ভূমিকম্প তরঙ্গ কাকে বলে? ভূমিকম্প তরঙ্গের শ্রেণীবিভাগ করো।
ভূমিকম্প তরঙ্গ: ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে সৃষ্ট কোন কম্পন যখন তরঙ্গের আকারে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে ভূমিকম্প তরঙ্গ বলে। তরঙ্গের বিস্তৃতি, দৈর্ঘ্য ও প্রকৃতি অনুসারে ভূমিকম্প তরঙ্গকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
A)দেহ তরঙ্গ: যে ভূমিকম্প তরঙ্গ ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে ভূ-অভ্যন্তরের মধ্য দিয়ে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছায়, তাকে দেহ তরঙ্গ বলে। এই দেহ তরঙ্গ আবার দুটি উপ বিভাগে বিভক্ত। সেগুলি হল-
1)প্রাথমিক তরঙ্গ বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ: দ্রুতগতি সম্পন্ন যে ভূমিকম্প তরঙ্গ ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে সর্বাপেক্ষা প্রথম উপকেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হয় বা সর্বাপেক্ষা প্রথম গ্রাহক যন্ত্রে পৌঁছায়, তাকে ভূমিকম্পের প্রাথমিক তরঙ্গ বা Primary Wave বা P তরঙ্গ বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলে।
বৈশিষ্ট্য
১)প্রাথমিক তরঙ্গ সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও দ্রুতগতি সম্পন্ন তরঙ্গ।
২)এই তরঙ্গ কঠিন তরল ও গ্যাসীয় তিন প্রকার মাধ্যমের মধ্য দিয়েই যেতে পারে। তবে কঠিন মাধ্যম অপেক্ষা তরল মাধ্যম দিয়ে যাওয়ার সময় এর গতিবেগ হাস পায়।
৩) এই তরঙ্গের গড় গতিবেগ 6-8কিমি/সেকেন্ড।
৪)যে মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক তরঙ্গ প্রবাহিত হয় সেই মাধ্যমের বস্তু কণাগুলি তরঙ্গ প্রবাহের দিকে সোজাসুজি কাঁপতে থাকে। তাই এই তরঙ্গকে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলা হয়।
৫)এই তরঙ্গ ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে ক্রমশ ওপরের দিকে সংকুচিত হয় বলে এই তরঙ্গের অপর নাম সংনমন তরঙ্গ। আবার ভূপৃষ্ঠের ওপর সজোরে আঘাত করে বলে এই তরঙ্গকে ধাক্কা তরঙ্গ বা ঠেলা তরঙ্গ বা পুশ ওয়েভ বলে।
2)অনুপস্থ তরঙ্গ বা তির্যক তরঙ্গ বা গৌণ তরঙ্গ: যে ভূকম্পীয় তরঙ্গ প্রাথমিক তরঙ্গের পর উপকেন্দ্রে এসে পৌঁছায় তাকে গৌণ তরঙ্গ বা Secondary Wave বা S তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বা তির্যক তরঙ্গ বলে।
বৈশিষ্ট্য
১)এই তরঙ্গ কেবলমাত্র কঠিন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে; তরল ও গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে না।
২) এই তরঙ্গ প্রচন্ড পীড়ন বা চাপ সৃষ্টি করে শিলাস্তরের ওঠা নামার মাধ্যমে আলোক তরঙ্গ বা জলতরঙ্গের মতো বিস্তার লাভ করে।
৩) এই তরঙ্গের গড় গতিবেগ 3.5-5 কিমি/সেকেন্ড।
৪) এই তরঙ্গ যে মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেই মাধ্যমের বস্তু কণাগুলি উল্লম্বভাবে কাঁপতে থাকে। তাই একে অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বলে।
৫) শিলা স্তরের তীব্র চাপ বা পীড়ন সৃষ্টি করে এই তরঙ্গ শিলার আয়তনের পরিবর্তন না ঘটিয়ে আকৃতির পরিবর্তন ঘটায় বলে একে পীড়ন তরঙ্গ বলা হয়।
B)পৃষ্ঠ তরঙ্গ বা পার্শ্ব তরঙ্গ: যে ভূমিকম্প তরঙ্গ ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠ বরাবর ঢেউয়ের মতো চারিদিকে বিস্তার লাভ করে, তাকে পৃষ্ঠতরঙ্গ বা পার্শ্ব তরঙ্গ বলে।
বৈশিষ্ট্য
১) এই তরঙ্গের গতিবিধি কঠিন মাধ্যমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
২)এই তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হওয়ায় একে Long Wave বা L তরঙ্গ বলে। এই তরঙ্গ সর্বাপেক্ষা বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে।
৩)সর্বাপেক্ষা ধীর গতি সম্পন্ন এই তরঙ্গের গড় গতিবেগ 4-4.3 কিমি/সেকেন্ড।
৪)সর্বাপেক্ষা ধীর গতি সম্পন্ন হলেও এই তরঙ্গের বিধ্বংসী ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি।
৫)পৃষ্ঠ তরঙ্গ দুই ধরনের হয়।যথা-
ক)লাভ তরঙ্গ: পৃষ্ঠ তরঙ্গের মধ্যে যে তরঙ্গ S তরঙ্গের মতো বস্তুকণার ওঠানামার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে ক্রমশ অনুভূমিকভাবে সর্পিল গতিতে গতিতে অগ্রসর হয়,তাকে লাভ তরঙ্গ বলে।
খ)রালে তরঙ্গ: পৃষ্ঠ তরঙ্গের মধ্যে যে তরঙ্গ বস্তুকণার ওঠানামা এবং সংকোচন-প্রসারণ এই দুটি পদ্ধতির সমন্বয়ে ভূপৃষ্ঠের উপরের অংশ দিয়ে কিছুটা উপবৃত্তাকার গতিতে অগ্রসর হয়, তাকে রালে তরঙ্গ বলে।