ভারতকে ভারতবর্ষ বলা হয় কেন ?: ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। দেশটির সরকারি নাম ভারত প্রজাতন্ত্র। ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে, জনসংখ্যার বিচারে এই দেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান উত্তর-পূর্বে চীন, নেপাল ও ভুটান এবং পূর্বে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অবস্থিত। এছাড়া, ভারত মহাসাগরে অবস্থিত শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া হল ভারতের নিকটবর্তী কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্র। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর ও পূর্বে বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত ভারতের উপকূলরেখার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৭,৫১৭ কিলোমিটার (৪,৬৭১ মাইল)।
আমাদের দেশকে ভারতবর্ষ বলার সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে, যেমন:
(i) প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে, বৈদিক যুগের রাজা ‘ভরতের’ নাম অনুসারে ‘ভারতবর্ষের নামকরণ’ করা হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিস্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে লেখা বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে:
‘উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য’ হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্
বর্ষং তদভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ
(অর্থাৎ, সমুদ্রের উত্তরে এবং হিমালয় পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত দেশের নাম হল ভারত, যেখানে ভরতের সন্ততিরা বসবাস করে)।
(ii) ঐতিহাসিক ডঃ রামশরণ শর্মা-র মতে, ভরত নামে এক প্রাচীন উপজাতির নাম অনুসারে এই দেশের নামকরণ ‘ভারতবর্ষ’ হয়।
(iii) কলিঙ্গ সম্রাট খারবেল-এর হস্তিগুম্ফা শিলালিপিতে ‘ভারধবস’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায় — এই নাম গুপ্তযুগে ‘ভারতবর্ষ’ নামে প্রখ্যাত হয়েছিল।
(iv) খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্ৰিক লেখক হেরডটাস্-এর মতে, তাঁর জানা সমস্ত দেশের মধ্যে ভারতের জনসংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই কারণেই ‘ভারত নামের সঙ্গে বর্ষ’ শব্দটি যোগ করে দেওয়া হয়।
ভারতবর্ষের ইন্ডিয়া বা হিন্দুস্থান নামকরণের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা
(i) প্রাচীনকালে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় এদেশে আসা গ্রিকরা ‘সিন্ধু নদী’-কে বলত ‘ইন্ডস’ (Indos)। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ‘সিন্ধু’ বা ‘ইন্ডস্’ নাম থেকেই ভারতবর্ষের ‘ইন্ডিয়া’ বা ‘হিন্দুস্থান’ নামকরণ করা হয়েছে।
(ii) ভারতবর্ষের ‘ইন্ডিয়া’, হিন্দ, হিন্দুস্থান প্রভৃতি নামকরণ সম্পর্কে আরও একটি প্রচলিত মত হল এই যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে প্রথম বিদেশি আক্রমণের নেতা পারস্য সম্রাট দারায়ুস বর্তমান সিন্ধু অঞ্চলের নামকরণ করেছিলেন ‘হিদু’ বা ‘হিন্দু’। আসলে সিন্ধুনদের পাঁচটি উপনদী (অর্থাৎ—বিতস্তা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিপাশা ও শতদ্রু) এবং গঙ্গা ও যমুনা-কে নিয়ে কল্পিত যে ‘সপ্তসিন্ধু’ যুগে যুগে বিদেশিদের আকৃষ্ট করেছিল, সেই ‘সপ্তসিন্ধু’ নাম থেকেই ‘হিন্দু’ নামের উদ্ভব হয়েছে।
(iii) খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে লেখা চিনা ইতিবৃত্তে ভারতবর্ষকে ‘তিয়েন-চু’ (Tien-tu) অথবা ‘চুয়ান্-তু’ (Chuan-tu) নামে অভিহিত করা হয়েছে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে চিনা পরিব্রাজক ইৎসিং লিখেছেন যে, সে যুগে ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলের লোকেরাই ‘হিন্দু’ নামে পরিচিত ছিল, অন্যত্র এই নামটি তারা নিজেরাই জানত না। এই স্বল্পখ্যাত নামই পরবর্তীকালে ভারতের সর্বত্র পরিচিতি লাভ করে।
এইসব ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারেই ভারতবর্ষ ইন্ডিয়া বা হিন্দুস্থান নামে পরিচিত হয়েছে, বিশেষ কোনো জাতি, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই নামটি সম্পর্কিত নয়।