শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর জীবনী | Sarat Chandra Pandit Dada Thakur Biography in Bengali

Rate this post

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর জীবনী: Gksolve.in আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Sarat Chandra Pandit Dada Thakur Biography in Bengali. আপনারা যারা শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর সম্পর্কে জানতে আগ্রহী শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর কে ছিলেন? Who is Sarat Chandra Pandit Dada Thakur?

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত (২৭ এপ্রিল, ১৮৮১ – ২৭ এপ্রিল, ১৯৬৮) বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজে দাদাঠাকুর নামেই পরিচিত, তিনি ছিলেন একজন বাঙালি কথাশিল্পী ও সাংবাদিক৷ যিনি মুখে মুখে ছড়া, হেঁয়ালী ও হাস্য কৌতুক রচনা করতেন। তার রচিত নানান হাসির গল্প বাঙলা সাহিত্যের অমর কীর্তি৷ তার প্রকাশিত বিখ্যাত গ্রন্থ বোতল পুরাণ।

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর জীবনী – Sarat Chandra Pandit Dada Thakur Biography in Bengali

নামশরৎ চন্দ্র পণ্ডিত (দাদাঠাকুর)
জন্ম27 এপ্রিল 1879
পিতাহরিলাল পণ্ডিত
মাতাতারাসুন্দরী দেবী
জন্মস্থানসিমল্যান্ডি, ভদ্রপুর, বীরভূম জেলা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাসাংবাদিকতা, বিদ্রূপাত্মক সাহিত্য রচয়িতা, কবি, সামাজিক সমালোচক, গীতিকার
মৃত্যু27 এপ্রিল 1968 (বয়স 87)

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর এর জন্ম: Sarat Chandra Pandit Dada Thakur’s Birthday

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর 27 এপ্রিল 1879 জন্মগ্রহণ করেন।

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Sarat Chandra Pandit Dada Thakur’s Parents And Birth Place

দাদাঠাকুর ছিলেন এমন এক বিরল চরিত্রের মানুষ। তার প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ ও স্বাধীনতাপ্রিয়তা আদর্শরূপে স্বীকৃত। দাদাঠাকুরের আসল নাম ছিল শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। বাংলা ১২৮৮ সালের ১৩ ই বৈশাখ মুর্শিদাবাদ জেলার অখ্যাত অবজ্ঞাত দরফপুর গ্রামে তার জন্ম হয়। তার পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ। শৈশবেই তিনি পিতা – মাতাকে হারান। কিন্তু তাঁর পিতৃব্য রসিকলাল তাকে কোনদিনই তাঁদের অভাব বুঝতে দেন নি।

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর এর শিক্ষাজীবন: Sarat Chandra Pandit Dada Thakur’s Educational Life

একদিকে তার স্নেহ – ভালবাসা, অন্যদিকে তার কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও শাসনের মধ্য দিয়ে বালক শরৎচন্দ্র বেড়ে উঠতে লাগলেন। সাতবছর বয়সে পিতৃব্য রসিকলাল বালক শরৎচন্দ্রকে জঙ্গীপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। আর্থিক অসঙ্গতির জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁকে অর্ধেক বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেন।

ছাত্রজীবনেই বালক শরৎ চন্দ্রের মধ্যে কবিত্ব – প্রতিভার স্ফুরণ ঘটতে দেখা যায়। ছাত্রাবস্থাতেই তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা করে তিনি সহপাঠী ও শিক্ষক মশাইদের বিস্ময়ের কারণ হন। একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে এক পঙ্গুলোকের দেখা পান। লোকটা কাঠের পায়ের সাহায্যে কোনরকমে পথ পাড়ি দিচ্ছে। শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের পা দুটো ছিল নগ্ন। পঙ্গু লোকটাকে দেখে শরৎচন্দ্রের মনে অনুশোচনা ও ব্যথার উদ্রেক হ’ল।

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর এর কর্ম জীবন: Sarat Chandra Pandit Dada Thakur’s Work Life

সে মুহূর্তেই তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, জীবনে কোনদিন জুতো পায়ে দেবেন না। পরিণত বয়সে তিনি লাট সাহেবের দরবারে, জমিদার ও সঙ্গতি সম্পন্ন ব্যক্তি প্রভৃতি সবার কাছেই নগ্নপায়ে যাতায়াত করতেন। এ কাজে তিনি কোনদিনই এতটুকু কুণ্ঠিত বা সঙ্কোচ বোধ করতেন না। শরৎচন্দ্র আমৃত্যু একই সাদামাঠা পোশাক – হাঁটুর ওপরে ধুতি, ফতুয়া বা একটি মাত্র উত্তরীয় ছিল তাঁর সম্বল। লাট সাহেব থেকে আরম্ভ করে ডিস্ট্রিকট ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত সকলের সঙ্গে এ পোশাকে নিঃসঙ্কোচে মেলামেশা করেছেন।

অন্যান্য অধিকাংশ বাঙালীর মত অনুকরণপ্রিয়তা দোষ তার আদৌ ছিল না। বাইরে ও ভেতরে তিনি ছিলেন যথার্থই একজন খাঁটি বাঙালী। কিন্তু সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খাঁটি ইওরোপিয়ানদের মতই সচেতন। গ্রামের বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে শরৎচন্দ্র ভর্তি হলেন বর্ধমান রাজ কলেজে। সেখানকার পাঠ শেষ করে ফিরে এলেন জঙ্গীপুরের বাড়িতে। এবার দু’পয়সা রোজগারের চিন্তা করা দরকার।

কলকাতার এক ছাপাখানার সরঞ্জাম বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে ছোট্ট একটা ছাপার মেশিন ক্রয় করলেন। মাত্র একুশ বছর বয়সে, ১৯০২ সালে তিনি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করলেন। নাম দিলেন পণ্ডিত প্রেস, রঘুনাথগঞ্জ। পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র তাঁর ছাপাখানার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন— ‘ আমার ছাপাখানার আমিই প্রোপ্রাইটর, আমি কম্পোজিটর, আমি প্রুফ রিডার আর আমি ইঙ্ক – ম্যান। কেবল প্রেস – ম্যান আমি নই।

সেটি ম্যান নয় — উওম্যান অর্থাৎ আমার অর্ধাঙ্গিনী। ছাপাখানার কাজে ব্রাহ্মণী আমাকে সাহায্য করেন, স্বামী স্ত্রীতে আমরা ছাপাখানা চালাই। ‘শরৎচন্দ্রের ছাপাখানায় নিমন্ত্রণপত্র, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, উপহারপত্র এবং হ্যান্ডবিল জাতীয় যাবতীয় কাজ ছাপা হতে লাগল। প্রেস চালাবার ফাঁকে তিনি সাধ্যমত পরোপকারও করতেন। তার এক কর্মচারী ছিল বোবা – কালা। শরৎচন্দ্র কারো কাছেই কোনদিন মুখ ফুটে কিছু চাইতেন না। মানুষ তো নয়ই, এমন কি দেবতার কাছেও কিছু চাওয়া ছিল তাঁর প্রকৃতি বিরুদ্ধ।

দেবতাদের যা দেবার তাতো জন্মকালে একবারেই দিয়ে দিয়েছেন হাত, পা, চোখ, কান ও মুখ প্রভৃতি। মানুষ যদি সেগুলোর সদ্ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজন মেটাতে না পারে তার জন্য দায়ী দেবতারা নয়, মানুষ নিজে। জ্ঞান হবার পর থেকে তিনি কোনদিন সরস্বতীর অঞ্জলি দেন নি। তবে কি তিনি নাস্তিক ছিলেন ? অবশ্যই না। পূজান্তে অঞ্জলি দেবার সময় ‘দেহী ‘ বলতে হবে বলেই তিনি একাজ থেকে দূরে সরে থাকতেন। বিপ্লবী নালিনীকান্ত সরকার দীর্ঘদিন শরৎচন্দ্রের আশ্রয়ে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। তাঁকে প্রেসের কাজে সাহায্য করতেন।

তিনি বলেছেন, ‘একবার দাদাঠাকুরের একটি ছেলের ভীষণ অসুখ করে বাঁচার সম্ভাবনা কম। তার সহধর্মিনী দুর্গাপ্রতিমা দর্শন করে এসে দাদাঠাকুবকে বললেন- ছেলের অসুখের জন্য মায়ের কাছে মানত করে এলাম। মাকে বললাম, মা আমার ছেলেকে ভাল করে দাও, আসছে বছর তোমার ভোগ দেব। ‘ শুনে দাদাঠাকুর ব্রাহ্মণীকে বললেন — ‘ যিনি নিজের ছেলের শুঁড় ভাল করতে পারেন না, তিনি তোমার ছেলের কি করবেন ? ‘

শরৎচন্দ্র এবার ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন যাতে মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী ছাপা হ’ত পত্রিকাটির সম্পাদক তিনিই ছিলেন, আর তিনিই ছিলেন কম্পোজিটর ও প্রেসম্যান যা একেবারেই কল্পনাতীত। পত্রিকাটি ছাপাবার জন্য একটি নতুন ছাপার মেশিন কিনতে গিয়ে এক ইংরেজ দোকানীর মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। তার বিচিত্র পোশাক দেখে সাহেব তো হেসেই খুন। তার ওপর কাঁধে একটি টিনের চোঙ ঝুলিয়ে রাখতে দেখে আরও বেশী করে তার হাসির উব্রক হ’ল।

চোঙটির প্রসঙ্গে সাহেব প্রশ্ন করলে তিনি ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিতে গিয়ে সেটার মুখ খুলে তার ভেতর থেকে ধূমপানের সরঞ্জামাদি বের করতে করতে বল্লেন — ‘এতে আমার জাতীয় স্মোকিং অ্যাপারেটাস রয়েছে।’ এবার তার ভেতর থেকে একটি হুকো, কল্কে, চকমকি পাথর, টিকেও কিছু তামাক বের করলেন। তারপর কল্কে সাজিয়ে চেয়ারের ওপর পা তুলে বিচিত্র ভঙ্গিতে বসে মৌজ করে ধূমপান করতে লাগলেন। সাহেব ভদ্রলোক তো সবিস্ময়ে তার কান্ড দেখতে লাগলেন।

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর এর রচনা: Written by Sarat Chandra Pandit Dada Thakur

শরৎচন্দ্র কর্তব্য সম্বন্ধে খুবই সজাগ ছিলেন। নইলে গলা সমান জল ভেঙ্গে স্কুলের প্রশ্নপত্র পৌঁছে দিতে কখনই উৎসাহী হতেন না। শরৎচন্দ্র ছাত্র – ছাত্রীদের ইংরাজী শিক্ষার মুশকিল আসান করতে গিয়ে চমৎকার এক পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। ফার্স্ট পারসন, সেকন্ড পারসন ও থার্ড পারসনের মধ্যে বাক্যে কোন্‌টি আগে বা পরে বসবে সে বিষয়ে একটি চমৎকার ছড়া লিখলেন—

“আমি, তুমি এবং তিনি যদি একই ক্রিয়ার কর্তা হন বিপদকালে মনে রেখো হও।”

অর্থাৎ প্রথমে সেকন্ড পারসন্, পরে থার্ড পারসন্ ও সব শেষে ফার্স্ট পারসন্ বসবে। পাংচুয়েশন্ সম্বন্ধে তিনি লিখলেন— মন, শুনরে পাংচুয়েশান / আই অ্যাম্ ভেরী বোল্ড / টু পাংচুয়েট হাউসহোল্ড, / সহজ উপায় বের করেছি যখন / কমা বসাইবে মাউন্ট এ সাইড – এ, কমা বসাইবে স্মিট্ – এ ওয়াইড – এ . গ্রীমেতে কোলন ড্যাসের সহিতে, সী এ ফুলস্টপ জানে সর্বজন।…. ইত্যাদি।

অঙ্ক শেখার চমৎকার যে ছড়াটি তখনকার দিনে ছাত্রদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াতো তা হচ্ছে– “কোটি লক্ষ হাজার শত / লিখে রাখো মনের মত। / ফি ঘরেতে জোড়া জোড়া / শতের ঘরে এক। / ডাইনে দুটো শূন্য দিয়ে / মজা করে দেখ।” শরৎচন্দ্রের তাৎক্ষণিক কবিতা রচনার ক্ষমতা দিল অসাধারণ। একবার গুরুসদয় দত্ত – র সঙ্গে এক উৎসব – অনুষ্ঠানে তার চিরাচরিত পোশাক পরে গেলেন।

সভায় স্বয়ং বড়লাট বাহাদুর সভাপতিত্ব করছেন। বহু রাজা জমিদারও সভায় উপস্থিত। কেতাদুরস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পাশে এমন এক বিচিত্র পোশাক পরা গেঁয়ো প্রৌঢ়কে দেখে উপস্থিত সবাই তো রীতিমত নাক সিঁটকাতে লাগলেন। তিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ভাষণের শুরুতে তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা করে শোনালেন— ‘আই অ্যাম কামিং ফ্রম্ মুর্শিদাবাদ / বাট নট ফ্রম বারহাম্ পোর, / হ্যাড আই কাম ফ্রম দ্যাট ভেরী প্লেস / অল মাইট হ্যাভ শাট্ আপ দ্য ডোর, / দে মাইট হ্যাড্ থট্ দ্যাট্ হ্যাভ কাম / ফ্রম দ্য ফেমাস্ অ্যাসাইলাম্, / আই অ্যাবোড ইন সাচ এ প্লেস / হুইচ ইজ নাউ ইন্‌ ফুল ডিসট্রেস্। …. দ্য ম্যাজিস্ট্রেট হ্যাজ ইন্ডেন্টেড মি / টু এন্টারটেন্‌ ইওর এক্সেলেন্সি।

শরৎচন্দ্র ছিলেন একজন যথার্থ সমাজসংস্কারক। সমাজের বুকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা ‘পণপ্রথা ‘ – র বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। তিনি বহু কবিতা লিখে, ছাপিয়ে এ কুপ্রথার বিরুদ্ধে কঠিন কুঠারাঘাত করেছেন। বিদূষক পত্রিকার এক জায়গায় পণপ্রথার কুফল সম্বন্ধে লিখেছেন — শাশুড়ির উক্তি— “কী কুক্ষণে লক্ষ্মীছাড়া / ঢুকলি এসে আমার ঘর / স্কন্ধে চেপে আসার পরে / সোনার ছেলে করলি পর।”

বধূর উক্তি— “নিজের মন্দ নিজেই করেছ / ঝগড়ার কোন নাহিকো ফল / কি আর হইবে বল মিছামিছি / গোড়া কেটে দিয়ে আগায় জল / জন্ম হইতে কলেজ ঘরটা / হিসাব করিয়া চার হাজার, / বাবার নিকটে নিয়েছ গুনিয়া / পুত্রে দাবী কেন আবার ? পণপ্রথার কুফল সম্বন্ধে তিনি আর এক কবিতায় লিখেছেন— “তুমি প্রভু, আমি দাসী / আমি স্ত্রী, তুমি স্বামী, / কারণ, তোমার বাবা মহাজন, / আর আমার বাবা আসামী, / তান্ন নাই মোর বাপের ঘরে, / তবু এলাম কত গয়না পরে, / পেয়েছিলে উচ্চশিক্ষা / শ্বশুরকে করাতে ভিক্ষা, / এই হৃদয়ে গর্ব করো / বল — এম.এ ., বি.এ. পাশ আমি।” ……. কলিকাতা বেতারকেন্দ্রে ‘গল্পদাদুর আসর’ – এ শরৎচন্দ্র লিখিত গল্প ও হাস্যরস সিক্ত ঘটনা পরিবেশন করতেন।

তাঁর একদিনের অনুষ্ঠানের কথা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। প্রশ্ন উত্তরের মধ্যে শিশুদের আনন্দ দিতে গিয়ে তিনি বললেন— “প্রঃ সংসারটা কার বশ ? / উঃ সংসার টাকার বশ। / প্রঃ রাম – রাবণের যুদ্ধের কারণ জান কি ? / উঃ- রাম – রাবণের যুদ্ধের কারণ জানকী। / কে সব দেবতাদের মধ্যে পালনকর্তা ? / কেশব দেবতাদের মধ্যে পালনকর্তা। / প্রঃ- মাসী কি দিয়েছে ? / মা সিকি দিয়েছে। / প্রঃ- এই শিল্পকর্ম কারকৃত ? / এ শিল্প কর্ম – কারকৃত। / প্রঃ- অরুচি হলে নিম কি রুচিকর ? / উঃ- অরুচি হলে নিমকি রুচিকর। / প্রঃ বড় দিনে ভেট কি দিলে ? / উঃ বড়দিনে ভেটকি দিলে।” …… শরৎচন্দ্র ছিলেন একজন যথার্থ পরোপকারব্রতী।

অপরের দুঃখ – দুর্দশা লাঘব করার নেশা তার অস্থি – মজ্জার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। দরিদ্রকে ঘৃণা করা, অবজ্ঞার চোখে দেখা সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের ধর্ম। তিনি কখনই এমন অসঙ্গত অশোভন আচরণ বরদাস্ত করতে পারতেন না। তাইতো কার্ত্তিক নামধারী এক তেলেভাজার দোকানিকে স্থানীয় মিউনিসিপালিটির কমিশনারের অপমান করার প্রতিবাদে তিনি কার্ত্তিককেই ওই কমিশনারের বিপক্ষে ভোটে দাঁড় করালেন। শরৎচন্দ্র – র বুদ্ধি কৌশল, অক্লান্ত পরিশ্রম, মানসিক দৃঢ়তাই শেষ পর্যন্ত কার্ত্তিক’কে ভোটে জিতিয়ে দিল।

সে সময় তিনি ‘ভোটরঙ্গ ‘ নামে একটি গান রচনা করলেন। সুর দিলেন, বিপ্লবী নলিনীকান্ত। পাড়ার ছেলে – বুড়ো দলবেঁধে সে গান গেয়ে কার্ত্তিক – এর হয়ে ভোটের প্রচার করল। গানটির কিয়দংশ উল্লেখ করা হল— “ভোট দিয়ে যা— / আয় ভোটার আয় ! / মাছ কুটলে মুড়ো দিব, / গাই বিয়োলে দুধ দিব, / দুধ খেতে বাটি দিব / সুদ দিলে টাকা দিব / ফি দিলে উকিল হব, / চাল দিলে ভাত দিব / মিটিংয়ে যাব না, অবসর পাব না / কোন কাজে লাগব না, /” কলিকাতার রাস্তাগুলির অদ্ভুত অদ্ভুত নামকরণকে বিষয়বস্তু করে তিনি রচনা করলেন, ‘কলকাতার ভুল’ নামে এক মনোজ্ঞ কবিতা।

তিনি লিখলেন— … “সরি হায়রে / কলকাতা কেবল ভুলে ভরা / সেথায় বুদ্ধিমানে চুরি করে / বোকায় পড়ে ধরা।।/ আজকাল কলকাতাতে / সব কথাতে / দেখছি ভারি ভুল / ভাবলাম, কলুটোলায় ফুল আছে / দেখি, কলুর বলদ বদ্যি সেথায় / করে তেল আমদানি ! / ….. নাইকো হাতী নইকো বাগান / হাতীবাগান বলে / বাদুড়বাগানেতে দেখি / বাদুড় নাহি ঝোলে / একটা সাঁকো নাইকো সেথায় / জোড়াসাঁকো নাম, / সেথা দিনে রাতে রবির উদয় / দেখে আসিলাম”।

এরই কিছুদিন পর শরৎচন্দ্র ‘কলকাতার মেদ’ নামে আর একটি ছড়া – কবিতা তার বোতলপুরাণে লিখলেন। নাম দিলেন ‘আত্মঘাতী দেবশর্মা। ছড়া – কবিতাটির কয়েকটি ছত্র উল্লেখ করা হ’ল— “মনের দুঃখে কলকাতা কেঁদে বলে ভাই ! / আমার মধ্যে ভুল পেলে, ভুল / আর কি কোথাও নাই ? / লকাতার ভুল লিখলেন যিনি / আমি বলি তাকে, / রাগ কোরো না দাদাঠাকুর / পার্সোনাল অ্যাটাক ! / আকাশেতে শরৎচন্দ্র / দেখছি তো সবে— / মলিন বেশে খালি পায়ে নেমে এলে কবে ? / … চাল ফুরালে ‘দানাপুরে’ / যোগাড় কর দানা ? / খানা জংশানেতে আসি / পাকাও বুঝি খানা ? / ডাল ফুরোলে ‘ডোমজুড়েতে’ / কিনে নিয়ে ঝুড়ি / ‘বুট’ পরে আর ‘মটর’ চড়ে / চল কি ‘মসুরী’।”

শরৎচন্দ্র নিজের জন্য জীবনে কোনদিন কারো কাছ থেকেই কিছু হাত পেতে গ্রহণ করেন নি। একমাত্র সুভাষচন্দ্র বসু যখন কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন তখন এক রকম জোর করেই তাকে একটি হগিং লাইসেন্স করে দিয়েছিলেন। যে কয়জন বিরল ব্যক্তিত্বের জীবিতকালেই তাঁদের জীবনকথা নিয়ে চলচ্চিত্র রচিত হয়েছে, শরৎচন্দ্র পণ্ডিত তাঁদের মধ্যে একজন।

শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত দাদাঠাকুর এর মৃত্যু: Sarat Chandra Pandit Dada Thakur’s Death

১৩৭৫ সালের ১২ ই বৈশাখ এই মহাত্মা যাবতীয় দুঃখ দারিদ্র্যের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন।

Leave a Comment