সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের (Ram Prasad Sen) জীবনী | Biography of Ram Prasad Sen

Rate this post

সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের (Ram Prasad Sen) জীবনী : সাধক কবি রামপ্রসাদ (Ram Prasad Sen) সম্বন্ধে যিনি সর্বপ্রথম অনুসন্ধান ও গবেষণায় প্রবৃত্ত হয়ে ছিলেন তিনি বাংলার আর এক সুখ্যাত কবি ঈশ্বর গুপ্ত। তিনি লিখে ছিলেন, ‘বঙ্গদেশের মধ্যে যে কয়জন মহাশয় কবি রূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন তন্মধ্যে রামপ্রসাদকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়াই গণ্য করিতে হইবে, কারণ, তিনি সকল রসের রসিক, প্রেমিক, ভাবুক ও ভক্ত এবং জ্ঞানী ছিলেন।’

প্রাচীন বাংলার কবি রামপ্রসাদ সম্পর্কে কবি ঈশ্বর গুপ্তের সংগৃহীত এবং গবেষণা লব্ধ তথ্যই এখনাে পর্যন্ত পন্ডিত-গবেষক মহলে স্বীকৃত। রামপ্রসাদী সংগীতের জনপ্রিয়তা গত তিনশো বছরে এত টুকু কমেনি। বরং ভক্ত, সাধক, ভাবুক তত্ত্ব জিজ্ঞাসু ও কাব্য রসিকের আগ্রহ ও সমাদর উত্তরােত্তর বৃদ্ধি করে চলেছে। রামপ্রসাদের (Ram Prasad Sen) মাতৃ সঙ্গীতে কে না আবিষ্ট হয়। অথচ এই সর্ব জনপ্রিয় কবির জীবন সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় খুবই কম। নানা গল্প কিংবদন্তিতে ভরা তার জীবন কাহিনী।

রাম প্রসাদ সেনের (Ram Prasad Sen) জন্ম স্থান ও পিতামাতা: Birth Place And Parents Of Ramprasad Sen

রামপ্রসাদের জন্মের সঠিক সন তারিখ নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন ডঃ দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি কবির জন্মকালীন গ্ৰহ সংস্থান ধরে হিসেব করে অনুমান করেছেন তার জন্ম মাস আশ্বিন, সন 1127 (1720 খ্রিঃ)। ঈশ্বর গুপ্ত ও মােটামুটি 1720 খ্রিঃ-ই সিদ্ধান্ত করেছেন। চব্বিশ পরগনা জেলার হালিশহরের অন্তর্গত ভাগীরথী তীরে অবস্থিত কুমারহট্ট গ্রাম। এখানেই রামপ্রসাদের আবির্ভাব হয়। তার কৌলিক নাম রামপ্রসাদ সেন। পিতার নাম রামরাম সেন।

রাম প্রসাদ সেনের (Ram Prasad Sen) প্রথম জীবন: Ramprasad Sen’s Early Life

রামপ্রসাদ (Ram Prasad Sen) একাধারে শক্তি সাধক, কবিও গায়ক। তার রচিত গানের গীত-ভঙ্গীই রামপ্রসাদী সুর নামে খ্যাত। তার রচিত ভক্তি গীতি বঙ্গসা হিত্যের অমূল্য সম্পদ। লােকগীতি ও পল্লীগীতির মতই তার নিজস্ব সুরে গাওয়া গীত বহুযুগ পূর্ব থেকে শােনা যায় বাংলার পথে ঘাটে, অরণ্যে প্রান্তরে। চাষী হল চালনা করছে, মাঝি নৌকায় দাঁড় বাইছে, উদাসী পথিক পথ চলছে, সকলেরই কণ্ঠে ধ্বনিত হয় রামপ্রসাদের গান। অল্প বয়সেই রামপ্রসাদ বাংল , সংস্কৃত, ফারসী ও হিন্দী ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। শিক্ষানুরাগের পাশাপাশি তার মধ্যে উপ্ত ছিল শক্তি তত্ত্বের বীজ শক্তি রূপিনী মায়ের নামে বিভাের থাকেন তিনি দিবানিশি। পিতার মৃতার পরে সংসারে দেখা দেয় অনটন। তখন বড়দুঃখে তিনি গাইলেন,

এ সংসারে এনে মাগাে করলি আমায় লােহা-পেটা।

তবু আমি কালী বলে ডাকি-

সাবাস আমার বুকের পাটা।

রাম প্রসাদ সেনের (Ram Prasad Sen) কর্ম জীবন: Ramprasad Sen’s Work Life

ঈশ্বর ভক্তি আর কবি শক্তি জন্মগত ভাবেই পেয়েছিলেন রামপ্রসাদ (Ram Prasad Sen)। কিন্তু তা দিয়ে তাে প্রাসাচ্ছাদন চলে না, বাধ্য হয়ে তাকে গরানহাটার জমিদার দুর্গাচরণ মিত্রের সেরেস্তায় মহুরীর কাজ নিতে হল। রামপ্রসাদ চলেএলেন কলকাতায়। কিন্তু সেরেস্তার হিসেবের খাতায় শ্যামা বিষয়ক গীতরচনা করে লিখে রাখতেন। ম্যানেজারের কাছে নালিশ শুনে দুর্গাচরণ তলব করেন হিসেবের খাতা। দেখেন জমা-খরচের পরিবর্তে লেখা শুধু গান-মাতৃসঙ্গীত। গানগুলির অন্তর্নিহিত ভাব অভিভূত করে দুর্গাচরণকে তিনি মাসিক তিনটাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করে রামপ্রসাদকে পাঠিয়ে দিলেন স্বগ্রামে সহৃদয় মনিবের বদান্যতায় এভাবে

রাম প্রসাদ সেনের বিবাহ জীবন ও পরিবার: Ramprasad Sen’s Marriage Life And Family

সংসার চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে রামপ্রসাদ (Ram Prasad Sen) ভগবৎ সাধনায় আত্ম নিয়ােগ করেন। সংসার সামলান স্ত্রী সর্বানী দেবী, রামপ্রসাদ গঙ্গাতীরে বসে প্রাণ-আকুল করা সুরে গান করেন। ভক্তিবাদী রামপ্রসাদের গানের সহজ সরল কথায় ব্যক্ত হয় প্রাণের আর্তি গৃঢ় ঈশ্বর-তত্ত্বের সহজ প্রতীকী- রপ। সেই গান শুনে গঙ্গাবক্ষে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বজরা থেমে যায়। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার চোখে জল আসে। মুগ্ধ কৃষ্ণচন্দ্র শ্রদ্ধা ভক্তির নিদর্শন স্বরূপ সাধক-কবিকে দান করেন একান্ন বিঘা নিষ্কর জমি। বাড়ির উঠোনে একবার বেড়া বাঁধ ছিলেন রামপ্রসাদ। মেয়ে জগদীশ্বরীকে বলেছেন বেড়ার অপর দিক থেকে খুঁটির দড়িটা বাড়িয়ে দিতে। ছেলেমানুষ জগদীশ্বরী পিতার আদেশ ভুলে মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজে চলে গেছে। এদিকে রামপ্রসাদ শ্যামা মায়ের গান ধরেছেন আর বেড়া বাঁধছেন। এক সময় সুষ্ঠু ভাবেই বেড়া বাঁধার কাজ শেষ করেন তিনি। বেড়ার দড়ি ফেরানাের কথা যখন মনে পড়ল জগদীশ্বরী ছুটে এলেন বাবার কাছে। এসে দেখেন বাবার বেড়া বাঁধা শেষ হয়ে গেছে। দুজনেই আশ্চর্য ! দুজনের মনেই প্রশ্ন দেখা দেয়। কে সেই মেয়ে, সারা বেলা বেড়ার অপর দিক থেকে রামপ্রসাদকে দড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন? সাধক বুঝলেন, ব্রহ্মময়ী মা কন্যারূপে এসে এতক্ষণ সন্তানকে সাহায্য করে গেছেন। আকুল হয়ে কেঁদে গেয়ে উঠলেন ভক্ত কবি –

নয়ন থাকতে দেখলে না মন

কেমন তােমার কপাল পােড়া।

মা ভক্তে ছলিতে তনয়া রূপেতে বেঁধে গেলেন ঘরের বেড়া।

রাম প্রসাদ সেনের রচনা: Written by Ramprasad Sen

একবার ঘটনাচক্রে রামপ্রসাদ রওনা হয়েছেন কাশী ধামে, সেখানে অন্নপূর্ণাকে গান শােনাবেন বলে। পথ চলতে চলতে শ্রান্ত রামপ্রসাদ (Ram Prasad Sen) ত্রিবেণীতে গঙ্গার ধারে বিশ্রাম করতে বসলেন। নিদ্রায় জড়িয়ে এলাে চোখ। এখানে ঘুমে স্বপ্ন দেখলেন, বিশ্বজননী বলছেন তােমাকে কাশী আসতে হবে কেন, আমি যে ভক্তের হৃদয়েই থাকি। এখানেই শােনাও তােমার মধুর কন্ঠের গান। অত কষ্ট করে অত দূরের পথে নাই বা গেলে প্রসাদ। জেগে উঠে রামপ্রসাদ গান ধরলেন –

আর কাজ কি আমার কাশী ।

মায়ের পদতলে পড়ে আছে গয় -গঙ্গা-বারানসী।।

এখান থেকে ফিরে গিয়েই তন্ত্র সাধনমতে পঞ্চমুন্ডীর আসন পাতলেন রামপ্রসাদ এখানেই তন্ত্রাচার্য শ্রীকৃষ্ণানন্দ আগম বাগীশ এসে মাতৃ মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন তাঁকে। গুরুর কৃপাবলে এখানেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন রামপ্রসাদ।

রাম প্রসাদ সেনের মৃত্যু: Ramprasad Sen’s Death

সিদ্ধিলাভের কিছুকাল পরেই একদিন মরদেহ ত্যাগ করে নিত্যলীলায় প্রবেশ করেন ভক্ত কবি রামপ্রসাদ। বাষট্টি বছর বয়সে, 1786 খ্রিঃ। বঙ্গভূমিতে যত কবি জন্মেছেন, তাদের মধ্যে রামপ্রসাদই সর্ব প্রথম বাংলা ভাষায় গীতিকাব্য রচনা করে তাতে সুর সংযােজন করেন এবং সঙ্গীত ক্ষেত্রে অভিনব এক স্থায়ী সঙ্গীত-রীতি ও সুরের প্রবর্তন করেন।

রাম প্রসাদ সেনের সম্মান: Ramprasad Sen’s Honors

রামপ্রসাদের কালী কীর্তন ও কৃষ্ণ কীর্তন নামে দুটি ছােট কাব্য রয়েছে। এছাড়া মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরােধে তিনি “বিদ্যাসুন্দর“ কাব্য রচনা করেছিলেন। তিনি “কবিরঞ্জন” উপাধি লাভ করেছিলেন।

Leave a Comment