উষ্ণ প্রস্রবণ কী? কেন উষ্ণ প্রস্রবণের সৃষ্টি হয়? প্রস্রবনের প্রকারভেদ

Rate this post

উষ্ণ প্রস্রবণ কী – প্রস্রবনের সংজ্ঞা – প্রস্রবণ রেখা – প্রস্রবনের প্রকারভেদ – উষ্ণ প্রস্রবন – গিজার – গিজার সৃষ্টির কারণ – ভ্যক্লুসিয়ান প্রস্রবণ – আর্তেজীয় কূপ বা প্রস্রবণ – আর্তেজীয় প্রস্রবণ সৃষ্টির কারণ – ভাঁজ গঠিত ভূমিরূপ ও আর্তেজীয় প্রস্রবণ – সম্পর্কে আলোচনা


ভূপৃষ্ঠের কোন স্থান দিয়ে ভূগর্ভের জল যখন স্বাভাবিক ধারাই বেরিয়ে আসে, তখন তাকে প্রস্রবণ বলে। প্রস্রবনের জল কখনো ধীরে আবার কখনো প্রবল বেগে বেরিয়ে আসে। বিজ্ঞানী মঙ্কহাউসের মতে, ভূ-গর্ভের জলের কিছুটা বেগের সাথে স্বাভাবিক ভাবে বাইরে বেরিয়ে আসাকে প্রস্রবণ বলে।

প্রস্রবনের উদাহরণ 

উত্তরাঞ্চলের কুমায়ন হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলে, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের ছোটনাগপুর অঞ্চল, মহারাষ্ট্রের কঙ্কন উপকূলের সোহাদ্রি পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশে প্রস্রবণ দেখা যায়।

প্রস্রবণ রেখা – পৃথিবীর অধিকাংশ প্রস্রবণ গুলিকে বিক্ষিপ্ত ভাবে থাকতে দেখা যায়। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে একটি রেখা বা শিলাস্তরের কোন ফাটল বরাবর অনেক গুলি প্রস্রবণ সারিবদ্ধ ভাবে অবস্থান করে, এইরূপ রেখাকে প্রস্রবণ রেখা বলে।

উদাহরণ – ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের কুমায়ন হিমালয়ে এরূপ প্রস্রবণ দেখা যায়।

প্রস্রবনের শ্রেনীবিভাগ – ভূপৃষ্ঠের যেসব প্রস্রবণ গঠিত হয়, সেগুলি বেশ কয়েক প্রকারের হয়। যেমন –

ক) প্রস্রবনের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে প্রস্রবনকে নিম্নলিখিত কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন –

১. অবিরাম প্রস্রবন :যে সব প্রস্রবণ থেকে জল সারাবছর ধরে বের হয়, সেগুলিকে অবিরাম প্রস্রবণ বলে। সম্পৃক্ত স্তর বেশি বিস্তৃত হলে প্রস্রবণ স্থায়ী হয় এবং তখন অবিরাম প্রস্রবনের উদ্ভব হয়।

২. সবিরাম প্রস্রবণ: কতগুলি প্রস্রবনের জলধারা স্থায়ী হয় না, কেবল মাত্র আর্দ্র ঋতুতেই জল বের হয়। এরূপ প্রস্রবণকে সবিরাম প্রস্রবণ বলে।

৩. উষ্ণ প্রস্রবণ: ভৌমজল অনেক সময় ভূ-গর্ভের অনেক গভীর স্থানে পৌছালে সেখানকার তাপে জল উষ্ণ হয়। এই উষ্ণ জল ভূপৃষ্ঠের কোন ফাটল বা গর্ত দিয়ে বের হয়। এই জলধারাকে উষ্ণ প্রস্রবণ বলে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বক্রেশ্বর, বিহারের রাজগির, হিমাচল প্রদেশের সিমলা কাছে তাতাপানি প্রভৃতি স্থানে উষ্ণ প্রস্রবণ দেখা যায়।

গিজার – Geyser একটি আইরিশ শব্দ যার অর্থ হল Roar বা গর্জন।যে সব উষ্ণ প্রস্রবনের জল প্রতিনিয়ত কিছু সময় অন্তর ফোয়ারার মতো স্তম্ভের আকারে সশব্দে প্রবলবেগে নির্গত হয়, সেগুলিকে গিজার বলে। যেমন – আমেরিকা ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের ওল্ড ফেথফুল গিজার।

সৃষ্টির কারণ – ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূ-অভ্যন্তরের দিকে উষ্ণতা ক্রমসশ বৃদ্ধি পায়। ভূপৃষ্ঠের জল ভূ-অভ্যন্তরের অনেক গভীরে প্রবেশ করলে তা উত্তপ্ত লাভা অঞ্চলের সংস্পর্শে এসে ফুটতে আরম্ভ করে। উপরিস্থিত জলস্তরের চাপে ওই জলের স্ফুটনাঙ্ক আরোও বেড়ে যায় এবং সেই জলের কিছু অংশ কালক্রমে অতিতাপিত বাস্পে পরিনত হয়ে উপরিস্থিত জলরাশিকে প্রবল বেগে ফোয়ারার আকারে সোজা ওপরে উৎক্ষিপ্ত করে গিজারের সৃষ্টি হয়।

৪. খনিজ প্রস্রবণ 

যে সব উষ্ণ প্রস্রবনের জলে প্রচুর পরিমানে খনিজ পদার্থ দ্রবীভূত থাকে সেগুলিকে খনিজ প্রস্রবণ বলে। খনিজ প্রস্রবনে সাধারণত প্রতি লিটার জলে েক গ্রামের বেশী খনিজ পদার্থ দ্রবীভূত থাকে। খনিজ প্রস্রবনের জলে রোগ নিরাময়ের গুন আছে । উদাহরণ – বক্রেশ্বর বা রাজগিরের প্রস্রবণ এক প্রকার খনিজ প্রস্রবণ।

খ) ভূ-অভ্যন্তরীন গঠন ও শিলার প্রকৃতির তারতম্যে বিভিন্ন প্রকার প্রস্রবণ গড়ে ওঠে। যথা –

১. ভৃগুতট পাদদেশ প্রস্রবণ

ভৃগুতটের পাদদেশে বিশেষত চুনাপাথর বা চক দিয়ে গঠিত অঞ্চলে অপ্রবেশ্য কাদাপাথর ও প্রবেশ্য বেলেপাথর বা চুনাপাথরের সংযোগ স্থল দিয়ে যে প্রস্রবণ নির্গত হয়, তাকে ভৃগুতট পাদদেশ প্রস্রবণ বলে।

২. নতিঢাল প্রস্রবণ 

প্রবেশ্য ও অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের সংযোগ স্থল যদি নতি ঢালে উন্মুক্ত হয়, তা হলে ওই স্থানে যে প্রস্রবণ নির্গত হয়, তাকে নতিঢাল প্রস্রবণ বলে।

৩. চ্যুতি ও দারণ প্রস্রবন

চ্যুতির ফলে কোন সম্পৃক্ত প্রবেশ্য শিলাস্তর (যেমন–বেলেপাথর বা চুনাপাথর) যদি কোনো অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের (যেমন– শ্লেট বা কাদাপাথর) ওপর গিয়ে পরে তাহলে যে প্রস্রবনের সৃষ্টি হয়, তাকে চ্যুতি ও দারণ প্রস্রবণ বলে।

৪. সমান্তরাল প্রস্রবণ

সমান্তরাল শিলাস্তরের মধ্যবর্তী স্থানে প্রবেশ্য শিলাস্তর থাকলে তাতে সঞ্চিত জল যে সব প্রস্রবণ গঠন করে, তা মোটামুটি ভাবে সমান্তরালে নির্গত হয় বলে, একে সমান্তরাল প্রস্রবণ বলে।

৫. ভ্যক্লুসিয়ান প্রস্রবণ

নামকরনের কারণ 

চুনাপাথর গঠিত গুহায় ফাটল বরাবর ভৌমজলরাশির বাইরে নির্গমন কে ভ্যক্লুসিয়ান প্রস্রবণ বলে। দক্ষিন ফ্রান্সের রোন নদী উপত্যকার ফনটেন দ্য ভ্যক্লুস নামক প্রস্রবন থেকে এই নামের উৎপত্তি হয়েছে।

সৃষ্টির কারণ – অসংখ্য ফাটল যুক্ত চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে বৃষ্টির জল ভূ-গর্ভে প্রবেশ করে এবং ফাটল গুলি আয়তনে বৃদ্ধি পায়,চুনাপাথর স্তরের নীচে অপ্রবেশ্য শিলাস্তর বিদ্যমান থাকলে, দুই ধরণের শিলাস্তরের সংযোগ বরাবর প্রসারিত ফাটলের মধ্য দিয়ে ভৌমজল তীব্র বেগে ভূপৃষ্ঠের ওপর এসে ভ্যক্লুসিয়ান প্রস্রবণ সৃষ্টি করে।

৬. প্রস্রবণ গুচ্ছ

অনেক সময় পার্বত্য ভূমির পাদদেশ অঞ্চল বরাবর একটি নিদিষ্ট উচ্চতায় শিলাস্তরের একই নতিতল বরাবর একাধিক প্রস্রবণ পরপর নিঃসৃত হয়, তখন সেই প্রস্রবন গুলিকে প্রস্রবণ গুচ্ছ বলা হয়।  

আর্টেজীয় কূপের উৎপত্তি ও গঠন

নামকরনের কারণ

যে কূপ খনন করলে পাম্পের সাহায্য ছাড়াই ভৌমজল স্বাভাবিক ভাবে নির্গত হয় সেই কূপকে আর্টেজীয় কূপ বলে। 

১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের আর্তোয়া নামক অঞ্চলে পৃথিবীর প্রথম এই ধরণের কূপ খনন করা হয়েছিল বলে, সেই অঞ্চলের নাম অনুযায়ী এই ধরণের কূপকে আর্টেজীয় কূপ বলা হয়।

সৃষ্টির কারণ

  • অনেক সময় ভাঁজ গঠিত শিলাস্তরে দুটি অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের মাঝ বরাবর অধোভঙ্গের আকারে একটি প্রবেশ্য শিলাস্তর থাকে।
  • প্রবেশ্য শিলাস্তরের প্রান্ত দুটি ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত থাকলে বৃষ্টির জল অতি সহজেই ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রবেশ্য শিলাস্তরের মধ্যে সঞ্চিত হতে থাকে।
  • প্রবেশ্য শিলাস্তরের দুপাশে অপ্রবেশ্য শিলাস্তর থাকায় প্রবেশ্য শিলাস্তরের সঞ্চিত জলের মধ্যেই অতিরিক্ত পার্শ্বচাপের সৃষ্টি হয়, এর ফলে প্রবেশ্য শিলাস্তর পর্যন্ত কূপ খনন করলে কিংবা প্রবেশ্য শিলাস্থিত ফাটল বরাবর জল স্বাভাবিক ভাবেই পাম্প ছাড়াই ভূপৃষ্ঠের বাইরে নির্গত হয়,এভাবে আর্টেজিয় কূপের সৃষ্টি হয়।

শর্ত সমূহ – আর্টেজীয় কূপ গঠনের প্রয়োজনীয় শর্ত গুলি হল:

১. অর্ধ চন্দ্রাকার বা অধোভঙ্গের আকারে প্রবেশ্য শিলাস্তরের উপস্থিতি।

২. প্রবেশ্য শিলাস্তরের উপর ও নীচে অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের উপস্থিতি।

৩. প্রবেশ্য শিলাস্তরের প্রান্তভাগের ভূপৃষ্ঠের ওপর উন্মোচন।

৪. প্রবেশ্য শিলাস্তরের অধোভঙ্গের নিম্নাংশে পর্যাপ্ত পরিমানে জলের চাপ থাকে যাতে কূপ খনন করলে স্বাভাবিক ভাবে ভৌমজল ভূপৃষ্ঠের বাইরে বেরিয়ে আসে।

ভাঁজ যুক্ত শিলায় আর্টেজীয় প্রস্রবণ দেখা যায় – ব্যাখ্যা করো?

ভূ-গর্ভের ভৌমজল নিজের চাপে ভূপৃষ্ঠের বাইরে বের হয়, তখন তাকে আর্টেজীয় প্রস্রবণ বলে। ভাজযুক্ত শিলায় আর্টেজীয় প্রস্রবণ দেখতে পাওয়া যায়। তার কারণ গুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল –

১. ভাঁজ যুক্ত শিলায় কখনো কখনো ওপরে ও নিচে দুটি অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের মধ্যে অধোভঙ্গের আকারে একটি প্রবেশ্য শিলাস্তর বিরাজ করে।

২. প্রবেশ্য স্তরের দুদিকে উঁচুতে ভূপৃষ্ঠ উন্মুক্ত থাকে।

৩. দুদিকে বৃষ্টি পড়লে বৃষ্টির জল প্রবেশ্য স্তর দিয়ে চুইয়ে এর মাঝখানে এসে জমে।

৪. এই জলের ওপর ও নিচে অপ্রবেশ্য স্তর থাকায় এই জল কোন দিকেই বের হতে পারে না ।

৫. সেই জন্য জলের চাপ খুব বেশি থাকে।

৬. এই অবস্থায় অপ্রবেশ্য শিলার মাঝখান দিয়ে প্রবেশ্য স্তর পর্যন্ত নলকূপ খনন করলে প্রবেশ্য স্তরের জল পাম্পের সাহায্য ছাড়াই প্রচন্ড বেগে ওপরে উঠতে থাকে। তাই ভাঁজযুক্ত অঞ্চলে আর্তেজীয় কূপ সৃষ্টি হয়।

Leave a Comment