কানাইলাল দত্ত জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Kanailal Dutta Biography in Bengali. আপনারা যারা কানাইলাল দত্ত সম্পর্কে জানতে আগ্রহী কানাইলাল দত্ত র জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।
কানাইলাল দত্ত কে ছিলেন? Who is Kanailal Dutta?
কানাইলাল দত্ত (৩১ আগস্ট ১৮৮৮ – ১০ নভেম্বর ১৯০৮) ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী ছিলেন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের মধ্যে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হওয়া নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীকে হত্যা করার জন্য তার ফাঁসি হয়।
কানাইলাল দত্ত জীবনী – Kanailal Dutta Biography in Bengali
নাম | কানাইলাল দত্ত |
জন্ম | 30 আগস্ট 1888 |
পিতা | চুনীলাল দত্ত |
মাতা | ব্রজেশ্বরী দেবী |
জন্মস্থান | চন্দননগর, হুগলি, বাংলা, ব্রিটিশ ভারত |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | ভারতীয় বিপ্লবী |
মৃত্যু | 10 নভেম্বর 1908 (বয়স 20) |
কানাইলাল দত্ত র জন্ম: Kanailal Dutta’s Birthday
কানাইলাল দত্ত 30 আগস্ট 1888 জন্মগ্রহণ করেন।
কানাইলাল দত্ত র পিতামাতা ও জন্মস্থান: Kanailal Dutta’s Parents And Birth Place
বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের জন্ম ১৮৮৮ খ্রিঃ ৩১ শে আগস্ট চন্দননগরে। তাঁর পিতার নাম চুনিলাল দত্ত। শৈশবে বোম্বাইয়ে, পরে চন্দননগরে ডুপ্লে বিদ্যামন্দিরে ও হুগলী মহসীন কলেজে শিক্ষালাভ করেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়েই তিনি বিলাতি বস্ত্র বর্জন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে বিপ্লবী দলের মুখপত্র যুগান্তর পত্রিকার পরিচালক চারুচন্দ্র রায়ের কাছে বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন। বি.এ পরীক্ষার পরেই কানাইলাল কলকাতার গুপ্ত বিপ্লবী দলের কার্যকলাপে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
কানাইলাল দত্ত র কর্ম জীবন: Kanailal Dutta’s Work Life
১৯০৮ খ্রিঃ মানিকতলা বোমা মামলায় অস্ত্র আইনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। কানাইলাল ছিলেন নিরলস কর্মী। যেমন মেধাবী তেমনি বিশ্বস্ত। এবারে কিন্তু হাসপাতালের দিকে যেতে যেতে একটা আবিষ্কার করে ফেললেন কানাই। ফলের পুঁটলিটা কেমন অস্বাভাবিক রকমের ভারি ঠেকছে সন্দেহ হতেই নতুন কাপড়ের ঢাকনা খানিকটা সরালেন। তারপরেই চমকে উঠলেন, সেই সঙ্গে উল্লসিতও। একটা আস্ত আধুনিক রিভলবার। বুঝতে পারলেন, তাকে বাদ দিয়েই কিছু প্ল্যান করা হচ্ছে। কিন্তু তা তো হতে দেওয়া যায় না।
দেশের কাজে কানাইয়ের অংশ থাকবে না — এ কী করে হয় ? সত্যেনের কাছে এসেই ধরে পড়লেন কানাই। তাঁকে বলতে হবে সব ঘটনা। এড়ানো গেল না তাঁকে। বাধ্য হয়েই সত্যেনকে সব ঘটনা খুলে বলতে হল। শুনে কানাই বললেন, আমাকেও সঙ্গে নিতে হবে। সত্যেন তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তার নিজের হাতে গড়া ক্ষুদিরাম চলে গেছে, প্রফুল্লও গেছে। এবারে তাকেও যেতে হবে। তাঁর আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করবার জন্য থাকবে কানাইলাল আর অন্যান্য বিপ্লবীরা। কিন্তু কানাইলাল কোন কথাই শুনলেন না। জেদ ধরে বসলেন, তিনিও সঙ্গে থাকবেন। অগত্যা রাজী হতে হল সত্যেনকে।
তিনি জানালেন, সামনের পয়লা সেপ্টেম্বর মামলার তারিখ। ওইদিন নরেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিবৃতি দেবে। তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হবে না ; তার আগেই শেষ করে ফেলতে হবে। কানাই তো উল্লাসে আত্মহারা। কিন্তু নরেনকে নাগালে পাওয়া যাবে কি করে ? সত্যেন জানালেন, নরেন রয়েছে ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডে। একেবারে জামাই আদরে ৷ সদাসতর্ক প্রহরী হিগিনস রয়েছে তার প্রহরায়। এর মধ্য থেকেই কাজ হাসিল করতে হবে। অস্ত্র এসে গেছে হাতে। এবারে নিশ্চিন্ত হয়ে ফাঁদ পাতলেন সত্যেন। তিনি নরেনকে খবর পাঠালেন জেলের টানা – হ্যাচড়া আর সহ্য হচ্ছে না।
তিনিও রাজসাক্ষী হতে রাজি — ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তার সঙ্গেই বিবৃতি দেবেন। গোঁসাই খবরটা ওপরওয়ালা পুলিশ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিল। তারা সত্যেনের ইচ্ছা অকৃত্রিম কিনা যাচাই করে খুশি হয়ে তাঁর রাজসাক্ষী হবার আর্জি মঞ্জুর করল। পুলিশের নির্দেশে নরেন এবার সত্যেনকে উপযুক্তভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবার দায়িত্ব পেল। সে ইউরোপীয়ান ওয়ার্ড থেকে হাসপাতালে এসে এসে সত্যেনকে তালিম দিতে লাগল। বিপ্লবীদের বিশ্বাস নেই, তারা কখন কি করে বসে।
সেই কারণে নরেন যখন হাসপাতালে সত্যেনের কাছে আসত তার সঙ্গে প্রায়ই থাকত হিগিনস ও লিন্টন নামে দুজন শ্বেতাঙ্গ। দিনের পর দিন হাসপাতালে ডেকে এনে সত্যেন নরেন গোঁসাইয়ের সঙ্গে দিব্যি খাতির জমিয়ে তুললেন। নরেনের উৎসাহের অন্ত নেই। সত্যেনের মত লোক যদি Carrobarator রূপে অপরাধ স্বীকার করে তাহলে আর তার ভাবনা কি। দন্ড মকুব তো হবেই তার, চাই কি সপরিবারে বিলাত গিয়ে রাজার হালে দিন কাটাতেও পারবে। সত্যেনের সঙ্গে নরেনের সাক্ষাৎ ক্রমে নিয়মিত হয়ে উঠল। নরেন আগের দিন সত্যেনকে যা যা শিখিয়ে পড়িয়ে যায়, যেভাবে কথা বলতে বলে যায়, পরদিন সত্যেন সব উল্টেপাল্টে খিচুড়ি পাকিয়ে তাকে শোনান। কিন্তু এমন হলে তো চলবে না। দুজনের বিবৃতির সঙ্গতি থাকতে তো হবে।
এ জন্য নরেন তার বিবৃতি বারবার সত্যেনকে পড়ে শোনায়। সতর্ক হতে উপদেশ দেয়। সত্যেনও গভীর মনোযোগের ভান করে ভাল করে শেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই তার মনে থাকে না। শেষ পর্যন্ত দুর্বল স্মরণশক্তির অছিলা তুলে তিনি লিখিত এজাহার আদালতে পড়ে শোনাবার অনুমতি চান। পুলিশের কর্তা তার আবেদন সানন্দে মঞ্জুর করেন। এতদিন ছিল শোনার পালা। এবারে শুরু হলো সত্যেনের লেখার পালা। রোজ একটু একটু করে এজাহার লেখা হতে থাকে। আগস্ট মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত সত্যেনের খেলা এভাবেই চলতে থাকে। পরের দিন ১ লা সেপ্টেম্বর।
সেদিন দেবব্রত, ইন্দ্রনাথ, যতীন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ আটজনের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী নরেনের জবানবন্দী দেবার কথা। সত্যেন্দ্রনাথ নরেনের কাছে জানতে পারেন, আরও অনেক নতুন নাম সেদিন প্রকাশ হবে। ফলে দেশের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ধৃত হবেন। বিপ্লবীদের কাজের মেরুদন্ড এর ফলে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বে। সত্যেন এই দিনটির প্রতীক্ষাতেই রয়েছেন। কানাইলালের সঙ্গে পরামর্শ হয়ে যায় তার। নরেনকে নিকেশ করার চেষ্টা আগে তিনি করবেন। কোন কারণে তা বার্থ হলে কানাইলাল চেষ্টা করবেন। কাজটা সারা হবে ডিস্পেনসারীর মধ্যে। সেখানেই সত্যেন নরেনকে ডেকে আনবেন।
কানাই ডিস্পেনসারীর বারান্দায় থাকবেন। দাঁত মাজার অছিলায়। সশস্ত্র অবস্থাতেই থাকবেন। যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাই সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথ ও কানাইলাল যে হত্যার পরিকল্পনা পাকা করলেন, তার সম্পর্কে কয়েকটি কথা জানা দরকার। নরেন গোঁসাই ছিল শ্রীরামপুরের জনৈক ধনী জমিদারের আদরের দুলাল। ফলে যৌবনে যতটা দুর্নীতিপরায়ণ হওয়া সম্ভব তার কিছুই তার বাকি ছিল না। বখাটেগিরি করতে করতেই তার স্বদেশী হওয়ার বাসনা জাগে।
১৯০৬ খ্রিঃ গোড়ার দিকে সে রামদাস মুখোপাধ্যায় ও বাঁকুড়ার সুরেন ব্যানার্জীর চিঠি নিয়ে কলকাতায় যুগান্তর অফিসে এসে চেষ্টাচরিত্র করে বারীন্দ্রকুমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং দলভুক্ত হয়। অরবিন্দ তাঁর কারাকাহিনীতে নরেন গোঁসাই সম্পর্কে লেখেন “গোঁসাইয়ের কথা নির্বোধ ও লঘুচেতা লোকের কথার ন্যায় হলেও তেজ ও সাহসপূর্ণ ছিল। তাঁহার তখন বিশ্বাস ছিল যে, তিনি খালাস পাইবেন। তিনি বলিতেন, আমার বাবা মোকদ্দমার কীট, তাঁহার সঙ্গে পুলিস কখনো পারিবে না। আমার এজাহার ও আমার বিরুদ্ধে যাইবে না, প্রামাণিক হইবে পুলিশ আমাকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়া এজাহার করাইয়াছে।” “আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি পুলিসের হাতে ছিলে সাক্ষী কোথায় ? ‘ গোঁসাই অম্লানবদনে বলিলেন, “ আমার বাবা কতশত মোকদ্দমা করিয়াছেন, এসব বেশ বোঝেন। সাক্ষীর অভাব হইবে না।
এইরূপ লোকই approver হয় …… অন্য বালকদের ন্যায় তাহার শান্ত ও শিষ্ট স্বভাব ছিল না। তিনি সাহসী, লঘুচেতা এবং চরিত্রে, কথায় কর্মে অসংযত ছিলেন। ধৃত হইবার কালে নরেন গোঁসাই তাহার স্বাভাবিক সাহস ও প্রলভতা দেখাইয়াছিলেন ; কিন্তু লঘুচেতা বলিয়া কারাবাসের যৎকিঞ্চিৎ দুঃখ ও অসুবিধা সহ্য করা তাঁহার পক্ষে অসাধ্য হইয়াছিল। তিনি জমিদারের ছেলে, সুতরাং সুখে বিলাসে, দুর্নীতিতে লালিত হইয়া কারাগৃহের কঠোর সংযম ও তপস্যায় অত্যন্ত কাতর হইয়াছিলেন আর সেইভাব সকলের নিকট প্রকাশ করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই।
যে কোন উপায়ে এই যন্ত্রণা হইতে মুক্ত হইবার উৎকট বাসনা তাঁহার মনে দিন দিন বাড়িতে লাগিল। প্রথম তাঁহার এই আশা ছিল যে নিজের স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করিয়া প্রমাণ করিতে পারিবেন যে পুলিস তাঁহাকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়া দোষ স্বীকার করাইয়াছিলেন। তিনি আমাদের নিকট জানাইলেন যে তাঁহার পিতা সেইরূপ মিথ্যাসাক্ষী জোগাড় করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন। কিন্তু অল্পদিনেই আর একভাব প্রকাশ পাইতে লাগিল। তাঁহার পিতা ও একজন মোক্তার তাঁহার নিকট জেলে ঘন ঘন যাতায়াত আরম্ভ করিলেন, শেষে ডিটেকটিভ শামসুল আলমও তঁাহার নিকট আসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া গোপনে কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন।
এই সময়ে হঠাৎ গোঁসাইয়ের কৌতূহল ও প্রশ্ন করিবার প্রবৃত্তি হইয়াছিল বলিয়া অনেকের সন্দেহের উদ্রেক হয়। ভারতবর্ষের বড় বড় লোকের সহিত তাঁহাদের আলাপ বা ঘনিষ্ঠতা ছিল কিনা, গুপ্ত সমিতিকে কে কে আর্থিক সাহায্য দিয়া তা পোষণ করিয়াছিলেন, সমিতির লোক বাহিরে বা ভারতের অন্যান্য প্রদেশে কে কে ছিল, কাহারা এখন সমিতির কার্য চালাইবেন, কোথায় শাখা – সমিতি রহিয়াছে ইত্যাদি অনেক ছোট – বড় প্রশ্ন বারীন্দ্র ও উপেন্দ্রকে করিতেন।
গোঁসাই – এর এই জ্ঞানতৃষ্ণার কথা অচিরাৎ সকলের কর্ণগোচর হইল এবং শামসুল আলমের সঙ্গে তাহার ঘনিষ্ঠতার কথাও আর গোপনীয় প্রেমালাপ না হইয়া Clean Secret হইয়া উঠিল। ইহা লইয়া অনেক আলোচনা হয়, এবং কেহ কেহ ইহাও লক্ষ্য করে যে এইরূপ পুলিস দর্শনের পরই সর্বদা নব নব প্রশ্ন গোঁসাইয়ের মনে ফুটিত। বলা বাহুল্য, তিনি এই সকল প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পান নাই। যখন প্রথম প্রথম এই কথা আসামীদের মধ্যে রাষ্ট্র হইতে লাগিল, তখন গোঁসাই স্বয়ং স্বীকার করিয়াছিলেন যে পুলিস তাহার নিকট আসিয়া রাজার সাক্ষী হইবার জন্য তাঁহাকে নানা উপায়ে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছেন।
কিন্তু আমাকে কোর্টে একবার এইকথা বলিয়াছিলেন। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, আপনি কি উত্তর দিয়াছেন ? তিনি বলিলেন, আমি কি শুনিব ! আর শুনিলেও আমি কি জানি যে তাহাদের মনের মত সাক্ষী দিব ? ” তাহার কিয়ৎদিন পরে আবার যখন এই কথা উল্লেখ করিলেন, তখন দেখিলাম ব্যাপারটা অনেকদূর গড়াইয়াছে। জেলে Identification parade- এর সময় আমার পার্শ্বে গোঁসাই দাঁড়াইয়াছিলেন, তখন তিনি আমাকে বলেন, পুলিশ কেবলই আমার নিকটে আসে।
আমি উপহাস করিয়া বলিলাম, আপনি এই কথা বলুন না কেন যে সার আন্ড্রু ফ্রেজার গুপ্ত সমতিরি প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তাহা হইলে তাহাদের পরিশ্রম সার্থক হইবে। গোঁসাই বলিলেন, সেই ধরনের কথা বলিয়াছি বটে। আমি তাঁহাকে বলিয়াছি যে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী আমাদের head এবং তাঁহাকে একবার বোমা দেখাইয়াছি। আমি স্তম্ভিত হইয়া তাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই কথা বলিবার প্রয়োজন কি ছিল ? গোঁসাই বলিলেন, আমি ওদের a দ্ধি করিয়া ছাড়িব। সেই ধরনের আরও অনেক খবর দিয়াছি। বেটারা carroboration খুঁজিয়া মরুক। কে জানে এই উপায়ে মোকদ্দমা ফাসিয়াও যাইতে পারে।
ইহার উত্তরে আমি কেবল বলিয়াছিলাম, এই নষ্টামি ছাড়িয়া দিন। উহাদের সঙ্গে চালাকি করিতে গেলে নিজে ঠকিবেন। জানিনা, গোঁসাইয়ের এই কথা কতদূর সত্য ছিল। আর সকল আসামীদের এই মত ছিল যে আমাদের চক্ষে ধূলা দিবার জন্য তিনি এই কথা বলিয়া ছিলেন। আমার বোধ হয় যে তখনও গোঁসাই approver হইতে সম্পূর্ণ কৃতনিশ্চয় হন নাই, তাহার মন সেই দিকে অনেকদূর অগ্রসর হইয়াছিল সত্য।
কিন্তু পুলিসকে ঠকাইয়া তাঁহাদের কেস মাটি করিবার আশাও তাঁহার ছিল। চালাকি ও অসদুপায়ে কার্যসিদ্ধি দুষ্প্রবৃত্তির স্বাভাবিক প্রেরণা। তখন হইতে বুঝিতে পারিলাম যে, গোসাই পুলিসের বশ হইয়া সত্যমিথ্যা তাঁহাদের যাহা প্রয়োজন, তাহা বলিয়া নিজে রক্ষা পাইবার চেষ্টা করিবেন। একটি নীচ স্বভাবের আরও নিম্নতর দুষ্কর্মের দিকে অধঃপতন আমাদের চক্ষের সম্মুখে নাটকের মত অভিনীত হইতে লাগিল। আমি দিন দিন দেখিলাম, গোঁসাইর মন কিরূপে বদলাইয়া যাইতেছে, তাহার মুখ, ভাবভঙ্গী, কথাবার্তারও পরিবর্তন হইতেছে। তিনি যে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাহার সঙ্গীদের সর্বনাশ করিবার যোগাড় করিতেছিলেন, তাহার সমর্থনের জন্য নানা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যুক্তি বাহির করিতে লাগিলেন। এমন interesting psychological study প্রায় হাতের নিকট পাওয়া যায় না।”
১৯০৮ খ্রিঃ ১ লা সেপ্টেম্বর সোমবার দিন সকালে সত্যেনের আহ্বানে নরেন এসেছিল হাসপাতালে। সেই সময় তার প্রহারায় ছিল হিগিনস ও লিন্টন নামে দুই শ্বেতাঙ্গ প্রহরী। সত্যেন্দ্র দোতলায় ডিসপেনসারীর মধ্যে একটি বেঞ্চিতে বসেছিলেন। কানাই দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। নরেনকে দেখেই কানাই বারান্দায় চলে যান। তিনি দাঁত মাজার ভান করে অপেক্ষা করতে থাকেন। কান সজাগ রাখেন ঘরের দিকে। ঘরের ভেতরে দুচার কথার পরেই সত্যেন নরেনকে গুলি করেন। গুলি উরুতে বিদ্ধ হয়। বাপরে বলে আর্তনাদ করেই নরেন ঘর থেকে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসে। হিগিনস ছুটে যায় সত্যেনকে ধরতে। ধস্তাধস্তিতে হিগিনসের মণিবন্ধে গুলি লাগে। সে সত্যেনকে ছেড়ে দিয়ে নরেনের অনুসরণ করে।
কানাই নরেনকে পালাতে দেখেই বিপুল বিক্রমে তার পশ্চাদ্ধাবন করেন। হাসপাতালের গেট পার হয়ে নরেনের কাছাকাছি পৌঁছে কানাই দ্রাম। দ্রাম। গুলি চালাতে থাকেন। গুলি খেয়ে নরেন সেখানেই স্নানঘরের পাশে নর্দমার মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান। এই সময় নরেনের দেহরক্ষী শ্বেতাঙ্গ কয়েদী লিন্টন কানাইকেধরতে গেলে তার গুলিতে লিন্টনের কপালের চামড়া ছড়ে যায়। সে সভয়ে পিছিয়ে পড়ে। এই সুযোগে কানাই নরেনকে আর একবার গুলিতে বিদ্ধ করেন। সত্যেনও এগিয়ে আসেন। দুজনে শেষ গুলিটি পর্যন্ত নরেনের ওপর বর্ষণ করেন। সব মিলিয়ে তাঁরা নয়টি গুলি ছোঁড়েন। তার মধ্যে চারটি নরেনের শরীরে বিদ্ধ হয়।
এরপর জেলের পাগলা ঘন্টি ভোম্বা (whistle) বেজে ওঠে। সশস্ত্র পুলিস সৈন্যরা এগিয়ে এসে সত্যেন ও নরেনকে বন্দি করে। মামলায় সত্যেন নিজের পক্ষে উকিল দিলেও কানাই কোন উকিল দিলেন না। কয়েদীর পোশাকেই মামলা চলাকালীন তিনি আদালতে হাজির হতেন। সাফ সাফ বলতেন, আমিই মেরেছি নরেনকে। ঘটনাচক্রে সত্যেন কাছে থাকলেও এ ব্যাপারে তার কোন অংশ ছিল না। আমি একাই মেরেছি। মামলা চলেছিল আলিপুরের দায়রা জজ মিঃ এফ.আর রো – এর আদালতে। মিঃ রো কানাইকে প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি রিভলভার পেলে কোথায় ? কানাইলাল হেসে জবাব দিয়েছিলেন, কে দিয়েছে ! দিয়েছে ক্ষুদিরামের আত্মা। —সরকারী খরচে কোন উকিল রাখতে চাও ? –ধন্যবাদ। তার কোন প্রয়োজন নেই। বিচারে কানাইয়ের সাজা হল প্রাণদন্ড। হাইকোর্টও এই দণ্ড বহাল রাখলেন। কারাগারে কানাই গানে গল্পে মশগুল হয়ে থাকতেন। তার ওজন বেড়েছিল ১৬ পাউন্ড।
কানাইলাল দত্ত র মৃত্যু: Kanailal Dutta’s Death
এ ছিল এক অস্বাভাবিক ব্যাপার। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামীর মনে যে মৃত্যু সম্পর্কে কোন বিকার ছিল না এর চাইতে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে। জেলখানায় কানাইলালের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তার অশ্রুমুখী মা। কানাই হাসি – উদ্ভাসিত মুখে তাকে বলেছিলেন, ‘ এতদিন তুমি ছিলে আমার মা। আর আজ, আজ তুমি সারা বাংলাদেশের মা। একি কম ভাগ্যের কথা। ১৯০৮ খ্রিঃ ১০ ই নভেম্বর ফাসির দিন ধার্য হয়েছিল। রাত শেষ হবার আগেই হাসিমুখে ফাসির রজ্জু গলায় পড়ে বীরের মৃত্যু বরণ করলেন কানাইলাল। সেদিন জেল – গেটের বাইরে এক বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল।
বীর কানাইকে শেষবারের মত একবার দেখে ধন্য হবার জন্য উপস্থিত হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। একসময় শবদেহ বাইরে নিয়ে আসা হল। অবিরাম শঙ্খধ্বনির সঙ্গে শুরু হল মহিলাদের লাজ বর্ষণ। হাজার হাজার মানুষ শবানুগমন করল। শোকযাত্রা অগ্রসর হতে থাকল কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে। সেদিন শিশু – বৃদ্ধ, বাঙ্গালী – অবাঙ্গালী নির্বিশেষে পুষ্পবর্ষণ করেছেন শবদেহ। কানাইয়ের স্পর্শধন্য সেই পুষ্প দেবতার প্রসাদী ফুল রূপে সংগ্রহ করে কপালে ছুইয়েছেন কানাইয়ের দেশবাসী। কালীঘাটের পূজারী ব্রাহ্মণগণ মায়ের প্রসাদী ফুলের মালা এনে দিয়েছিলেন আমাদের পাগলী মায়ের পাগল ছেলের শবদেহে। এ মালা কানাই ছাড়া আর কাকে মানায়।