লিওনার্দো দা ভিঞ্চি জীবনী – Leonardo da Vinci Biography in Bengali

Rate this post

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি জীবনী: gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Leonardo da Vinci Biography in Bengali. আপনারা যারা লিওনার্দো দা ভিঞ্চি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি র জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কে ছিলেন? Who is Leonardo da Vinci?

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪/১৫ এপ্রিল, ১৪৫২ – ২ মে, ১৫১৯) ইতালীয় রেনেসাঁস পর্বের চিত্রশিল্পী। অবশ্য বহুমুখী প্রতিভাধর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অন্যান্য পরিচয়ও সুবিদিত- ভাস্কর, স্থপতি, সঙ্গীতজ্ঞ, সমরযন্ত্রশিল্পী এবং বিংশ শতাব্দীর বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্য জনক। দা ভিঞ্চির জন্ম ফ্লোরেন্সের অদূরবতী ভিঞ্চি নগরের এক গ্রামে, ১৪৫২ সালের ১৪/১৫ই এপ্রিল। তার বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে মোনালিসা, দ্য লাস্ট সাপার অন্যতম। তার শৈল্পিক মেধার বিকাশ ঘটে খুব অল্প বয়সেই। আনুমানিক ১৪৬৯ সালে রেনেসাঁসের অপর বিশিষ্ট শিল্পী ও ভাস্কর আন্দ্রেয়া ভেরোচ্চোর কাছে ছবি আঁকায় ভিঞ্চির শিক্ষানবিশী জীবনের সূচনা। এই শিক্ষাগুরুর অধীনেই তিনি ১৪৭৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষত চিত্রাঙ্কনে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ১৪৭২ সালে তিনি চিত্রশিল্পীদের সংঘে যোগ দেন এবং এই সময় থেকেই তার চিত্রকর জীবনের সূচনা হয়

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি জীবনী – Leonardo da Vinci Biography in Bengali

নামলিওনার্দো দা ভিঞ্চি
জন্ম15 এপ্রিল 1452
পিতানোটারি পিয়েরে দা ভিঞ্চি
মাতাকাতেরিনা
জন্মস্থানভিঞ্চি,ইতালি, বর্তমানে ফ্লোরেন্সের প্রদেশ, ইতালি
জাতীয়তাইতালীয়
পেশাচিত্রশিল্পী
মৃত্যু2 মে 1519 (বয়স 67)

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি র জন্ম: Leonardo da Vinci’s Birthday

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৪৫২ সালের ১৪/১৫ এপ্রিল জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি র পিতামাতা ও জন্মস্থান: Leonardo da Vinci’s Parents And Birth Place

পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালীর শিল্প – সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে নতুন যুগের সূচনা হয় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন তার অন্যতম পথপ্রদর্শক। লিওনার্দোর জন্ম হয় ইতালীর ভিঞ্চি গ্রামের অ্যানপিয়ানো নামক স্থানে ১৪৫২ খ্রিঃ ১৪ ই এপ্রিল। পরবর্তীকালে যিনি বহু বিচিত্র গুণের আধারস্বরূপ হয়ে উঠেছিলেন, নিয়তির বিধানে জন্মের পর থেকেই তাঁকে নাটকীয় ঘটনার স্রোতে পড়তে হয়।

লিওনার্দোর মায়ের পরিবার ছিল অতি সাধাবণ। চাষবাসই ছিল তাদের জীবিকা। মা ক্যাটারিনা ছিলেন গ্রামের সরাইখানার সাধারণ পরিচারিকা। কিন্তু লিওনার্দোর বাবা পীয়িরো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন সম্ভ্রান্ত আইনজীবী পরিবারের সস্তান। স্বভাবতঃই তাঁর পছন্দ মত স্ত্রী তিনি ঘরে তুলতে পারলেন না। ক্যাটারিনার সঙ্গে পীয়িরোর সম্পর্ক তারা অস্বীকার করলেন এবং অন্য এক সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিলেন।

লিওনার্দোর সবে মাত্র জন্ম হয়েছে সেই সময়। নবজাতকের মুখের দিকে তাকিয়ে পিয়িরোর মায়া হল। তিনি তাকে নিজের প্রাসাদে তুলে আনলেন। সেই থেকেই মায়ের সঙ্গে চিরদিনের জন্য ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল লিওনার্দোর।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি র ছোটবেলা: Leonardo da Vinci’s Childhood

লিওনার্দোই ছিলেন ভিঞ্চি পরিবারের একমাত্র সন্তান। তাই শৈশবে তাঁর খেলার সঙ্গী কেউ ছিল না। নিজেই নিজের দুরন্তপনা নিয়ে মগ্ন থাকতেন। প্রকৃতি যেন মূর্তিমন্ত শিল্প করেই গড়েছিলেন বালক লিওনার্দোকে। যেমনি গায়ের রঙ, তেমনি একমাথা ঝাকড়া চুল, তেমনি চোখমুখের গড়ন। একবার তাকালে সহজে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। রূপের সঙ্গে অসামান্য বুদ্ধিও পেয়েছিলেন লিওনার্দো। কাজেই সহজেই সকলের প্রিয় হয়ে উঠলেন।

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লিওনার্দোর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। গণিতের নানা কঠিন সমস্যা তিনি অতি সহজেই সমাধান করে ফেলেন। এই সময়েই লিওনার্দোর গানবাজনার প্রতিও বিশেষ আগ্রহ দেখা দেয়। আর সুযোগ পেলেই দেখা যায় আপন মনে ছবি আঁকছেন।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি র শিক্ষাজীবন: Leonardo da Vinci’s Educational Life

তাঁর শিল্পপ্রতিভা লক্ষ্য করে লিওনার্দোর বাবা ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন ভেরোসিওর স্টুডিওতে। এখানেই শিল্পকার্যে লিওনার্দোর শিক্ষানবিশী শুরু হল। তখন তার বয়স আঠারো বছর। শিল্পী হিসেবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে লিওনার্দোর খ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় ভেরোসিওর অনেক অসমাপ্ত কাজও শেষ করার ভার পড়ে তার ওপর।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি র প্রথম জীবন: Leonardo da Vinci’s Early Life

১৪৭২ খ্রিঃ জুন মাসেই স্বাধীন শিল্পী হিসেবে লিওনার্দোর নাম ওঠে ইতালীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের ফ্লোরেনটাইন গীল্ড নামক পুস্তকে। লিওনার্দোর এই সময়কার অধিকাংশ ছবিই আজ হারিয়ে গেছে। অ্যাডোরেশন অব দ্য কিংস শীর্ষক অসমাপ্ত ছবিটিই কেবল পাওয়া যায়। কেবল চিত্রকলায় নয় স্থাপত্যে ও ভাস্কর্যেও লিওনার্দো ক্রমে দক্ষতা অর্জন করতে থাকেন।

১৪৭৭ খ্রিঃ থেকে ১৪৮২ খ্রিঃ পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছর লিওনার্দো ইতালীর বিখ্যাত লোরেঞ্জোর পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনভাবে ছবি আঁকতে থাকেন। অসংখ্য ছবি এঁকেছেন লিওনার্দো। কোথাও হয়ত শিশুর হাঁটুর চামড়ার খাঁজগুলো ধরা পড়েছে, কোথাও বা যুদ্ধরত সৈনিকের মুমূর্মু চেহারা, আবার কোথাও খেটে – খাওয়া মানুষের ঘর্মাক্ত রূপ। কোথাও আবার প্রার্থনারতা যুবতীর নতজানু দেহভঙ্গী। ভিখিরির গলার কাপাকাপা পেশিবন্ধন নিখুঁত হয়ে ধরা পড়েছে লিওনার্দোর তুলির আঁচড়ে।

এইসব ছবির উপকরণ সংগ্রহের জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছে শিল্পীকে। ঘন্টার পর ঘন্টা হাসপাতালে বসে কাটিয়েছেন মুমূর্ষু বৃদ্ধের শেষ অবস্থা দেখার জন্য। ফাসিকাঠে ঝোলার আগে কয়েদীর মানসিক প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তাও তিনি তন্ময় হয়ে লক্ষ্য করেছেন। লিওনার্দো নিজের সম্বন্ধে বলেছেন, ‘ আমি পছন্দ করি অদ্ভুত ধরনের কাজ করতে। ’ এই অদ্ভুত কাজের নেশাই তঁাকে চিত্রকর, সমরযন্ত্রের কারিগর, বীণাবাদক, শল্যচিকিৎসক, বিজ্ঞানী প্রভৃতি পেশায় দক্ষ করে তুলেছিল।

এই বহুমুখী দক্ষতার জন্যই তার সময়ে তিনি ‘ একের মধ্যে দশ মানুষ ’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। নতুন কিছু জানার প্রবল আগ্রহ ছেলেবেলা থেকেই ছিল লিওনার্দোর। এর ফলেই প্রকৃতির বুকের বিভিন্ন রহস্য ও সমাধান ধরা পড়েছিল তার কাছে। এইভাবেই তিনি চিত্রশিল্পী থেকে হয়ে উঠলেন বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অসাধারণ অবদান তাঁকে সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে।

লিওনার্দো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উৎসাহিত হয়েছিলেন মূলত ব্যবহারিক প্রয়োজনের তাগিদেই। চিত্রশিল্পীর অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি অনুভব করেছিলেন যে, সার্থক চিত্রশিল্পী হতে গেলে বিজ্ঞানের কয়েকটি বিভাগের বিস্তারিত জ্ঞান থাকা বিশেষ প্রয়োজন। সেই লক্ষ পূর্ণ করতে গিয়ে তিনি আলোকবিদ্যা, চর্ম্মের গঠনবৈচিত্র্য, শারীরস্থান প্রভৃতি বিষয়ে আকৃষ্ট হন। লিওনার্দো তার চিন্তাধারা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ এলোমেলোভাবে টীকার আকারে লিখে রাখতেন।

তার যে নোট বইটি পাওয়া গেছে তাতে পৃষ্ঠা সংখ্যা সাত হাজার। তাতে পাওয়া গেছে, শবব্যবচ্ছেদ বিদ্যার বিভিন্ন গবেষণা, যুদ্ধাস্ত্র, জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা, উড়ন্ত যান, ব্যঙ্গ চিত্র, ধাঁধাঁ, অঙ্ক, সঙ্কেত চিত্র প্রভৃতি ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানুষের মাথায় প্রথম আসে উড়োজাহাজ বা হেলিকপ্টারের কথা। অথচ চারশ বছর আগেই পঞ্চাশ শতাব্দীতে লিওনার্দো ডানাওয়ালা উড়ন্ত যান ও ডানাহীন যানের নানা ধরনের নকশা তৈরি করেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, উড়ন্ত যানের অ্যাবজরভার ধরনের যন্ত্রের কথা পর্যন্ত তার নকশায় বলা হয়েছে।

উড়ন্ত যানের নকশা তৈরি করবার জন্য বাতাসের স্রোতে উড়ন্ত পাখির ডানার বিস্তারের পদ্ধতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়ন করতে হয়েছে তাকে। দড়ি তৈরির উন্নত যন্ত্র, ফাইল তৈরির যন্ত্র, শান দেওয়ার যন্ত্র, বায়ুচালিত কল, সুর রচনার জন্য বিভিন্ন ধরনের নতুন যন্ত্র ও সূঁচও তিনি বানিয়েছিলেন। বল বিয়ারিং ব্যবহার করা একটি জলঘড়িও তার ছিল। ত্রিশবছর বয়স পর্যন্ত লিওনার্দো ফ্লোরেন্সে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত ছিলেন।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি র কর্ম জীবন: Leonardo da Vinci’s Work Life

১৪৮২ খ্রিঃ তিনি ফ্লোরেন্স ছেড়ে মিলানে আসেন। সেই সময়ে মিলানের শাসনকর্তা ছিলেন কাউন্ট লু দোভিকো। একবার তিনি বাদ্যযন্ত্রশিল্পীদের এক সভার আয়োজন করেন। দেশ – দেশান্তরের শিল্পীরা জড়ো হলেন সেই সভায়। লিওনার্দোও উপস্থিত হলেন নিজের হাতে তৈরি রুপোর একটা যন্ত্র নিয়ে, যন্ত্রের আকৃতি অনেকটা ঘোড়ার মাথার মত। শিল্পীদের সভায় দাঁড়িয়ে লিওনার্দো সেই যন্ত্র বাজিয়ে সকলকেস্তম্ভিত করেছিলেন।

মুগ্ধ কাউন্ট লিওনার্দোকে ডেকে চাকরি দিলেন। মিলানের প্রধান চিত্রশিল্পী ও ইঞ্জিনিয়ার পদে নিযুক্ত হলেন তিনি। নিজের পেশাদার কাজের সম্বন্ধেবলতে গিয়ে লিওনার্দো কাউন্টকে লেখা পত্রে বিভিন্ন সামরিকও নৌবিদ্যা সম্বন্ধীয় যন্ত্রপাতি আবিষ্কার ও নির্মাণে তার পারদর্শিতাব কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন। এটা করেছিলেন ইচ্ছে করেই, কেননা তিনি জানতেন একজন শাসকের কাছে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের চাইতে যুদ্ধে জেতার অস্ত্রের আকর্ষণই বেশি হওয়া স্বাভাবিক।

লিওনার্দোর উল্লিখিত সামরিক যন্ত্রপাতির মধ্যে সাঁজোয়া গাড়ি, আগুনে বোমা, স্থানান্তরযোগ্য সেতু, উঁচু প্রাচীরে আরোহণের উপযোগী দড়ির মই, বিশালাকার গুলতি, গোলা চালবার উপযুক্ত আড় ধনুক প্রভৃতি ছিল ৷ সেই সময়ে ইতালীর বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। ফলে তাকে অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের কাজেই এখানে বেশি সময় ব্যয় করতে হত। এই সময়েই লিওনার্দো ডাইভিং সুট ও সাবমেরিনের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সাবমেরিনের নির্মাণকৌশল তিনি প্রকাশ করেননি।

তাঁর ভয় ছিল, তার এই যন্ত্র মানুষ ভবিষ্যতে সমুদ্রের তলদেশ থেকে মানবজাতির ধ্বংসের জন্য ব্যবহার করতে পারে। মিলানে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভা দেখা দেয় ১৪৮৫ খ্রিঃ। এই সময়েই লিওনার্দো অঙ্কন করেন তাঁর বিখ্যাত চিত্র দি লাস্ট সাপার। কাউন্টের পৃষ্ঠপোষকাতায় চিত্রটি সাত্তামেরিয়ার ভোজনকক্ষে স্থান লাভ করে। লিওনার্দোর নোটবুকটি আবিষ্কার না হলে সাবমেরিনের মত তার অনেক আবিষ্কারের কথাই বিশ্ববাসীর অজানা থেকে যেত।

নীলামে উঠেছিল নোটবুকটি এবং উচ্চমূল্য নির্ধারিত হয়েছিল সেটির। কেবল বিষয়বস্তুর জন্যই নয় নোট বুকটির অন্যতম আকর্ষণ ছিল তার হস্তলিপি। সবই ছিল উল্টোভাবে লেখা— আয়নার সামনে ধরে পড়তে হয়। নোটবুকের পাঠোদ্ধার হলে বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলেছিলেন আরো আগে এসব কথা জানা গেলে আজকের বিজ্ঞানীদের বহু শতাব্দীর পরিশ্রম বেঁচে যেত।

নোটবুক থেকেই জানা গেছে ভবিষ্যৎ মহাযুদ্ধে যেসব মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হবে, তার অধিকাংশই লিওনার্দোর আয়ত্তে ছিল। স্পেন – আমেরিকার যুদ্ধে যে গাটলিং গান ব্যবহৃত হয়েছে, তার পথপ্রদর্শক ছিল লিওনার্দোর আবিষ্কৃত মেশিনগান। তার পরিকল্পিত বন্দুকটি ত্রিভুজাকৃতির অবলম্বনের ওপরে দাঁড় করানো যেত। অনেকগুলো নল ছিল বন্দুকের। প্রথম নল থেকে যখন গুলি ছোঁড়া হবে, তখন দ্বিতীয় নলে গুলি ভর্তি হবে। আবার দ্বিতীয় নলে যখন গুলি ছোঁড়া হবে তখন প্রথম নল ঠান্ডা হবে। এমনি আধুনিক ব্যবস্থা ছিল সেই বন্দুকের।

লিওনার্দোর অন্যতম আবিষ্কার ছিল দুই কাঠামো বিশিষ্ট জাহাজ। ওপরের অংশ শত্রপক্ষের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও জাহাজটি জলে ভাসতে পারত অভ্যন্তরীণ কাঠামোর জোরে। বিজ্ঞানীদের যেসব আবিষ্কার আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব করেছে, লিওনার্দোই ছিলেন তার পথপ্রদর্শক। এই কারণে বিজ্ঞানের জগতে লিওনার্দো প্রথম আধুনিক বা The first Modern বলে স্বীকৃত। লিওনার্দোর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর হিসেব দেওয়া এককথায় অসম্ভব ৷

কয়েকটি বিশেষ অবিষ্কার যা আমাদের জানা উচিত তা হল— বাতাসের বেগ পরিমাপক যন্ত্র অ্যানিমোমিটার, আধুনিক কালের স্বয়ংচালিত গাড়ির অডোমিটার তাঁরই আবিষ্কার। লিওনার্দোর পরিকল্পিত ঘড়িতেই সর্বপ্রথম ঘন্টা ও মিনিটের সময়সূচক হিসেবে দুটি কঁাটা ব্যবহৃত হয়। ভার উত্তোলনের সুবিধার জন্য অটোমোবাইল জ্যাকের মত একটিযন্ত্রও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন।

স্বয়ংচালিত দূরযানের বেগ নির্দেশক যন্ত্র স্পিডোমিটার তারই আবিষ্কার। এছাড়াও স্ক্রু – কাটিংমেসিন, ধাতু ছেদন যন্ত্র, চাষের উপযোগী বুলডজার . সিমেন্ট মিশ্রণের যন্ত্র, নদী থেকে কাদা তোলার যন্ত্র — এ সব কিছুই লিওনার্দো আবিষ্কার করেছিলেন। লিওনার্দোই প্রথম ব্যবহার করেন মেগনেটিক নিডল বা চুম্বক শলাকা। তিনি প্রমাণ করে দেখান যে আমাদের পৃথিবী একটি বিরাট চুম্বক। ডিফারেনশিয়াল গিয়ার এর তিনিই উদ্ভাবক, ইঞ্জিন চালনার যে চালনচক্র বা প্রপেলার তা – ও তার আবিষ্কার।

গাণিতিক হিসাবের বিষয়বস্তুকে রেখাচিত্রে বা গ্রাফস – এর সাহায্যে বোঝাবার চেষ্টা তিনিই প্রথম করেন। এককথায় বলা চলে জ্ঞান – বিজ্ঞানের প্রায় সর্বক্ষেত্রেই লিওনার্দোর স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। নিউটনের বহু পূর্বেই লিওনার্দো মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা উল্লেখ করে গেছেন। গ্যালিলিওর অনেক আগে লিওনার্দোই প্রথম সৌরজগৎ সম্বন্ধে স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে আসেন। তিনি তার নোটবইতে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, পৃথিবী ডিম্বাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্র নয়, অন্যান্য অনেক গ্রহের মধ্যে একটি।

যেসব নক্ষত্র আমরা খালি চোখে আকাশে দেখতে পাই সেগুলো কোটি কোটি মাইল দূরে। আমাদের সূর্য এই লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের মধ্যে একটি। সূর্যরশ্মির যে সাতটা রং আছে, যার বিচ্ছুরণ আমরা দেখতে পাই আকাশের রামধনুতে, এই বর্ণালীর বিষয়টিও লিওনার্দো নিউটনের আগেই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। ছবি আঁকার প্রয়োজনেই মানবদেহের প্রত্যেক স্থানের অস্থি ও পেশী খুঁটিয়ে দেখার জন্য বহু শব ব্যবচ্ছেদ করেন লিওনার্দো। এই বিষয়ে তার জ্ঞান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এঁকে রেখে গেছেন তিনি।

নরকঙ্কাল ও নরদেহের মাংসপেশীর সঠিক বর্ণনা তিনিই প্রথম দেন। লিওনার্দোর মানবদেহ সংক্রান্ত অসংখ্য চিত্র ও স্কেচের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশই ছিল হৃদপিন্ডের ওপর। হৃদপিন্ডের গঠন, কার্য ও ব্যবহার সম্বন্ধে তিনি দীর্ঘকাল গবেষণা করেন। তিনিই প্রথম দেখান যে, ফুস ফুস থেকে বায়ুনলের যে শাখাপ্রশাখা রয়েছে, তার সঙ্গে হৃদপিন্ডের কোন যোগ নেই। হৃদপিন্ডের ব্যবচ্ছেদ, অঙ্কন ও ছাঁচ নির্মাণের দ্বারা বহু পরীক্ষার পর লিওনার্দো মহাধমনীর মূলে অবস্থিত কপাটিকা বা ভালব আবিষ্কার করেন। এই কপাটিকাগুলি কেবল একদিকেই রক্ত সংবহনের কাজ করে।

তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে হৃদপিন্ডের চারটি নিলয় বা Ventricle থাকে। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত স্থপতিবিদ্যাতেও লিওনার্দোর বিচরণ ছিল অত্যন্ত সাবলীল। আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যায় তাঁর অবদান নগণ্য নয়। তিনি রাস্তা, গির্জা, সোপান শ্রেণী, আস্তাবল, কেন্দ্রীয়ভাবে তাপের ব্যবস্থা এবং ছোট ছোট শহরের নানা ধরনের নকশা তৈরি করেন। দীর্ঘদিন ধরে বহু বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন, বহু কিছু উদ্ভাবন করেছেন লিওনার্দো।

পড়ন্ত যৌবনে এসে তিনি কেমন ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েন। তার শিল্পদৃষ্টিও হয়ে এল স্তিমিত। কাজকর্ম ছেড়ে কিছুকাল ঘুরে বেড়ালেন মানটুয়া, ভেনিস, রোম, পার্মা প্রভৃতি স্থানে ৷ শেষে জন্মভূমি ফ্লোরেন্সে ফিরে আসেন। শেষ জীবন কাটে তার রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের অতিথি রূপে। তার উদভ্রান্ত অবস্থার সময়ে আঁকা অবিস্মরণীয় ছবি মোনালিসা চিত্র

চিত্রটি অঙ্কিত হয়েছিল ফ্লোরেন্সের গিয়োকেন্সের স্ত্রী লিসা জেরারডিনির ওপরে। লিসা ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে। কিন্তু তার সাজপোশাকে কোন জাঁকজমক থাকত না। ঘোর কালো রঙের পোশাক শরীরে রাখতেন তিনি। সম্ভ্রান্ত ঘরের অন্যান্য মেয়েদের মত হাতে কোন ঘড়িও ব্যবহার করতেন না। তার কাল পোশাক গ্রহণের পেছনের কারণটি ছিল বড়ই করুণ। একমাত্র শিশুপুত্রের মৃত্যুশোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন তিনি। জীবনে বেঁচে থাকার সার্থকতাই যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন।

লিওনার্দোর ওপর যখন লিসার ছবি আঁকার ভার পড়ে, তখন তার বয়স মাত্র একুশ। ছবিটি সম্পূর্ণ করতে শিল্পীর সময় লেগেছিল ছয় বছর। একই পোশাকের পটভূমিতে লিসার শোকাতুরা মূর্তিটি ধরে রেখেছেন লিওনার্দো। কিন্তু তার ঠোটে জুড়ে দিয়েছেন এক রহস্যময় বিচিত্র ক্রূর হাসি। এ যেন হাসি নয়, জীবনের প্রতি অনুচ্চারিত বিদ্রূপ আর অবজ্ঞা। মোনালিসা চিত্রের এই রহস্যময় হাসি চিত্রজগতের ইতিহাসে অনন্য।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি র মৃত্যু: Leonardo da Vinci’s Death

সর্বকালের বিস্ময় মানব লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ১৫১৯ খ্রিঃ ২ রা মে দক্ষিণ ফ্রান্সে অত্যন্ত সাধারণ এক মানুষের মত লোকান্তর যাত্রা করেন।

Leave a Comment