বৌদ্ধধর্ম ও জৈন ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য: বৌদ্ধধর্ম- বৌদ্ধধর্ম একটি ভারতীয় ধর্ম বা দার্শনিক ঐতিহ্য। এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম যার অনুসারী সংখ্যা ৫২০ মিলিয়নেরও বেশি বা বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৭ শতাংশের অধিক এবং তারা বৌদ্ধ হিসেবে পরিচিত। বৌদ্ধধর্ম বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক চর্চাকে ধারণ করে যেগুলো মূলত সিদ্ধার্থ গৌতমের মৌলিক শিক্ষা ও এর ব্যাখ্যাকৃত দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ ও ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রাচীন ভারতে একটি শ্রমণ ঐতিহ্য হিসেবে উৎপত্তিলাভ করে এবং এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান বিদ্যমান শাখা সাধারণত পণ্ডিতদের দ্বারা স্বীকৃত: থেরবাদ, মহাযান ও বজ্রযান।
জৈনধর্ম – জৈনধর্ম (প্রথাগত নাম জিন সাশন বা জৈন ধর্ম) হল একটি ভারতীয় ধর্ম। এই ধর্ম সকল জীবিত প্রাণীর প্রতি অহিংসার শিক্ষা দেয়। জৈন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন অহিংসা ও আত্ম-সংযম হল মোক্ষ এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিলাভের পন্থা।
“জৈন” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “জিন” (অর্থাৎ, জয়ী) শব্দটি থেকে। যে মানুষ আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ইত্যাদি আন্তরিক আবেগগুলিকে জয় করেছেন এবং সেই জয়ের মাধ্যমে পবিত্র অনন্ত জ্ঞান (কেবল জ্ঞান) লাভ করেছেন, তাঁকেই “জিন” বলা হয়। “জিন”দের আচরিত ও প্রচারিত পথের অনুগামীদের বলে “জৈন”।
জৈনধর্ম শ্রমণ প্রথা থেকে উদ্গত ধর্মমত। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মমতগুলির অন্যতম। জৈনরা তাঁদের ইতিহাসে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের কথা উল্লেখ করেন। এঁদের শিক্ষাই জৈনধর্মের মূল ভিত্তি। প্রথম তীর্থঙ্করের নাম ঋষভ এবং সর্বশেষ তীর্থঙ্করের নাম মহাবীর।
ভারতে জৈন ধর্মবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় ১০,২০০,০০০। এছাড়া উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের অন্যত্রও অভিবাসী জৈনদের দেখা মেলে। ভারতের অপরাপর ধর্মমত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জৈনদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তিদানের একটি প্রাচীন প্রথা জৈনদের মধ্যে আজও বিদ্যমান; এবং ভারতে এই সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার হার অত্যন্ত উচ্চ। শুধু তাই নয়, জৈন গ্রন্থাগারগুলি দেশের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারও বটে।
বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য
প্রাচীন ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাসে বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক ছিলেন গৌতমবুদ্ধ বা বুদ্ধদেব এবং জৈনধর্মের প্রবর্তক ছিলেন মহাবীর। এই দুই ধর্মের মধ্যে কিছু মিল বা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেলেও আবার কিছু অমিল বা বৈসাদৃশ্যও দেখা যায়। আজ আমরা বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের মধ্যেকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যগুলি আলোচনা করবো।
বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য
বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য দেখা যায়, যেমন:
(i) প্রায় একই সময়ে (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে) উভয় ধর্মমতের উদ্ভব ঘটেছিল।
(ii) উভয় ধর্মই ছিল প্রতিবাদী, ব্রাহ্মণ্য প্রাধান্য ও জাতিভেদ প্রথার বিরোধী।
(iii) উভয় ধর্মই ছিল ক্ষত্রিয় রাজকুমার দ্বারা প্রবর্তিত, অহিংসা নীতিতে বিশ্বাসী, কর্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী এবং বেদ বিরোধী।
(iv) বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম উভয় ধর্মমতই মানুষকে তার কর্মফলের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে।
(v) বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম — উভয় ধর্মেই অহিংসা নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
(vi) দুই ধর্মই কর্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী এবং জাতিভেদ প্রথা ও অন্যান্য বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের বিরোধী।
বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের মধ্যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য
বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের মধ্যে যেমন কিছু সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি আবার কিছু বৈসাদৃশ্যও রয়েছে। বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের মধ্যেকার বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য গুলি হল:
বৌদ্ধ ধর্ম | জৈন ধর্ম |
---|---|
১. বৌদ্ধগণ মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী। | ১. জৈনরা কঠোর কৃচ্ছসাধন ও তপশ্চর্যায় বিশ্বাসী। |
২. অহিংসা সম্পর্কে বৌদ্ধরা ততটা কঠোর নন। | ২. অহিংসা সম্পর্কে জৈনগণ চরমপন্থী। |
৩. বৌদ্ধধর্মে সংঘ অপরিহার্য। | ৩. জৈনধর্মে সংঘ অপরিহার্য নয়। |
৪. বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণ্য মতবাদ ও রাজনীতিকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। | ৪. জৈনরা ব্রাহ্মণ্য মতবাদ ও রাজনীতি কিছুটা মানেন। |
৫. বৌদ্ধধর্ম অচেতন পদার্থের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। | ৫. জৈনধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, যাবতীয় অচেতন পদার্থের মধ্যেও প্রাণ আছে। |
৬. বৌদ্ধরা হীনযান ও মহাযান — এই দুটি প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত। | ৬. জৈনরা দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর — এই দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত। |
Well presentation