একটি দণ্ড বা ঈষার সঙ্গে যুক্ত এবং তার সঙ্গে একটি যুপ সংযুক্ত থাকত যা ষণ্ড-পৃষ্ঠে ন্যস্ত হত। সেই সময় সম্ভবত বহুসংখ্যক ষণ্ডের ব্যবহার হত লাঙল দ্বারা ক্ষেত্র কর্ষণের জন্য। অথর্ববেদ-এর বর্ণনায় চার, ছয়, আট, বারো-এমনকী, চব্বিশটি পর্যন্ত ষণ্ড যুত লাঙলের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে যা বাস্তবে সম্ভবপর ছিল না বলেই মনে করা যায়, তবে দুটি বা চারটি যন্ডের ব্যবহার হওয়া সম্ভব এবং এই লাঙল নিশ্চয় অত্যন্ত ভারী ও মজবুত ছিল। লাঙল নির্মাণে খরিদ বা উদুম্বর (খয়ের এবং ডুমুর) কাষ্ঠের ব্যবহার প্রচলিত ছিল বলে জানা গেলেও পরবর্তীকালে লাঙলের সিরাটি ধাতু নির্মিত ছিল, যাকে পবিরবৎ বা সুতীক্ষ্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ-য়েও লাঙলের ফলায় ধাতুর ব্যবহার উল্লিখিত হয়েছে। রামশরণ শর্মা মনে করেন, পরবর্তী বৈদিক যুগে লাঙলের ফলায় লোহার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সারের ব্যবহারেরও উল্লেখ পাওয়া যায়-‘সকৃৎ’ বা গোময় এবং ‘করীষ’ বা শুদ্ধ গোময়।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বৈদিক আর্যদের পূর্ব-অভিমুখী অভিযানের কথা রয়েছে। সপ্তসিন্ধু অঞ্চল থেকে বৈদিক আর্যরা এই সময়ে শতদ্রু ও গঙ্গা-বিভাজিত অঞ্চল ছাড়িয়ে আরও পূর্বে গঙ্গা ও যমুনার অববাহিকা ধরে অগ্রসর হয়েছিলেন। এই অভিযানের পিছনে কৃষি-অর্থনীতির বিকাশ ও প্রসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ, গাঙ্গেয় সমভূমি সুজলা ও নদীতীরবর্তী অঞ্চল অত্যন্ত সুফলা। কিন্তু নদী থেকে দূরবর্তী অঞ্চলগুলি গভীর শিকড়বিশিষ্ট বৃক্ষ সমৃদ্ধ হওয়ায় চাষের জন্য উপযোগী ছিল না। এই ঘন মৌসুমী অরণ্যকে কৃষিক্ষেত্র প্রস্তুত করতে প্রয়োজন ছিল লোহার ব্যবহার। পরবর্তী বৈদিক যুগে, অন্ততপক্ষে খ্রিঃপূঃ সপ্তম শতাব্দীর আগে সাধারণ জীবনে ও কৃষিকর্মে লোহার নিত্যপ্রচলন শুরু হয়নি। সুতরাং বিদেঘ মাধব তাঁর পুরোহিত গৌতম রাহুগণের সঙ্গে সরস্বতী নদীর তীর থেকে পূর্ব অভিমুখে যে অগ্রসর হয়েছিলেন সদানীরা নদীর তীর অবধি, তা সম্ভব হয়েছিল বৃক্ষরাজিতে অগ্নি নিক্ষেপ করে। বন পুড়িয়ে কৃষির জন্য পরিসর ক্ষেত্র প্রস্তুত করার রীতিটি রপ্ত হয়েছিল। এই বন কেটে এবং পুড়িয়ে চাষের উপযোগী ক্ষেত্র প্রস্তুত করা ‘ঝুম’ চাষের পদ্ধতিটি খুবই প্রাচীন এবং পূর্ব হিমালয়ের প্রাগৈতিহাসিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রীতি প্রচলিত ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। সুতরাং শতপথ ব্রাহ্মণ- এ বৈদিক আর্যদের কৃষি সম্প্রসারণের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল।

পরবর্তী বৈদিক যুগে শস্যতালিকাও দীর্ঘায়িত হল। যব ও তিল এবং সম্ভবত ধানের সঙ্গে যুক্ত হল গোধূম যা পূর্বে উল্লিখিত ছিল না। এ ছাড়া, মাষ কলাই, মুদ্‌গ, খল্ব ইত্যাদি ডাল জাতীয় শস্য কৃষির আওতায় এল। প্রিয়ঙ্গু নামে একপ্রকার শস্যেরও নাম পাওয়া যায় যা সম্ভবত অত্যন্ত ক্ষুদ্র দানা বিশিষ্ট কোন জাতের বাজরা। ইক্ষুর ফলন ও ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় অথর্ববেদ-এ। যব ও ধান্যর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শস্যের চাষ হতে দেখা যায়। গোভিধূক নামে একপ্রকার যবের কথা বলা হচ্ছে যা গবাদি পশুর খাদ্যের জন্য উত্তম বলে বর্ণিত। উপবক ও ইন্দ্রযব নামে আরও দুই প্রকার যবের উল্লেখ রয়েছে।

ধানের মধ্যেও প্রকারভেদ হল। ‘কৃষ্ণব্রীহি’ ও ‘শুরুব্রীহি’, অর্থাৎ যার বর্ণ কৃষ্ণাভ তা কৃষাব্রীহি এবং বর্ণ শুক্ল হলে শুরুব্রীহি। ‘হয়েন’ ধান সম্পূর্ণ এক বছর লাগত পাকতে। ‘নিবার’ ধান নিচু জলাভূমি অঞ্চলে ভাল ফলত। মহাব্রীহিকে ব্রীহির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বা ‘সম্রাট’ বলা হচ্ছে। এ ছাড়াও, বিভিন্ন জাতির ডাল, সব্জী ও তৈলবীজের উল্লেখ, প্রকারান্তরে একটি মিশ্র কৃষিব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়। সুতরাং দেখা যায় পরবর্তী বৈদিক যুগে বিভিন্ন সময়ের উপযোগী, বিভিন্ন রকম চাহিচদার যোগান দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জাতের শস্যের নির্বাচন, বাছাই ও ফলন ঘটেছে। অর্থাৎ একটি সুপরিকল্পিত কৃষিব্যবস্থার বিকাশ ঘটছে। এক্ষেত্রে সেচব্যবস্থার বিকাশও লক্ষ্য করা যায়। ‘রোধ’ অর্থাৎ বাঁধের ব্যবহার সম্ভবত কৃষিক্ষেত্র সিঞ্চনের জন্য নদীর খাতে তৈরি করা হত।

সকল প্রকার কৃত্রিম সেচব্যবস্থাকেই ‘খনিত্রী’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে, যেমন কুয়ো, হ্রদ, নালা ইত্যাদি। হ্রদ বেসান্ত, বেসান্তি বিভিন্ন আয়তনের জলাধার বা জলাশয় যা ক্ষেত্রসিঞ্চনে ব্যবহৃত হত। অথর্ববেদ-এ বলা হয়েছে কৃত্রিম নালা বা ‘কুল্য’র কথা, যা জলাশয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকত। এই ‘কুল্য’গুলি কৃষিক্ষেত্রে জল সঞ্চারের কাজে লাগত। বন ও জলাভূমি সংস্কারের কথা আগেই দেখা গেছে। ধাতু-নির্মিত লাঙলের ব্যবহার ও কৃত্রিম সেচব্যবস্থার সূচনা এবং একই সঙ্গে বহু উপজাতির শস্যের ফলন কৃষি-অর্থনীতির অগ্রসরকে চিহ্নিত করে।

কৃষির সঙ্গে সঙ্গে জীবিকারূপে হস্তশিল্পের উল্লেখও ঋগ্বৈদিক যুগ থেকেই পাওয়া যায়। পশম ও কৌষেয় বস্ত্র ও পরে সুতি বস্ত্র বুননের বিবরণ বৈদিক সাহিত্যে বারবার পাওয়া যায়। মৃৎপাত্র, দারুনির্মিত আসবাব ও পরিবহন, বংশনির্মিত বস্তু, তেল, চর্মজাত দ্রব্য, সুরা ও ধাতব যন্ত্রপাতি এবং হাতিয়ারের উল্লেখ বৈদিক সমাজে ক্রমবর্ধমান হস্তশিল্পের চিত্র তুলে ধরে। ঋগ্বেদ-য়েই এর সূচনা দেখা যায়। ঋভুগণকে সুচারু কারুশিল্পীরূপে প্রশংসা করা হয়েছে। ভূগুগণ প্রশংসাধন্য ছিলেন রথনির্মাণে দক্ষতার জন্য। ভেড়ার পশম দ্বারা প্রস্তুত বস্ত্র বুননের কথাও জানা যায়। বস্ত্র প্রস্তুতকারক ‘বায়’ বলে অভিহিত হতেন। তবে বস্ত্র বুননের ক্ষেত্রে মহিলা শিল্পীর কথাই বেশি বলা হয়েছে। দারুশিল্পের কথাও পাওয়া যায় ঋগ্বেদ-এ। তত্ত্ব বা তক্ষকারগণ কাষ্ঠনির্মিত রথ, ঢাকা, নৌকা ও পাত্র প্রস্তুত করতেন। রথকার ও তক্ষকারগণ বৈদিক সমাজে যথেষ্ট মর্যাদা পেতেন। তাঁরা রত্নিন-রূপে নব অভিষিক্ত রাজার দ্বারা সমাদৃত হতেন।

শিল্প প্রয়াস

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে শিল্পের তালিকা শস্যের মতোই আরও দীর্ঘ হল। রাজসনেয়ী সংহিতা-এ একটি সম্পৃক্ত তালিকা পাওয়া যায় যা হস্তশিল্প সম্প্রসারণের পরিচায়ক। এতে কৌলাল বা মৃৎশিল্পী, কর্মার বা ধাতুশিল্পী, মনিকার, ইষকার (তীর নির্মাণ), ধনুকার রজ্জুকার (দড়ি নির্মাতা), জ্যাকার (ধনুকের ছিলা প্রস্তুতকারী), সুরাকার, বাস, পঙ্গুলী বা রজক, রঞ্জয়িত্রী (কাপড় রঙ করে যে নারী), চৰ্ম্মন্ন (চর্মকার), হিরণকার (স্বর্ণকার) ইত্যাদি হস্তশিল্পী বা কারিগর ও কারিগরী বৃত্তির কথা বলা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, এই সময়কার যে সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে, বিশেষত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও পশ্চিম-উত্তরপ্রদেশে, তা এ ধরনের হস্তশিল্প বিকাশেরই পরিচায়ক, অর্থাৎ উত্তর ভারতে সমসাময়িক প্রায় সব সংস্কৃতির সমাজের এই ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছিল-বৈদিক সভ্যতায় পৃথকভাবে কিছুর উদ্ভাবন ঘটেনি। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল লোহার প্রথম উদ্ভব, বিকাশ ও লোহা ব্যবহারের প্রসার। সংস্কৃত ভাষায় লোহার প্রতিশব্দ ‘অয়স’। ঋগ্বেদ-এ যদিও ‘অয়স’ শব্দটি প্রথম পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু এই ‘অয়স’ ধাতু বলতে যা ব্যবহৃত হত তাকেই বোঝাত, পৃথকভাবে লোহাকে নয়। লোহার ব্যবহার খ্রিঃপূঃ ১৫০০ শতাব্দীতে সূচিত হয়নি। সর্বপ্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনরূপে লোহা পাওয়া যায় খ্রিঃ পূঃ ১০০০ শতাব্দীতে- রাজস্থানের তাম্র প্রস্তর সংস্কৃতির অহর-এ এবং চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির নোহ্-তে। এছাড়া, কর্ণাটকের হাল্লুর-এও লোহার ব্যবহার সূচিত হয়েছিল। এরই সঙ্গে পরবর্তী সাহিত্যে দেখা যায় পৃথকভাবে ধাতুর নামকরণ- লোহিত বা তামা, কৃষ্ণায়স বা শ্যামায়স (লোহা), হিরণ্য বা স্বর্ণ, রজত বা রূপা, কাংস বা কাঁসা, ত্রপু বা টিন ও সীসা-অর্থাৎ বিভিন্ন ধাতুর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত ধাতুসংকর পদ্ধতিও শুরু হয়েছিল। ইতিপূর্বে লোহা ছাড়া অন্যান্য ধাতুর মিশ্রণ সংঘটিত হয়েছে হরপ্পীয় সভ্যতার কারিগরদের হাতে। লোহা অন্যান্য ধাতুর সাথে সংযুক্ত হলে জীবনে এক নতুন মাত্রা এল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে তার নিদর্শন পাওয়া যায়। অথর্ববেদ ও রাজসনেয়ী সংহিতা-এ নিশ্চিতরূপে লোহার ব্যবহার চিহ্নিত করা যায়। লোহা কৃষ্ণায়স বা শ্যামায়স নামে সুচিত হল। শতপথ ব্রাহ্মণ-এ বলা হয়েছে যে অশ্বমেধ যজ্ঞে বধ্য অশ্বটি ছাড়া অন্যান্য সমস্ত পশু লোহার অস্ত্রে বলি দেওয়া হত। অর্থাৎ যেহেতু লোহা সাধারণ কৃষকের ব্যবহৃত ধাতু তাই অশ্বমেধের অশ্বটি, যা রাজশক্তির প্রতিভূ, তাকে লোহার অস্ত্রে বধ করা যাবে না। এই উল্লেখ থেকে দুটি ধারণা স্পষ্ট যে শতপথ ব্রাহ্মণ-এর রচনাকালে কৃষিকর্মে লোহার ব্যবহার প্রচলিত হয়েছে এবং সাধারণ কৃষক অন্যান্য ধাতব ও প্রস্তর নির্মিত হাতিয়ারের সঙ্গে সঙ্গে লোহার ব্যবহার করতে শুরু করেছে। লোহার আবিষ্কার ও ব্যবহার যে পরবর্তী বৈদিক শিল্প তথা সমগ্র অর্থনীতিকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল তা অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরাই স্বীকার করেন। লোহা ব্যবহারের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বিশেষ করে পরবর্তী উত্তর ভারতের উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্রে পাওয়া গেছে যা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে লোহার ব্যাপকতর প্রচলন নির্দিষ্ট করে।

বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি

ঋগ্বেদ-এ বাণিজ্যের উল্লেখ রয়েছে, যদিও এই জীবিকাটি সম্পর্কে গোড়ায় বৈদিক আর্যদের অনুদার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। এই সংহিতায় ‘পণি’দের উল্লেখ রয়েছে যাঁদের বাণিজ্যে পারদর্শী ও চতুর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সম্ভবত এই পণিরা অনার্য জাতির লোক ছিলেন। এঁরা কৃষ্ণবর্ণ, খর্বদেহ, খর্বনাসা, স্থূলভাষী বলে বর্ণিত। ঋগ্বেদিক আর্যরা সর্বদাই এঁদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার শংকায় ভুগতেন। বৈদিক আর্যরা পণিদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। দেবতাদের উদ্দেশে প্রার্থনা করা হয়েছে ঋগ্বেদ-এ, যাতে পণিরা ধ্বংস হয়। বাণিজ্যের প্রতি এই ঘৃণার মনোভাব অবশ্য পরে অপসারিত হয়েছিল। ঋগ্বেদ-য়েই তার প্রমাণ রয়েছে। সামগ্রী বিনিময়ের মূল্যরূপে শুল্কর উল্লেখ রয়েছে। ইন্দ্রের কাষ্ঠনির্মিত মূর্তি বিক্রয়ের কথা জানা যায়। ঋগ্বেদ-এ হিরণ্যচূর্ণ থলিতে মাটির জালায় ভরে রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া, সুবর্ণপিণ্ড বা হিরণ্যপিণ্ড জমা করার কথাও রয়েছে। ‘নিষ্ক’ শব্দটি সম্ভবত এই হিরণ্যপিণ্ডগুলিকেই বোঝাত। তবে বিনিময়ের মূল্য হিসাবে সুবর্ণ-খণ্ডের ব্যবহার এ যুগের বৈদিক আর্যরা জানতেন না। চলাচলের জন্য যণ্ডবাহী ‘অনস’ অর্থাৎ শকটের কথাও বলা হয়েছে। তবে ঋগ্বেদ-এ বাণিজ্যের যে উল্লেখ রয়েছে তা প্রধানত ‘পণি’ ও ‘অসুর’দের সম্বন্ধে। এই ‘পণি’ বা ‘অসুর’গণ অনার্য হরপ্পীয় সভ্যতার পরবর্তী সংস্কৃতির মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই এই সংস্কৃতিগুলিতে পূর্বের হরপ্পীয়দের ন্যায় না হলেও অন্তত কিছু পরিমাণ বাণিজ্যিক কার্যকলাপ অব্যাহত ছিল। কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের বিনিময়ে স্থলপথে এবং জলপথে, পূর্বের তুলনায় সীমিতভাবে চালিত ছিল। পণিদের দুঃসাহসিক অভিযান, অর্থলোভ ও বাণিজ্যিক চাতুর্য সম্ভবন্ধে ঋগ্বেদ-য়ের বিবরণ উন্নত অনার্য উপজাতিগুলির বাণিজ্যিক পারদর্শিতাই নির্দেশ করে।

বাণিজ্যপথ

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘বণিজ’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। যজুর্বেদ-এ বণিজ কথাটি স্পষ্টভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বণিক্ এবং ‘বাণিজ’ অর্থাৎ বণিকের পুত্ররূপে। এই বণিকেরা আর্য বর্ণভিত্তিক সমাজের অংশ বলে বর্ণিত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে-বাণিজ্য জীবিকাটি বৈদিক সমাজের অঙ্গ হয়ে পড়ছে এবং বণিকগোষ্ঠী একটি বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত হচ্ছেন। এঁরা বৈশ্যবর্ণের অংশরূপে পরিচিতি পেলেন। স্থলপথ ও জলপথ দু’ভাবেই বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। পূর্বের হরপ্পীয় সভ্যতার যুগে যে সব বাণিজ্য চালিত ছিল সেগুলি ছাড়াও পূর্ব অভিমুখী নানা নতুন পথে পণ্য চলাচল শুরু হল। ‘পথিকৃৎ’ কথাটি ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদ-এ পাওয়া যায় যা নতুন পথের দিশারীকে চিহ্নিত করে। স্থলপথে বাণিজ্য গোচালিত শকটেই বেশি হত। ঋগ্বেদ-এ জলপথে বাণিজ্যেরও উল্লেখ রয়েছে, অবশ্য এক্ষেত্রে ‘পণি’দের কথাই বলা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণে অনার্য হরপ্পীয়দের উত্তরসূরি ‘পণি’রা পূর্বের হরপ্পীয়দের মতো না হলেও আংশিকভাবে অন্তত জলপথে বাণিজ্যের ধারাটি বজায় রেখেছিল। তবে এই জলপথ ‘সমুদ্র’ ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ বর্তমান। সমসাময়িক কালের নৌ-ব্যবস্থায় সমুদ্র-বাণিজ্যের সম্ভাবনাটি ক্ষীণ। অবশ্য পরবর্তী বৈদিক যুগে সমুদ্র-উপকূল ধরে নৌবাণিজ্য সূচিত হয়েছিল বলে ধরা যেতে পারে।

বিনিময় ও মুদ্রার ব্যবহার

বিনিময়-প্রথার ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের পরিমাপ করার প্রচলন ঋগ্বেদিক যুগেই শুরু হয়েছিল। গোড়ার দিকে সামগ্রিকভাবে পণ্য-বিনিময় থেকে ধীরে ধীরে প্রথমে গোধন ও পরে ধান্য পরিমাপ হিসাবে নির্ধারিত হয়েছিল। পণ্য-বিনিময়ের মূল্য ‘শুল্ক’ বলে অভিহিত হল এবং গোধনকে মূল্য বা শুল্করূপে স্থির করল। পরে কৃষি-অর্থনীতির সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে শস্য শুল্করূপে গোধনের স্থান অধিকার করল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে অবশ্য কয়েকটি শব্দ ও তার বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায় যে, এ সময়ে সম্ভবত ধাতব মুদ্রাও শুল্ক বা বিনিময়ের মাধ্যমরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। কোন কোন ঐতিহাসিক ‘নিষ্ক’, ‘কৃষ্ণল’ বা শতমান শব্দগুলিকে মূল্যনির্ধারক ধাতবখণ্ডরূপে গণ্য করেন এবং কোনও কোনও ঐতিহাসিক ‘কাল’ বা শতমান একেকটি পরিমাপের মুদ্রা ছিল বলে মনে করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য শতমান একটি বিশেষ তৌলরীতির মুদ্রারূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে বৈদিক যুগে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার সম্বন্ধে সন্দেহ থাকলেও অর্থনীতিতে যে অগ্রগতি দেখা দিয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে বিনিময় প্রথায় বিশেষ পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল বলে মনে করা যায়। যার ফলে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি মুদ্রার প্রচলন নিঃসন্দেহে নজরে আসে।

সম্পদের মালিকানা

কৃষি ও শিল্প উৎপাদন এবং বাণিজ্যের প্রসারের ফলে পরবর্তী বৈদিক সমাজের রূপান্তর ঘটে। পূর্ববর্তী কৌমগোষ্ঠী ও যৌথ মালিকানার সংগঠনগুলি ধীরে ধীরে তাদের গুরুত্ব হারায়। সমাজে সম্পদ ও বিশেষত উদ্বৃত্তের উদ্ভবের ফলে সামাজিক শ্রেণী-বৈষম্যের সূচনা হয়। সমাজের আধ্যাত্মিক জীবনের অভিভাবক ব্রাহ্মণ-পুরোহিতগণ ও রাজন্যগণ এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় সব থেকে বেশি লাভবান হন। এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ, ধনোৎপাদক বৈশ্য ও শূদ্রবর্ণের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে একে অপরকে সহায়তা করেন। এর ফলে উদ্বৃত্ত সম্পদ সংগ্রহ করার মাধ্যমরূপে কর ব্যবস্থার প্রচলন হয়। কর ব্যবস্থার তাত্ত্বিক দিকটি ব্রাহ্মণদের দ্বারা সৃষ্ট। পূর্বের কৌমসমাজে দলপতি বা রাজাকে সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় ‘বলি’ বা তাঁদের আহরিত বা লুণ্ঠিত ধনের একাংশ উপঢৌকন দিতেন। কিন্তু উদ্বৃত্ত সম্পদ বৃদ্ধি ও সমাজে ধর্মীয় প্রভাব ও রাজশক্তির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে রাজাকে দেয় বলি বাধ্যতামূলক হয়ে উঠল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রাজা বলিহুৎ, অর্থাৎ বলি-আহরণকারী ব্যক্তি বলে অভিহিত হলেন। এ ছাড়া, ‘ভাগ ও শুল্ক’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে সম্পদের মালিকানা সম্বন্ধে নির্দিষ্ট কিছু আলোচনা পাওয়া যায়। শতপথ ব্রাহ্মণ- এ জমির মালিকানা সম্ভবন্ধে বলা হয়েছে-ক্ষত্রিয় বা রাজা যদি কৌমের সর্বসম্মতিক্রমে কোন ব্যক্তিকে জমির অধিকার দেন তবেই জমির উপর স্বত্ব প্রমাণিত হয়। বৈদিক সাহিত্যের উপাদান থেকে ভি. এ. স্মিথ, ই. ডব্লিউ, হপকিন্স, জি. ব্যুলর প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এ যুগে জমির উপর রাজার মালিকানাই প্রচলিত ছিল। তবে অন্যদিকে জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার উপস্থিতিও বৈদিক সাহিত্যে প্রমাণিত। ঋগ্বেদ-এ এর উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া, ক্ষেত্রপতি এবং ক্ষেত্রপত্নী অর্থে জমির মালিক ও তার স্ত্রীকেই নির্দেশ করা হয়েছে। তবে কৃষিজাত দ্রব্যের উপর রাজাধিকার বৃদ্ধি পেয়েছিল পরবর্তী বৈদিক সমাজে এবং এর প্রতিফলন ঘটেছিল প্রশাসনিক সংগঠনে। রাজস্ব সংগ্রহের জন্য বিশেষ কর্মচারীপদ সৃষ্ট হয়েছিল-‘সংগ্রহীত্ব’। ‘রত্নিন’রূপে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে এই রাজকর্মচারীর উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী বৈদিক সমাজে লক্ষণীয় এই পরিবর্তনে উত্তর ভারতে এক সামগ্রিক পরিবর্তনের সূচনা লক্ষ্য করা যায়, যার ফলে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি গাঙ্গেয় উপত্যকায় ঐতিহাসিক নগরায়ণের উদ্ভব ঘটে।

বৈদিক যুগের রাজনৈতিক সংগঠন

বৈদিক অর্থনীতি, কৃষি বা শিল্পে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সুচনা, সম্পত্তিগত ধারণার জন্ম দেয়। ধন ও ধনোৎপাদনের সঙ্গে ধন নিয়ন্ত্রণের নিবিড় সম্পর্ক। ধন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমরূপে রাজনৈতিক শক্তির প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংগঠনের বিকাশ পূর্বে অর্থাৎ হরপ্পীয় যুগে ঘটে থাকলেও সর্বপ্রথম এর সাহিত্যিক নিদর্শন বৈদিক সাহিত্য থেকেই মেলে। রাজনীতির মতো কৃত্রিম একটি সংগঠন সাহিত্যিক উপাদানের ভিত্তিতেই একমাত্র সম্যকরূপে উপলব্ধ হয়। সুতরাং বৈদিক যুগের রাষ্ট্র বা রাজনীতিগত ভাবনা ভারতে এ বিষয়ে সর্বপ্রথম চিন্তাধারারূপে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয়। ঋগ্বেদ-এ বিভিন্ন ‘গোষ্ঠী’র উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া ‘কুল’, ‘বিশ’, ‘জন’, ‘গণ’ ইত্যাদি শব্দগুলির প্রত্যেকটিই একটি সমাজভিত্তিক সংগঠনকে নির্দিষ্ট করে যা রাজনৈতিক সংগঠনের পূর্বসূরিরূপে গণ্য হতে পারে। ঋগ্বেদ-এ বর্ণিত যাযাবর জীবনযাত্রায় গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের কথা রয়েছে যা কতকগুলি উপজাতীয় স্তরে সংগঠিত হয়েছিল। রোমিলা থাপার ঋগ্বেদ-এ বর্ণিত শক্তিশালী দাশরাজ্ঞের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পুরু, দ্রুহ্য, অনু, তুর্কশ এবং যদু ইত্যাদি প্রধান উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলি দাশরাজরূপে অভিহিত হয়েছেন। অপর শক্তিশালী গোষ্ঠীভুক্ত ভরতগণ এঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ঋগ্বেদ-এ আর্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের উল্লেখ বারংবার এসেছে। তবে অপরদিকে আর্য এবং অনার্য উপজাতিগুলির মধ্যেও নিরন্তর সংগ্রাম চলছিল ঋগ্বেদ- য়ের যুগে। এই পারস্পরিক সংগ্রামের প্রধান কারণ গোধন সংরক্ষণ ও আহরণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। ঋগ্বেদ- য়ের প্রথম ও ষষ্ঠ মন্ডলে রাজা বা গোষ্ঠীপ্রদানের বর্ণনা রয়েছে। গোধন দখলকারী দলপতিরূপে গোধন আহরণের জনাই যে প্রধানত যুদ্ধ সংঘটিত করত সেই চিত্রটিও উজ্জ্বল। গোধন কাঙ্ক্ষিত বস্তু ও লুণ্ঠনের উপযোগী। ঋগ্বেদ- এ যুদ্ধের সমার্থক ‘গবিষ্টি’ শব্দটি এই দিকেরই ইঙ্গিত করে। ঋগ্বেদ-য়ের শাসকের অভিধা নরপতি, মহীপতি বা ভূপতি কোনওটিই না, তিনি ‘গোপতি’ (গবাদি পশুর অধিকর্তা) বলে আখ্যাত। ‘গবিষ্টি’ যে বীরের নেতৃত্বে চালিত, তিনি ইন্দ্ররূপে ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত। ঋগ্বেদ-এর নবম মণ্ডলে সোমের প্রতি প্রার্থনা করা হয়েছে “হে সোম, তুমি শোধিত হয়ে ইন্দ্রের সাথে একরথে আরোহণপূর্বক বিস্তর গাভী আনয়ন কর”। সোম রাত্রির পথপ্রদর্শক। তিনি পশুধন লুণ্ঠনের উপযুক্ত সহায়ক হবেন। ইন্দ্র বা নেতৃস্থানীয় যোদ্ধাকে তিনি সাহায্য করবেন। ধন আহরণ ও আত্মরক্ষায় নেতৃত্বদান করে দলপতি যোদ্ধা রাজনৈতিক সংগঠনে প্রথম অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠলেন। গৃহের বা পরিবারের অভিভাবক গৃহপতি থেকে কুলের নেতৃত্বে কুলপ বা কুলপতি ও গোষ্ঠীর স্তরে গোষ্ঠীপতির উত্তরণ, স্তরে স্তরে রাজনৈতিক সংগঠনের সোপান রচনা করেছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামাজিক এককগুলি সময়ের সঙ্গে নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে এসে রাজনৈতিক সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়। এ ভাবেই গ্রামণীর অধীনে গ্রাম, বিশপতির অধীনে বিশ্ ও রাজা বা রাজন্যবর্গের অধীনে রাষ্ট্রসংগঠন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক শক্তির বিকাশে ব্রাহ্মণ-পুরোহিত সম্প্রদায় যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি গ্রহণ করেছিল তা বৈদিক সাহিত্যে সুস্পষ্টরূপে দেখা যায়। সাধারণের কাছে রাজশক্তির মাহাত্ম্য ও দৈবী চরিত্রের ব্যাখ্যা করে ধর্মীয় স্বীকৃতি দান করে এই ব্রাহ্মণ-সম্প্রদায় রাষ্ট্রশক্তির নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

গণরাষ্ট্র

বৈদিক সাহিত্যে উপজাতীয় জীবনে গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি ধারার উজ্জ্বল উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। একদিকে পৃথকভাবে ‘গণ’রাষ্ট্র বা সংগঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে রাজতান্ত্রিক সংগঠনের মধ্যে ‘সভা’ও ‘সমিতি’র অস্তিত্বে এই ধারার প্রচলন পরিলক্ষিত। গণরাষ্ট্রের উল্লেখ ঋগ্বেদ-এ ৪৬ বার। অথর্ববেদ-এ ৯ বার এবং ব্রাহ্মণ সাহিত্যে-এ বহুবার পাওয়া যায়। ‘রাজনঃ সমিতাবিবা’ কথাটি সম্ভবত সমিতি’তে বহুসংখ্যক নেতৃবৃন্দ বা রাজাদের অধিষ্ঠান করার ছবিটি তুলে ধরেছে। একাধিক রাজার মধ্যে একজন প্রধান রাজা বা ‘জ্যেষ্ঠ রাজা’র কথাও বলা হয়েছে। সম্ভবত এই গণরাষ্ট্রে একাধিক রাজা ও গণনায়কের প্রচলন ছিল। বুদ্রের পুত্র মরূদগণের গণসংগঠনের কথা বলা হয়েছে যার সদস্যসংখ্যা ছিল ৪৯। দেবতাদের গণসংগঠনগুলির প্রাচীনত্ব অনুমান করা হয়েছে বৈদিক সাহিত্যে। এর থেকে গণসংগঠনগুলির প্রাচীনত্ব অনুমান করা যায়। কে.পি. জয়সোয়াল মনে করেন যে, বৈদিক সমাজে রাজতন্ত্রের উত্থান আগে ঘটে এবং তার কিছু পরে গণরাষ্ট্রগুলির উদ্ভব হয়। রামশরণ শর্মার মতানুসারে বৈদিক গণগুলি মুখ্যত আর্যভাষীদের সভ্য সংগঠন ছিল এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলির মধ্যে উপজাতীয় চরিত্র বর্তমান ছিল। বৈদিক সাহিত্যর সূত্র থেকে মনে হয়, উপজাতীয় স্তরে গণরাজ্য বা সংগঠনের অস্তিত্ব, রাজশক্তি আত্মপ্রকাশ করার বহু পূর্বেই বর্তমান ছিল। এই সংগঠনগুলির বিভিন্ন নাম ও গঠনের ইঙ্গিত বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায় যথা-স্বরাজ্য, যার শীর্ষে নেতৃত্ব করতেন স্বরাষ্ট্র। তিনি রাজ্যের সমস্ত সদস্যের সঙ্গে সমানাধিকার ভোগ করতেন এবং তাঁর নেতৃত্ব দান করতেন। সুতরাং এখানে সমব্যক্তিদের মধ্যে থেকে একজন স্বরাটের নির্বাচনের চিত্র পাওয়া যায়। তিনি বাজপেয় যজ্ঞ সম্পাদন করতেন। শুক্লযজুর্বেদ-এ উত্তর ভারতে স্বরাটের অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। অপর একটি গণসংগঠন ‘বৈরাজ্য’ নামে অভিহিত হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ হিমালয়ের উত্তরে বৈরাজ্যের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। কুরু ও উত্তর মদ্রদের উল্লেখ রয়েছে যাঁরা বৈরাজ্য সংগঠন গঠন করেছিলেন। আলতেকার মনে করেন, বৈরাজ্য একটি রাজপদ-বিহীন রাষ্ট্রসংগঠন ছিল। অথর্ববেদ-এ গণ ও মহাগণ- এর উল্লেখ রয়েছে যা থেকে বিভিন্ন আকার ও স্তরে গণরাষ্ট্র সংগঠনের বিন্যাস ঘটেছিল বলে মনে হয়।

সভা ও সমিতি

বৈদিক সমাজে রাজতন্ত্র বিকাশের সূচনা ঋগ্বেদ-য়েই লক্ষ্য করা যায়। রাজতন্ত্রের বিকাশে সভা, সমিতি ও বিদথর মতো গণসংগঠনগুলির অস্তিত্ব পূর্বেই উপজাতীয় ধারার প্রচলন নির্দেশ করে। তবে মূল গণরাষ্ট্রগুলির অস্তিত্ব সম্ভবত পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজশক্তির উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গৌণ হয়ে পড়েছিল। অথর্ববেদ-এ ‘সভা’ ও ‘সমিতি’কে প্রজাপতির দুই যমজ কন্যারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ-এ বলা হয়েছে, যেমন রাজা তেমনই সভা এবং সমিতিও স্বয়ং প্রজাপতির নিকট অধিকারপ্রাপ্ত। ঋগ্বেদ-এর বর্ণনায় সভা ও সমিতির সামাজিক পরিচয় পাওয়া যায়। ‘সভমেতি কিতবঃ’ কথাটি থেকে সভায় দ্যূতক্রীড়া অনুষ্ঠিত হওয়ার চিত্রটি পাওয়া যায়। দৈবী সমিতির কথাও জানা যায় ঋগ্বেদ-এ। সমিতি সম্ভবত সমস্ত জনগণের বা বিশ’-এর জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু সভার সদস্যপদ সম্ভবত সীমিত ছিল। “সভ্যেয়ো বিপ্রো” এবং “রয়ি সভাবান” এই কথাগুলি থেকে মনে হয়, ব্রাহ্মণ বা বিপ্র ও ধনশালী ব্যক্তিরাই বা মঘবানরাই সভার সদস্যপদে আসীন ছিলেন। রাধাকুমুদ মুখার্জীর মতে সভা ও সমিতি ভারতের আদি ও সুপ্রাচীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। বৈদিক সাহিত্যে ‘সভাপতি’ ও ‘সভাপাল’-এর উল্লেখও পাওয়া যায়। জিমারের মতে সভা একটি গ্রামীণ সংস্থা ছিল যার পৌরোহিত্য করতেন গ্রামীণ বা গ্রামপ্রধান। কে.পি. জয়সোয়ালের মতে বৈদিক যুগের সভা প্রতিষ্ঠান এবং সমিতির সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। এ বিষয়ে ম্যাকডোনেল মনে করেন, বৈদিক যুগে রাজার নিরংকুশক্ষমতার পথে এক বিপুল অন্তরায় ছিল সমিতিতে প্রকাশ্য জনমত। অবশ্য ম্যাকডোনেল এবং কীথ তাঁদের বৈদিক ইন্ডেক্‌স গ্রন্থে এও লিখেছেন যে রাজপদে নির্বাচনের প্রচলনটি বৈদিক সমাজে আদৌ ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বৈদিক যুগের গোড়ায় রাজপদে নির্বাচন প্রচলিত থাকলেও রাজার দৈবী অধিকারের তত্ত্বটি পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ক্রমশ প্রকট হয়। এর সঙ্গে জড়িত সভার ক্রমশ-পরিবর্তিত রূপটি। প্রথম থেকেই জনসংগঠনরূপে সভার চরিত্র অনেকটা সংকুচিত ছিল। সামাজিক বৈষম্যের প্রতিফলনও লক্ষ্য করা যায় সভার সংগঠনে। পরবর্তী কালে সভা রাজসভায় পরিণত হয়। ছান্দোগ্য উপনিষদ-এ গৌতম নামে এক ব্রাহ্মণকে রাজসভায় রাজার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। এ ছাড়া, সামাজিক জীবনে সভা অভিজাত সম্প্রদায়ের আমোদ-প্রমোদের কেন্দ্র হয়ে পড়ে। পরবর্তী বৈদিক সমাজের রাজনৈতিক পটভূমিতে সভা কেন্দ্রীয় অভিজাত শাসনের অঙ্গ হয়ে পড়ে যার কেন্দ্রে রাজার অবস্থান ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

রাজশক্তির প্রাধান্য

ঋগ্বেদিক রাষ্ট্র গঠনে রাজশক্তির অগ্রগণ্য ভূমিকাও লক্ষ্য করা যায়। এই সাহিত্যে রাজাদের উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন ভরতগণের নেতৃত্বে দিবোদাস ও তৎপুত্র সুদাস, অভ্যাবর্তিত চায়মান রুষমদের রাজা ঋণদয় অগ্নিবেশ, রাজপুত্র ইত্যাদি। রাজতন্ত্র বংশানুক্রমিক ছিল কিনা গোড়ার যুগে তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না-তবে একাধিক রাজ-তনয়ের নাম পাওয়া যায়। রাজন্যবর্গের সৃষ্টি হয়েছিল সেকথা সুস্পষ্ট। রোমিলা থাপার দেখিয়েছেন যে ঋগ্বেদের সমাজেই বিশ্ অর্থাৎ সাধারণ জনগোষ্ঠী ও রাজন্যবর্গের মধ্যে পৃথকীকরণ ঘটে গেছে। তবুও ‘বিশ’-এর মতামত ও সামাজিক ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল, কারণ জমি ভোগদখলের ক্ষেত্রে রাজাকে বিশেষ সম্মতি গ্রহণ করতে হত। ঋগ্বেদের রাজার সর্বপ্রথম ভূমিকা ছিল নেতৃত্বদান, এর সঙ্গে যুক্ত ছিল উপজাতি এবং তার সম্পত্তি রক্ষা করার দায়িত্বটিও। বিচারকার্যও রাজার দ্বারা পরিচালিত হত। রাজাকে যোদ্ধারূপে ইন্দ্র এবং বিচারকরূপে বরুণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

বৈদিক তত্ত্বে রাজার ক্ষমতা ঐশীশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল কিনা তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে। চার্লস ড্রেকমেয়ার মনে করেন যে বেদে এমন কিছু তথ্য নেই যা এই সমাজে রাজশক্তির ঐশ্বরিক চরিত্র নির্দিষ্ট করে। কে. পি. জয়সওয়াল তাঁর হিন্দু পলিটি গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে হিন্দু (বৈদিক) রাজশক্তি একটি চুক্তি বা অঙ্গীকার থেকে উদ্ভুত, যে অঙ্গীকারের মাধ্যমে রাজা সমগ্র জনগণের সম্পদ বৃদ্ধির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ড্রেকমেয়ার এবং জয়সওয়াল দু’জনই বৈদিক রাজশক্তির উদ্ভব জনমত সাপেক্ষ বলে মনে করেন। এরই অপরদিকে ইউ, এন. ঘোষালের মতে ব্রাহ্মণ্য সমাজে রাজশক্তির উত্থান সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছাভূত। তিনি এক্ষেত্রে অবশ্য অনেক পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য-এর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। পি.ভি. কানের মতে ঘোষালের ধারণা সঠিক নয়। রাজশক্তির ঐশ্বরিক ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সূচনা পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে অবশ্যই লক্ষণীয়। কিন্তু অথর্ববেদ-এর সময়কাল অবধি বৈদিক রাজনৈতিক জীবনে জনগোষ্ঠী ও গণ প্রতিষ্ঠান, যথা সভা বা সমিতির গুরুত্ব যথেষ্টরূপে বজায় ছিল। ঋগ্বেদ-এর প্রার্থনা করা হচ্ছে “”বিশা-জ্বা সর্বাবান্ত” অর্থাৎ সর্বজন যেন রাজাকে আকাঙ্ক্ষা করেন। ঐ সংহিতাতেই আবার ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে যাতে রাজার শাসন শান্তিপূর্ণ ও নির্বিঘ্ন হয়, যাতে প্রজাগণ রাজাকে স্বেচ্ছায় বলি অর্পণ করেন এবং রাজার সার্বভৌমত্ব প্রসারে সহযোগিতা করে তাঁকে শত্রুমুক্ত করেন। অথর্ববেদ-এ রাজার পক্ষ থেকে সমস্ত বর্ণের প্রজাদের সম্মতি ও বিশ্বস্ততা কামনা করতে দেখা যাচ্ছে এবং এই শ্লোকেই রাজা অনুরোধ করেছেন প্রজাদের, তাঁরা যেন তাঁকে ত্যাগ না করেন, যেন তাঁরা স্বপক্ষে স্থির থাকেন এবং তাঁর কর্মে তৃপ্ত হন। নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলেছেন, এই সমাজে রাজার দৈবশক্তির দাবি বা অধিকার স্থাপন সম্ভব ছিল না।

কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে গোড়া থেকেই এর বিপরীতমুখী ধারাটি বিদ্যমান। রাজার দৈবী অধিকারের তত্ত্বটি বহুবার আলোচিত হয়েছে এই সাহিত্যে। এই দুই বিপরীতমুখী তত্ত্বের উপস্থিতি বহুমুখী রাজনীতি বা রাজনৈতিক ভাবনার প্রচলন ইঙ্গিত করে। ঋগ্বেদ-এ রাজা এসদস্য নিজেকে সর্বশক্তিমান, বিশ্বজগতের প্রভু, ইন্দ্র ও বরুণের ন্যায় মানবের রাজা অদিতির পুত্র পৃথিবী ও আকাশ বলে ঘোষণা করেছেন। এই ধারার প্রতিফলন পরবর্তী কালেঅর্থর্ববেদ-য়েও বর্তমান। রাজশক্তির সাফল্য কামনা করে বলা হচ্ছে: রাজা ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করুন, ধনপতি

হন, বিষ্পতিরূপে বিরাজ করুন। তিনি ইন্দ্রের প্রিয়, ওষধি ও গবাদি পশুর প্রিয়, জনগণের একমাত্র প্রভু এবং মনুর বংশজাত উত্তম রাজা, তিনি সিংহ-প্রতীক এবং সমস্ত প্রজাগণকে (বিশ) ভক্ষণ করতে সক্ষম। তৈত্তিরীয় সংহিতা-এ রাজসূয় যজ্ঞের রাজাকে পুরোহিতগণ সবিতা, বরুণ এবং ইন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুতরাং একাধারে সর্বজননির্বাচিত রাজা ও দৈবশক্তিজাত রাজার দ্বৈত বর্ণনা বৈদিক সাহিত্যের গোড়ার যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল যা পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার দৈব অধিকারের পটভূমি রচনা করেছে এবং এরই সঙ্গে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রেরও উদ্ভব হয়।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে দৈবী রাজশক্তির তত্ত্বটি নিঃসন্দেহে অঙ্কুরিত ও পল্লবিত হয়েছে। ডি.ডি. কোশাম্বী তৈত্তিরীয় সংহিতা এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে বিভিন্ন ধরনের, যথা রাজসূয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ, ঐন্দ্রমহাভিষেক, ইত্যাদি, অভিষেক ও তৎসংশ্লিষ্ট যাগযজ্ঞের মাধ্যমে রাজা বা দলপতিকে উপজাতীয় গণতান্ত্রিক গন্ডির পাশ থেকে মুক্ত করার প্রয়াস লক্ষ্য করেছেন। উপজাতীয় সভার উল্লেখ পরবর্তী সাহিত্যে নেই বললেই চলে। বর্ণভিত্তিক সমাজের পূর্ণ বিকাশ ও প্রসার ঘটে যায় এই যুগে। যার ফলে একটি শ্রেণীভিত্তিক সমাজের উদ্ভব হয়। এই শ্রেণী ও বর্ণে বিভক্ত সমাজের শীর্ষে রাজশক্তির স্থান আরও সুদৃঢ় হয়। রাজশক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সমাজের অভিজাত বর্ণ ও শ্রেণীর মানুষের সম্মতি ও সহায়তার দিকটিও বৈদিক সাহিত্যে ফুটে উঠেছে। এক্ষেত্রে সমাজের গণতান্ত্রিক শক্তি নয় বরং উচ্চকোটির মানুষের প্রাধান্যই প্রকাশ পায়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রাজসূয় যজ্ঞের উপাঙ্গরূপে রত্নহিবংসি অনুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে। নবাভিষিক্ত রাজা রাজসূয় যজ্ঞের প্রারম্ভে একাদশ ‘রত্নিন’-এর গমনপূর্বক তাঁদের উপঢৌকন অর্পণ করবেন। বিভিন্ন সাহিত্যগুলিতে রত্নিন’দের পরিচয় পাওয়া যায়। এঁরা হলেন, ব্রাহ্মণ- পুরেহিত, মহিষী, বাবাতা, রাজন্য, গ্রামণী ভাগদুঘ, সংগ্রহীত্ব, সেনানী, সূত, ক্ষতৃ, তক্ষণ, রথকার, অক্ষবাপ ও গোবিকর্তন। এঁদের উল্লেখ প্রায় সব রচনাগুলিতেই বর্তমান। রাজন্য ও পরিবৃক্তির উল্লেখ দশম ও একাদশ রত্নিনরূপে শতপথ ব্রাহ্মণ ছাড়া সব রচনাতে বর্তমান। কিছু রচনায় বাবাত, তক্ষণ ও রথকারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। শতপথ ব্রাহ্মণ-এ যজ্ঞের হোতাকে রাজন্যবর্গের প্রতিনিধি বলা হয়েছে। এবং এর সাথে যুক্ত হয়েছেন গোবিকর্তন ও পালাগল। কে.পি. জয়সওয়ালের মতে এই রত্নিনগণ ঋগ্বৈদিক পূর্বের সমিতির অংশ ছিলেন। এঁরাই পরবর্তীকালে রাজাকৃতরূপে, রাজতন্ত্রের প্রসারে সহায়তা করেছেন। পরবর্তী বৈদিক যুগের রাষ্ট্রীয় সংগঠনে এই রত্নিনগণ উচ্চপদে আসীন। সম্ভবত এই রাজন্য, গ্রামীণ, তক্ষণ, রথকারগণ তাঁদের নিজস্ব বর্ণ বা কৌমের প্রতিনিধিরূপে রাজ-অভিষেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। রাজ অভিষেকে ‘রত্নিন’দের এই উপস্থিতি গণতান্ত্রিক ধারার সংকোচন ও ক্রমশ অবলুপ্তির দিকটি নির্দেশ করে। ক্রমশ সমাজে একটি স্তরীভূত ক্ষমতার বিন্যাস প্রকাশ পায়। স্তরবিভক্ত সমাজের শীর্ষে আসীন রাজশক্তি ও তার সহায়ক পুরোহিত সম্প্রদায়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাদের আসন দৃঢ়বদ্ধ হয়ে ওঠে। রাজার রাজস্ব সংগ্রহের অধিকারও বৃদ্ধি পায় ও এর দ্বারা রাজশক্তির উত্থান আরও সহজ হয়ে পড়ে। উদ্বৃত্ত ফসল ও প্রসারিত কৃষিক্ষেত্র সমাজে সম্পদের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভব ঘটায়। সম্পদ- রক্ষকের ভূমিকায় রাজশক্তির আত্মপ্রকাশ পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রথম ধাপ সৃষ্টি করে। উদ্বৃত্ত সম্পদ উৎপাদন, আহরণ, সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে বাহুবল সাংগঠনিক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা বোধ হওয়ায় ক্রমশ রাষ্ট্রশক্তি এবং রাজার জনসাধারণের দ্বারা উৎপন্ন সামগ্রীর উপর অধিকারও বৃদ্ধি পায়। ঋগ্বেদ-এ যে রাজা জনসাধারণের স্বেচ্ছায় দান ‘বলি’ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন, তিনি পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পরিণত হলেন ‘বলিহৎ’ অর্থাৎ বলি আহরণকারী ব্যক্তিরূপে। রাজ্য, রাষ্ট্র ও ক্ষত্র কথাগুলি সমার্থকরূপে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ব্যবহৃত। তার কারণ, এ যুগে রাষ্ট্রসংগঠনের শীর্ষে ক্ষত্রিয়বর্গ তথা রাজার উপস্থিতি একটি অতি প্রচলিত স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রাজশক্তির প্রতি তাত্ত্বিক নেতৃবর্গ বা ব্রাহ্মণ- পুরোহিতবর্গের পূর্ণ সমর্থন লক্ষ্য করা যায়। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এই দুই প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের একে অপরের সঙ্গে ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা এই দুই সম্প্রদায়ের সামাজিক প্রাধান্য রক্ষায় সাহায্য করে। শতপথ ব্রাহ্মণ-এ নানা যজ্ঞানুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে যা রাজার পক্ষ থেকে জনসাধারণের নিকট গুরুত্বের জন্য অনুষ্ঠিত। রাজার সার্বভৌমত্বের কথা অশ্বমেধ, বাজপেয় বা ঐন্দ্রমহাভিষেক যজ্ঞের মাধ্যমে প্রচারিত। অথর্ববেদে বলা হয়েছে “বৃষা পৃথিব্যা অয়ম্ বৃষা বিশ্বস্য ভূতস্য ককুন-মনুষ্যানাম্ একবৃষো ভব”। অর্থাৎ রাজা সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর সমস্ত বস্তুর অধিকারী। তিনি মানবসমাজের অধিপতি। এই ধরনের অনুষ্ঠান ও শ্লোকরচনার মাধ্যমে রাজাধিকারের পরিধি প্রসারিত করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে এই রাজার নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংগঠনের বিকাশ পরবর্তী অধ্যায়ে উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকায় ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সংগঠনের পূর্বাভাস দেয়।

৩.৯ অনুশীলনী

১। ঋগ্বৈদিক যুগের আর্থ-সামাজিক জীবনের বিবরণ দিন।

২। পরবর্তী বৈদিক সমাজের পরিবর্তনের সূত্রগুলি ব্যাখ্যা করুন। এই পরিবর্তনের ফলে সমাজে নারীর ভূমিকায় কী রূপান্তর ঘটেছিল?

৩। ঋগ্বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক সমাজের তুলনামূলক আলোচনা করুন।

৪। পরবর্তী বৈদিক সমাজে অর্থনৈতিক অগ্রগতির চিত্রটি আলোচনা করুন।

৫। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে আর উপজাতীয় সমাজ থেকে রাষ্ট্রসমাজের বিবর্তনের ধারাটি ব্যাখ্যা করুন।

৬। বৈদিক সাহিত্যে রাজতন্ত্রের উদ্ভব সম্বন্ধে আলোচিত তত্ত্বের বিবরণ দিন।

৭। বৈদিক ‘সভা’ ও ‘সমিতিক্ষ’ সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত রচনা লিখুন।

Leave a Comment