ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের সংজ্ঞা বৈশিষ্ট্য ও সৃষ্টির কারণ – Tropical Cyclone

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের সংজ্ঞা বৈশিষ্ট্য ও সৃষ্টির কারণ – Tropical Cyclone: ঘূর্ণিঝড় বা ঘূর্ণিবাত্যা হল ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সংবলিত আবহাওয়ার একটি নিম্ন-চাপ প্রক্রিয়া যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে।

ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে যদিও দুর্যোগের সৃষ্টি হয়, কিন্তু এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে। গড়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৮০ টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর অধিকাংশই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, কিন্তু যে অল্প সংখ্যক উপকূলে আঘাত হানে তা অনেক সময় ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে।

ঘূর্ণবাত কোথায় সৃষ্টি হয়? ক্রান্তীয় অঞ্চলে জলভাগের ওপর এবং নাতিশীতােষ্ণ অঞ্চলে স্থলভাগের ওপর সাধারণতঃ ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হয়ে থাকে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে জলভাগের ওপর হঠাৎ নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হলে চারপাশের বায়ু প্রবলবেগে কুণ্ডলাকারে ঘুরতে ঘুরতে ঐ নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে এবং প্রবল ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়।

ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত – উভয় গোলার্ধের ক্রান্তীয় অঞ্চলে ৫ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রি উত্তর ও দক্ষিন অক্ষরেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অধিকাংশ ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত সংঘটিত হয়।

এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে অত্যাধিক উষ্ণতার জন্য সমুদ্রপৃষ্টের উপরিভাগের বায়ু উষ্ণ ও হালকা হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়। ফলে এই অঞ্চলে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। তখন চারপাশের অপেক্ষাকৃত শীত ও ভারী বায়ু প্রবল গতিবেগে কুন্ডলির আকারে ঘুরতে ঘুরতে এইরূপ গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ধেয়ে আসে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে এইরূপ প্রবল গতি সম্পন্ন কেন্দ্রমুখী ঘূর্নায়মান ঊর্দ্ধগামী বায়ু প্রবাহকে ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত বলে। ক্রান্তীয় ঘূর্নিঝর বা ঘূর্নবাতের কেন্দ্রে গভীর নিম্নচাপের উপস্থিতি দেখা যায়। যা ক্যাটাগরি -১ ঘূর্নবাতের ক্ষেত্রে ৯৮০ মিলিবার মতো ও  ক্যাটাগরি -৫ ঘূর্নবাতের ক্ষেত্রে ৯২০ মিলিবারে নেমে যায়।

Table of Contents

ক্রান্তীয় ঘূর্নিঝরের বৈশিষ্ট্য 

১. ক্রান্তীয় ঘূর্নিবাতকে ঘিরে সমচাপ রেখা গুলির আকৃতি গোলাকার  হয়।

২. বায়ুর গতিবেগ প্রতি ঘণ্টা ৫০ কিমি থেকে ৩০০ কিমি  পর্যন্ত হয়ে থাকে। 

৩. ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত সাধারণত গ্রীষ্ম ও শরৎ কালে বেশি দেখা যায়।

৪. এই ঘূর্নিঝরের কেন্দ্রে চক্ষুর অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। যার ব্যাস ১০ থেকে ৪০ কিমি হয়ে থাকে। 

৫. ক্রান্তীয় ঘুর্নিবাতের সাথে প্রতীপ ঘূর্নবাতের আগমন হয় না। 

৬. ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের ব্যাস ১৫০ থেকে ৩০০ কিমি হয়ে থাকে।

৭. এই ঘূর্নবাতের সাথে উষ্ণ ও শীতল সীমান্তের কোনো সম্পর্ক নেই ।

৮. লীনতাপ এই ঘূর্নবাতের শক্তির প্রধান উৎস। 

৯. কিউমুলোনিম্বাস মেঘের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

১০. এই ঘূর্নবাত মানুষ ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি করে। 

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত সৃষ্টির অনুকূল ভৌগোলিক শর্ত

১. সমুদ্র পৃষ্টের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হবে।

২. কোরিওলিস শক্তির বিদ্যমানতা

৩. পূর্বস্থিত দূর্বল নিম্নচাপ অঞ্চল

৪. উপরি স্তরে প্রতীপ ঘূর্নবাত অর্থাৎ বায়ুর বহিঃমুখী গমন

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের অন্যতম সঞ্চালক লীনতাপের উৎস

২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বিশিস্ট সমুদ্র জলের গভীরতা থাকে ৬০ থেকে ৭০ মিটার, যা যথেষ্ট আদ্রতার সরবরাহ করে, ফলে ঘনীভবন জনিত লীনতাপের যোগান অব্যাহত থাকে। এই লীনতাপ ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত ত্বরান্বিত করে।

মহাসাগরের পশ্চিমদিকে বেশি ঘূর্নবাত সৃষ্টির মূল কারণ

ক্রান্তীয় অঞ্চলে পূর্বালি বানিজ্যবায়ুর (TradeWind) প্রভাবে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বিশিষ্ট সমুদ্র স্রোত পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে মহাসাগরের পশ্চিমদিকে উষ্ণ জলের একটি গভীর স্তর গঠন করে। যার ফলে মহাসাগরের পশ্চিমদিকে বেশি ঘূর্নবাত সৃষ্টি হয়। 

মহাসাগরের পূর্বদিকে ঘূর্নবাত সৃষ্টি না হওয়ার মূল কারণ

মহাসাগর গুলির পূর্ব দিকে শীতল স্রোতের উপস্থিতি, সমুদ্র জলের উষ্ণতা অনেকটা কমিয়ে দেয়। তাই ঘূর্নবাত সৃষ্টির জন্য অনুকূল পরিবেশে না থাকায় ঘূর্নবাত সৃষ্টি হয় না।

ব্যতিক্রম ঘটনা  কোনো কোনো বছর এল নিনোর উপস্থিতির জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে হ্যারিকেনের সৃষ্টি হয়।

স্থলভাগে অবতরনের পর ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের শক্তি হ্রাস পায় কেন?

স্থলভাগে অবতরনের পর ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতে আদ্রতা তথা জলীয় বাস্পের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যা, ফলে লীন তাপ সৃষ্টি না হওয়ায় ঘূর্নবাত তার শক্তি হারিয়ে ফেলে।

গ্রীষ্মকালে ঘূর্নবাত প্রাদুর্ভাবের কারণ কি?

উত্তর গোলার্ধে গরমকালে তাপমাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় এই সময় সমুদ্র পৃষ্টের জলের তাপমাত্রাও অনেক বেশি হয়, তাই মে, জুন ও জুলাই মাসে বেশি  ঘূর্নবাতের প্রাদুর্ভাব ঘটে।

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের সৃষ্টি পদ্ধতি

ক্রান্তীয় অঞ্চলে ৫ ডিগ্রি থেকে ২৫ ডিগ্রি অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্টের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এসে পৌছালে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।

নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে পাশ্ববর্তী উচ্চচাপ যুক্ত অঞ্চল থেকে বাতাস দ্রুত গতি তে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধেয়ে এসে  ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের উৎপত্তি ঘটায়।

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের গঠন

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের চক্ষু (Eye) 

  • এটি ঘূর্নবাতের কেন্দ্রের শান্ত ও পরিস্কার আবহাওয়া যুক্ত স্থান।
  • এখানে কোন বৃষ্টিপাত হয় না। অনেক সময় নীল আকাশ দেখা যায়।
  • চক্ষুর ব্যাস ৩০ থেকে ৬০ কিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের চক্ষু প্রাচীর (Eye Wall)

  • ঘূর্নবাতের চক্ষুকে ঘিরে থাকে চক্ষুপ্রাচীর। এখানে বাতাসের গতি বেগ সর্বাধিক হয়।
  • পরিচলন স্রোতের উপস্থিতির জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
  • কিউমূলোনিম্বাস মেঘের উপস্থিতি থাকে চক্ষু প্রাচীরে।

কুন্ডলীয় বলয় (Spiral bands)

  • চক্ষু প্রাচীরের পরবর্তী অংশ হল কুন্ডলীয় বলয় বলয়।
  • এই অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে, একে বৃষ্টিবলয়ও বলা হয়।

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের উলম্ব গঠন

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের উলম্ব গঠনকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়

১. নিম্ন স্তর – এটি ভূপৃষ্ট থেকে ৩ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অন্তঃস্থ স্তর নামেও পরিচিত। এই স্তর টি ঘূর্নবাত সৃষ্টির জন্য দায়ী।

২. মধ্যস্তর – এটি ৩ থেকে ৭ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে ঘূর্নিঝরের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।

৩. সর্বোচ্চ স্তর – এটি ১২ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে বাতাসের বহিঃমুখী প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়।

ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত প্রভাবিত অঞ্চল

  • পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর – এই অঞ্চলে সবথেকে বেশি ঘূর্নঝড় সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের অন্তর্গত পূর্ব চিন, জাপান, ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জে এটি টাইফুন নামে পরিচিত।
  • পশ্চিম আটলান্তিক মহাসাগর ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে এটি হ্যারিকেন নামে পরিচিত।
  • আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের নাম সাইক্লোন।
  • অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত উইলি উইলি নামে পরিচিত।

আরব সাগর অপেক্ষা বঙ্গোপসাগরে ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত বেশি হওয়ার কারণ

উত্তর ভারত মহাসাগর অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে প্রতি বছর গড়ে ৫ টি ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত হয় এবং বিশ্বব্যাপী গড়ে ৮০ টি  ক্রান্তীয় ঘূর্নবাত হয়,বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে ক্রান্তীয় ঘূর্নবাতের অনুপাত ৪:১।

বঙ্গোপসাগরে বেশি ঘূর্নবাত সৃষ্টির কারণ – 

১. নিম্ন বায়ুমণ্ডলীয় গোলযোগের বিদ্যমানতা 

বঙ্গোপসাগরে যে ঘূর্নবাত সৃষ্টি হয়, তা হয় বঙ্গোপসাগরে দক্ষিন পূর্ব অংশে নিম্নচাপ জনিত কারণে অথবা উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর সৃষ্ট টাইফুনের অবশিষ্টাংশ থেকে উৎপত্তি হয়, যা দক্ষিন চিন সাগর থেকে ভারত সাগরে চলে আসে। যেহেতু সবথেকে বেশি ঘূর্নবাত উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে হয়ে থাকে , তার প্রভাবে বঙ্গোপসাগরেও অনেক বেশি ঘূর্নবাত সৃষ্টি হয়।

অন্যদিকে আরবসাগরে যে ঘূর্নবাত সৃষ্টি হয়, তা নিজস্ব নিম্নচাপ জনিত কারণে বা বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্নিবাতের অবশিষ্টাংশ থেকে সৃষ্টি হয়, যা ভারতীয় উপদ্বীপ পেরিয়ে আরব সাগরে আসে। যেহেতু বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্নিবাতের শক্তি স্থলভাগে অবতরনের সময় হ্রাস পায়, তাই খুব কম পরিমান অংশ আরব সাগরে এসে পৌঁছায়।

২. উচ্চ সমুদ্রপৃষ্টীয় তাপমাত্রা 

বঙ্গোপসাগরের পৃষ্ট তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রি থেকে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। অন্যদিকে মৌসুমি বায়ুর উপস্থিতির জন্য আরব সাগরের তাপমাত্রা বঙ্গোপসাগরের থেকে ১-২ ডিগ্রি কম হয়।

৩. বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র পৃষ্টের নিম্ন লবনতা

বঙ্গোপসাগরে অনেক বড়ো বড়ো নদী এসে মিলিত হওয়ায় সমুদ্র পৃষ্টের লবনতা আরব সাগরের তুলনায় অনেক কম ।

লবনাক্ত জলের তুলনায় স্বাদু জলের ঘনত্ব কম হওয়ায় জল স্থির থাকে ও বাস্পীভবনের পরিমান বৃদ্ধি করে।

সাফির-সিম্পসন ঝরের গতি ও ক্ষয় ক্ষতির পরিমানের উপর ভিত্তি করে হ্যারিকেন কে ৫ টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন  –

২০১৯  ২০২০ সালের কিছু বিধ্বংসী ঘূর্নিঝড়  

১. হ্যারিকেন ডোরিয়ান – সেপ্টেম্বর,২০১৯, দক্ষিন-পূর্ব আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাহামা দ্বীপপুঞ্জ

২. সাইক্লোন ফনি – এপ্রিল, ২০১৯, ভারতের ওড়িশা

৩. টাইফুন হাগিবিস – অক্টোবর, ২০১৯, জাপান

৪. সাইক্লোন ইডাই (Idai) – মার্চ, ২০১৯ , মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার

৫. টাইফুন লেকিমা – জুলাই, ২০১৯, ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জ

৬. হ্যারিকেন লরেঞ্জো – সেপ্টেম্বর, ২০১৯, অ্যারিজোনা, USA

৭. সাইক্লোন হেরল্ড (Herold) – মার্চ, ২০২০, মাদাগাস্কার (২০২০ সালের প্রথম ক্রান্তীয় ঘূর্নিঝর)

৮. টাইফুন ভংফং বা আম্ব (Vongfong or Ambo) – মার্চ, ২০২০, ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জ

9. সাইক্লোন মাঙ্গাস – মার্চ, ২০২০, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া

১০. সাইক্লোন আম্ফান – মার্চ, ২০২০, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ 

Leave a Comment